তেল কূটনীতি

তেল কূটনীতি প্রসঙ্গে তৈলসম্পদে ব্রিটিশ প্রাধান্য, রুশ আগ্রহ, আমেরিকার আগ্রহ, তেল কূটনীতির প্রসার, মার্কিন সমস্যা, তেল কূটনীতির লক্ষ্য, তেল কূটনীতির প্রথম পর্যায় ও দ্বিতীয় পর্যায় সম্পর্কে জানবো।

মধ্যপ্রাচ্যে তেল কূটনীতি প্রসঙ্গে তেল কূটনীতি বা পেট্রোলিয়াম রাজনীতি, তেল কূটনীতি কী, তেল কূটনীতির লক্ষ্য, তেল কূটনীতির কারণ, তেল জাতীয়করণের কারণ ও প্রভাব, তেল কূটনীতির প্রথম পর্যায় ও দ্বিতীয় পর্যায়, তেল কূটনীতির প্রকৃতি ও বিশ্বরাজনীতিতে তেল কূটনীতির প্রভাব সম্পর্কে জানব।

তেল কূটনীতি

ঐতিহাসিক ঘটনাতেল কূটনীতি
দেশআমেরিকা
অ্যাংলো-ইরানিয়ান অয়েল কোম্পানিইংল্যান্ড
ইরনের তেল শিল্পের জাতীয়করণ১৯৫১ খ্রি
ইরাক-ইরান যুদ্ধ১৯৮০-৮৮ খ্রি
কুয়েত যুদ্ধ১৯৯০-৯১খ্রি
তেল কূটনীতি

ভূমিকা :- বিংশ শতকের শুরুতে মধ্যপ্রাচ্যে বিপুল পরিমাণ তেলের ভাণ্ডারের খোঁজ পাওয়া যায়। এরপর থেকে এখানকার তেলের ওপর নিজ নিজ প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করতে ইউরোপীয় দেশগুলির মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়ে যায়। এজন্য বিংশ শতক তেল কুটনীতির শতক নামে পরিচিত।

তৈলসম্পদে ব্রিটিশ প্রাধান্য

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-এর পূর্বে মধ্যপ্রাচ্যে তেলের ওপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার কাজে সবচেয়ে এগিয়েছিল ব্রিটেন। তার উদ্যোগে ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে অ্যাংলো-ইরানিয়ান অয়েল কোম্পানি গড়ে ওঠে।

রুশ প্রাধান্য

রাশিয়াও মধ্যপ্রাচ্যের তেলের ওপর দখলদারির চেষ্টা চালানোয় শেষপর্যন্ত ইরানের উত্তরাংশে রাশিয়ার এবং দক্ষিণাংশে ব্রিটেনের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়।

আমেরিকার আগ্রহ

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকা উপলব্ধি করেছিল যে, নিজের দেশে উৎপাদিত তেল তার অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে সক্ষম নয়। এজন্য মধ্যপ্রাচ্যের তেলের ওপর আমেরিকার নজর পড়ে। ব্রিটেন ও ফ্রান্স-এর সঙ্গে বহু দরকষাকষি করে আমেরিকা ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে এই অঞ্চলের তেলের ওপর কিছুটা অধিকার কায়েম করে।

তেল কূটনীতির প্রসার

রাশিয়ার বলশেভিকরা ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে ইরানের তেলের ওপর বিশেষ অধিকার ছেড়ে দিলেও ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে তারা ইরানে সেই অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়। এই পরিস্থিতিতে ইরান ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে তেল শিল্পের জাতীয়করণ করে। এর বিরুদ্ধে ব্রিটেন আন্তর্জাতিক আদালতে যায়। ফলে আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রে জটিলতা বৃদ্ধি পায়।

মার্কিন সমস্যা

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-এর পরবর্তীকালে, বিশেষ করে ১৯৬০-এর দশকে আমেরিকা পৃথিবীর নানা প্রান্তে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার ফলে প্রতিরক্ষা খাতে তার ব্যয় বিপুল পরিমাণে বৃদ্ধি পায় এবং অভ্যন্তরীণ উন্নয়নের গতিও হ্রাস পায়। তা ছাড়া প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে চিনের উত্থানও আমেরিকার পক্ষে আনন্দদায়ক ছিল না।

তেল কূটনীতি

তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে আমেরিকার এই সব সমস্যার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল তৈল সম্পদের সংকোচন। তেল সংকোচনের ফলে মার্কিন পরিবহণ শিল্প ও অন্যান্য কিছু শিল্প অবক্ষয়ের মুখে পড়ে। এর ফলে আমেরিকা বিভিন্ন দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলে মধ্যপ্রাচ্যের তেল-সমৃদ্ধ অঞ্চলে প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়। আমেরিকার এই কূটনৈতিক পদক্ষেপ ‘তেল কূটনীতি’ নামে পরিচিত।

তেল কূটনীতির লক্ষ্য

আমেরিকার তেল কূটনীতির প্রধান লক্ষ্যগুলি ছিল –

  • (১) তেল-সমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যে নিরঙ্কুশ মার্কিন প্রভাব প্রতিষ্ঠা করা,
  • (২) তেল কূটনীতি ও তেল-বাণিজ্য নিজ নিয়ন্ত্রণে রেখে সমগ্র বিশ্বরাজনীতিতে মার্কিন-প্রাধান্য বজায় রাখা,
  • (৩) তেল-বাণিজ্য থেকে প্রাপ্ত মুনাফার দ্বারা মার্কিন অর্থনীতিকে মজবুত করা।

তেল কূটনীতির প্রথম পর্যায়

আমেরিকা ছাড়াও ক্রমে অন্যান্য বেশ কয়েকটি দেশও তেল কূটনীতিতে জড়িয়ে পড়ে। বিংশ শতকের সূচনালগ্নে মধ্যপ্রাচ্যে বিপুল রিমাণ তেলের সন্ধান মেলে। এরপরেই তেলসমৃদ্ধ অঞ্চলগুলির দখলদারি নিয়ে ইউরোপীয় দেশগুলির মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এক্ষেত্রে বিভিন্ন দিক গুলি হল –

(১) ব্রিটেন ও সোভিয়েতের দখলদারি

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে ব্রিটেন মধ্যপ্রাচ্যে তেলের দখলদারির ক্ষেত্রে প্রথম ছাড়পত্র পায়। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে ইরানে গঠিত হয় অ্যাংলো-ইরানিয়ান অয়েল কোম্পানি। এই সময়ে রাশিয়াও ইরান থেকে তেল সংগ্রহে আগ্রহ দেখায়। বিদেশি সাহায্যে তেল উত্তোলনের লক্ষ্যে ব্রিটেন ও সোভিয়েতের সঙ্গে মিলিত হয়ে ইরান এক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। চুক্তি অনুযায়ী ইরানের উত্তরাংশে সোভিয়েত আর দক্ষিণাংশে ব্রিটেন নিজ নিজ দখলদারি কায়েম করে।

(২) মার্কিন অংশীদারিত্ব কায়েম

আমেরিকা উপলব্ধি করে তার নিজের সঞ্চিত তেল আগামী দিনের জন্য যথেষ্ট নয়। তাই ইতিপূর্বে ফ্রান্স ও ব্রিটেনের মধ্যে স্বাক্ষরিত ‘সান রেমো’ চুক্তির তীব্র বিরোধিতা করে আমেরিকা। বেশ কিছুদিন টানাপোড়েনের পর টার্কিশ পেট্রোলিয়াম কোম্পানিতে মার্কিনি অংশীদারিত্ব কায়েম হয় ।

(৩) ইরানের সংসদীয় ঘোষণা ও আইন

তেল কূটনীতির প্রশ্নে ইরানের সংসদ বা মজলিস হস্তক্ষেপ করে। মজলিস এক ঘোষণায় বলে, ইরানের মাটি থেকে সমস্ত বিদেশি সৈন্য সরিয়ে না নেওয়া পর্যন্ত তেলের অধিকার বিষয়ক যাবতীয় আলোচনা স্থগিত থাকবে। এই ঘোষণার পরে ইরানের মজলিস ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দের ২৪ এপ্রিল এক আইন পাস করিয়ে তেলের খনিগুলিকে জাতীয়করণ করে নেয়।

তেল কূটনীতির দ্বিতীয় পর্যায়

দীর্ঘসূত্রতার তেল কূটনীতির দ্বিতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন ঘটনা গুলি হল –

(১) মার্কিন প্রতিক্রিয়া

ইরানের সংসদ মজলিস-এর ঘোষণায় ক্ষুব্ধ হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরানের বিরুদ্ধে আর্থিক অবরোধ ঘোষণা করে। পাশাপাশি সুকৌশলে মার্কিন মদতে শাহ্ মহম্মদ রেজাকে ইরানে ক্ষমতায় নিয়ে আসা হয়। ক্ষমতায় এসে শাহ্ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তেলের বিনিময়ে অস্ত্র কেনার চুক্তি করে।

(২) ইরান-ইরাক যুদ্ধ

১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে শিয়া নেতা আয়াতুল্লা খোমেইনি-র নেতৃত্বে ইরানে শুরু হয় মার্কিন বিরোধিতা। সূচনা ঘটে শাহ্ মহম্মদ রেজা বিরোধী ইসলামীয় বিপ্লবের। এই পরিস্থিতি মোকাবিলার লক্ষ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগন ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধনীতি গ্রহণ করেন। এক্ষেত্রে তিনি ইরাককে ব্যবহার করেন। মার্কিনি সাহায্য নিয়ে ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হুসেন ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে ইরান আক্রমণ করেন।

(৩) কুয়েত যুদ্ধ

ইরাক ইরান যুদ্ধ-এর ১০ বছর পরে ইরাক কুয়েতের ওপর আক্রমণ চালায়। তাই ইরাক কুয়েত আক্রমণ করার পরেই আমেরিকা ইরাকের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ ঘোষণা করে। আমেরিকা ইরাককে সাবধান করে দিয়ে বলে নির্দিষ্ট সময়কাল অর্থাৎ ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দের ১৫ জানুয়ারির মধ্যে ইরাক কুয়েত ত্যাগ না করলে তার বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালানো হবে। কিন্তু ইরাক মার্কিনি হুঁশিয়ারি অগ্রাহ্য করায় ২৮টি ইউরোপীয় রাষ্ট্রের সেনাবাহিনী নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরাককে আক্রমণ করে। এই অসম লড়াইয়ের এক মাস পরে ইরাক কুয়েত ত্যাগ করে।

(৪) ইরাক-মার্কিন যুদ্ধ

নিজের প্রয়োজনীয় তেলের শতকরা ৫০ ভাগ আমেরিকাকে বাইরে থেকে আমদানি করতে হয়। যার মধ্যে শতকরা ২৫ ভাগ আসত মধ্যপ্রাচ্য থেকে। তাই আমেরিকা চেয়েছিল ইরাকের তেলের ভাণ্ডারগুলি নিজের নিয়ন্ত্রণে আনতে। মার্কিন রাষ্ট্রপতি বুশ পারমাণবিক ও রাসায়নিক অস্ত্র মজুত রাখার অজুহাতে ইরাক আক্রমণ করেন। মার্কিন নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক বাহিনীর সমরাভিযানের কাছে ইরাক পর্যুদস্ত হয়। সাদ্দাম হুসেন পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হয়। কুয়েত মুক্তি লাভ করে।

উপসংহার :- আমেরিকার লক্ষ্য ছিল কুয়েতের মুক্তি ঘটিয়ে এবং ইরাকের ক্ষমতা থেকে সাদ্দাম হুসেনকে সরিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের তৈল সম্পদের উপর নিজের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা। বলা বাহুল্য এই কাজে আমেরিকা অনেকটাই সফল হয়েছিল।

(FAQ) তেল কূটনীতি সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. তেল কূটনীতি কি?

আমেরিকা বিভিন্ন দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলে মধ্যপ্রাচ্যের তেল-সমৃদ্ধ অঞ্চলে প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়। আমেরিকার এই কূটনৈতিক পদক্ষেপ ‘তেল কূটনীতি’ নামে পরিচিত।

২. কার উদ্যোগে কখন অ্যাংলো-ইরানিয়ান অয়েল কোম্পানি গড়ে ওঠে?

ইংল্যান্ডের উদ্যোগে ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে।

৩. ইরান তেল শিল্পের জাতীয়করণ করে কখন?

১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে।

৪. ইরান-ইরাক যুদ্ধ শুরু হয় কখন?

১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে।

৫. ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় ইরাকের প্রেসিডেন্ট কে ছিলেন?

সাদ্দাম হুসেন।

Leave a Comment