ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাব

ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাব প্রসঙ্গে ইতিবাচক প্রভাব হিসেবে নবযুগের সূচনা, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব, জাতীয়তাবাদের উত্থান, জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ, সমাজ সংস্কার আন্দোলন, ধর্মসংস্কার আন্দোলন, নারী শিক্ষার প্রসার, জাতীয়তাবাদী সাহিত্য সৃষ্টি, পাশ্চাত্য বিজ্ঞান চর্চার উদ্ভব, গণতন্ত্র ও মানবতাবাদী ধারণার উদ্ভব, আধুনিক ভাবধারার বিস্তার এবং কুপ্রভাব হিসেবে বেকারত্ব বৃদ্ধি, স্বল্প সংখ্যক মানুষের শিক্ষার সুযোগ, শহরাঞ্চলে সীমাবদ্ধ ও অবহেলিত নারী শিক্ষা সম্পর্কে জানবো।

ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাব

ঐতিহাসিক ঘটনাভারত -এ পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাব
প্রত্যক্ষ প্রভাববাংলার নবজাগরণ
ব্রাহ্মসমাজরামমোহন রায়
আর্যসমাজস্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী
নব্যবঙ্গ আন্দোলনডিরোজিও
বিধবাবিবাহ আন্দোলনবিদ্যাসাগর
ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাব

ভূমিকা:- ঊনবিংশ শতকে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তার ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাব ছিল ব্যাপক ও বহুমুখী। ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রত্যক্ষ প্রভাবে রেনেসাঁস বা নবজাগরণ ঘটে। পাশাপাশি পশ্চিমি আদর্শ ভারতের সমাজ, ধর্ম, রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে এনেছিল গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন।

ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাব

উনিশ শতকে ভারতে খ্রিস্টান মিশনারি ও দেশীয় ব্যক্তিদের এবং সরকারি উদ্যোগে পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারের সুপ্রভাব ও কুপ্রভাব দুইই ছিল। যেমন –

(ক) সুপ্রভাব

ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের ইতিবাচক দিক গুলি ছিল নিম্নরূপ –

(১) নবযুগের সূচনা

পাশ্চাত্য শিক্ষায় আলােকপ্রাপ্ত ভারতবাসী আধুনিকতার পথে পা বাড়িয়েছিল। তারা রাজনীতি, দর্শন, বিজ্ঞান প্রভৃতি ক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জন করেছিল। ফলে ভারতীয়দের মধ্যে এক নবচেতনার জন্ম হয়েছিল ও ভারতে নবযুগের সূচনা হয়েছিল।

(২) শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব

পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ভারতে একদল ইংরেজি শিক্ষিত শ্রেণির উদ্ভব ঘটে এবং এঁদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়। এঁরা নিজেদের মেধা ও পরিশ্রমকে কাজে লাগিয়ে প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছিল। এই সম্প্রদায়ের অন্তর্গত ছিল উকিল, ডাক্তার, শিক্ষক, অধ্যাপক প্রমুখ। এঁরা পরবর্তীতে সমাজ ও ধর্মসংস্কারের ক্ষেত্রে এঁরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।

(৩) জাতীয়তাবাদের উদ্ভব

ঊনিশ শতকে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের প্রভাবে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ও বিকাশ ঘটে। ভলতেয়ার, রুশাে, ম্যাৎসিনি, মিল, লক, টমাস পেইন, এডমণ্ড বার্ক প্রমুখ পাশ্চাত্য দার্শনিকের চিন্তাধারা থেকে ভারতবাসী জাতীয়তাবাদী আদর্শ, যুক্তিবাদ ও মানবতার শিক্ষা গ্রহণ করে।

(৪) জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ

ফরাসী বিপ্লব, জার্মানির ঐক্য আন্দোলন, ইতালির ঐক্য আন্দোলন, বল্কান জাতীয়তাবাদ প্রভৃতি দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে এই আদর্শগুলিকে শিক্ষিত ভারতীয়রা ভারতীয় সমাজে বাস্তবায়িত করতে সচেষ্ট হয় এবং এরই প্রভাবে ভারতে গড়ে ওঠে জাতায়ীতবাদী চেতনা।

(৫) সমাজ সংস্কার আন্দোলন

পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে উনিশ শতকে ভারতে সমাজ সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়।শিক্ষিত সম্প্রদায় ভারতের চিরাচরিত অন্ধবিশ্বাসও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিল। এদের মধ্যে রাজা রামমােহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, ডিরােজিও, রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ প্রমুখ বিশেষ উল্লেখযােগ্য। এঁরা ভারতীয় সমাজ থেকে সতীদাহ প্রথা, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ প্রভৃতি দূর করতে এবং বিধবাবিবাহ, নারীশিক্ষা প্রভৃতির প্রসারের জন্য আন্দোলন করেছিলেন।

(৬) ধর্মসংস্কার আন্দোলন

পাশ্চাত্য শিক্ষায় প্রভাবিত হয়ে বেশ কিছু ধর্মসংস্কারকের নেতৃত্বে এই সময়শুরু হয় ধর্মসংস্কার আন্দোলন। স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর নেতৃত্বে আর্য সমাজ সনাতন হিন্দুধর্মকে গণমুখী ও জনপ্রিয় করে তােলার চেষ্টা করে। ব্রাহ্মসমাজের নেতৃত্বে পৌত্তলিকতাবাদের বিরােধিতা শুরু হয়। থিওসফিক্যাল সােসাইটি -র উদ্যোগে গড়ে ওঠা আন্দোলন হিন্দুধর্মের নব উত্থানে সাহায্য করে।

(৭) নারীশিক্ষার প্রসার

ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব পরিলক্ষিত হয় নারী শিক্ষা বিস্তারে। বেথুনের উদ্যোগে বেথুন বালিকা বিদ্যালয় ও বিদ্যাসাগরের উদ্যোগে বাংলায় প্রায় ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় গড়ে ওঠে। তাছাড়া চার্লস উডের প্রতিবেদনে নারীশিক্ষার উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল।

(৮) জাতীয়তাবাদী সাহিত্য সৃষ্টি

পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে উনিশ শতকে বেশ কিছু জাতীয়তাবাদী সাহিত্য সৃষ্টি হয়। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের শিক্ষকদের প্রচেষ্টায় পাশ্চাত্যপন্থী গদ্য সাহিত্যের সৃষ্টি হয়। রামমােহন রায়, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, নবীনচন্দ্র সেন, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখের সাহিত্য ও কাব্যে পাশ্চাত্য প্রভাব ছিল সুস্পষ্ট।

(৯) পাশ্চাত্য বিজ্ঞান চর্চার উদ্ভব

পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারের ফলে আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার পথ উন্মুক্ত হয়ে পড়ে। ফলে প্রচলিত অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের প্রভাব এই সময় ক্রমশ কমে আসতে থাকে। আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু ছিলেন এই যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভারতীয় বিজ্ঞানী।

(১০) গণতন্ত্র ও মানবতাবাদের ধারণার উদ্ভব

ঊনবিংশ শতকে পাশ্চাত্য সাহিত্য, দর্শন, শিল্প প্রভৃতির চর্চার ফলে ভারতীয়দের মধ্যে গণতন্ত্র ও মানবতাবাদ-এর ধারণার উদ্ভব ঘটে।

(১১) আধুনিকভাব ধারার বিস্তার

উনবিংশ শতকে পাশ্চাত্য সাহিত্য ও দর্শন পাঠের প্রভাবে ভারতীয়দের মধ্যে যুক্তিবাদী মানসিকতা গড়ে ওঠে।পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ভারতীয় মানুষজন ভারতের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জীবনকে পরিশুদ্ধ করতে বদ্ধপরিকর হয়ে ওঠে।

(খ) কুপ্রভাব

পাশ্চাত্য শিক্ষার বেশ কিছু নেতিবাচক প্রভাবও ছিল।যেমন –

(১) বেকারত্ব বৃদ্ধি

ঐতিহাসিক পার্সিভ্যাল স্পিয়ারের মতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারের ফলে মুসলিম মৌলানা ও সংস্কৃত পণ্ডিত বা হিন্দু চিকিৎসক, মুসলিম হাকিমরা ক্রমশ তাদের প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলে এবং বেকার হয়ে পড়ে।

(২) স্বল্প সংখ্যক মানুষের শিক্ষার সুযােগ

পাশ্চাত্য শিক্ষার মাধ্যম ছিল ইংরেজি ভাষা। ফলে সমাজের অল্প সংখ্যক মানুষের পক্ষে এই শিক্ষা গ্রহণের সুযােগ আসে।

(৩) শহরাঞ্চলে সীমাবদ্ধ

পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাব মূলত শহরাঞ্চলেই সীমাবদ্ধ ছিল। গ্রামীণ ভারতে এর প্রভাব ছিল স্বল্প। আবার বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি শিক্ষা অবহেলিতই থেকে গিয়েছিল।

(৪) অবহেলিত নারীশিক্ষা

পাশ্চাত্য শিক্ষা ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে বিস্তার লাভ করলেও ভারতের নারী শিক্ষা অবহেলিত থেকে যায়।

মূল্যায়ণ

সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বলা যায় ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রবর্তন ছিল এক দিকচিহ্ন, তা যেমন ভারতীয় সমাজ শিক্ষা জীবনের ওপর প্রভাব ফেলেছিল তেমনই ভারতের সমাজ সংস্কৃতিতে একটি বহিরাগত চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছিল। ভারতবাসী পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমেই এই চ্যালেঞ্জকে মােকাবিলা করেছিল।

উপসংহার:-  সমাজের অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার ও ঘৃণ্য মূল্যবােধকে দূর করার জন্য ঊনবিংশ শতাব্দীতে বহু সমাজ ও ধর্মসংস্কার আন্দোলন শুর হয় এবং পরবর্তী সময়ে এই আন্দোলন ব্রিটিশ-বিরােধী জাতীয় সংগ্রামের পটভূমি তৈরি করে দেয়।

(FAQ) ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাব সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. ভারতের কোন শ্রেণীর মানুষের মধ্যে পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তার ঘটে?

মধ্যবিত্ত শ্রেনী।

২. উনিশ শতকে ভারতের দুজন সমাজ সংস্কারকের নাম লেখ।

রামমোহন রায় ও বিদ্যাসাগর।

৩. ব্রাহ্মসমাজ কে প্রতিষ্ঠা করেন?

রাজা রামমোহন রায়।

৪. আর্যসমাজ কে প্রতিষ্ঠা করেন?

স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী।

Leave a Comment