ভারতে পারসিক অভিযানের ফলাফল প্রসঙ্গে রাজনৈতিক ফল হিসেবে সাম্রাজ্য বিস্তারের প্রেরণা, লোহার ব্যবহার ও মুদ্রা ব্যবস্থা, মৌর্য সাম্রাজ্যের ওপর প্রভাব ও মৌর্য শিল্পে পারসিক প্রভাব সম্পর্কে জানবো।
প্রাচীন ভারতে পারসিক অভিযানের ফলাফল
ঐতিহাসিক ঘটনা | ভারতে পারসিক অভিযানের ফলাফল |
প্রথম অভিযান | কাইরাস |
মগধ সম্রাট | বিম্বিসার |
অ্যারামাইক লিপি | খরোষ্ঠী লিপি |
ভূমিকা :- ভারত -এ পারসিক বিজয়ের কোনো প্রত্যক্ষ প্রভাব দেখা যায় না। পারসিক সাম্রাজ্য স্থায়ী না হওয়ার ফলে এই সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক গুরুত্ব তেমন ছিল না। ভারতীয় পুরাণ বা প্রাচীন সাহিত্যে এই আক্রমণের কোনো উল্লেখ দেখা যায় নি।
ভারতে পারসিক অভিযানের রাজনৈতিক ফল
ভারতের উত্তর-পশ্চিমে যখন পারসিক সাম্রাজ্য স্থাপনের চেষ্টা চলছিল, সেই সময় গঙ্গা-যমুনা উপত্যকায় মগধ তার নব যৌবনের প্রখর তেজ নিয়ে সাম্রাজ্য স্থাপনের কাজে রত ছিল। এজন্য ভারতীয় লেখকদের দৃষ্টি প্রধানত মগধের দিকেই আবদ্ধ ছিল।
(১) গান্ধার রাজের সাহায্যের আবেদন
গান্ধার রাজ পুকুসতি তাঁর শত্রুর বিরুদ্ধে মগধ সম্রাট বিম্বিসারের সাহায্য চান বলে জানা যায়। এই শত্রু কে তা ঠিক জানা যায় নি। হয়ত এই শত্রু পারসিকরাও হতে পারে।
(২) সাম্রাজ্য বিস্তারের প্রেরণা
বিম্বিসার ও অজাতশত্রু পারস্যের এক সমুদ্র থেকে অপর সমুদ্র পর্যন্ত সাম্রাজ্য বিস্তার দেখে ভারতে এই ধরনের সাম্রাজ্য বিস্তারের প্রেরণা পেয়েছিলেন বলে অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন।
(৩) ভারত সম্পর্কে গ্ৰিকদের কৌতূহল
পারস্যের মাধ্যমে ভারতের কথা গ্রিস দেশ জানতে পারে। গ্রীস দেশ অভিযানের সময় পারসিক সম্রাট জারেক্সিসের বাহিনীতে ভারতীয় সেনার উপস্থিতি ভারত সম্পর্কে গ্রীকদের মনে কৌতূহল জাগায়। হেরোডোটাস ভারতবর্ষ সম্পর্কে তথ্য দিতে আরম্ভ করেন। পারস্যের সাম্রাজ্যের পথ ধরে ম্যাসিডনের দিকবিজয়ী আলেকজাণ্ডার ভারত আক্রমণ করেন। পারস্যের পথে ভারতীয় পণ্ডিতেরা গ্রীসে যান এবং সক্রেটিস -এর সঙ্গে দর্শন নিয়ে আলোচনা করেন।
(৪) লোহা ও মুদ্রা ব্যবস্থা
হুইলার -এর মতে, পারস্যের কাছ থেকে আমাদের দেশ ভারতবর্ষ লোহার ব্যাপক ব্যবহার ও মুদ্রা তৈরির কৌশল শিক্ষা নেয়।
(৫) শাসন ব্যবস্থায় প্রভাব
পারসিক শাসনব্যবস্থায় সাম্রাজ্যে সর্বত্র শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষা করা, রাজপথগুলিকে নিরাপদ রাখার ব্যবস্থা থাকত। এজন্যে পারসিক আমলে তক্ষশীলা, পুষ্কলাবতী, কপিশায় পথের পাশে নগর গড়ে ওঠে। ভারতীয় শাসকরা বিশেষত মৌর্য সম্রাটরা পারসিকদের কাছ থেকে এই উত্তরাধিকার গ্রহণ করেন।
মৌর্য সাম্রাজ্যের উপর ভারতে পারসিক অভিযানের প্রভাব
মৌর্য সাম্রাজ্য -এর ওপর পারস্যের প্রভাব অনেকটা ব্যাপকভাবে দেখা যায়। যেমন –
(১) সর্বভারতীয় সাম্রাজ্য স্থাপনের আদর্শ
স্পুনার প্রমুখ পণ্ডিতদের মতে, মৌর্য সম্রাটরা ভারতীয় ছিলেন না, পারসিক ছিলেন। স্পুনারের এই মত অধিকাংশ পণ্ডিত অগ্রাহ্য করেন। তবে স্পুনারের এই মত সমর্থনযোগ্য যে, মৌর্য রাজারা পারসিকদের কাছ থেকে সর্বভারতীয় সাম্রাজ্য স্থাপনের আদর্শ গ্ৰহণ করেন।
(২) শাসন ব্যবস্থায় অনুকরণ
মৌর্য শাসনব্যবস্থায় কিছু কিছু পারসিক প্রভাব দেখা যায়। মৌর্য শাসনব্যবস্থায় কেন্দ্রীকরণ নীতি পারসিকদের শাসনব্যবস্থা থেকে নেওয়া হয় বলে অনেকে মনে করেন। গুজরাটে অশোক -এর নিযুক্ত শাসনকর্তা ছিলেন যবন বা পারসিক তুষাস্প। মৌর্য সম্রাটদের দেহরক্ষিণীর কাজে পারসিক নারী নিয়োগ করা হত।
(৩) প্রাসাদের অনুকরণ
মৌর্য সম্রাটরা কেশ সংস্কার প্রভৃতি উৎসব পারস্যের অনুকরণে করতেন। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য -এর পাটলিপুত্র -এর কাষ্ঠ-নির্মিত প্রাসাদ পারস্যের পার্সিপোলিস প্রাসাদের অনুকরণ বলে স্পুনার মনে করেন। এমন কি স্পুনার বলেন যে, পারসিক কারিগররাই পাটলিপুত্রের মৌর্য রাজপ্রাসাদ নির্মাণ করেন। ভারতের পৌরাণিক স্থপতি ময়দানব হলেন পারস্যের অসুর ময় বামারা। স্পুনারের এই মতকে ঐতিহাসিকরা কাল্পনিক বলে মনে করেন।
(৪) স্থাপত্যে প্রভাব
মৌর্য সাম্রাজ্যের ওপর পারসিক প্রভাব কিছুটা ছিল। আলেকজাণ্ডার পার্সিপোলিস নগরী ধ্বংস করার পর বহু পারসিক স্থপতি ও ভাস্কর ভারতে চলে আসেন। তাঁদের প্রভাবে ইন্দো-পারসিক স্থাপত্যের অগ্রগতি হয়। অশোকের স্তম্ভগুলিকে অনেকে এই স্থাপত্যের বিশেষ নিদর্শন বলে মনে করেন।
(৫) ভাস্কর্য
পূর্বে ভারতে পাথর খোদাই করে স্তম্ভ নির্মাণ ও তার গায়ে লিপি খোদাই করার চল ছিল না। অশোক স্তম্ভগুলির অসাধারণ পালিশ এবং খোদাইয়ের কাজ পারসিক ভাস্কর্যের প্রভাব বলে মনে করা হয়।
(৬) লিপি
পারসিক সম্রাটরা ভারতের অধিকৃত অঞ্চলে আরমাইক লিপি চালু করেন। মৌর্য যুগের খরোষ্ঠী লিপি এই আরমাইক লিপি থেকে উদ্ভূত হয়। পারসিক মুদ্রা দারিক ও শেকেলের অনুকরণে মৌর্য মুদ্রা তৈরি হয়।
মৌর্য শিল্পে পারসিক অভিযানের প্রভাব
আলেকজাণ্ডারের ভারত আক্রমণ -এ পারসিক সাম্রাজ্য ধ্বংস হলেও ভারতের সঙ্গে পারস্যের সাংস্কৃতিক সম্পর্কে ছেদ পড়ে নি। পারস্য থেকে বহু স্থপতি এই সময় ভারতে চলে আসেন। তাদের প্রভাব মৌর্য শিল্পকলা ও অশোকের স্তম্ভগুলি তৈরির ক্ষেত্রে দেখা যায়। যেমন –
(১) অশোকের স্তম্ভ
মর্টিমার হুইলার-এর মতে, অশোকের স্তম্ভের সিংহমূর্তিগুলি, উল্টো করে রাখা পদ্ম, স্তম্ভের গায়ে তাঁর বাণী খোদাই পারসিক প্রভাব মনে করিয়ে দেয়। পারসিক সম্রাটরা বাহিস্থান, নাকস-ই-রুস্তম লিপি এমনভাবেই তৈরি করাতেন।
(২) লেখের ভূমিকা
অশোকের লেখগুলি রচনায় যে ভূমিকা ব্যবহার করা হয় তা অনেকটা দরায়ুসের লেখের ভূমিকার অনুকরণ। অশোক তার লেখগুলির মুখবন্ধে বলেন “দেবানাম পিয় প্রিয়দশী এবম্ অহি”। অর্থাৎ দেবতাগণের প্রিয় প্রিয়দর্শী একথা বলেছেন। পারসিক সম্রাট দরায়ুসের নিজের মুখবন্ধে এই রকম বয়ান দেখা যায়। পণ্ডিতদের অনুমান যে অশোক তাঁর লেখের বয়ান এখান থেকেই নেন। অশোকের লেখে “দিপি” ও “নিপিষ্ট” প্রভৃতি শব্দ পারসিক ভাষা থেকে গৃহীত বলে মনে করা হয়।
উপসংহার :- ভারতও পারস্যকে কিছু দিয়েছিল, শুধু পারস্য থেকে নেয়নি। পারস্যের ম্যানিকেয় ধর্মমত ভারতীয় বৌদ্ধ ধর্ম -এর প্রভাবে উদ্ভূত হয়। মহাযান বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে পারস্যের জরাথুস্ট্রীয় ধর্মতত্ত্বের কিছু যোগ ছিল।
(FAQ) ভারতে পারসিক অভিযানের ফলাফল সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
বিম্বিসার, অজাতশত্রু।
চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য।
খরোষ্ঠী লিপি।