আরব ইজরায়েল যুদ্ধ প্রসঙ্গে প্রথম আরব-ইজরায়েল যুদ্ধ ও যুদ্ধের অবসান, দ্বিতীর আরব-ইজরায়েল যুদ্ধ, প্রেক্ষাপট, সংঘর্ষ, গুরুত্ব, তৃতীয় আরব-ইজরায়েল যুদ্ধ, প্রেক্ষাপট, সংঘর্ষ, গুরুত্ব, চতুর্থ আরব-ইজরায়েল যুদ্ধের প্রেক্ষাপট, যুদ্ধবিরতি ও জেনেভা সম্মেলন সম্পর্কে জানবো।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে আরব ইজরায়েল যুদ্ধ প্রসঙ্গে প্রথম আরব-ইজরায়েল যুদ্ধ, দ্বিতীর আরব-ইজরায়েল যুদ্ধ, তৃতীয় আরব-ইজরায়েল যুদ্ধ, চতুর্থ আরব-ইজরায়েল যুদ্ধ ও আরব-ইজরায়েল যুদ্ধের গুরুত্ব সম্পর্কে জানব।
আরব ইজরায়েল যুদ্ধ
ঐতিহাসিক যুদ্ধ | আরব-ইজরায়েল যুদ্ধ |
প্রথম আরব-ইজরায়েল যুদ্ধ | ১৯৪৮ খ্রি |
দ্বিতীয় আরব-ইজরায়েল যুদ্ধ | ১৯৫৬ খ্রি |
তৃতীয় আরব-ইজরায়েল যুদ্ধ | ১৯৬৭ খ্রি |
চতুর্থ আরব-ইজরায়েল যুদ্ধ | ১৯৭৩ খ্রি |
যুদ্ধের সমাপ্তি | জেনেভা সম্মেলন |
ভূমিকা :- সদ্য স্বাধীন ইজরায়েল রাষ্ট্রের সাথে আরব দেশগুলির বিরোধ শুরু হয়। ১৯৪৮-৭৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চারটি আরব-ইজরায়েল যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
প্রথম আরব-ইজরায়েল যুদ্ধ
১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে প্রথম আরব-ইজরায়েল যুদ্ধ শুরু হয়। এর বিভিন্ন দিক গুলি হল –
(১) ইজরায়েল আক্রমণ
স্বাধীন ইজরায়েল রাষ্ট্র-প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে মিশর, জর্ডন, লেবানন, সিরিয়া ও ইরাক এই পাঁচটি আরব রাষ্ট্র ইজরায়েল আক্রমণ করে।
(২) আরবদের পরাজয়
আরবদের জনসংখ্যা ও সেনাবাহিনীর শক্তি বেশি থাকা সত্ত্বেও তারা ইজরায়েলের কাছে পরাজিত হয়। যুদ্ধে জয়ী ইজরায়েল জাতিপুঞ্জ নির্ধারিত সীমানা অপেক্ষা অনেক বেশি ভূখণ্ড নিজেদের অধিকারে নিয়ে নেয়। এভাবে প্যালেস্টাইনের প্রায় ৩/৪ অংশ অঞ্চল এবং লোহিত সাগরে অবস্থিত মিশরের এইলাট বন্দরটি ইজরায়েলের দখলে চলে যায়। আরবদের অধিকারে থাকে মধ্য ও পূর্বাংশ এবং গাজা ভূখণ্ড।
(৩) আরব শরণার্থীদের দুর্দশা
এই যুদ্ধের ফলে কয়েক লক্ষ নিরীহ আরব গৃহহারা ও রাষ্ট্রহারা হয়। তারা মিশর, জর্ডন, সিরিয়া ও লেবাননের শরণার্থী শিবিরগুলিতে চরম দুর্দশার মধ্যে জীবন কাটাতে বাধ্য হয়।
প্রথম আরব-ইজরায়েল যুদ্ধের অবসান
জাতিপুঞ্জের উদ্যোগে ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে সাময়িক শান্তি স্থাপিত হয়।
দ্বিতীর আরব-ইজরায়েল যুদ্ধ
১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে প্রথম আরব-ইজরায়েল যুদ্ধে আরবরা পরাজিত হয়। এরপর আরবদের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে ইজরায়েল নিজেদের রাষ্ট্রকে সুসংহত করার উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু বিভিন্ন কারণে উভয় পক্ষের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। এর ফলে ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে ইজরায়েলের বিরুদ্ধে আরব দেশগুলি আবার আক্রমণ চালায়।
দ্বিতীর আরব-ইজরায়েল যুদ্ধের প্রেক্ষাপট
১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে ইজরায়েলের সঙ্গে আরব দেশগুলির বিবাদের প্রধান কারণগুলি ছিল নিম্নলিখিত –
(১) পৈতৃক ভূখণ্ডের দাবি
আরব দেশগুলি তাদের ভূখণ্ডে ইজরায়েলের অস্তিত্ব কোনোভাবেই মেনে নিতে পারে নি। তারা যে-কোনো মূল্যে নিজেদের পিতৃভূমির মাটি উদ্ধার করতে বদ্ধপরিকর ছিল।
(২) সীমানা নিয়ে বিরোধ
রাষ্ট্রীয় সীমানা নিয়ে ইজরায়েলের সঙ্গে আরব দেশগুলির বিরোধ ছিল।
(৩) আরব শরণার্থীদের সমস্যা
ইজরায়েল থেকে বিতাড়িত আরব শরণার্থীদের সমস্যার সমাধান করা আরব দেশগুলির কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল।
(৪) ইজরায়েলে বসবাসকারী আরবদের সমস্যা
ইজরায়েলে বসবাসকারী আরবদের সমস্যাও ক্রমে জটিল হয়ে উঠেছিল।
দ্বিতীর আরব-ইজরায়েল যুদ্ধের প্রত্যক্ষ কারণ
১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে মিশরের রাষ্ট্রপতি নাসের সুয়েজ খাল জাতীয়করণ করে সেখানে ইজরায়েলের জাহাজের প্রবেশ নিষিদ্ধ করলে এর বিরুদ্ধে ইজরায়েল জাতিপুঞ্জে আবেদন করে। এতে কোনো কাজ না হলে মিশরের বিরুদ্ধে ইজরায়েল ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের ২৯ অক্টোবর যুদ্ধ ঘোষণা করে।
আরব-ইজরায়েল সংঘর্ষ
১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে আরব দেশগুলির সঙ্গে ইজরায়েলের শান্তি স্থাপিত হলেও উভয় পক্ষের মধ্যে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ চলতেই থাকে। যেমন –
(১) আক্রমণ
সুয়েজ খাল জাতীয়করণের প্রতিবাদে ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও ইজরায়েল মিশর আক্রমণের গোপন পরিকল্পনা করে। সেই অনুসারে ইজরায়েল ২৯ অক্টোবর মিশর আক্রমণ করে এবং এক সপ্তাহের মধ্যে মিশরের সিনাই উপদ্বীপ দখল করে নেয়।
(২) আমেরিকার উদ্যোগ
আমেরিকা জাতিপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদে ইজরায়েল ও মিশরের মধ্যে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব উত্থাপন করলে ব্রিটেন ও ফ্রান্স ‘ভেটো’ প্রয়োগ করে প্রস্তাবটি বাতিল করে দেয়। ৩০ অক্টোবর মিশরের রাজধানী কায়রোর ওপর ব্রিটেন ও ফ্রান্সের বিমানবাহিনী বোমা বর্ষণ করে।
(৩) জাতিপুঞ্জের উদ্যোগ
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে জাতিপুঞ্জের প্রস্তাব অনুসারে দশটি দেশের সেনাবাহিনী নিয়ে খুব শীঘ্রই জাতিপুঞ্জের সেনাবাহিনী গড়ে ওঠে। ইতিমধ্যে মিশরে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের অনৈতিক নীতির বিরুদ্ধে রাশিয়া তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে, এমনকি এই দুই দেশের বিরুদ্ধে রকেট আক্রমণের হুমকি দেয়।
আরব-ইজরায়েল শান্তি স্থাপন
যাই হোক, জাতিপুঞ্জের সেনাবাহিনী ১৫ নভেম্বর মিশরে হাজির হয়। মিশর থেকে ক্রমে ইজরায়েল, ব্রিটেন ও ফ্রান্সের সেনা অপসারিত হয় এবং শান্তি স্থাপিত হয়।
দ্বিতীর আরব-ইজরায়েল যুদ্ধের গুরুত্ব
১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে আরব ও ইজরায়েলের মধ্যে যুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ ফলাফলগুলি হল –
(১) সীমান্তে শান্তি
আরব ও ইজরায়েলের সীমান্তে আপাতত শান্তি স্থাপিত হয় এবং ইজরায়েলে আরবদের অনুপ্রবেশ বন্ধ হয়।
(২) ইজরায়েলের বাণিজ্য বৃদ্ধি
ইজরায়েলের দখলে এসে এইলাট বন্দর সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং এই বন্দরের মাধ্যমে ইজরায়েলের বৈদেশিক বাণিজ্য যথেষ্ট পরিমাণে বৃদ্ধি পায়।
(৩) যোগাযোগ বৃদ্ধি
এই যুদ্ধের ফলে আকাবা উপসাগর ও তিরান প্রণালীর মাধ্যমে ইজরায়েলের সঙ্গে বহির্বিশ্বের যোগাযোগ বৃদ্ধি পায়। কিন্তু আরব-ইজরায়েল সীমান্তে আপাতত শান্তি স্থাপিত হলেও জাতিপুঞ্জের মহাসচিব দাগ হ্যামারশিল্ড উপলব্ধি করেছিলেন যে, জাতিপুঞ্জের বাহিনী সরে গেলেই সেখানে আবার সংঘর্ষ শুরু হবে।
তৃতীয় আরব-ইজরায়েল যুদ্ধ
১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের যুদ্ধবিরতি আরব-ইজরায়েল সম্পর্কে আপাতত শান্তি এনে দেয়। কিন্তু সেই অঞ্চলে জাতিপুঞ্জের শান্তিরক্ষী বাহিনী অবস্থান করলেও এই শান্তি মোটেই দীর্ঘস্থায়ী ছিল না। আপাত শান্তির আড়ালে উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধের প্রস্তুতি চলছিল। এই সময় আরব-ইজরায়েল সীমান্তের শান্তির জন্য জাতিপুঞ্জের শান্তিরক্ষা বাহিনী মিশরে অবস্থান করছিল। মিশরের রাষ্ট্রপতি নাসের ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দের ১৭ মে জাতিপুঞ্জের বাহিনী প্রত্যাহার করার আবেদন জানালে জাতিপুঞ্জ দু-দিনের মধ্যেই বাহিনী প্রত্যাহার করে নেয়। এর ফলে শীঘ্রই সংঘাতের পরিবেশ তৈরি হয়।
তৃতীয় আরব-ইজরায়েল যুদ্ধের প্রেক্ষাপট
১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে আরব-ইজরায়েল সংঘর্ষের পিছনে যে কারণগুলি ছিল সেগুলি হল –
(১) বিবদমান সেনা মোতায়েন
মিশরের অনুরোধে জাতিপুঞ্জ ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে সেখান থেকে তার শান্তিসেনা সরিয়ে নিলে সঙ্গে সঙ্গে ইজরায়েল, সিরিয়া ও জর্ডন তাদের সীমান্তে নিজেদের সেনা মোতায়েন করে। ফলে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।
(২) মিশরের গাজা ভূখণ্ড দখল
মিশর ২০ মে গাজা অঞ্চলে নিজের আধিপত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে।
(৩) আরব লিগের ঘোষণা
আরব লিগের সদস্যগুলি একটি যৌথ ঘোষণা মারফত জানায় যে, তাদের সংস্থার যে- কোনো সদস্য-রাষ্ট্রের ওপর কোনো আক্রমণ সমবেতভাবে সকলের ওপর আক্রমণ বলে তারা মনে করবে।
(৪) মিশরের সেনা-প্রস্তুতি
মিশর ২০ মে তার সেনাবাহিনীকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দেয়।
(৫) জাহাজ চলাচলে নিষেধাজ্ঞা
মিশর ২২ মে টিরান প্রণালী দিয়ে ইজরায়েলের জাহাজ চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করে।
(৬) আকাবা অবরোধ
এরপর শীঘ্রই মিশর আকাবা উপসাগর অবরোধ করে। ফলে ইজরায়েলের এইলাট বন্দরটি বন্ধ হয়ে গিয়ে ইজরায়েলের বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এসব কারণে আরব দুনিয়ায় খুবই উত্তপ্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় এবং আমেরিকা ও রাশিয়া এই অঞ্চলে তাদের নৌবহর পাঠায়।
আরব-ইজরায়েল সংঘর্ষ
১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে থেকে পুনরায় আরব-ইজরায়েল সংঘর্ষ শুরু হয়। এর বিভিন্ন দিক গুলি হল –
(১) ইজরায়েলের আক্রমণ
ইজরায়েলের বিমানবাহিনী ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দের ৫ জুন একই সঙ্গে গাজা, সিনাই, সিরিয়া ও সংযুক্ত আরব প্রজাতন্ত্রের ওপর আক্রমণ চালায়। আকস্মিক আক্রমণে সংযুক্ত আরব প্রজাতন্ত্রের বিমানবাহিনীর অধিকাংশই ধ্বংস হয়ে যায়। আরব বাহিনী বিভিন্ন রণাঙ্গণে বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়। পরবর্তী পাঁচদিনে ইজরায়েল জর্ডন নদী থেকে সুয়েজ খাল পর্যন্ত এলাকা, জেরুজালেমের আরব-অধিকৃত অঞ্চল, আকাবা উপসাগরের নিকটবর্তী শারম এল শরক দখল করে এবং টিরান প্রণালী দিয়ে ইজরায়েলের জাহাজ চলাচলের সকল বাধা দূর করে।
(২) যুদ্ধবিরতি
৮ জুন জাতিপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব গৃহীত হলে ইজরায়েল ও আরব রাষ্ট্রগুলি এই প্রস্তাব মানতে বাধ্য হয়। তবে ইজরায়েল যেমন তার অধিকৃত এলাকা ছাড়তে রাজি ছিল না তেমনি যুদ্ধে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত আরবরা কোনো আলোচনায় বসতে রাজি ছিল না।
তৃতীয় আরব-ইজরায়েল যুদ্ধের গুরুত্ব
১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দের আরব-ইজরায়েল যুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ ফলাফলগুলি হল –
(১) ইজরায়েলের সাফল্য
এই যুদ্ধে আরব দেশগুলির বিরুদ্ধে ইজরায়েলের সাফল্য ছিল ব্যাপক ও চমকপ্রদ। তারা মাত্র ৬ দিনের যুদ্ধে সংযুক্ত আরব প্রজাতন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত বহু স্থান দখল করে এবং জাতিপুঞ্জের নির্দেশ অমান্য করে সেগুলি ফেরত দিতেও অস্বীকার করে।
(২) মধ্যবর্তী অঞ্চল
ইজরায়েল কর্তৃক নববিজিত এই অঞ্চলগুলি ভবিষ্যৎ যুদ্ধকালে দু-পক্ষের মধ্যে ‘মধ্যবর্তী অঞ্চল’ হিসেবে কাজ করে। এই অঞ্চলে বসবাসকারী আরবজাতির প্রায় ১০ লক্ষ মানুষের অধিকাংশই ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে গাজা উপত্যকায় শরণার্থী শিবিরের বাসিন্দা ছিল। তারা এই অঞ্চলে বসবাস শুরু করলে বহু সমস্যার সৃষ্টি হয়।
(৩) রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীলতা
এই যুদ্ধ ছিল আরব দেশগুলির কাছে, বিশেষ করে মিশরের রাষ্ট্রপতি নাসেরের কাছে বিরাট পরাজয়। এই যুদ্ধের পর থেকে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে আরব রাষ্ট্রগুলি সোভিয়েত রাশিয়ার ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল হতে বাধ্য হয়। রাশিয়া তাদের অন্যতম মিত্রে পরিণত হয় এবং তাদের বিভিন্ন সামরিক সহায়তা দিতে থাকে।
(৪) নতুন সংঘর্ষের পটভূমি
১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দের যুদ্ধবিরতি মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের অবসান ঘটায় নি, বরং নতুন সংঘর্ষ ও যুদ্ধের পটভূমি তৈরি করেছিল। এই যুদ্ধের পর থেকে উভয় পক্ষই নতুন করে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে সেই যুদ্ধ শুরু হয় যা ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দের যুদ্ধের চেয়ে অনেক দীর্ঘস্থায়ী ছিল। এই যুদ্ধে আমেরিকা ইজরায়েলকে এবং রাশিয়া আরব দেশগুলিকে সহায়তা করে।
চতুর্থ আরব-ইজরায়েল যুদ্ধ
১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দের যুদ্ধের পর ইজরায়েল তার দখল করা আরব ভূখণ্ড ফিরিয়ে দেয় নি। ফলে এই সময় উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধবিরতির দ্বারা শান্তি প্রতিষ্ঠিত হলেও তা ছিল একান্তই ক্ষণস্থায়ী। ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে আরব-ইজরায়েলের যুদ্ধে তার প্রমাণ মেলে।
চতুর্থ আরব-ইজরায়েল যুদ্ধের প্রেক্ষাপট
১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত চতুর্থ আরব ইসরাইল যুদ্ধের প্রেক্ষাপট ছিল নিম্নরূপ –
(১) উভয় পক্ষের শক্তিবৃদ্ধি
আপাত শান্তির আড়ালে আমেরিকার কাছ থেকে ইজরায়েল এবং রাশিয়ার কাছ থেকে আরব দেশগুলি সামরিক সাহায্য নিয়ে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করছিল এবং উভয় পক্ষই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। পাশাপাশি উভয় পক্ষের মধ্যে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেই চলেছিল।
(২) ইজরায়েলি আগ্রাসন
১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দের ৩১ অক্টোবর ইজরায়েলের বোমারু বিমান মিশরের রাজধানী কায়রোর কাছে বোমাবর্ষণ করে এবং নীলনদের ওপর একটি সেতু ধ্বংস করে। পাশাপাশি ডিসেম্বর মাসে জর্ডন ও ইরাকের ওপর আক্রমণ চালায়। ইজরায়েল কিছুদিন পরে লেবাননের রাজধানী বেইরুটের বিমানবন্দরে বোমাবর্ষণ করে ১৩টি বিমান ধ্বংস করে। জাতিপুঞ্জ ইজরায়েলের এই আগ্রাসী নীতির তীব্র নিন্দা করে।
(৩) আরব জঙ্গিবাদ
ইতিমধ্যে আরব জাতীয়তাবাদীদের বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠী বিদেশি ইহুদিদের হাত থেকে মাতৃভূমি পুনরুদ্ধারের উদ্দেশ্যে তীব্র লড়াই শুরু করে। এই জঙ্গিদের হাতে ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে মিউনিখ অলিম্পিকে অংশগ্রহণকারী ইজরায়েলি কুস্তিগিররা নিহত হয়। এভাবে পরিস্থিতি প্রচণ্ড উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে ওঠে।
আরব-ইজরায়েল সংঘর্ষ
ইজরায়েলের বিভিন্ন আগ্রাসনমূলক আচরণে আরব দুনিয়া ক্ষোভে বারুদের স্তূপে পরিণত হয়েছিল। যেমন –
(১) ইয়ম কিপুরের যুদ্ধ
এই পরিস্থিতিতে ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দের ৬ অক্টোবর মিশর ও সিরিয়া যৌথভাবে ইজরায়েল অধিকৃত অঞ্চলের ওপর বোমাবর্ষণ করে। ইহুদিদের বার্ষিক ইয়ম কিপুর উৎসবের দিনে আরবরা ইজরায়েলের কাছ থেকে তাদের হারানো অঞ্চল পুনরুদ্ধারের উদ্দেশ্যে আক্রমণ শুরু করেছিল বলে এই যুদ্ধ ইয়ম কিপুরের যুদ্ধ নামে পরিচিত।
(২) ইজরায়েলের প্রাথমিক বিপর্যয়
মিশরের বিমান ও স্থলবাহিনীর আক্রমণে ইজরায়েল ক্রমে পিছু হটতে থাকে। মিশরীয় সেনা সুয়েজ খাল অতিক্রম করে সিনাই পর্যন্ত অগ্রসর হয়। সিরিয়া চারদিক থেকে ইজরায়েলের নিয়ন্ত্রণ রেখা অতিক্রম করে ইজরায়েলের দিকে এগোতে থাকে। সৌদি আরব, জর্ডন, ইরাক, টিউনিশিয়া প্রভৃতি দেশ মিশর ও সিরিয়ার সঙ্গে হাত মেলায়। রাশিয়াও আরব রাষ্ট্রগুলির পাশে দাঁড়ায়। এভাবে যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে ইজরায়েলি বাহিনী প্রচণ্ড বিপর্যয়ের মুখে পড়ে।
(৩) ইজরায়েলের প্রতি-আক্রমণ
আমেরিকা ইজরায়েলকে সহায়তা করলে যুদ্ধ শুরুর ৯ দিন পর ইজরায়েল প্রতি-আক্রমণ শুরু করে। তারা দু-দিনের মধ্যেই আরব বাহিনীকে পিছু হটতে বাধ্য করে। তারা সিরিয়ার সীমান্তে আক্রমণ চালিয়ে গোলান হাইটস্ দখল করে এবং সুয়েজ খাল অতিক্রম করে মিশরীয় বাহিনীর একটি অংশকে চারদিক থেকে অবরোধ করে।
আরব-ইজরায়েল যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব
যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব নিয়ে ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দের ২১ অক্টোবর আমেরিকা ও রাশিয়ার মধ্যে আলোচনা শুরু হয়। ২২ অক্টোবর জাতিপুঞ্জ যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব গ্রহণ করে। কিন্তু তা সত্ত্বেও উভয়পক্ষ যুদ্ধ চালিয়ে যায়।
জেনেভা সম্মেলন
শেষপর্যন্ত ২০ ডিসেম্বর জেনেভায় একটি সম্মেলনে মিশর, জর্ডন, ইজরায়েল, আমেরিকা, রাশিয়া ও অন্যান্য কয়েকটি দেশের প্রতিনিধিরা সমবেত হয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে –
- (১) দু-পক্ষের দ্বারা স্বীকৃত সীমানায় আরব ও ইজরায়েলের সৈন্য অপসারিত হবে।
- (২) বেসামরিকীকরণ করা স্থানগুলির নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হবে।
- (৩) প্যালেস্টিনীয়দের স্বার্থ সুরক্ষার ব্যবস্থা করা হবে।
- (৪) খ্রিস্টান, ইহুদি ও মুসলিমদের পবিত্রস্থান রক্ষা করা হবে।
- (৫) মিশরীয় ও ইজরায়েলি সেনাবাহিনী সুয়েজের পূর্বতীর থেকে ৩২ কিলোমিটার দূরে অপসারিত করা হবে।
উপসংহার :- এভাবে জেনেভা সম্মেলনের দ্বারা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা ইজরায়েলের সঙ্গে আরব দেশগুলির বিরোধের মীমাংসার চেষ্টা করা হয়।
(FAQ) আরব ইজরায়েল যুদ্ধ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে।
১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে।
১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে।
১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে।
১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দের ২৩ ডিসেম্বর জেনেভা সম্মেলনে।