ভারতে তুর্কী বিজয়ের গুরুত্ব

ভারতে তুর্কী বিজয়ের গুরুত্ব প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় শক্তির উদ্ভব, রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক ঐক্য, বিচ্ছিন্নতাবাদের উদ্ভব, সামন্ত প্রথা ধ্বংস আভ্যন্তরীন স্থিতি, সর্বভারতীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েম, দিল্লির মর্যাদা বৃদ্ধি ও নগর জীবনের উদ্ভব সম্পর্কে জানবো।

ভারতে তুর্কী বিজয়ের গুরুত্ব

ঐতিহাসিক ঘটনাভারতে তুর্কী বিজয়ের গুরুত্ব
তুর্কী অভিযানমহম্মদ ঘুরী
বংশঘুর বংশ
ভারতে রাজ্য স্থাপয়িতামহম্মদ ঘুরী
বিশ্বস্ত দাসকুতুবউদ্দিন আইবক
ভারতে তুর্কী বিজয়ের গুরুত্ব

ভূমিকা :- ভারত-এ তুর্কী বিজয় কেবলমাত্র একটি বৈদেশিক আক্রমণের ঘটনা ছিল না। তাদের ভারতে আসার ফলে ভারতের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তন ঘটে। তুর্কী আক্রমণ শুধুমাত্র বিজয় ছিল না, এটিকে একটি বিপ্লবও বলা যায়।

তুর্কী বিজয়ের ফলে কেন্দ্রিয় শক্তির উদ্ভব

এই তুর্কী বিজয়ের প্রাক্কালে উত্তর ভারত ছিল কয়েকটি পরস্পর বিবাদমান রাজপুত রাজ্যখণ্ডের সমষ্টি। ভারতে তখন গুপ্ত বা হর্ষবর্ধন-এর যুগের কেন্দ্রীয় শক্তির কোনো চিহ্ন ছিল না। তুর্কী বিজয়ের পর ভারতে পুনরায় কেন্দ্রীয় শক্তির পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয়। তুর্কী সুলতানের সিংহাসন ছিল এই কেন্দ্রীয় ক্ষমতার আধার।

তুর্কী বিজয়ের ফলে ভারতে রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক ঐক্য

কেন্দ্রীয় ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে ভারতে পুনরায় রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক ঐক্য ফিরে আসে।

তুর্কী বিজয়ের ফলে বিচ্ছিন্নতাবাদের উদ্ভব

ভরতে তুর্কী বিজয়ের প্রাক্কালে রাজপুত রাজ্যগুলিতে সামন্ত প্রথা ছিল প্রধান। সামন্ত প্রথার ফলে স্থানীয় স্বায়ত্বশাসন প্রথা, বিচ্ছিন্নতাবাদের উদ্ভব হয়।

তুর্কী বিজয়ের ফলে ভারতে সামন্ত প্রথা ধ্বংস

ভরতে তুর্কী ইক্তা ব্যবস্থা চালু হলে সামন্ত প্রথা ধ্বংস হয়। বিভিন্ন অঞ্চলে ইক্তাদাররা সামন্ত প্রথা ভেঙে ফেলে এবং সুলতানি আইন ও শাসন প্রবর্তন করে।

তুর্কী বিজয়ের ফলে ভরতে আভ্যন্তরীন স্থিতি

  • (১) হিন্দু রাজপুত রাজারা বীর ধর্ম অনুসারে বিজয়া দশমীর দিন থেকে যুদ্ধ যাত্রায় বের হতেন। শীতকাল পর্যন্ত কারণে-অকারণে তাঁরা প্রতিবেশী শক্তির সঙ্গে যুদ্ধ করে রক্তক্ষয় করতেন এবং সাধারণ লোকের জীবনকে ত্রস্ত করতেন।
  • (২) প্রভূত ধন-সম্পদ ও প্রাণ এই অকারণ যুদ্ধে ব্যয়িত হত। শান্তি-স্থিতি বলতে প্রায় কিছুই ছিল না। সুলতানি শাসন স্থাপিত হলে এই “মুমুর্ষার” প্রতিদ্বন্দ্বিতা বন্ধ হয়। পাঁচ বা ছয় শতক পরে জনজীবনে, রাষ্ট্রজীবনে স্থিতি ফিরে আসে।

ভরতে তুর্কী বিজয়ের ফলে দিল্লির মর্যাদা বৃদ্ধি

  • (১) তুর্কী বিজয়ের ফলে দিল্লী ভারতের ঐতিহাসিক রাজধানীতে পরিণত হয়। প্রাচীন পাটলিপুত্র, কনৌজ, উজ্জয়িনী, তক্ষশিলা হতাদরে মূলায় মুখ লুকিয়ে থাকে। দিল্লী ভারতের শাসনকেন্দ্রে পরিণত হয়।
  • (২) কুতুবউদ্দিন আইবক সর্বপ্রথম দিল্লীকে তার রাজধানী হিসেবে মনোনীত করেন। তাঁর আমল থেকেই দিল্লী স্বাধীন সুলতানির রাজধানী হিসেবে পরিগণিত হয়। ইলতুৎমিস দিল্লী নগরীকে প্রাসাদ, মিনার, মসজিদ, খানকায় সাজিয়ে দেন। সারা ইসলামীয় জগতে হজরত-ই-দিল্লী বা দিল্লী নগরের মহিমা ছড়িয়ে পড়ে।
  • (৩) তারপর থেকে দিল্লীর ক্রমে উন্নতি ঘটে। মহম্মদ-বিন-তুঘলক-এর আমলে দিল্লী থেকে কিছুদিনের জন্য রাজধানী স্থানান্তর হলেও তার আমলেই দিল্লীতে আবার রাজধানী ফিরিয়ে আনা হয়। দিল্লীকে কেন্দ্র করে এক সর্বভারতীয় শাসনের চেতনা গড়ে ওঠে।

তুর্কী বিজয়ের ফলে সর্বভারতীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েম

ঘুরী আমল থেকে উত্তর ভারতের প্রধান কেন্দ্রগুলিতে তুর্কী প্রশাসক বসিয়ে, প্রধান সড়কগুলি তুর্কী শাসকদের নিয়ন্ত্রণে রেখে এবং দিল্লীর সঙ্গে প্রদেশের যোগ ঘনিষ্ঠ করে তুর্কী সুলতানরা এক সর্বভারতীয় শাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলেন।

তুর্কী বিজয়ের ফলে মধ্য এশিয়ার সাথে ভরতের ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি

  • (১) স্যার জে. এন. সরকারের মতে, তুর্কী সুলতানি শাসনের ফলে উত্তর ভারতের সঙ্গে মধ্য এশিয়ার যোগাযোগ ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে। এক সময় কণিষ্ক-এর যুগে যেরূপ ভারত ও মধ্য এশিয়া পরস্পরের কাছে এসেছিল, তুর্কী আমলে তার পুনরাবৃত্তি ঘটে।
  • (২) সপ্তম শতক থেকে ভারত যেরূপ অন্তর্মুখী হয়ে বহির্বিশ্ব থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, দ্বাদশ শতকে তুর্কী শাসনের ফলে তার অবসান ঘটে। ভারতের সীমা প্রসারিত হয়। মধ্য এশিয়া, পশ্চিম এশিয়া এমন কি আফ্রিকার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

তুর্কী বিজয়ের ফলে ভরতে নগর বিপ্লব

এই তুর্কী শাসনের ফলে উত্তর ভারতে “নগর বিপ্লব” ঘটে। রাজপুত যুগে যে কয়েকটি নগর ছিল তা ছিল উচ্চশ্রেণীর লোকের বাসস্থান। নিম্নবর্ণের লোকেরা নগরে স্থান পেত না। কিন্তু তুর্কী শাসনকর্তারা উত্তর ভারতের বিভিন্ন স্থানে নতুন নতুন শহরের পত্তন করেন। এই শহরগুলি ছিল উচ্চ-নীচ সকল শ্রেণীর নিকট অবারিত দ্বার। শ্রমিক, কারিগর শ্রেণী এই সকল শহরে এসে শিল্পের কাজ করত ও জীবিকা অর্জন করতে পারত।

তুর্কী বিজয়ের ফলে নগর জীবনের উদ্ভব

শহরগুলি প্রধানত প্রাচীর ঘেরা ছিল। হিন্দু সমাজের শোষিত ও নির্যাতিত নিম্নবর্ণের লোকেরা এই শহরগুলিতে তাদের মুক্তি খুঁজে পায়। মধ্য যুগের ইউরোপ-এর নগরগুলি যেমন নির্যাতিত ভূমিদাসদের আশ্রয়স্থল ছিল, তুর্কী যুগে স্থাপিত নগরগুলি ছিল নিম্নবর্ণের লোকের মুক্তির কেন্দ্র। কারণ তুর্কী শাসনকর্তারা নগরের সমাজ বিন্যাসের ক্ষেত্রে জাতিভেদ প্রথাকে স্বীকার করতেন না।

ভরতে তুর্কী বিজয়ের ফলে শহর পত্তন

তুর্কী শাসনকালে দিল্লী, লাহোর, আজমীর, ফিরোজপুর, বাদাউন, গৌড় প্রভৃতি বহু শহর স্থাপিত হয়। নগরগুলির সংখ্যা বাড়লে ও রাস্তাঘাটের উন্নতি হলে বাণিজ্য বৃদ্ধি পায়।

তুর্কী বিজয়ের ফলে সামরিক সংগঠনে বিপ্লব

সামরিক দিক থেকে ভারতের প্রচলিত সামরিক সংগঠন অকার্যকারী প্রমাণিত হয়। পদাতিক পাইক সেনার স্থলে অশ্বারোহী সেনা বা সওয়ারণ-ই-মুকাতালারা প্রাধান্য পায়। সেনাদল কেবলমাত্র রাজপুত বা ক্ষত্রিয় শ্রেণীর অধিকারে না রেখে সকল শ্রেণীর জন্য খুলে দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে যোগ্য লোকেরাই সেনাদলে যোগ দিতে পারে।

উপসংহার :- তুর্কী বিজয় ভারতের ভাষাগুলির ক্ষেত্রে নানা রূপান্তর আনে। তুর্কী শাসনের আগে ভারতের বিভিন্ন স্থানে আঞ্চলিক ভাষার প্রাধান্য ছিল। তুর্কীরা শাসনের সুবিধার জন্য সকল স্থানে ফারসী বা পারসিক ভাষার প্রচলন করে। এভাবে তুর্কী বিজয় ভারতের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা করে।

(FAQ) ভারতে তুর্কী বিজয়ের গুরুত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. ভারতে তুর্কী আক্রমণের নেতা কে ছিলেন?

মহম্মদ ঘুরী।

২. মহম্মদ ঘুরী কোন যুদ্ধে পৃথ্বিরাজ চৌহানের কাছে পরাজিত হন?

তরাইনের প্রথম যুদ্ধ, ১১৯১ খ্রি।

৩. মহম্মদ ঘুরী কোন যুদ্ধে পৃথ্বিরাজ চৌহানকে পরাজিত করেন?

তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধ, ১১৯২ খ্রিস্টাব্দে।

৪. মহম্মদ ঘুরীর বিশ্বস্ত সেনাপতি কে ছিলেন?

কুতুবউদ্দিন আইবক।

৫. কোন চালুক্য রাজার কাছে মহম্মদ ঘুরী পরাজিত হন?

ভীমদেব।

Leave a Comment