কুষাণ সাম্রাজ্যবাদের চরিত্র

কুষাণ সাম্রাজ্যবাদের চরিত্র প্রসঙ্গে মধ্য এশিয় চরিত্র, কুষাণ সাম্রাজ্যের ভারতীয়করণ, মিশ্র সংস্কৃতি, কুষাণ সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক ভিত্তি ও চীনা সাক্ষ্য সম্পর্কে জানবো।

কুষাণ সাম্রাজ্যবাদের চরিত্র

ঐতিহাসিক ঘটনাকুষাণ সাম্রাজ্যবাদের চরিত্র
সাম্রাজ্যকুষাণ সাম্রাজ্য
প্রতিষ্ঠাতাকুজুল কদফিসেস
শ্রেষ্ঠ রাজাকণিষ্ক
শেষ রাজাদ্বিতীয় বাসুদেব
কুষাণ সাম্রাজ্যবাদের চরিত্র

ভূমিকা :- কুষাণ সাম্রাজ্য ভারত -এ প্রসারিত হওয়ার আগে মধ্য এশিয়ার ব্যাকট্রিয়া, পার্থিয়া, কাশগড়, খোটান ও পামীর মালভূমি নিয়ে বিস্তৃত ছিল।

কুষাণ সাম্রাজ্যের মধ্য এশিয় চরিত্র

  • (১) ডঃ বি এন মুখার্জী প্রমুখ গবেষকের মতে, কুষাণ সাম্রাজ্যের হৃদপিণ্ড ছিল ব্যাকট্রিয়া। এমন কি কুষাণ সাম্রাজ্যের পতন-এর যুগেও ব্যাকট্রিয়া ছিল এই সাম্রাজ্যের প্রধান অঙ্গ। কুষাণ সাম্রাজ্য ভারতে ধ্বংসপ্রাপ্ত হলেও উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল ও ব্যাকট্রিয়া নিয়ে কুষাণ শাসন অনেকদিন টিকে ছিল।
  • (২) বহু ঐতিহাসিক মনে করেন যে, কুষাণ সাম্রাজ্য ছিল মূলত একটি বিদেশী সাম্রাজ্য যা ভারতের প্রতিবেশী অঞ্চল থেকে ভারতের কিছু অংশে বিস্তৃত হয়েছিল। যেমনভাবে একদা পারসিক সাম্রাজ্য পারস্য হতে ভারতের একাংশে বিস্তৃত হয়েছিল।
  • (৩) সেইভাবে ব্যাকট্রিয়া-কেন্দ্রিক কুষাণ সাম্রাজ্য ভারতে বিস্তৃত হয়েছিল। এই মতের সমর্থনে আরও বলা হয় যে, কুষাণ সম্রাট কণিষ্ক তাঁর মুদ্রা ও লিপিতে ব্যাকট্রিয় ভাষা ব্যবহার করেন, কোন ভারতীয় ভাষা ব্যবহার করেননি।

কুষাণ সাম্রাজ্যের ভারতীয়করণ

  • (১) অধুনা এই মতবাদ পরিত্যক্ত হয়েছে। নতুন গবেষণার আলোকে যে সকল তথ্য পাওয়া গেছে তাতে দেখা যায় যে, কুষাণ সাম্রাজ্যের আর্থিক সমৃদ্ধি তার ভারতীয় অংশের ওপর একান্তভাবে নির্ভরশীল ছিল। যদিও কুষাণ সাম্রাজ্যে আদিতে বৈদেশিক চরিত্র ছিল, পরে এই সাম্রাজ্যের ভারতীয়করণ ঘটেছিল।
  • (২) কুষাণ বিম কদফিসেস ও বাসুদেব ছিলেন শিবের উপাসক। কুষাণ সম্রাট কণিষ্ক ভারতীয় বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন। পেশোয়ার পেটিকা লিপি, পেশোয়ারের বৌদ্ধ সঙ্ঘারাম নির্মাণ বৌদ্ধধর্মের প্রতি কণিষ্কের নিষ্ঠার প্রমাণ দিচ্ছে। হিউয়েন সাঙ বলেছেন যে, কণিষ্ক বৌদ্ধধর্মের মধ্যে বিভেদ দূর করার জন্য চতুর্থ বৌদ্ধ সঙ্গীতি আহ্বান করেন।
  • (৩) কুষাণ সম্রাটদের পৃষ্ঠপোষকতায় ভারতীয় বৌদ্ধধর্ম মধ্য এশিয়ার খোটান, চীন, জাপান পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। ব্যাকট্রিয়া কুষাণ সাম্রাজ্যের মূল কেন্দ্র হলেও, পুরুষপুর বা পেশোয়ার, মথুরা কুষাণ সাম্রাজ্যের কম গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল ছিল না।

কুষাণ সাম্রাজ্যের মিশ্র সংস্কৃতি

  • (১) কুষাণ সম্রাটদের প্রচেষ্টায় ভারতে এক মিশ্র সংস্কৃতির উদ্ভব হয়েছিল। ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে ব্যাকট্রিয় সংস্কৃতির মেলবন্ধন কুষাণ যুগে সম্ভব হয়। তবে ভারতীয় উচ্চতর সংস্কৃতি এতে প্রাধান্য পায় এতে সন্দেহ নেই। এজন্য কুষাণ যুগে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম -এর প্রসার যেমন ঘটে তেমন গান্ধার শিল্প -এর বিকাশ ঘটে।
  • (২) কুষাণ মুদ্রায় শিব, কার্তিকেয় ছাড়া গ্রীক দেবতা হেরাক্লেস, হেলিয়াসেরও মূর্তি দেখা যায়। কুষাণ যুগে খোটান পর্যন্ত ভারতীয় বণিক ও ভিক্ষুদের উপনিবেশ স্থাপিত হয়। কুষাণ যুগে মিশ্র সংস্কৃতি হিসেবে যেমন গান্ধার শিল্পের বিকাশ হয় তেমন মথুরা শিল্পেরও বিকাশ ঘটে। কুষাণ যুগে সংস্কৃত ভাষাকে ধর্মশাস্ত্র রচনার জন্য ব্যবহার করা হয়।

কুষাণ সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক ভিত্তি

  • (১) কুষাণ সাম্রাজ্যবাদের মূল ভিত্তি তার অর্থনীতিতে দেখা যায়। বহু গবেষক এখন মনে করেন যে, ভারতে কুষাণ সাম্রাজ্য বিস্তৃত হওয়ার মূলে অর্থনৈতিক কারণ ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। পরবর্তীকালে কুষাণ সাম্রাজ্যের আর্থিক শ্রীবৃদ্ধি বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে ঘটেছিল।
  • (২) এই বাণিজ্যের মূল কেন্দ্র ছিল উত্তর-পশ্চিম ভারত। এল বুলনিস (L.. Boulnis) নামে জনৈক রাশিয়ান গবেষক তার সিল্ক রুট (Silk Route) নামক গবেষণা গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে, চীনের সঙ্গে রোম -এর বাণিজ্য বিশেষত চীনা রেশম রোমে রপ্তানি হত।
  • (৩) এই বাণিজ্যের পথ ছিল পারস্যের ভেতর দিয়ে। যে রাস্তায় এই বাণিজ্য চলত তার নাম ছিল রেশম রাস্তা (Silk Route) দুটি কারণে এই পথে বাণিজ্য বন্ধ হয় – পারস্যের সঙ্গে রোমের যুদ্ধ এবং পার্থিয় সাম্রাজ্য কর্তৃক উচ্চহারে বাণিজ্য কর আরোপ।
  • (৪) সুতরাং চীন থেকে মাল রেশম রাস্তা ধরে ও ব্যাকট্রিয়া হয়ে ভারতের পথে ভারতের সিন্ধু অঞ্চলের বন্দর দিয়ে রোমে যেতে থাকে। পেরিপ্লাসে শেষ খ্রিস্ট পূর্ব এবং প্রথম খ্রিস্টাব্দে সিন্ধু বন্দর পট্টলা ও বারবারিকাম থেকে রোমান সাম্রাজ্যে লঙ্কা ও মরিচ রপ্তানির কথা বলা হয়েছে।
  • (৫) নিম্ন সিন্ধু অঞ্চলের অর্থনৈতিক গুরুত্বের কথা একটি শিলালিপি থেকে জানা যায়। ইন্দ্রামিদও নামে এক বণিক (৫০-৩০ খ্রিস্ট পূর্ব) তাঁর লিপিতে বলেছেন যে, দক্ষিণ ভারত থেকে মশলা উজ্জয়িনী হয়ে কচ্ছের বারিগাজা এবং সিন্ধুর বারবারিকাম বন্দরে আসত। এখান থেকে রোমান সাম্রাজ্যে মাল রপ্তানি হত।
  • (৬) চীন থেকে আনীত রেশম ও অন্য মালের কথা বলা হয়েছে। বিম কদফিসেস ও কণিষ্ক এই কারণে নিম্ন সিন্ধু অঞ্চল অধিকার করেন। ভারতীয় পণ্যও এই বন্দরগুলি থেকে রপ্তানি হত। স্থলপথে ভারতের পণ্য মধ্য এশিয়ায় যেত।
  • (৭) খোটানে ভারতীয় বণিকদের উপনিবেশ স্থাপিত হয়েছিল বলে জানা যায়। ভারতীয় পণ্য মধ্য এশিয়ায় খোটান হয়ে কাস্পিয়ান সাগরের তীর পর্যন্ত চলে যেত। ভারতের সঙ্গে রোমের বাণিজ্যের জন্য রোম থেকে এত সোনা চলে আসত যে, রোমান পণ্ডিত প্লিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
  • (৮) টলেমির ভূগোল থেকে জানা যায় যে, মধ্য প্রদেশের সাঁচী অঞ্চলের হীরার খনি থেকে কুষাণদের বহু অর্থ লাভ হত। ডঃ বি এন মুখার্জীর মতে, কণিষ্ক এই হীরার খনিগুলি হতে রোমে হীরা চালান দিয়ে বহু সম্পদ পান।

কুষাণ সাম্রাজ্যের আর্থিক সমৃদ্ধির চীনা সাক্ষ্য

চীনা ঐতিহাসিকরা ইউ-চি বা কুষাণদের আর্থিক সমৃদ্ধির উল্লেখ করেছেন। এই সমৃদ্ধি তাদের বাণিজ্য শুল্ক থেকে এসেছিল। এই বাণিজ্য শুল্ক প্রধানত ভারতীয় বাণিজ্য এবং সিন্ধু বন্দর হতে রপ্তানি বাণিজ্যের মাধ্যমে কুষাণরা লাভ করত। ভারতে কুষাণ সাম্রাজ্যবাদের পশ্চাতে এই অর্থনৈতিক কারণ সক্রিয় ছিল।

উপসংহার :- পরবর্তীকালে শক-ক্ষত্রপগণ নিম্ন সিন্ধু অধিকার করলে এই রপ্তানি বাণিজ্য কুষাণদের হাত ছাড়া হয়। তাছাড়া রোমান বণিকরা মৌসুমী বায়ুর গতি আবিষ্কার করে সেই বায়ুতে জাহাজ চালিয়ে সরাসরি দক্ষিণ ভারতীয় বন্দরে বাণিজ্য করতে চলে আসে।

(FAQ) কুষাণ সাম্রাজ্যবাদের চরিত্র সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. কুষাণ সাম্রাজ্যের শ্রেষ্ঠ সম্রাট কে ছিলেন?

কণিষ্ক।

২. কণিষ্ক কোন ধর্ম গ্ৰহণ করেন?

বৌদ্ধ ধর্ম।

৩. কণিষ্কের সময় বৌদ্ধ ধর্মের কোন মত জনপ্রিয় হয়?

মহাযান।

৪. চতুর্থ বৌদ্ধ সংগীতি কার রাজত্বকালে অনুষ্ঠিত হয়?

কুষাণ সম্রাট কণিষ্ক।

৫. বুদ্ধচরিত কে রচনা করেন?

অশ্বঘোষ।

Leave a Comment