বাণিজ্য বিপ্লব

বাণিজ্য বিপ্লব প্রসঙ্গে বাণিজ্যিক রীতিনীতির প্রকৃতি নির্ধারণ, বাণিজ্যের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন, বাণিজ্য বিপ্লব, বাণিজ্য বৃদ্ধির পথ প্রশস্ত, বাণিজ্যের অধোগতির কারণ, বাণিজ্যের পুনরুজ্জীবন, মোট বাণিজ্যের পরিমাণ বৃদ্ধি, ইউরোপীয় বাণিজ্যের আন্তর্জাতিক রূপ ধারণ, বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আটলান্টিক উপকূলের গুরুত্ব, বাণিজ্য বিপ্লবের উপর মুদ্রাস্ফীতির প্রভাব, মশলা বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্র লিসবন, বাণিজ্য আমদানি পণ্য, দাস ব্যবসার শ্রীবৃদ্ধি, বাণিজ্য বিপ্লবের অন্যতম বৈশিষ্ট্য, বাণিজ্য বিপ্লবী ব্যাংকারদের ভূমিকা, প্রসিদ্ধ বাণিজ্যিক সংগঠন ও বাণিজ্য বিপ্লবের যুগে বাণিজ্যিক কেন্দ্র সম্পর্কে জানবো।

ইউরোপীয় ইতিহাসে বাণিজ্য বিপ্লব প্রসঙ্গে মধ্যযুগীয় ইউরোপ 950-1350 সালের বাণিজ্যিক বিপ্লব, বাণিজ্য বিপ্লবের উপর মুদ্রাস্ফীতির প্রভাব, বাণিজ্য বিপ্লবের অন্যতম বৈশিষ্ট্য, ইউরোপীয় অর্থনীতিতে বাণিজ্য বিপ্লবের প্রভাব ও গুরুত্ব সম্পর্কে জানব।

বাণিজ্য বিপ্লব

ঐতিহাসিক ঘটনাবাণিজ্য বিপ্লব
সময়কালষোড়শ-সপ্তদশ শতক
মশলা বাণিজ্যের কেন্দ্রলিসবন
বিশেষ প্রভাবমুদ্রাস্ফীতি
বৃহৎ বাণিজ্য কেন্দ্রঅ্যান্টওয়ার্প
সর্বাধিক গুরুত্ব বৃদ্ধিআমস্টারডাম
বাণিজ্য বিপ্লব

ভূমিকা :- ষোড়শ এবং সপ্তদশ শতকের ইউরোপ-এ বাণিজ্য বিপ্লব ছিল একটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। এই যুগে বহির্দেশীয় ভৌগোলিক ও উপনিবেশিক বিস্তার এবং ইউরোপের প্রভূত পরিমাণ সোনা আমদানির ফলে ইউরোপীয় বাণিজ্যের বৈপ্লবিক রূপান্তর ঘটেছিল।

বাণিজ্যিক রীতিনীতির প্রকৃতি নির্ধারণ

নতুন বাণিজ্য ও সমুদ্রপথ আবিষ্কার এবং দক্ষিণ আমেরিকার সোনা ষোড়শ শতকের ইউরোপে এবং তার পরবর্তী যুগে অর্থনীতি ব্যাবসাবাণিজ্য এবং বাণিজ্যিক রীতিনীতির প্রকৃতি নির্ধারণ করেছিল।

বাণিজ্যের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন

এই যুগের বাণিজ্যের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনগুলি ছিল আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের বিস্তার, আঞ্চলিক বাণিজ্যের অবসান, মহাসাগরীয় বাণিজ্য (প্রধানত আটলান্টিক ও ভারত মহাসাগরীয় বাণিজ্য), নতুন নতুন বাজারের উৎপত্তি ও প্রসার এবং নতুন বাণিজ্যিক সংগঠনসমূহের উদ্ভব।

বাণিজ্য বিপ্লব

১৫৫০ থেকে ১৭০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ইউরোপে এবং বিশেষত নেদারল্যান্ডস বা হল্যান্ড এবং ইংল্যান্ড-এ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের উন্নতি এবং বিনিময় ও ব্যাংকিং ব্যাবসার প্রসারকে অর্থনৈতিক ইতিহাসবিদগণ বাণিজ্য বিপ্লব (Commercial Revolution) আখ্যা দিয়েছেন।

বাণিজ্য বৃদ্ধির পথ প্রশস্ত

ষোড়শ শতকের এই বাণিজ্য বিপ্লব অকস্মাৎ ঘটে নি। ইতিপূর্বে মধ্যযুগ থেকে ইউরোপে যে দীর্ঘকালব্যাপী মন্দা চলেছিল, নানা ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতে ষোড়শ শতকে তার অবসান ঘটেছিল এবং বাণিজ্য বৃদ্ধির পথ প্রশস্ত হয়েছিল।

বাণিজ্যের অধোগতির কারণ

  • (১) মধ্যযুগে যে সমস্ত ঘটনা বাণিজ্যিক অধোগতির জন্য দায়ী ছিল, তার মধ্যে অন্যতম ছিল মারাত্মক প্লেগ মহামারি, যা ইউরোপে Black Death নামে অখ্যাতি অর্জন করেছিল। এই বিধ্বংসী মহামারির ফলে ইউরোপের জনসংখ্যার বিশাল অংশ নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে এবং দেশে জনসংখ্যা প্রায় ১২ থেকে ৬০ শতাংশ হ্রাসপ্রাপ্ত হয়েছিল।
  • (২) জনসংখ্যা হ্রাসের সঙ্গে সঙ্গে কৃষি, শিল্প বাণিজ্যের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিল। প্রধানত জনসংখ্যা হ্রাসজনিত সমস্যার ফলে বিভিন্ন পণ্যের মূল্য এবং কৃষি ও শিল্প-জাত পণ্যের উৎপাদন যথেষ্ট কমে গিয়েছিল। বলাবাহুল্য বাণিজ্যের পরিমাণও হ্রাসপ্রাপ্ত হয়েছিল।

বাণিজ্যের পুনরুজ্জীবন

অবশেষে প্লেগের প্রকোপ কমে এলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসে এবং কৃষি ও শিল্পের মতো বাণিজ্যিক ক্ষেত্রেও এক প্রকার পুনরুজ্জীবন লক্ষ্য করা যায়।

আলোচ্য সময়ে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণ

ষোড়শ শতকের প্রথমার্ধে অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, চরম খাদ্যাভাব, দুর্ভিক্ষ, মহামারি প্রভৃতি প্রাকৃতিক বা মনুষ্যসৃষ্ট বিপর্যয় তেমনভাবে ঘটে নি। প্রধানত এই কারণেই আলোচ্য পর্বে ইউরোপীয় জনসংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল। এই জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১৬২০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় অক্ষুণ্ণ ছিল।

মোট বাণিজ্যের পরিমাণ বৃদ্ধি

এই প্রবণতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আলোচ্য যুগে একদিকে যেমন শিল্পোৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছিল, অন্যদিকে তেমনি মোট ইউরোপীয় বাণিজ্যের পরিমাণও যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছিল। শুধু জনসংখ্যা বৃদ্ধি নয়, উৎপাদন বৃদ্ধি ও নতুন নতুন বাণিজ্যপথ আবিষ্কৃত হওয়ার ফলে এই যুগে ইউরোপীয় বণিকরা আরও বেশি পরিমাণ পণ্যের বাণিজ্যিক আদান প্রদান করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ইতিপূর্বে বিগত শতকে কখনোই এই আদান প্রদানের পরিমাণ এত বেশি ছিল না।

ইউরোপীয় বাণিজ্যের আন্তর্জাতিক রূপ ধারণ

  • (১) এই যুগে পোর্তুগিজ বণিকরা তাদের মাল্লাকার বাণিজ্যকেন্দ্র থেকে আরও পূর্বদিকে লবঙ্গ ও জায়ফল উৎপাদন কেন্দ্রগুলির দিকে অগ্রসর হয়েছিল। ১৫৬৫ খ্রিস্টাব্দে স্পেনীয় জাহাজগুলি ম্যানিলা এবং অ্যাকুপালকোর (মেক্সিকোর একটি বন্দর) মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হলে ইউরোপীয় বাণিজ্য প্রকৃত অর্থে আন্তর্জাতিক রূপ ধারণ করেছিল।
  • (২) পশ্চিম ইউরোপে সেভিল ধীরে ধীরে আটলান্টিক মহাসাগরীয় কেন্দ্রিক বাণিজ্যে একটি অন্যতম কেন্দ্ররূপে আত্মপ্রকাশ করতে থাকে। চিনা Zunk গুলি (বিশেষ এক প্রকার চীন দেশীয় পাল তোলা নৌকা যার তলদেশ অপেক্ষাকৃত চ্যাপটা) ম্যানিলা বন্দরে প্রায় বছরে অন্তত একবার মহার্ঘ রেশম, নানাপ্রকার মশলা ও চিনা মাটির বাসন নিয়ে আসত, বিনিময়ে তারা নিয়ে যেত প্রায় সমমূল্যের মেক্সিকোর রূপা।

বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আটলান্টিক উপকূলের গুরুত্ব

  • (১) পঞ্চদশ শতকের প্রায় অন্তিম পর্ব পর্যন্ত পশ্চিম ইউরোপীয় বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ভূমধ্যসাগরের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। কিন্তু ষোড়শ শতকের অন্তিম পর্বে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের গুরুত্ব অনেকটাই ক্ষুণ্ণ হয়। এই যুগে অর্থনৈতিক ভারসাম্য উত্তর-পশ্চিমে আটলান্টিক উপকূলে সরে যায়।
  • (২) ইতিপূর্বেই বাণিজ্যিক রূপান্তরের ক্ষেত্রে নতুন বাণিজ্যপথ এবং দক্ষিণ আমেরিকার সোনার ভূমিকার কথা বলা হয়েছে। আলোচ্য পর্বে স্পেনীয় এবং অন্যান্য ইউরোপীয় বণিক ও ভাগ্যান্বেষীরা ব্যাপক পরিমাণ সোনা এবং রুপো স্পেন এবং ইউরোপের অন্যত্র আমদানি করেছেন।

বাণিজ্য বিপ্লবের উপর মুদ্রাস্ফীতির প্রভাব

আলোচ্য পর্বে পণ্যদ্রব্যের উৎপাদন যে হারে বৃদ্ধি পেয়েছিল ইউরোপের বাজারে স্বর্ণ এবং রৌপ্যখণ্ডের জোগান তার চেয়ে অনেক বেশি হারে বৃদ্ধি পেয়েছিল। প্রধানত এই কারণেই ইউরোপীয় মহাদেশে ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতি ঘটেছিল। এই মুদ্রাস্ফীতি একদিকে যেমন দ্রব্যমূল্য বিপ্লব (Price Revolution) ঘটিয়েছিল অন্যদিকে তেমনি এই প্রক্রিয়া বাণিজ্য বিপ্লবকেও ত্বরান্বিত করেছিল।

মশলা বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্র লিসবন

প্রধানত এই বাণিজ্য বিপ্লবের ফলশ্রুতি হিসাবে ষোড়শ শতকের ইউরোপে মশলা বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্ররূপে ভেনিসের জায়গা দখল করেছিল লিসবন। শুধু লিসবন নয়, আলোচ্য পর্বে আটলান্টিক মহাসাগরের উপকূলে অবস্থিত অন্যান্য বন্দর তথা বাণিজ্য কেন্দ্রগুলির গুরুত্ব যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছিল।

বাল্টিক অঞ্চলের অবক্ষয়ের কারণ

এই যুগে শুধু ভূমধ্যসাগরীয় নয়, বাল্টিক নগরীগুলির (বিশেষত জার্মান নগরীগুলি) গুরুত্ব যথেষ্ট হ্রাসপ্রাপ্ত হয়েছিল। ইতিপূর্বে আল্পস পেরিয়ে ভেনিস থেকে যে মশলা উত্তরে আসত এই যুগে তা কার্যত বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এটাই ছিল বাল্টিক অঞ্চলের অবক্ষয়ের অন্যতম কারণ।

বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আমদানি পণ্য

ষোড়শ শতকের ইউরোপে নতুন বাণিজ্যের সঙ্গে সংগতি রেখে নতুন নতুন পণ্যসম্ভার ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আমদানি করা হতে থাকে। এই যুগে কোকো আসত আমেরিকা থেকে, চিন থেকে আসত পোর্সেলিন, প্রাচ্য দেশ থেকে আসত নীল এবং নিকট ও দূর প্রাচ্য থেকে আসত চা ও কফি। এর আগে আমদানির ক্ষেত্রে প্রধান ছিল প্রাচ্যের মশলা এবং পশ্চিমের সোনা ও রুপো।

দাস ব্যাবসার শ্রীবৃদ্ধি

এছাড়া এই সময় দাস ব্যাবসারও যথেষ্ট শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছিল। প্রধানত এই কারণেই আফ্রিকা থেকে বিপুল সংখ্যক কালো মানুষদের দাস রূপে জাহাজ বোঝাই করে আমেরিকায় পাঠানো হতে থাকে।

বাণিজ্য বিপ্লবের অন্যতম বৈশিষ্ট্য

  • (১) আলোচ্য পর্বে বাণিজ্য বিপ্লবের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল মুদ্রা-অর্থনীতির (Money Economic) ব্যাপক প্রচলন। এর প্রভাব শুধু শহর অঞ্চলে নয় গ্রাম অঞ্চলেও গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করেছিল। অবশ্য এই প্রথার পাশাপাশি বিনিময় প্রথা বা বাণিজ্য (barter-trade) তার অস্তিত্ব রক্ষা করতে পেরেছিল।
  • (২) এই বাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করেছিল নানাপ্রকার খাদ্যদ্রব্য ও কাঁচামাল এবং তৈরি মাল (manufactured goods)। এগুলি অবশ্য প্রধানত ইউরোপীয় দেশগুলির মধ্যে বিনিময় করা হত। এই যুগে ইংল্যান্ড তার পশম রপ্তানি করত উত্তর ইউরোপে, সেই পণ্য আর পূর্বে এশিয়ায় রপ্তানি করার কথা চিন্তা করে নি।
  • (৩) পোর্তুগালের ভারতীয় উপনিবেশ থাকা সত্ত্বেও তারা তাদের দেশে আঙুর থেকে উৎপাদিত অতি উৎকৃষ্ট সুরা ভারতে রপ্তানি না করে ইংল্যান্ডে প্রেরণ করত। অনুরূপভাবে স্পেনের উল পাঠানো হত ইতালি ও নেদারল্যান্ডসে।
  • (৪) অবশ্যই বিনিময় প্রথার দ্বারা কোনোমতেই তেমন উল্লেখযোগ্যভাবে উপকৃত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল না এবং এই বাণিজ্যের পরিমাণও ছিল অপেক্ষাকৃত কম, প্রধানত এই কারণেই পরবর্তীকালে এই বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ইউরোপ বহির্ভূত অঞ্চলের কথা চিন্তা করেছিল।
  • (৫) এই কারণে আরও পরবর্তীকালে ইউরোপ বহির্ভূত অঞ্চলে নতুন নতুন শিল্প ও বাণিজ্য গড়ে উঠেছিল। এইগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল চিনি এবং তামাক শিল্প। এছাড়া কোনো কোনো ক্ষেত্রে জাহাজ শিল্প, বন্দরের জন্য প্রয়োজনীয় গুদাম এবং অস্ত্রশিল্প গড়ে উঠেছিল। বলাবাহুল্য এই প্রক্রিয়া পরবর্তীকালে ইউরোপে পুঁজিবাদী বিকাশের পথকে প্রশস্ত করেছিল।

বাণিজ্যে উন্নত পশ্চিম ইউরোপ

  • (১) ষোড়শ শতকে বাণিজ্য বিপ্লব সত্ত্বেও বিশ্ববাজার সংগঠনের ক্ষেত্রে এক প্রকার বৈষম্যের উদ্ভব ঘটে। আলোচ্য পর্বে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে উন্নত অঞ্চল ছিল পশ্চিম ইউরোপ। অনুন্নত অঞ্চল ছিল পূর্ব ইউরোপ। এই উন্নত বা metropolitan অঞ্চল শিল্পজাত পণ্য উৎপাদনের দায়িত্ব কুক্ষিগত করে রেখেছিল।
  • (২) অন্যদিকে অনুন্নত পূর্ব ‘প্রান্তিক’ অঞ্চলের দায়িত্ব ছিল মূলত খাদ্যশস্য ও নানাপ্রকার কাঁচামাল জোগান৷ প্রথমোক্ত অঞ্চলের উৎপাদন ব্যবস্থা নির্ভরশীল ছিল মূলত স্বাধীন ও মুক্ত শ্রমিকদের উপর। কিন্তু শেষোক্ত অঞ্চল নির্ভরশীল ছিল দাস বা serf শ্রমের ওপর।
  • (৩) আমেরিকা মহাদেশে অবশ্য এই দুই প্রকার বাণিজ্য সংগঠনের বিচিত্র সহাবস্থান লক্ষ্য করা যায়। এই অসম শ্রমবিভাজনে এশিয়া মহাদেশ তখনও অন্তর্ভুক্ত হয় নি, কারণ এশিয়ায় তখনও উল্লেখযোগ্য ইউরোপীয় সাম্রাজ্য-এর বিস্তার ঘটে নি।

বাণিজ্য বিপ্লবে ব্যাংকারদের ভূমিকা

  • (১) এই যুগে বাণিজ্য বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করতে ব্যাংকাররা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল। মধ্যযুগে ব্যাংকিং ব্যবসায় মোটামুটিভাবে ইতালীয়দের একচেটিয়া প্রাধান্য ছিল। কিন্তু ১৫০০ খ্রিস্টাব্দের পর মাত্র কয়েক দশক অতিক্রান্ত হলে ইতালীয়দের Monopoly-কে চ্যালেঞ্জ জানাতে ব্যাংক ব্যবসায় অবতীর্ণ হয়েছিল জার্মান, ইংরেজ এবং ফরাসিগণ।
  • (২) ব্যাংক এবং অন্যান্য আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে এরা এমন নতুন আর্থিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে থাকে যা এখানে ইতিপূর্বে এগুলি হয় ছিল না নয়তো সংখ্যায় খুব কম ছিল। এই প্রসঙ্গে কাস্তিল, পোর্তুগাল এবং বিশেষভাবে জার্মানির কথা বলা যায়। বলাবাহুল্য এর ফলে সমগ্র ইউরোপীয় মহাদেশে ব্যাংক এবং আর্থিক লেনদেন সংক্রান্ত ব্যাবসার প্রসার ঘটেছিল।
  • (৩) বহুস্থানে Merchant Banker-রা আর্থিক লেনদেনের উদ্দেশ্যে Exchange খুলেছিলেন। বহু ক্ষেত্রে এগুলিকে ‘বুসে’ (‘Bourses’) বলা হত। ফ্রান্স-এর একটি প্রসিদ্ধ ব্যাংক ব্যবসায়ী পরিবার ব্রুজ শহরে Place de la Bourse in Bruges নামক একটি Exchange প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেই থেকেই অন্যান্য Exchange গুলি বুর্সে নামে পরিচিত হতে থাকে।
  • (৪) ফরাসি ভাষায় ‘de la bourse’-র অর্থ টাকার থলি বা ধনাগার বোঝায়। যাইহোক এই কেন্দ্রগুলিতে একদিকে যেমন Bill of Exchange গুলি বিক্রয় করা হত এবং বিভিন্ন মুদ্রার বিনিময় মূল্য স্থির করা হত। ১৫৩১ খ্রিস্টাব্দে অ্যান্টওয়ার্প শহরে অনুরূপ একটি কেন্দ্র খোলা হয়েছিল যেখানে বিভিন্ন ইউরোপীয় দেশে এবং বিভিন্ন ভাষাভাষীর ব্যবসায়ীগণ আর্থিক লেনদেন এবং অন্যান্য কাজে ব্যস্ত থাকতেন।
  • (৫) বিভিন্ন রঙের পোশাক পরিহিত এই ব্যবসায়ীরা নানা ভাষায় নিজেদের মধ্যে আর্থিক লেনদেন সংক্রান্ত তথ্য ও চিন্তার আদানপ্রদান করতেন। সব মিলিয়ে এদের উপস্থিতি সেখানে এক বর্ণাঢ্য ও বিচিত্র পরিবেশ সৃষ্টি করত। মনে হত সেই স্থান যেন ছোটো পৃথিবীর এক নিদর্শন।

প্রসিদ্ধ বাণিজ্যিক সংগঠন

  • (১) ১৪৬০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ইউরোপের সর্বাধিক প্রসিদ্ধ বাণিজ্যিক সংগঠন ছিল Medici Bank of Florence। কিন্তু ষোড়শ শতকের মধ্যভাগে অগসবার্গ-এর Fugger Company মোট বাণিজ্যের পরিমাণের ক্ষেত্রে প্রথমোক্ত প্রতিষ্ঠানকে অতিক্রম করে আরও বেশি খ্যাতি অর্জন করেছিল।
  • (২) তার আগে অবশ্য Medici Bank-এর মোট বাণিজ্যের পরিমাণ নেহাত উপেক্ষণীয় ছিল না। যদিও এই প্রতিষ্ঠানটি Bank বা Banco নামে পরিচিত ছিল কিন্তু এর কার্যকলাপের পরিধি আর্থিক ক্ষেত্র অতিক্রম করে বাণিজ্যিক এবং শিল্পের ক্ষেত্রেও প্রসারিত হয়েছিল। ইউরোপে তাদের মোট শাখার সংখ্যা ছিল আট।
  • (৩) অন্যদিকে Fugger-দের শাখার কেন্দ্র পঁচিশ অতিক্রম করেছিল। Medici-দের কাপড়ের কল ছিল তিনটি (তিনটিই ছিল মাঝারি মাপের শিল্প)। অন্যদিকে Fugger-রা তাদের খ্যাতি ও সমৃদ্ধির চূড়ান্ত পর্বে টাইরল-এ একাধিক রুপোর খনি, সাইলেশিয়ায় একাধিক সোনার খনি, স্পেনে কয়েকটি পারার খনির অধিকারী ছিল।
  • (৪) শুধু তাই নয় তারা হাঙ্গেরির তামার খনি এবং উৎপাদনকে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করত। যেখানে ১৪৫১ খ্রিস্টাব্দে Medici Bank-এ মোট মূলধনের পরিমাণ ছিল নব্বই হাজার ফ্লোরিন, সেখানে আলোচ্য পর্বে ১৫৪৭ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ Fugger-দের মোট মূলধনের পরিমাণ ওই সংখ্যার প্রায় দশ গুণ ছিল।
  • (৫) এই পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে ষোড়শ শতকে বাণিজ্য বিপ্লবের যুগে ব্যাবসা এবং আর্থিক লেনদেনের পরিমাণ কত বেশি বৃদ্ধি পেয়েছিল। Medici Bank-এর জনৈক এজেন্ট বার্গান্ডির ডিউককে মাত্রাতিরিক্ত ঋণ প্রদান করলে ওই প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবক্ষয়ের সূচনা হয়েছিল।

বাণিজ্য বিপ্লবের যুগে বাণিজ্যিক কেন্দ্র

  • (১) অ্যান্টওয়ার্প শুধু আর্থিক লেনদেন নয় এটি ছিল সেই যুগে ইউরোপের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্র। এখানে পূর্ব ও মধ্য ইউরোপ থেকে খাদ্যশস্য, রুপো, তামা, কাঠ প্রভৃতি পণ্য ইংল্যান্ডের বস্ত্র এবং আটলান্টিকের পশ্চিমে অবস্থিত New World আমেরিকা মহাদেশ থেকে বিলাসবহুল সামগ্রী আমদানি করা হত।
  • (২) বলাবাহুল্য, এটি ছিল ওইসব পণ্যের ক্রয়-বিক্রয়ের একটি বৃহৎ কেন্দ্র। পোর্তুগাল এবং উত্তর জার্মানির বণিক পুঁজিপতিদের সহায়তায় এই শহর ও বাণিজ্যকেন্দ্র গড়ে উঠেছিল। কিন্তু আরও পরবর্তীকালে স্পেনীয় সোনা-রুপো, মশলা আমদানি ব্যাবসার ওপর পোর্তুগালের একচেটিয়া অধিকার ক্ষুণ্ণ হলে অ্যান্টওয়ার্পের আর্থিক অবনতির সূচনা হয়েছিল।
  • (৩) ষোড়শ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা অ্যান্টওয়ার্পকে আরও অবনতির দিকে ঠেলে দিয়েছিল। অতঃপর এই স্থান দখল করেছিল অন্যান্য ইউরোপীয় নগর ও বাণিজ্যকেন্দ্র, যথা লন্ডন, জেনোয়া, হামবুর্গ, লিভার্নো, আমস্টারডাম।

উপসংহার :- ইউরোপীয় নগর ও বাণিজ্য কেন্দ্র আমস্টারডামের গুরুত্ব সর্বাধিক বৃদ্ধি পেয়েছিল। কারণ এই শহরটি বাল্টিক অঞ্চল, উত্তর ইউরোপ এবং আটলান্টিক উপকূলের বাণিজ্য অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করত। যেহেতু এই শহর ছিল হল্যান্ডের অন্তর্ভুক্ত সেহেতু এর উন্নতি ও বিকাশের অর্থ ছিল হল্যান্ড তথা ওলন্দাজদের সমৃদ্ধি ও বিকাশ।

(FAQ) বাণিজ্য বিপ্লব সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. ইউরোপে বাণিজ্য বিপ্লব সংঘটিত হয় কখন?

ষোড়শ এবং সপ্তদশ শতকে।

২. মশলা বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্র কোথায় ছিল?

লিসবন।

৩. বাণিজ্য বিপ্লবের সময় ইউরোপের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্র কোনটি ছিল?

অ্যান্টওয়ার্প।

৪. বাণিজ্য বিপ্লবের শেষের দিকে বাণিজ্যের কোন কেন্দ্র গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে?

আমস্টারডাম।

অন্যান্য ঐতিহাসিক ঘটনাগুলি

Leave a Comment