বক্সার প্রোটোকল

বক্সার প্রোটোকল প্রসঙ্গে বক্সার বিদ্রোহে প্রচণ্ড সংঘর্ষ, বক্সার বিদ্রোহের ব্যর্থতা, বক্সার প্রটোকল স্বাক্ষর, বক্সার প্রটোকলের প্রথম শর্ত, বক্সার প্রোটোকলের দ্বিতীয় শর্ত, বক্সার প্রটোকলের তৃতীয় শর্ত, বক্সার প্রোটোকলের চতুর্থ শর্ত, বক্সার প্রোটোকলের পঞ্চম শর্ত, বক্সার প্রোটোকলের ষষ্ঠ শর্ত, বক্সার প্রোটোকলের সপ্তম শর্ত, বক্সার প্রোটোকলের মাধ্যমে মাঞ্চু সরকারের ভাবমূর্তি প্রকাশ ও বক্সার প্রটোকলের ফলে গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পর্কে জানবো।

কূটনৈতিক বক্সার প্রোটোকল প্রসঙ্গে বক্সার বিদ্রোহের ব্যর্থতায় বক্সার প্রটোকল স্বাক্ষর, বক্সার প্রটোকলের শর্ত, বক্সার প্রটোকলের ফলে গণতান্ত্রিক বিপ্লব ও বক্সার প্রোটোকলের সপ্তম শর্ত, বক্সার প্রোটোকলের মাধ্যমে মাঞ্চু সরকারের ভাবমূর্তি সম্পর্কে জানব।

বক্সার প্রোটোকল

ঐতিহাসিক ঘটনাবক্সার প্রোটোকল
সময়কাল৭ সেপ্টেম্বর ১৯০১ খ্রি
স্বাক্ষরকারীচীন ও ১১ টি বিদেশি শক্তি
ক্ষতিপূরণ৫০০ মিলিয়ন ডলার
ফাঁসি১২ জন রাজপুরুষ
গণতান্ত্রিক বিপ্লবের নায়কসান ইয়াৎ সেন
বক্সার প্রোটোকল

ভূমিকা :- শানটুং অঞ্চলে বক্সার বিদ্রোহ-এর সূচনা হয়েছিল। তারপর এই বিদ্রোহ চীনের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু শীঘ্রই এই বিদ্রোহ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।

বক্সার বিদ্রোহে প্রচণ্ড সংঘর্ষ

  • (১) ১৯০০ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে তিয়েনসিনে বক্সার এবং বিদেশি সৈন্যদের মধ্যে প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয়। বিদ্রোহীরা পিকিং এবং তিয়েনসিনের মধ্যে টেলিগ্রাফ যোগাযোগ ধ্বংস করে দেন। ১০ জুন ব্রিটিশদের গ্রীষ্মকালীন দূতাবাসে অগ্নিসংযোগ করা হয় এবং জাপানি দূতাবাসের চ্যান্সেলর সুগিয়ামা বিদ্রোহীদের হাতে নিহত হন।
  • (২) ১৩ জুন বক্সাররা পিকিং এ প্রবেশ করে গির্জা ও বিদেশি দূতাবাসগুলিতে আগুন ধরিয়ে দেন এবং বহু চীনা খ্রিস্টানকে হত্যা করেন। ২০ জুন পিকিং-এর রাজপথে জার্মান রাষ্ট্রদূত ক্লিমেন্স কেটেলার নিহত হলেন।

চীনে বক্সার বিদ্রোহের ব্যর্থতা

  • (১) এমতাবস্থায় বিধবা সম্রাজ্ঞী বক্সারদের সাহায্যে বিদেশিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেন। এই সিদ্ধান্তের ফলে অবশ্যই বিদ্রোহীদের ক্ষতি হয়েছিল। কারণ চিনের সরকারি বাহিনীর নেতা জং লু বিদেশিদের প্রতি কখনোই ক্ষুব্ধ ছিলেন না। তাই দূতাবাসগুলির ওপর আক্রমণের সময় তিনি সর্বশক্তি প্রয়োগ করেন নি।
  • (২) তাছাড়া, দক্ষিণ-পূর্ব চীনের বিভিন্ন অঞ্চল অর্থাৎ উহান, ক্যান্টন এবং নানকিং-এ গভর্নরদের প্রচেষ্টায় বক্সার বিদ্রোহ দানা বেঁধে ওঠে নি। চিনের রক্ষণশীল বিধবা রানি এ সময়ে অত্যন্ত সুযোগসন্ধানী ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন।
  • (৩) মাঞ্চু শাসনকে বিদ্রোহীদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য তিনি বক্সারদের সমর্থন করার প্রতিশ্রুতি দিলেও, একই সাথে তিনি বিদেশিদের জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, তাদের আক্রমণ করার কোনো পরিকল্পনাই মাঞ্চু সরকারের নেই।
  • (৪) তাছাড়া, যে সমস্ত প্রাদেশিক গভর্নরেরা বিদেশিদের প্রতি নরম মনোভাব দেখাতে চেয়েছিলেন তাঁদের বিদেশি-বিরোধী পদক্ষেপ গ্রহণ করার বিষয়েও তিনি কোনো নির্দেশ পাঠান নি। গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের মার্কসবাদী ঐতিহাসিকেরা এই ভূমিকাকে “বিধবা সম্রাজ্ঞীর দু-মুখো নীতি” বলে আখ্যায়িত করেছেন।
  • (৫) প্রকৃতপক্ষে সরকারি বাহিনীর ওপর নির্ভরশীলতা বক্সার বিদ্রোহীদের ক্ষতির কারণ হয়ে দেখা দিয়েছিল। এই অবস্থায় আটটি বিদেশি শক্তি পিকিং-এর অবরুদ্ধ বিদেশি দূতাবাসগুলির অবরোধ মুক্ত করার জন্য একটি যৌথ আন্তর্জাতিক বাহিনী গঠন করে। এই বাহিনী ১৯০০ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে বক্সারদের পরাস্ত করে তিয়েনসিন দখল করে নেয়।
  • (৬) তারপর এই বাহিনী আগস্ট মাসে বিদ্রোহীদের দমন করার উদ্দেশ্যে পিকিং অভিমুখে যাত্রা করে। ১৪ আগস্টের মধ্যে বিদেশি সেনারা বিদ্রোহীদের সমস্ত অবরোধ ভেঙে ফেলে। বিদেশি দূতাবাসগুলিকে অবরোধমুক্ত করার পর বিদেশি সৈন্যবাহিনী পিকিং-এ ব্যাপক লুঠতরাজ এবং ধ্বংসলীলা চালায়। ১৫ আগস্ট বিধবা সম্রাজ্ঞী কয়েকজন সহকারীকে সঙ্গে নিয়ে ছদ্মবেশে পিকিং ছেড়ে পালিয়ে যান।
  • (৭) এই অবস্থায় চিনের প্রতি সাম্রাজ্যবাদী বিদেশি শক্তিবর্গ কী নীতি গ্রহণ করবে তাই নিয়ে তাদের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দেয়। জার্মানরা চিনাদের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য উত্তর চিনের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রবল ধ্বংসলীলা চালায়। বক্সার বিদ্রোহের সুযোগে রাশিয়া মাঞ্চুরিয়া দখল করে নেয়।
  • (৮) এর ফলে ব্রিটেন ও জাপান আশঙ্কিত হয়ে ওঠে। ফরাসিরা ঘোষণা করে তারা চিনের ভাঙন চায় না। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র তখন চিনের আঞ্চলিক অখণ্ডতা রাখার জন্য একটি স্মারকপত্র প্রকাশ করে। এটি ছিল আমেরিকার “মুক্তদ্বার নীতি” সংক্রান্ত দ্বিতীয় ঘোষণাপত্র।

বক্সার প্রোটোকল

চিনের পরাজয় এবং বক্সার বিদ্রোহের ব্যর্থতার পর বিদেশি শক্তিসমূহ চীনকে ১২টি শর্ত সম্বলিত একটি চুক্তির প্রস্তাব দেয় ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে ২৪ ডিসেম্বর। ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে ৭ সেপ্টেম্বর চিন এবং ১১টি বিদেশি শক্তির মধ্যে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি “বক্সার প্রোটোকল” নামে বিখ্যাত।

চীনে বক্সার প্রোটোকলের শর্তসমূহ

এই চুক্তির শর্তগুলি ছিল চিনের পক্ষে যথেষ্ট অপমানজনক। অথচ চিনের পক্ষে এই চুক্তি স্বাক্ষর না করে কোনো উপায় ছিল না। শর্তগুলি ছিল নিম্নরূপ  –

বক্সার প্রোটোকলের প্রথম শর্ত

১২ জন রাজপুরুষ যাঁরা বক্সারদের বিদেশি-বিরোধী জেহাদে যোগদান করেছিলেন তাঁদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় অথবা আত্মহত্যা করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। তাছাড়া, আরও শ’খানেক রাজপুরুষকে কঠোর শাস্তি দেওয়া হয়। যে-কোনো আন্তর্জাতিক চুক্তির ক্ষেত্রেই এটি ছিল একটি নজিরবিহীন সিদ্ধান্ত।

চীনে বক্সার প্রোটোকলের দ্বিতীয় শর্ত

এক বিরাট অঙ্কের ক্ষতিপূরণ দানে চিনকে বাধ্য করা হয়। সিদ্ধান্ত হয় যে, চিনকে ৫০০ মিলিয়ন আমেরিকান ডলার ক্ষতিপূরণ ১৯০১-১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বিভিন্ন কিস্তিতে দিতে হবে। বৃহৎ শক্তিবর্গ ছাড়াও ইতালি, নেদারল্যান্ডস, অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, স্পেন, পোর্তুগাল এবং স্ক্যান্ডিনেভীয় দেশগুলিও চিন থেকে প্রাপ্ত ক্ষতিপূরণের অংশীদার হবে।

বক্সার প্রোটোকলের তৃতীয় শর্ত

যে সব শহরে বিদেশি-বিরোধী আন্দোলন তীব্র রূপ নিয়েছিল সে সব অঞ্চলে সরকারি পরীক্ষা ব্যবস্থা ৫ বছরের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হল। কমপক্ষে ৪৫টি শহরে পরীক্ষা ব্যবস্থা বাতিল হয়।

চীনে বক্সার প্রোটোকলের চতুর্থ শর্ত

পিকিং-এর বিদেশি দূতাবাসগুলিকে পাহারা দেবার জন্য বিদেশি সৈন্যবাহিনী স্থায়ীভাবে মোতায়েন করা হল।

বক্সার প্রোটোকলের পঞ্চম শর্ত

পিকিং থেকে সমুদ্র পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটিগুলিতে এবং রেলপথে বিদেশি সৈন্য মোতায়েন করা হল।

চীনে বক্সার প্রোটোকলের ষষ্ঠ শর্ত

সিদ্ধান্ত হয় যে, আগামী দুই বছরের মধ্যে চিন বিদেশ থেকে কোনো অস্ত্র বা যুদ্ধসামগ্রী আমদানি করতে পারবে না।

বক্সার প্রোটোকলের সপ্তম শর্ত

জার্মানি ও জাপানের কাছে চিনকে প্রতিনিধিদল পাঠিয়ে সরাসরি কৃতকর্মের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করতে হবে।

চীনে বক্সার প্রোটোকলের মাধ্যমে চিনের সার্বভৌমত্ব আঘাতপ্রাপ্ত

এই বক্সার প্রোটোকল স্বাক্ষরের ফলে বিশ্বের দরবারে চিনের মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হয়। চিনের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব চরম আঘাত পায়। মাঞ্চু রাজতন্ত্র বিদেশি শক্তিগুলির হাতের ক্রীড়নকে পরিণত হয়।

বক্সার প্রোটোকলের মাধ্যমে মাঞ্চু সরকারের ভাবমূর্তি প্রকাশ

এই পরিস্থিতিতে মাঞ্চু সরকার একটি সাংবিধানিক সরকার গড়ে তোলার জন্য কতকগুলি সংস্কার সাধনের প্রচেষ্টা চালায়। কিন্তু তাতেও চিনা জনগণের চোখে মাঞ্চু সরকারের ভাবমূর্তির বিশেষ উন্নতি ঘটে না।

চীনে বক্সার প্রোটোকলের ফলে গণতান্ত্রিক বিপ্লব

  • (১) মাঞ্চু নেতৃত্বের অপদার্থতায় হতাশ চিনা জনগণ সেই মুহূর্তে মনে করেছিলেন বৈপ্লবিক সংগ্রাম ছাড়া গত্যন্তর নেই। চিনের গণতান্ত্রিক বিপ্লবের নায়ক ড. সান ইয়াৎ-সেন সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মাধ্যমে চিং শাসনের উচ্ছেদের ডাক দিয়েছিলেন।
  • (২) চিনের বুদ্ধিজীবী এবং মর্যাদাসম্পন্ন নাগরিকেরা এই ডাক কে বেআইনি আন্দোলনের রাস্তা মনে করতেন। কিন্তু “বক্সার প্রোটোকল” যখন চিনের মর্যাদা হ্রাস করেছিল, তখন তাঁরা বৈপ্লবিক আন্দোলনের সমর্থক হতে আরম্ভ করেন। একজন রাজদ্রোহীর থেকে সান ইয়াৎ সেন একজন দেশপ্রেমিক বিপ্লবীতে রূপান্তরিত হন।

উপসংহার :- ১৯০১ খ্রিস্টাব্দের পরবর্তী ঘটনাস্রোত চিনকে অনিবার্যভাবে ১৯১১ খ্রিস্টাব্দের বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের দিকে নিয়ে যায়।

(FAQ) বক্সার প্রোটোকল সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. বক্সার প্রোটোকল স্বাক্ষরিত হয় কখন?

৭ সেপ্টেম্বর ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে।

২. চিনের সাথে কতগুলি বিদেশি শক্তির বক্সার প্রোটোকল স্বাক্ষরিত হয়?

১১ টি।

৩. চিনের গণতান্ত্রিক বিপ্লবের নায়ক কে ছিলেন?

সান ইয়াৎ সেন।

অন্যান্য ঐতিহাসিক ঘটনাগুলি

Leave a Comment