কৈবর্ত বিদ্রোহ প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক উপাদান, রামচরিত কাব্যের ঐতিহাসিকতা, রামচরিতে কৈবর্ত বিদ্রোহের বর্ণনা, রামচরিতের বর্ণনার ত্রুটি, দিব্য সম্পর্কে মন্তব্য, মহীপালের কুশাসন, সামন্ত বিদ্রোহ, দিব্যর জনপ্রিয়তা ও বরেন্দ্রী পুনরুদ্ধার সম্পর্কে জানবো।
প্রাচীন বাংলার কৈবর্ত বিদ্রোহ প্রসঙ্গে কৈবর্ত বিদ্রোহের কারণ, কৈবর্ত বিদ্রোহের নেতা, কৈবর্ত বিদ্রোহের নায়ক, কৈবর্ত বিদ্রোহ সম্পর্কে ঐতিহাসিক উপাদান, সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিত মানসে কৈবর্ত বিদ্রোহের বর্ণনা, কৈবর্ত বিদ্রোহের নায়ক দিব্য সম্পর্কে মন্তব্য, নিছক সামন্ত বিদ্রোহ নয়, কৈবর্ত বিদ্রোহের নায়ক দিব্যর জনপ্রিয়তা, কৈবর্তদের হাত থেকে বরেন্দ্রী পুনরুদ্ধার।
বাংলার কৈবর্ত বিদ্রোহ
ঐতিহাসিক যুদ্ধ | কৈবর্ত বিদ্রোহ |
নেতা | দিব্য বা দিব্বোক |
প্রতিপক্ষ | দ্বিতীয় মহীপাল |
দখল | বরেন্দ্রভূমি |
দমন | রামপাল |
ভূমিকা :- প্রাচীন ভারত -এর পাল বংশীয় রাজা দ্বিতীয় মহিপাল কে নিহত করে কৈবর্ত বিদ্রোহের নায়ক দিব্য বরেন্দ্রভূমির সিংহাসনে বসেন। এই রাজনৈতিক বিপ্লব শুধুমাত্র একটি রাজবংশের পরিবর্তন করেছিল নাকি একটি গণবিদ্রোহের ইঙ্গিত দিয়েছিল তা নিয়ে আধুনিক পণ্ডিতদের মধ্যে বিতর্ক আছে।
কৈবর্ত বিদ্রোহ সম্পর্কে ঐতিহাসিক উপাদান
- (১) দ্বিতীয় মহিপালের পতন ও দিব্যের অভুত্থান সম্পর্কে একমাত্র ঐতিহাসিক উপাদান হল সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিত কাব্য। এই কাব্যটি দ্ব্যর্থবোধক ভাবে রচিত। এক অর্থে রামচন্দ্রের বিজয় ও গুণকীর্তন করা হয়েছে, অন্য অর্থে পাল রাজা রামপালের জীবন এবং সিংহাসন লাভ ও তার কৃতিত্বের বর্ণনা করা হয়েছে। ঐতিহাসিকরা এই দ্বিতীয় অর্থের জন্যই রামচরিতকে এক বিশিষ্ট ঐতিহাসিক উপাদান বলে ব্যবহার করেন।
- (২) এছাড়া কুমারপালের মন্ত্রী বৈদ্যদেবের কামাউলি পট্ট, মদনপালের মানাহালি পট্ট ও ভোজবর্মনের বেলবা পট্ট থেকে কৈবর্ত বিদ্রোহের কথা জানা যায়।
রামচরিত কাব্যের ঐতিহাসিকতা
- (১) সন্ধ্যাকর নন্দীর রচনা পাল বংশের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট বলে অনেকে মনে করেন। কারণ, সন্ধ্যাকর নন্দীর পিতা প্রজাপতি নন্দী ছিলেন পাল বংশের মন্ত্রী। তার পুত্র সন্ধ্যাকর নন্দী ছিলেন রামপালের সভা কবি।
- (২) সুতরাং পাল রাজাদের অন্নপুষ্ট এই কবি নির্ভীকভাবে সত্য ভাষণ করবেন এমন আশা করা যায় না। যদি বাণভট্টের হর্ষচরিতকে হর্ষবর্ধন -এর প্রতি ঈষৎ পক্ষপাত দুষ্ট এবং শশাঙ্ক -এর প্রতি বিরোধীভাবাপন্ন বলা হয়, তবে সন্ধ্যাকরের রচনা একই দোষে দুষ্ট। তাই সন্ধ্যাকর নন্দীর দেওয়া তথ্যকে সাবধানতার সঙ্গে ব্যবহার করা উচিত।
রামচরিতে কৈবর্ত বিদ্রোহের বর্ণনা
- (১) সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিতের কয়েকটি শ্লোকে দিব্য দ্বারা দ্বিতীয় মহিপালের হত্যা এবং দিব্যের এই কাজ সম্পর্কে মন্তব্য ও রামপাল কর্তৃক দিব্যের ভ্রাতুষ্পুত্র ভীমকে নিহত করে বরেন্দ্রীর সিংহাসন উদ্ধারের কথা বলা হয়েছে।
- (২) রামচরিতের মতে দ্বিতীয় মহিপাল ন্যায় ও স্বাধীনভাবে বিচার করে কাজ করতে অপারগ ছিলেন। তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছেন এই মিথ্যা সন্দেহে তিনি তাঁর দুই ভাই শূরপাল ও রামপালকে কারাগারে বন্দী করেন।
- (৩) তার বিরুদ্ধে সামন্তরা সঙ্ঘবদ্ধ হলে তিনি ঠিকমতো প্রস্তুতি না করে যুদ্ধযাত্রা করেন। এই সামন্তরা তার অত্যাচারী শাসনে অতিষ্ঠ হয়ে বিদ্রোহ করেছিল। এই যুদ্ধে তিনি নিহত হন। তার মৃত্যুর পর দিব্য বা দিব্বোক নামে বরেন্দ্রীর এক প্রভাবশালী কৈবর্ত বংশীয় সামন্ত বরেন্দ্রীর সিংহাসনে বসেন।
- (৪) দিব্য ছিলেন দ্বিতীয় মহিপালের অধীনস্থ সামন্ত। তিনি কৈবর্তদের বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন। কারণ, কৈবর্তরা মহীপালের কুশাসনে অতিষ্ঠ হয়েছিল।
কৈবর্ত বিদ্রোহ সম্পর্কে রামচরিতের বর্ণনার ত্রুটি
সন্ধ্যাকর নন্দীর রচনায় একথা স্পষ্টভাবে বলা হয় নি যে, দিব্যই বিদ্রোহী সামন্তদের নেতৃত্ব দেন বা মহীপালের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। এমন হতে পারে যে, সামন্তরা বিদ্রোহ করার আগেই দিব্য কৈবর্তদের বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন এবং কৈবর্ত বিদ্রোহ বা বরেন্দ্র বিদ্রোহ আগেই ঘটেছিল।
কৈবর্ত বিদ্রোহের নায়ক দিব্য সম্পর্কে সন্ধ্যাকরের মন্তব্য
সন্ধ্যাকরের মতে দিব্যের সিংহাসন অধিকার করার কাজ ছিল দস্যুদের মতই। তিনি ছিলেন উপাধিব্রতী অর্থাৎ কর্তব্য পালনের ছদ্মবেশ ধারণকারী। তিনি অনীক ধর্মবিপ্লব অর্থাৎ বেআইনি ও ধর্ম বহির্ভূত বিদ্রোহ ঘটিয়েছিলেন। তার আসল উদ্দেশ্য ছিল নিজ উচ্চাকাঙ্ক্ষা সিদ্ধ করা। কিন্তু বাইরে তিনি জনসাধারণের রক্ষার জন্য ছদ্ম নেতৃত্ব দেন।
কৈবর্ত বিদ্রোহের নায়ক দিব্য সম্পর্কে মন্তব্য সঠিক নয়
সন্ধ্যাকর নন্দী দিব্যের বিদ্রোহ সম্পর্কে যে কঠোর মন্তব্য করেছেন তা অনেকাংশে সত্য নয় বলে মনে করা হয়। পাল বংশের আশ্রিত এই লেখক দিব্যকে দস্যু ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারেন নি। দিব্য নিজে সিংহাসনে না বসে যদি রামপালকে সিংহাসন ছেড়ে দিতেন তাহলে বংশানুক্রমিক ন্যায্য অধিকার রক্ষা হত।
কৈবর্ত বিদ্রোহ সম্পর্কে অক্ষয়কুমার মৈত্রের মন্তব্য
ঐতিহাসিক অক্ষয়কুমার মৈত্রের মতে যদিও রামপাল ছিলেন দ্বিতীয় মহিপালের কনিষ্ঠ, তিনিই ছিলেন সর্বসম্মত প্রার্থী। তার পরিবর্তে দ্বিতীয় মহিপাল সিংহাসনে বসায় সামন্ত শ্রেণী বিদ্রোহ করে। কিন্তু যদি রামপাল সর্বসম্মত প্রার্থী হবেন তবে দ্বিতীয় মহিপালের পতনের পর সামন্ত শ্রেণি কেন তাকে সমর্থন জানাননি এবং কেন কৈবর্ত দিব্য বিনা প্রতিবাদে সিংহাসনে বসতে পারেন। রামপালের স্বার্থে এইবিদ্রোহ হয় এ কথা মনে করা যায় না।
কৈবর্ত বিদ্রোহ সম্পর্কে ডঃ মজুমদারের অভিমত
- (১) দিব্যের বিদ্রোহের প্রকৃতি সম্পর্কে ডক্টর আর সি মজুমদার বলেছেন যে “আর পাঁচটা সাধারণ বিদ্রোহের মতই দিব্যের বিদ্রোহ ছিল দুর্বল রাজার বিরুদ্ধে সামন্ত বিদ্রোহ। এটা ছিল পাল সাম্রাজ্য -এর বিভিন্ন অঞ্চলের ভাঙ্গনের একটা অঙ্গ।” দিব্য কোনো মহৎ উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে জনসাধারণকে দ্বিতীয় মহীপালের শাসন থেকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসেন, এ কথা তিনি মনে করেন না।
- (২) পাল বংশের প্রতিষ্ঠাতা গোপাল -এর মতো জনসাধারণের ইচ্ছাক্রমে তিনি সিংহাসনে বসেন এবং দেশকে সংকট থেকে রক্ষা করেন তাও ঠিক নয়। দিব্যের বিদ্রোহ ছিল একটি নিছক সামন্ত বিদ্রোহ। রামচরিতের মতে সম্মিলিত সামন্ত চক্রের দ্বারা এই বিদ্রোহ ঘটে। ডঃ মজুমদার এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
কৈবর্ত বিদ্রোহ নিছক সামন্ত বিদ্রোহ নয়
দিব্যের বিদ্রোহ জনসাধারণের স্বার্থে ঘটেছিল নাকি জনসাধারণের ইচ্ছায় দিব্য সিংহাসনে বসেন একথার কোনো প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায় নি। কিন্তু কিছু কিছু পরোক্ষ প্রমাণ ইঙ্গিত দেয় যে, দিব্যের বিদ্রোহ নিছক সামন্ত বিদ্রোহ ছিল না।
কৈবর্ত বিদ্রোহের নায়ক দিব্য স্মৃতি উৎসবে বক্তৃতা
পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, স্যার যদুনাথ সরকার, রমাপ্রসাদ চন্দ প্রমুখ দিব্য স্মৃতি উৎসবে প্রদত্ত বক্তৃতামালায় বলেছেন যে, মহীপালের অত্যাচার থেকে জনসাধারণকে রক্ষা করতে দিব্য এগিয়ে আসেন। বাংলা ১৩৪২ সনের ভারতবর্ষ পত্রিকায় এ সম্পর্কে প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়।
কৈবর্ত বিদ্রোহের পূর্বে মহীপালের কুশাসন
সন্ধ্যাকর নন্দী স্পষ্ট ভাষায় দ্বিতীয় মহীপালের কুশাসনের কথা বলেছেন। মহীপাল এতই অত্যাচারী ছিলেন যে তিনি নিজ ভ্রাতাদেরও কারাগারে আবদ্ধ রাখেন। তিনি আরও বলেছেন যে মহীপালের কুশাসনে কৈবর্ত সম্প্রদায় অতিষ্ঠ হয়েছিল। সুতরাং দ্বিতীয় মহীপালের কুশাসন প্রমানিত।
সামন্তদের বিদ্রোহ
দ্বিতীয় মহীপালের কুশাসনে অতিষ্ঠ হয়ে সামন্তরা যুদ্ধ ঘোষণা করে। দিব্যও ছিলেন বরেন্দ্রীর অন্যতম প্রধান সামন্ত ও দ্বিতীয় মহীপালের কর্মচারী। তবে তিনি সামন্ত বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন কিনা তা জানা যায় নি।
কৈবর্ত বিদ্রোহের নায়ক দিব্যর জনপ্রিয়তা
- (১) যদি দিব্য দস্যু ও বেআইনি ভাবে সিংহাসন দখলদারি হবেন তবে অন্যান্য সামন্ত ও জনসাধারণ তাকে কেন মেনে নিল? পাল বংশের পৈতৃক সিংহাসনে বহিরাগত লোককে বিনা কারণে সকলে মেনে নেবেনা একথা মনে করা যায় না।
- (২) অন্ততঃ দিব্য তাদের কাছে জনপ্রিয় ও গ্ৰহণীয় ছিলেন। যদি দিব্য জনপ্রিয় না হতেন এবং তার কিছু ভাবমূর্তি না থাকত তবে তিন পুরুষ ধরে বরেন্দ্রীর সিংহাসনে তারা থাকতে পারতেন না।
কৈবর্তদের হাত থেকে বরেন্দ্রী পুনরুদ্ধার
পরবর্তী রাজা রামপাল সামন্তদের কর হ্রাস ও অন্যান্য সুবিধাদানের প্রলোভন দেখিয়ে সামন্তদের নিজ পক্ষে আনেন এবং বরেন্দ্রী পুনরুদ্ধার করেন।
উপসংহার :- ডঃ নীহাররঞ্জন রায় কৈবর্ত বিদ্রোহের কোনো সামাজিক গুরুত্ব ছিল বলে মনে করেন না। ডঃ মজুমদার এই বিদ্রোহকে নিছক একটি উচ্চাকাঙ্ক্ষী সামন্তের বিদ্রোহ অ্যাখ্যা দিয়েছেন।
প্রিয় পাঠক/পাঠিকা আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ সময় করে আমাদের এই “কৈবর্ত বিদ্রোহ” পোস্টটি পড়ার জন্য। এই ভাবেই adhunikitihas.com ওয়েবসাইটের পাশে থাকুন। যে কোনো প্রশ্ন উত্তর জানতে এই ওয়েবসাইট টি ফলো করুণ এবং নিজেকে তথ্য সমৃদ্ধ করে তুলুন।
সবশেষে আপনার কাছে আমাদের অনুরোধ যদি এই পোস্টটি আপনার ভালো লেগে থাকে তাহলে Comment ও Share করে দিবেন, (ধন্যবাদ)।
(FAQ) কৈবর্ত বিদ্রোহ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
পাল রাজা দ্বিতীয় মহীপালের আমলে।
দিব্য বা দিব্বোক।
বরেন্দ্রভূমি।
পাল রাজা রামপাল।
সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিত কাব্য থেকে।