প্রতি-ধর্মসংস্কার আন্দোলন

প্রতি-ধর্মসংস্কার আন্দোলন প্রসঙ্গে সৎ যাজকদের উপলব্ধি, প্রতি-ধর্মসংস্কার আন্দোলন কি, প্রতি-ধর্মসংস্কার আন্দোলনে চার্চের সংস্কার, ট্রেন্টের সভা, প্রোটেস্ট্যান্টদের ট্রেন্টের সভা পরিত্যাগ, ট্রেন্টের সভার কার্যাবলী, প্রতি-ধর্মসংস্কারে স্পেনের ভূমিকা, প্রতি-ধর্মসংস্কারে স্পেনের রানির ভূমিকা, ইনকুইজিশন প্রতিষ্ঠা, প্রতি-ধর্মসংস্কার আন্দোলনের নেতা, জেসুইট সংঘ প্রতিষ্ঠা, জেসুইট সংঘের সদস্যদের কাজ ও প্রতি-ধর্মসংস্কার আন্দোলনের ফলাফল সম্পর্কে জানবো।

ইউরোপে প্রতি-ধর্মসংস্কার আন্দোলন প্রসঙ্গে প্রতি-ধর্মসংস্কার আন্দোলন কী, প্রতি-ধর্মসংস্কার আন্দোলনের উদ্দেশ্য, প্রতি-ধর্মসংস্কার আন্দোলনের নেতা, প্রতি-ধর্মসংস্কারে স্পেনের রানির ভূমিকা, প্রতি-ধর্মসংস্কার আন্দোলনে চার্চের সংস্কার, প্রতি-ধর্মসংস্কার আন্দোলন হওয়ার কারণ ও ফলাফল সম্পর্কে জানব।

প্রতি-ধর্মসংস্কার আন্দোলন

ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রতি-ধর্মসংস্কার আন্দোলন
উদ্দেশ্যক্যাথোলিক চার্চ ও ধর্মের শুদ্ধিকরণ
অন্যতম কেন্দ্রস্পেন
নেতাইগনেসিয়াস লয়োলা
ট্রেন্টের ধর্মসভা১৫৪৫ খ্রি
ইনকুইজিশন১৫৮০ খ্রি
প্রতি-ধর্মসংস্কার আন্দোলন

ভূমিকা :- ইউরোপ-এর জনমানসে ধর্মসংস্কার আন্দোলন ও প্রোটেস্টান্ট মতবাদ এক সুতীব্র জোয়ার এনেছিল। প্রোটেস্টান্ট ধর্মের অতি দ্রুত প্রসারে ধর্মপ্রাণ ক্যাথোলিকরা আতঙ্কিত হয়েছিলেন এই ভেবে যে, ক্যাথোলিক মতবাদের অস্তিত্ব হয়তো কিছুদিনের মধ্যেই লুপ্ত হয়ে যাবে। তাই তারা শুদ্ধি আন্দোলনের সূচনা করে।

সৎ যাজকদের উপলব্ধি

ইউরোপে প্রোটেস্ট্যান্টদের দ্রুত উত্থানের পরিস্থিতিতে কিছু সৎ যাজক ও ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি উপলব্ধি করেন যে, শুধু প্রোটেস্টান্ট মতবাদের বিরোধিতা করে ক্যাথোলিক মতবাদকে রক্ষা করা সম্ভব নয়।

প্রতি-ধর্মসংস্কার আন্দোলন কি?

কিছু সৎ যাজক ও ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি ক্যাথোলিক চার্চের দুর্নীতি ও অনাচার বন্ধ করে যাজকদের সৎ ও পবিত্র ধর্মীয় জীবনযাপনের মাধ্যমে ক্যাথোলিক চার্চের হারানো মর্যাদা ফিরিয়ে আনার দাবি জানান। এর ফলে ষোড়শ শতকে ক্যাথোলিক চার্চ ও ধর্মের শুদ্ধি আন্দোলন শুরু হয়। ক্যাথোলিক চার্চ ও ধর্মের শুদ্ধিকরণের আন্দোলনই ‘প্রতি-ধর্মসংস্কার আন্দোলন’ (Counter Movement) নামে পরিচিত।

ইউরোপে প্রতি-ধর্মসংস্কার আন্দোলনে চার্চের সংস্কার

  • (১) পোপ দশম লিও (১৫১৩-১৫২১ খ্রি.) সর্বপ্রথম ক্যাথোলিক চার্চের অভ্যন্তরীণ সংস্কারের গুরুত্বের কথা প্রচার করেন। পোপ তৃতীয় পল-এর আমলে (১৫৩৪-১৫৪৯ খ্রি.) চার্চের সংস্কার চলতে থাকে। পোপ পঞ্চম পায়াসের আমলে (১৫৬৬-১৫৭২ খ্রি.) ইউরোপের চার্চগুলির সংস্কারের কাজে তীব্র গতি আসে।
  • (২) পরবর্তী পোপগণও চার্চের দুর্নীতি দূরীকরণ এবং সংস্কার প্রবর্তনের মাধ্যমে চার্চের অস্তিত্ব রক্ষায় যত্নবান হন। যেসব বিশপ নিজেদের কর্মক্ষেত্র ছেড়ে রোমে বিলাসবহুল জীবন কাটাতেন তাদের নিজেদের কর্মক্ষেত্রে ফিরে গিয়ে কর্তব্যপালনের কঠোর নির্দেশ দেওয়া হয়।
  • (৩) রোম-এর ভবঘুরে সন্ন্যাসীদের ধরে জাহাজে দাঁড় টানার কাজে নিয়োগ করা হয়। যাজকদের আদর্শবান ও নৈতিক চরিত্রের অধিকারী হতে এবং ধর্ম ও মানবসেবায় আত্মনিয়োগ করতে বলা হয়।
  • (৪) অলস যাজকদের পদচ্যুত করে কোনো নিম্নমানের পরিশ্রমসাধ্য কাজে নিযুক্ত করা হয়।
  • (৫) জিওভানি, গিবার্তি, কারাফা প্রমুখ ক্যাথোলিক নেতা আর্তের সেবা, দরিদ্রদের সহায়তা, রোগীর সেবা, নৈতিক আদর্শ পালন প্রভৃতির মাধ্যমে অন্যান্য বিশপ ও যাজকদের সামনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।

প্রতি-ধর্মসংস্কারের উদ্দেশ্যে ট্রেন্টের সভা

খ্রিস্টান চার্চ ও যাজকতন্ত্রের সংস্কার সাধন করতে পোপ তৃতীয় পল বিশেষ উদ্যোগ নেন। এই কাজে তিনি বিভিন্ন দেশের বিশপদের সহযোগিতা প্রার্থনা করেন। তিনি ১৫৪৫ খ্রিস্টাব্দে ইতালির ট্রেন্ট শহরে ‘কাউন্সিল অব ট্রেন্ট’ নামে একটি ধর্মসভার আয়োজন করেন। ১৫৬৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই সভা চলে।

অতপর প্রোটেস্টান্টদের ট্রেন্টের সভা ত্যাগ

ট্রেন্টের সভায় ক্যাথোলিকদের সঙ্গে প্রোটেস্টান্ট সম্প্রদায় যোগদান করলেও ক্যাথোলিকরা প্রোটেস্টান্টদের সঙ্গে কোনো ধরনের আপস করতে রাজি ছিল না। ফলে প্রোটেস্টান্টরা এই সভা ছেড়ে বেরিয়ে যায়।

প্রতি-ধর্মসংস্কারের উদ্দেশ্যে ট্রেন্টের সভার কার্য

এই সভায় যাজকদের জন্য কিছু নিয়ম নীতি সুনির্দিষ্ট করা হয়। তাঁদের পবিত্র জীবনযাপন, ধর্মশাস্ত্র ও শিক্ষা বিষয়ক জ্ঞানচর্চার ওপর জোর দেওয়া হয়। দীর্ঘদিন ধরে চলা এই ধর্মসভায় ক্যাথোলিক চার্চের পক্ষে বিভিন্ন সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করা হলে রোমান পোপতন্ত্রের প্রতি মানুষের আস্থা আবার ফিরে আসতে থাকে।

ইউরোপে প্রতি-ধর্মসংস্কারে স্পেনের ভূমিকা

স্পেন ছিল প্রতি-ধর্মসংস্কার আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্র। স্পেনের রাজা ছিলেন গোঁড়া ক্যাথোলিকপন্থী। তা ছাড়া স্পেনবাসী দীর্ঘদিন ধরে বিধর্মী মুর বা আরবদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নিযুক্ত থাকার ফলে নিজেদের ক্যাথোলিক ধর্মের প্রতি আরও বেশি অনুরক্ত হয়ে পড়ে। ক্যাথোলিকধর্মের ঐক্য স্পেনবাসীর মধ্যে ঐক্যবদ্ধ জাতীয়তাবোধের সঞ্চার করে।

প্রতি-ধর্মসংস্কারে স্পেনের রানির ভূমিকা

স্পেনের রানি ইসাবেলা ক্যাথোলিকধর্মের বিশুদ্ধতা ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

ইউরোপে প্রতি-ধর্মসংস্কারের উদ্দেশ্যে ‘ইনকুইজিশন’ প্রতিষ্ঠা

স্পেনবাসী তাদের ধর্মবিরোধীদের দমন করতে ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দে ‘ইনকুইজিশন’ নামে একটি ধর্মীয় আদালতের প্রতিষ্ঠা করে। ধর্মবিরোধীদের খুঁজে বের করে ইনকুইজিশন আদালতে বিচারের মাধ্যমে তাদের শাস্তিদানের ব্যবস্থা করা হয়।

বিরোধী মতবাদের্ বিশ্বাসী মানুষদের হত্যার যন্ত্র প্রতি ধর্মসংস্কার আন্দোলন

তবে এই আন্দোলন শেষপর্যন্ত বিরোধী মতবাদে বিশ্বাসী মানুষদের হত্যা করার একটি যন্ত্রে পরিণত হয়।

প্রতি-ধর্মসংস্কার আন্দোলনের নেতা লয়োলা

এই প্রতি-ধর্মসংস্কার আন্দোলনের একজন অন্যতম নেতা ছিলেন স্পেনের ইগনেসিয়াস লয়োলা (১৪৯১-১৫৫৬ খ্রি.)। লয়োলা সৈনিক হিসেবে যুদ্ধক্ষেত্রে আহত হওয়ার পর তার মা তাকে খ্রিস্টানধর্মের একজন সেবকরূপে নিজেকে নিয়োজিত করেন। তিনি প্রচার করেন যে, শুধু চার্চ ও যাজকদের শুদ্ধিকরণের মাধ্যমে ক্যাথোলিকধর্মকে জনপ্রিয় করা সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন যীশুখ্রিস্টের সেবা ও ত্যাগের আদর্শ প্রচার। তিনি সমাজসেবা ও শিক্ষার প্রসারের ওপর বিশেষ জোর দেন।

ইউরোপে প্রতি-ধর্মসংস্কার আন্দোলনের উদ্দেশ্যে জেসুইট সংঘ প্রতিষ্ঠা

লয়োলা জিশুখ্রিস্টের সেবা ও ত্যাগের আদর্শ প্রচারের উদ্দেশ্যে ‘সোসাইটি অব জেসাস’ (Society of Jesus) নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন যা সাধারণভাবে ‘জেসুইট সংঘ’ নামে পরিচিত।

প্রতি-ধর্মসংস্কারের উদ্দেশ্যে জেসুইট সংঘের সদস্য দের কাজ

জেসুইট সংঘের সদস্যরা ধর্মত্যাগীদের আবার খ্রিস্টানধর্মে ফিরিয়ে আনা, খ্রিস্টানধর্মের প্রতি অখ্রিস্টানদের আকৃষ্ট করা, শিক্ষার প্রসার ঘটানো প্রভৃতি কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তাঁরা নিজেদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা ত্যাগ করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আদেশ পালনকেই কর্তব্য হিসেবে গ্রহণ করেন। জেসুইট সম্প্রদায়ের অনুগামীদের ক্যাথোলিকধর্মের প্রতি আনুগত্য, ব্রহ্মচর্য, দারিদ্র্যব্রত গ্রহণ, পোপের প্রতি আনুগত্য প্রভৃতি কর্তব্য পালন করতে হয়।

প্রতি-ধর্মসংস্কারের উদ্দেশ্যে জেসুইট সংঘের শাখা স্থাপন

ভারত, চীন, জাপান সহ বিভিন্ন দেশে জেসুইট সংঘের শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়।

প্রতি-ধর্মসংস্কার আন্দোলনে স্পেনের সন্ন্যাসী সংঘের ভূমিকা

স্পেনে কয়েকটি সন্ন্যাসী সংঘের সদস্যগণ প্রতি-ধর্মসংস্কার আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন সেন্ট টেরেসা (১৫১৫-১৫৮২ খ্রি.)। তাঁর লেখা ‘The Way of Perfection’ সৎ ধর্মচর্চার এক উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ।

প্রতি-ধর্মসংস্কার আন্দোলনের ফলাফল

এই প্রতি-ধর্মসংস্কার আন্দোলনের ফলে ইউরোপে বেশ কিছু সুফল লক্ষ্য করা গিয়েছিল। যেমন –

(১) দুর্নীতি হ্রাস

এই আন্দোলনের ফলে ক্যাথোলিক ধর্মের অনাচার ও দুর্নীতি বহুলাংশে হ্রাস পায়।

(২) ত্যাগ ও সেবার আদর্শ

এই আন্দোলনের ফলে ক্যাথোলিক চার্চ ও যাজকতন্ত্র আবার পূর্বেকার বিশুদ্ধ ধর্মচর্চায় মগ্ন হওয়ার চেষ্টা শুরু করে। যাজকরা খ্রিস্টের ত্যাগ ও সেবার আদর্শ পালন করে ধর্মে নৈতিকতা ফিরিয়ে আনেন।

(৩) ক্যাথোলিক চার্চের ওপর শ্রদ্ধা

রোমান ক্যাথোলিক চার্চের ওপর সাধারণ খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের শ্রদ্ধা আবার ফিরে আসে।

উপসংহার :- এই ভাবে রোমান ক্যাথোলিক সম্প্রদায় শুধু যে তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয় তা-ই নয়, মানুষ ক্যাথোলিক ধর্মের প্রতি আবার শ্রদ্ধাশীল হয়ে উঠলে এর প্রসার ঘটতে শুরু করে।

(FAQ) ঋষি অরবিন্দ ঘোষ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. প্রতি-ধর্মসংস্কার আন্দোলন কি?

ক্যাথোলিক চার্চ ও ধর্মের শুদ্ধিকরণের আন্দোলন ‘প্রতি-ধর্মসংস্কার আন্দোলন’ (Counter Movement) নামে পরিচিত।

২. সর্বপ্রথম ক্যাথোলিক চার্চের অভ্যন্তরীণ সংস্কারের গুরুত্বের কথা প্রচার করেন কে?

পোপ দশম লিও।

৩. কখন কোথায় ট্রেন্টের ধর্মসভা আয়োজিত হয়?

১৫৪৫ খ্রিস্টাব্দে ইতালির ট্রেন্ট শহরে।

৪. প্রতি-ধর্মসংস্কার আন্দোলনের উল্লেখযোগ্য নেতা কে ছিলেন?

স্পেনের ইগনেসিয়াস লয়োলা।

৫. প্রতি-ধর্মসংস্কার আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্র কোথায় ছিল?

স্পেন।

অন্যান্য ঐতিহাসিক ঘটনাগুলি

Leave a Comment