স্বাধীন ইজরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা প্রসঙ্গে আরব দুনিয়া, আরব দেশগুলির অবস্থান, আরব দেশসমূহ, আরব দুনিয়ার রাজনৈতিক জটিলতা, ইহুদি রাষ্ট্রের দাবিতে আন্দোলন, স্বাধীন ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা প্রচার, ইহুদিদের নিয়ে রাজনৈতিক আন্দোলনের সূচনা, প্যালেস্টাইন সমস্যার কারণ ও স্বাধীন ইজরায়েল রাষ্ট্রের আবির্ভাব সম্পর্কে জানবো।
দ্বিতীয বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে স্বাধীন ইজরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা প্রসঙ্গে আরব দুনিয়ার রাজনৈতিক জটিলতা, আরব দেশগুলির অবস্থান, ইহুদি রাষ্ট্রের দাবিতে আন্দোলন, ইহুদিদের নিয়ে রাজনৈতিক আন্দোলনের সূচনা, প্যালেস্টাইন সমস্যা ও স্বাধীন ইজরায়েল রাষ্ট্রের আত্মপ্রকাশ সম্পর্কে জানব।
স্বাধীন ইজরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা
ঐতিহাসিক ঘটনা | স্বাধীন ইজরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা |
ইহুদি রাষ্ট্রের প্রচার | লিওন প্রিয়ান্সকার |
আন্দোলনের সূচনাকারী | থিওডোর হারজল |
ব্যালফুর ঘোষণা | ইংল্যান্ড |
আরব লীগ গঠন | ১৯৪৫ খ্রি |
স্বাধীন ইজরায়েল | ১৪ মে ১৯৪৮ খ্রি |
রাজধানী | তেল আভিভ |
প্রথম রাষ্ট্রপতি | ড. ওয়েইজম্যান |
ভূমিকা :- পশ্চিম এশিয়ার ভূমধ্যসাগরের তীরে অবস্থিত প্যালেস্টাইন বা ইজরায়েল দীর্ঘ দু-হাজার বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। বহু শতক আগে থেকেই প্যালেস্টাইন খ্রিস্টানদের পবিত্র ভূমি বলে বিবেচিত হয়। প্যালেস্টাইন ৬৫ খ্রিস্টপূর্ব থেকে ৬৩৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রোমান সাম্রাজ্য-এর অধীনে, ১০৯৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১১৮৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত খ্রিস্টানদের অধীনে এবং এরপর তুরস্ক-এর অধীনে ছিল।
আরব দুনিয়া
আরব দুনিয়া বা আরব বিশ্ব বলতে কোনো সর্বজনগ্রাহ্য অঞ্চলকে বোঝানো মুশকিল। এজন্য সাধারণভাবে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে গঠিত আরব লিগের সদস্য রাষ্ট্রগুলিকেই আরব দুনিয়ার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্যে আরব ভাষাভাষী দেশগুলিকে নিয়ে আরব দুনিয়া গড়ে উঠেছে।
আরব দেশগুলির অবস্থান
পশ্চিমে আটলান্টিক মহাসাগরের উপকূল থেকে পূর্বে আরবসাগর এবং উত্তরে ভূমধ্যসাগর থেকে দক্ষিণে আফ্রিকার উচ্চ অংশ ও দক্ষিণ-পূর্বে ভারত মহাসাগরের উপকূল পর্যন্ত অঞ্চলে আরব দেশগুলি অবস্থিত।
আরব দেশ সমূহ
আরব দুনিয়ার প্রধান দেশগুলি হল মিশর, সিরিয়া, প্যালেস্টাইন, সৌদি আরব, ইরাক, জর্ডন, সুদান, লিবিয়া, লেবানন প্রভৃতি। আরব দুনিয়ার সঙ্গে আরও কিছু অঞ্চল যুক্ত হয়ে মধ্যপ্রাচ্য গড়ে উঠেছে। আবার মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ আরব দুনিয়ার বাইরে অবস্থিত। যাই হোক, মধ্যপ্রাচ্যের বেশিরভাগ দেশই আরব দুনিয়ার অন্তর্ভুক্ত এবং আরব দুনিয়ার বেশিরভাগ দেশই মধ্যপ্রাচ্যের অন্তর্ভুক্ত।
আরব দুনিয়ার রাজনৈতিক জটিলতা
বিংশ শতকের শুরু থেকে এই অঞ্চলকে কেন্দ্র করে বিশ্বরাজনীতি বারবার আন্দোলিত হয়। আরব দুনিয়ার দেশগুলির ভৌগোলিক অবস্থান, তৈল সম্পদ, আরব জাতীয়তাবাদের উন্মেষ, বিশ্ব ইহুদি আন্দোলন, এই অঞ্চলে পশ্চিমি দেশগুলির লোলুপ দৃষ্টি প্রভৃতি বিষয়গুলি আরব দুনিয়ার রাজনীতিকে জটিল করে তোলে।
ইহুদি রাষ্ট্রের দাবিতে আন্দোলন
ঊনবিংশ শতকের শেষদিকে প্যালেস্টাইনে স্বাধীন ইহুদি জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলন শুরু হয় যা ‘জাইওনিস্ট আন্দোলন’ নামে পরিচিত। এই আন্দোলনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল প্যালেস্টাইনে ইহুদিদের পুনর্বাসন দান এবং ইহুদি জাতির জন্য প্যালেস্টাইনে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা।
স্বাধীন ইহুদি রাষ্ট্র স্থাপনের কথা প্রচার
জনৈক রুশ-ইহুদি চিকিৎসক লিওন পিয়ান্সকার ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে সর্বপ্রথম প্যালেস্টাইনে স্বাধীন ইহুদি রাষ্ট্র স্থাপনের কথা প্রচার করেন।
ইহুদিদের নিয়ে রাজনৈতিক আন্দোলনের সূচনা
এরপর অস্ট্রিয়ার ইহুদি সাংবাদিক থিওডোর হারজল পৃথক রাষ্ট্রের দাবিতে ইহুদিদের নিয়ে রাজনৈতিক আন্দোলনের সূচনা করেন। ঊনবিংশ শতকের শেষদিকে প্যালেস্টাইন সমস্যা অর্থাৎ প্যালেস্টাইনে ইহুদি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাকে কেন্দ্র করে আরব দুনিয়ার রাজনীতি জটিল ও সংঘাতপূর্ণ হয়ে ওঠে।
প্যালেস্টাইন সমস্যার কারণ
ঊনবিংশ শতকের শেষদিকে প্যালেস্টাইন সমস্যার পিছনে যেসব কারণগুলি দায়ী ছিল সেগুলি হল –
(১) জাতীয়তাবাদীদের সংঘাত
মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষুদ্রতম রাষ্ট্র প্যালেস্টাইনে দুটি পরস্পরবিরোধী উগ্র জাতীয়তাবাদের উদ্ভব ঘটে – আরব জাতীয়তাবাদ এবং ইহুদি জাতীয়তাবাদ। এই দুই জাতীয়তাবাদের মধ্যে সামঞ্জস্য রক্ষা বা সহাবস্থানের কোনো পরিস্থিতি ছিল না।
(২) সুয়েজ খালের গুরুত্ব
সুয়েজ খাল ছিল প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে যোগাযোগের গুরুত্বপূর্ণ জলপথ। সুয়েজ খাল ও মধ্যপ্রাচ্যে ব্রিটেন নিজের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থরক্ষার উদ্দেশ্যে প্যালেস্টাইনের ওপর কর্তৃত্ব বজায় রাখতে চাইত।
(৩) ধর্মীয় সংঘাত
প্যালেস্টাইন ছিল ইহুদি, খ্রিস্টান ও ইসলাম ধর্মের পবিত্র ভূমি ও গুরুত্বপূর্ণ স্থান। উক্ত ধর্মের অনুগামীরা প্যালেস্টাইনে নিজ নিজ আধিপত্য প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে নিজেদের মধ্যে সংঘাতে লিপ্ত ছিল।
(৪) মার্কিন উদ্দেশ্য
প্যালেস্টাইনে আমেরিকারও যথেষ্ট স্বার্থ ছিল। আমেরিকায় ৫ মিলিয়ন ইহুদি বসবাস করত। মার্কিন রাজনৈতিক দলগুলি নির্বাচনে সেখানকার ইহুদিদের সমর্থন লাভের উদ্দেশ্যে প্যালেস্টাইনকে কেন্দ্র করে ইহুদি জাতীয়তাবাদকে সমর্থন করত।
(৫) ব্রিটেনের জটিল নীতি
ব্রিটেন আরব বিশ্বে ইহুদি এবং মুসলিম উভয় জাতির প্রতিই সহানুভূতি দেখাত। ভারতের ব্রিটিশ শাসনের প্রতি মুসলিমদের সমর্থন আদায় করাই ছিল আরবের মুসলিমদের প্রতি ব্রিটেনের সহানুভূতি দেখানোর মূল উদ্দেশ্য। প্যালেস্টাইনে আরব ও ইহুদি উভয় পক্ষকে সমর্থন করে ব্রিটেন এখানকার পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে।
স্বাধীন ইজরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা
প্যালেস্টাইন বা ইজরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার বিভিন্ন দিক গুলি হল –
(ক) ব্যালফুর ঘোলণা
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ব্রিটেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার ব্যালফুর ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের ২ ডিসেম্বর এক ঘোষণায় জানান যে, যুদ্ধের পর প্যালেস্টাইনে ইহুদিদের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করা হবে। এরপর জাতিসংঘ ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে প্যালেস্টাইনকে ব্রিটেনের অছি বা অভিভাবকত্বাধীন অঞ্চল বলে ঘোষণা করে।
(খ) প্যালেস্টাইনে ইহুদিদের ভিড়
- (১) ব্যালফুর ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দ থেকে প্রচুর সংখ্যক ইহুদি প্যালেস্টাইনে প্রবেশ করতে থাকে। ধনী, বিদ্বান ও কারিগরি জ্ঞানে সমৃদ্ধ ইহুদিরা উচ্চমূল্যে দরিদ্র ও নিরক্ষর আরবদের জমিজমা কিনে নিতে থাকে। এ ছাড়া ইউরোপ-এ অর্থনৈতিক বিপর্যয় শুরু হলে আরও বেশি সংখ্যায় ইহুদিরা প্যালেস্টাইনে চলে আসতে থাকে।
- (২) ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে প্যালেস্টাইনে ইহুদিদের সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ৩ লক্ষ। জার্মানির ইহুদি-বিদ্বেষী শাসক হিটলার নির্মমভাবে ইহুদি নিধন শুরু করলে সেখানকার ইহুদিরাও প্যালেস্টাইনে চলে আসতে থাকে।
(গ) ইহুদি আগমনের বিরোধিতা
- (১) এভাবে দলে দলে ইহুদি প্যালেস্টাইনে চলে আসায় সংখ্যাগরিষ্ঠ আরবরা নিজেদের মাতৃভূমিতেই সংখ্যালঘু শরণার্থীতে পরিণত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-এর পরবর্তীকালে প্যালেস্টাইনে ইহুদিদের সংখ্যা বিপুল বৃদ্ধি পায়। এর ফলে আরবরা প্রচণ্ড ক্ষুদ্ধ হয়।
- (২) এই পরিস্থিতিতে লেবানন, সিরিয়া, ইরাক, ট্রান্স-জর্ডন, সৌদি আরব, ইয়েমেন ও মিশর – এই সাতটি আরব রাষ্ট্র ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে ‘আরব লিগ’ গঠন করে এবং প্যালেস্টাইনে ইহুদিদের অনুপ্রবেশ বন্ধের দাবি জানায়।
(ঘ) জাতিপুঞ্জের বিশেষ কমিটি
- (১) প্যালেস্টাইন সমস্যার জটিলতা উপলব্ধি করে ব্রিটিশ সরকার বিষয়টি ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে জাতিপুঞ্জ-এর হাতে ছেড়ে দেয়। জাতিপুঞ্জের সাধারণ সভা এবিষয়ে ১১ সদস্যের একটি বিশেষ কমিটি গঠন করে। কমিটির অধিকাংশ সদস্য প্যালেস্টাইনকে আরব ও ইহুদিদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়ার প্রস্তাব দেয়।
- (২) এই সিদ্ধান্ত ইহুদি নেতৃবৃন্দ, আমেরিকা ও রাশিয়া মেনে নিলেও আরব দেশগুলি সহ আফ্রিকা ও এশিয়ার বহু দেশ এর প্রতিবাদ করে। নানা স্থানে সংঘর্ষ শুরু হয়ে যায় এবং ইহুদিরা দলে দলে প্যালেস্টাইনে প্রবেশ করতে থাকে। এই পরিস্থিতিতে ব্রিটেন ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ১৪ মে প্যালেস্টাইনে ব্রিটিশ ‘অছি’র অবসান ঘটায় এবং প্যালেস্টাইন থেকে তাদের সেনা সরিয়ে নিয়ে যায়।
(৩) স্বাধীনতা ঘোষণা
প্যালেস্টাইন থেকে ব্রিটেন তার সেনা সরিয়ে নিলে ইহুদি নেতৃবৃন্দ ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ১৪ মে মধ্যরাত্রে তেল আভিভের জাদুঘর-এ সমবেত হন। সেখানে আন্তর্জাতিক ইহুদি সংস্থার সভাপতি ডেভিড বেন গুরিয়ন স্বাধীন ইজরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করেন। আমেরিকা এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ইজরায়েল রাষ্ট্রকে স্বাধীন বলে স্বীকৃতি দেয়।
উপসংহার :- নতুন এই ইজরায়েল রাষ্ট্রের রাজধানী হয় তেল আভিভ এবং ইজরায়েলের প্রথম রাষ্ট্রপতি হন ড. ওয়েইজম্যান।
(FAQ) স্বাধীন ইজরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
মিশর, সিরিয়া, প্যালেস্টাইন, সৌদি আরব, ইরাক, জর্ডন, সুদান, লিবিয়া, লেবানন প্রভৃতি।
১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে।
পশ্চিম এশিয়ার ভূমধ্যসাগরের তীরে।
রোমান সাম্রাজ্য, খ্রিস্টানদের ও তুরস্কের অধীনে।
রুশ ইহুদি চিকিৎসক লিওন প্রিয়ান্সকার ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে।
১৪ মে ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে।
তেল আভিভ।
ডক্টর ওয়েইজম্যান।