সিরাজউদ্দৌলা (Siraj ud-Daulah)

সিরাজউদ্দৌলা (Siraj ud-Daulah) -র পূর্ণ নাম, জন্ম পরিচয়, বংশ পরিচয়, রাজ্যাভিষেক, সিংহাসনে আরোহণ, নবাব হিসেবে সিরাজউদ্দৌলার প্রাথমিক কার্যাবলি, পরিবারের পরিণতি সম্পর্কে আলোকপাত করা হল।

বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলা প্রসঙ্গে তার জন্ম পরিচয়, বংশ পরিচয়, পিতা , মাতা ও স্ত্রীর নাম, সিরাজউদ্দৌলার পুরো নাম, পোষ্যপুত্র সিরাজউদ্দৌলা, আদরের নাতি সিরাজউদ্দৌলা, ঢাকার নৌ বাহিনীর প্রধান সিরাজউদ্দৌলা, তার রাজ্যাভিষেক, আত্মীয়দের বিরোধিতা, সিংহাসনে আরোহণ, নবাব হিসেবে প্রাথমিক কার্যাবলি, কলকাতা দখল, আলিনগরের সন্ধি, পলাশির যুদ্ধ, সিরাজদ্দৌলার বন্দীত্ব, তার মৃত্যু, মুর্শিদাবাদের কথিত কাহিনী, সিরাজউদ্দৌলার পরিবারের পরিণতি, সিরাজউদ্দৌলার সমালোচনা, সিরাজউদ্দৌলার চরিত্র, আদর্শ সম্পর্কে জানবো।

নবাব সিরাজউদ্দৌলা (Nawab Sirajuddaula)

ঐতিহাসিক চরিত্রসিরাজদ্দৌলা
জন্ম১৭৩৩ খ্রিস্টাব্দ
পিতাজৈনুদ্দিন আহমদ
মাতাআমিনা বেগম
রাজত্ব১৭৫৬ – ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দ
যুদ্ধপলাশীর যুদ্ধ (২৩ জুন ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দ)
পূর্বসূরিআলিবর্দি খাঁ
উত্তরসূরিমীর জাফর
রাজধানীমুর্শিদাবাদ, সুবাহ বাংলা
মৃত্যু১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দ (বয়স ২৩ বছর)
নবাব-সিরাজউদ্দৌলা

ভূমিকা :- সিরাজউদ্দৌলা ছিলেন বাংলা-বিহার-ওড়িশার শেষ স্বাধীন নবাব। বাংলার ইতিহাসের এক প্রতিমূর্তি। পলাশীর যুদ্ধে তাঁর পরাজয় ও মৃত্যুর পরই ভারতবর্ষ -এ ১৯০ বছরের ইংরেজ শাসনের সূত্রপাত হয়।

সিরাজউদ্দৌলার পূর্ণ নাম (Full name of Sirajuddaula)

নবাব মনসুর-উল-মুলক সিরাজউদ্দৌলা শাহ কুলী খান মির্জা মুহম্মদ হয়বত জঙ্গ বাহাদুর

বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলার জন্ম পরিচয় (Birth identity of Sirajuddaula)

আলীবর্দী খাঁ যখন পাটনার শাসনভার লাভ করেন, তখন তার তৃতীয়া কন্যা আমিনা বেগমের গর্ভে মির্জা মুহম্মদ সিরাজউদ্দৌলার জন্ম হয়। সিরাজউদ্দৌলার জন্ম ১৭৩৩ সালে।

সিরাজউদ্দৌলার বংশ পরিচয় (Genealogy of Sirajuddaula)

নবাব সিরাজউদ্দৌলা ছিলেন বাংলার নবাব আলীবর্দী খান-এর নাতি। আলিবর্দি খানের কনিষ্ঠা কন্যা আমিনা বেগম ও জৈনুদ্দিন আহমদের পুত্র।

পোষ্যপুত্র সিরাজউদ্দৌলা (Pet son Sirajuddaula)

নবাব সিরাজের জন্মকে সৌভাগ্যের লক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করে নবাব আলীবর্দী খান আনন্দের আতিশয্যে নবজাতক সিরাজ উদ দৌলাকে পোষ্যপুত্র হিসেবে গ্রহণ করেন।

আদরের নাতি সিরাজউদ্দৌলা (Adar’s grandson Sirajuddaula)

নানা আলিবর্দি খানের কাছে সিরাজ উদ দৌলা ছিল খুবই আদরের। কারণ তার কোনো পুত্র ছিল না। সিরাজ উদ দৌলা মাতামহের স্নেহ-ভালোবাসায় বড় হতে থাকেন।

ঢাকার নৌবাহিনীর প্রধান সিরাজউদ্দৌলা (Sirajuddaula is the Chief of Naval Forces of Dhaka)

আলিবর্দী খানের জীবদ্দশায় সিরাজউদ্দৌলা ঢাকার নৌবাহিনীর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

সিরাজউদ্দৌলার রাজ্যাভিষেক (Siraj-ud-Daulah’s coronation)

নবাব সিরাজউদ্দৌলার রাজ্যাভিষেক নিয়ে কাহিনী বর্তমান।

  • (১) ১৭৪৬ সালে আলিবর্দী খান মারাঠাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে গেলে কিশোর সিরাজ উদ দৌলা তার সাথী হন।
  • (২) আলিবর্দি সিরাজ-উদ-দৌলাকে বালক বয়সেই পাটনার শাসনকর্তা নিযুক্ত করেছিলেন।  
  • (৩) বয়স অল্প ছিল বলে রাজা জানকীরামকে রাজপ্রতিনিধি নিযুক্ত করা হয়। কিন্তু বিষয়টি সিরাজদ্দৌলাকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি।
  • (৪) একদিন গোপনে কয়েকজন বিশ্বস্ত অনুচরকে নিয়ে ভ্রমণের নাম করে স্ত্রী লুৎফান্নেসাকে সঙ্গে নিয়ে মুর্শিদাবাদ থেকে সোজা পাটনা গিয়ে উপস্থিত হন এবং জানকীরামকে তার শাসনভার ছেড়ে দেওয়ার আদেশ দেন।  
  • (৫) নবাবের বিনা অনুমতিতে জানকীরাম তার শাসনভার ছেড়ে দিতে অস্বীকৃতি জানান। দুর্গের দ্বার বন্ধ করে বৃদ্ধ নবাবের কাছে বিস্তারিত তথ্য জানিয়ে দূত পাঠান।
  • (৬) জানকীরামের আচরণে ভীষণ ক্ষুদ্ধ হয়ে সিরাজউদ্দৌলা দুর্গ আক্রমণ করেন। উভয়পক্ষে লড়াই শুরু হয়ে গেলে হতাহতের ঘটনাও ঘটে।
  • (৭) ঘটনার সংবাদ পেয়ে আলিবর্দি খাঁ দ্রুত ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছান এবং পরিস্থিতি স্বাভাবিক করেন। সেদিনই আলিবর্দি খাঁ দুর্গের অভ্যন্তরস্থ দরবারে স্নেহভাজন দৌহিত্রকে পাশে বসিয়ে ঘোষণা করেন,

“আমার পরে সিরাজ-উদ-দৌলাই বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার মসনদে আরোহণ করবে।”

ইতিহাসে এই ঘটনাকে সিরাজ-উদ-দৌলার যৌবরাজ্যাভিষেক বলে অভিহিত করা হয়েছে। এই সময়ে সিরাজ-উদ-দৌলার বয়স ছিল মাত্র সতেরো বছর।   

আত্মীয়দের বিরোধিতার মুখে সিরাজদ্দৌলা

সিরাজউদ্দৌলাকে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী মনোনয়ন করার ঘটনা তার আত্মীয়বর্গের অনেকেই মেনে নিতে পারেনি। অনেকেই তার বিরোধিতা শুরু করেন। এদের মধ্যে ছিলেন আলিবর্দি খাঁর বড় মেয়ে ঘসেটি বেগম এবং তার স্বামী নোয়াজেশ মোহাম্মদ।

বাংলার নবাব সিরাজদ্দৌলার সিংহাসনে আরোহণ

১৭৫৬ সালের ১০ এপ্রিল আলিবর্দি খাঁর মৃত্যু হলে নবাব সিরাজউদ্দৌলা বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার সিংহাসনে আরোহণ করেন (১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দের ১০ এপ্রিল)।

নবাব হিসেবে সিরাজদ্দৌলার প্রাথমিক কার্যাবলি

বাংলার নবাব হিসেবে সিরাজউদ্দৌলা প্রাথমিক কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।

(১) মতিঝিল প্রাসাদ অধিকার

সিরাজউদ্দৌলা প্রথমেই ঘসেটি বেগমের চক্রান্ত চূর্ণ করার জন্য সচেষ্ট হন। সিরাজউদ্দৌলা মতিঝিল প্রাসাদ অধিকার করে ঘসেটি বেগমকে মুর্শিদাবাদে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেন।

(২) কাশিমবাজার দুর্গ অবরোধ

  • (ক) মতিঝিল অধিকার করে নবাব সিরাজ উদ দৌলা কাশিমবাজারের উদ্দেশ্যে রওনা হন। ১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দের ২৭ মে তার সেনাবাহিনী কাশিমবাজার দুর্গ অবরোধ করেন।
  • (খ) সিরাজ উদ দৌলা কাশিমবাজার দুর্গের কুঠিয়াল ওয়াটসনকে দরবারে হাজির হয়ে তার নির্দেশ যথাযথভাবে পালন করার জন্য অঙ্গীকারপত্র লিখতে বলেন। ওয়াটসন এই অঙ্গীকারপত্র লিখতে বাধ্য হন।

(৩) সিরাজ উদ দৌলার কলকাতা আক্রমণ

১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দের ১৮ জুন সিরাজউদ্দৌলা কলকাতা আক্রমণ করেন।

  • (ক) ইংরেজদের সাথে তুমুল যুদ্ধ হওয়ার পর ২০ জুন কলকাতা দুর্গ সিরাজ উদ দৌলার দখলে আসে। সিরাজউদ্দৌলা কলকাতার নাম পরিবর্তন করে রাখেন আলিনগর।
  • (খ) সিরাজ উদ দৌলা দুর্গে প্রবেশ করে এবং দরবারে উপবেশন করে উমিচাঁদ ও কৃষ্ণবল্লভকে সেখানে হাজির হওয়ার আদেশ দেন।
  • (গ) পরে সেনাপতি মানিকচাঁদের হাতে দুর্গের শাসনভার ছেড়ে দিয়ে সিরাজউদ্দৌলা ১২ জুলাই রাজধানীতে প্রত্যাবর্তন করেন।

(৪) নবাবগঞ্জের যুদ্ধ

  • (ক) দিল্লীর বাদশা পূর্ণিয়ার নবাব শওকত জঙ্গকে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাবি সনদ পাঠালে শওকত নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রার আয়োজন করেন।
  • (খ) ইংরেজরা সিরাজ উদ দৌলা ও শওকত জঙ্গের মধ্যে বিরোধের সংবাদ পেয়ে গোপনে শওকত জঙ্গের সাথে মিত্রতা করার চেষ্টা করতে থাকে।
  • (গ) অন্যদিকে মাদ্রাজের ইংরেজ দরবার কর্নেল রবার্ট ক্লাইভকে প্রধান সেনাপতি করে কলকাতা পুনরুদ্ধারের জন্য পাঠায়।
  • (ঘ) সিরাজ-উদ-দৌলাও শওকত জঙ্গকে প্রতিরোধ করার জন্য রওনা হন। পথিমধ্যে নবাবগঞ্জ নামক স্থানে উভয়পক্ষ সম্মুখ যুদ্ধে লিপ্ত হয়। যুদ্ধে শওকত জঙ্গ নিহত হন।
  • (ঙ) সিরাজউদ্দৌলা মোহনলালের হাতে পূর্ণিয়ার শাসনভার অর্পণ করে রাজধানীতে ফিরে আসেন।

(৫) ইংরেজদের কলকাতা আক্রমণ প্রতিরোধের চেষ্টা

সিরাজ উদ দৌলা কলকাতা থেকে ইংরেজদের উচ্ছেদ করার প্রয়াস চালিয়েও ব্যর্থ হন।

  • (ক) ক্লাইভ ও ওয়াটসন কলকাতায় এসে সিরাজ-উদ-দৌলার কাছে সন্ধির প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন এবং সিরাজউদ্দৌলা তাতে রাজিও হয়েছিলেন।
  • (খ) কিন্তু ইংরেজরা (ক্লাইভ ও ওয়াটসন) শর্ত ভঙ্গ করে কলকাতা আক্রমণ করে প্রায় বিনাযুদ্ধে তারা কলকাতা দুর্গ জয় করে নেন।
  • (গ) সিরাজউদ্দৌলা তার মন্ত্রীদের কুচক্রের বিষয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়ে ইংরেজদের সাথে একটি সম্পর্ক স্থাপনের জন্য চেষ্টা চালাতে থাকেন।

(৬) আলিনগরের সন্ধি

ইংরেজদের সকল দাবিতে রাজি হয়ে সিরাজ উদ দৌলা ১৭৫৭ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি ইংরেজদের সাথে একটি সন্ধিপত্রে স্বাক্ষর করেন। ইতিহাসে এই সন্ধি ‘আলিনগরের সন্ধি‘ নামে পরিচিত। এই সন্ধির প্রতিশ্রুতি পালনে নবাবকে যথেষ্ট ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছিল।

(৭) কুচক্রী সেনাপতিদের বিচার এবং বিরূপ প্রতিক্রিয়া

সব ধরনের ঝামেলা মোটামুটি শান্ত হওয়ার পর সিরাজউদ্দৌলা সেনাপতিদের অপকর্মের বিচার শুরু করেন।

  • (ক) মানিকচাঁদকে কারাবন্দি করা হয়। এর ফলে রাজবল্লভ, জগৎশেঠ ও মীরজাফর সবাই ভীত হয়ে পড়েন।
  • (খ) স্বার্থ রক্ষার জন্য জগৎশেঠের মন্ত্রণাভবনে মিলিত হয়ে রাজবল্লভ, জগৎশেঠ, মীরজাফর প্রমুখরা ইংরেজদের সাহায্যে নবাবকে সিংহাসনচ্যুত করে মীরজাফরকে সিংহাসনে বসাবার চক্রান্ত শুরু করেন।
  • (গ) ইয়ার লতিফ গোপনে ওয়াটসনের সঙ্গে মিলিত হয়ে কুমন্ত্রণা দেন যে, সিরাজ উদ দৌলা খুব শীঘ্রই ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবেন। আর এই কারণেই সিরাজউদ্দৌলা পলাশীতে শিবির স্থাপন করেছেন।
  • (ঘ) এরপর ক্লাইভ তার সেনাবাহিনীর অর্ধেক লুকিয়ে রেখে বাকিদের নিয়ে কলকাতায় পৌঁছান আর নবাবকে পত্র লেখেন যে, “আমরা সেনাদল উঠিয়ে আনলাম আর আপনি পলাশীতে ছাউনি গেড়ে বসেছেন?”
  • (ঙ) সিরাজ উদ দৌলা সরল বিশ্বাসেই মীরজাফরকে পলাশী থেকে ছাউনি উঠিয়ে মুর্শিদাবাদ চলে যাবার আদেশ দেন।
  • (চ) মীরজাফর রাজধানীতে পৌঁছামাত্রই স্ক্রাফটন তার সঙ্গে মিলিত হয়ে গোপন সন্ধির খসড়া তৈরি করেন। ১৭ মে কলকাতার ইংরেজ দরবারে এই গোপন সন্ধিপত্রের খসড়া নিয়ে আলোচনা হয়।
  • (ছ) মীরজাফরের স্বাক্ষরের জন্য এই গোপন সন্ধিপত্র ১০ জুন তার কাছে পাঠানো হয়। কিন্তু এই গুপ্ত বৈঠক গোপন থাকে নি।
  • (জ) গোপন সন্ধিপত্রের সংবাদ জানতে পেরে সিরাজ উদ দৌলা মীরজাফরকে বন্দি করার ব্যবস্থা নেন। অপরদিকে ওয়াটসন রাজধানী থেকে পালিয়ে যান।

ইংরেজদের সাথে সিরাজদ্দৌলার পলাশীর যুদ্ধ

শেষ পর্যন্ত নবাব সিরাজ উদ দৌলা ও ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মধ্যে সংঘটিত হয় ইতিহাস বিখ্যাত পলাশীর যুদ্ধ।

  • (১) ১৭৫৭ সালের ১২ জুন কলকাতার ইংরেজ সৈন্যরা চন্দননগরের সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিলিত হয়। সেখানে দুর্গ রক্ষার জন্য অল্প কিছু সৈন্য রেখে তারা ১৩ জুন অবশিষ্ট সৈন্য নিয়ে যুদ্ধযাত্রা করে।
  • (২) কলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদের পথে হুগলি, কাটোয়ার দুর্গ, অগ্রদ্বীপ ও পলাশীতে নবাবের যথেষ্ট সৈন্য থাকা সত্ত্বেও তারা কেউই ইংরেজদের পথ রোধ করে নি। নবাব সিরাজউদ্দৌলা বুঝতে পারেন সেনাপতিরাও এই ষড়যন্ত্রে শামিল।
  • (৩) বিদ্রোহের আভাস পেয়ে সিরাজ উদ দৌলা মীরজাফরকে বন্দি করার চিন্তা বাদ দেন। তিনি মীরজাফরকে ক্ষমা করে তাকে শপথ নিতে বলেন।
  • (৪) মীরজাফর পবিত্র কোরান স্পর্শ করে অঙ্গীকার করেন যে, তিনি শরীরের একবিন্দু রক্ত থাকতেও বাংলার স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ন হতে দেবেন না।
  • (৫) গৃহবিবাদের মীমাংসা করে সিরাজ উদ দৌলা রায়দুর্লভ, ইয়ার লতিফ, মীরজাফর, মিরমদন, মোহনলাল ও ফরাসি সেনাপতি সিনফ্রেঁকে সৈন্য চালানোর দায়িত্ব দিয়ে তাদের সঙ্গে যুদ্ধযাত্রা শুরু করেন।
  • (৬) ২৩ জুন সকাল থেকেই পলাশীর প্রান্তরে ইংরেজরা সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়। যুদ্ধের উদ্দেশ্যে ইংরেজরা ‘লক্ষবাগ’ নামক আমবাগানে সৈন্য সমাবেশ করে।
  • (৭) সকাল আটটার সময় হঠাৎ করেই মীর মদন ইংরেজবাহিনীকে আক্রমণ করেন। তার প্রবল আক্রমণে টিকতে না পেরে ক্লাইভ তার সেনাবাহিনী নিয়ে আমবাগানে আশ্রয় নেন।
  • (৮) কিন্তু মীরজাফর, ইয়ার লতিফ, রায় দুর্লভ যেখানে সৈন্যসমাবেশ করেছিলেন সেখানেই নিস্পৃহভাবে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাদের সামান্য সহায়তা পেলেও হয়ত মিরমদন ইংরেজদের পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য করতেন।
  • (৮) দুপুরের সময় হঠাৎ বৃষ্টি নামলে সিরাজ উদ দৌলার গোলাবারুদ ভিজে যায়। তবুও সাহসী মিরমদন ইংরেজদের সাথে লড়াই চালিয়ে যেতে লাগলেন। কিন্তু হঠাৎ করেই গোলার আঘাতে মিরমদন মৃত্যুবরণ করেন।
  • (৯) মীরমদনের পতনের পরেও অন্যতম সেনাপতি মোহনলাল যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি যুদ্ধবিরতির বিরুদ্ধে গিয়ে ইংরেজবাহিনী কে আক্রমণের পক্ষপাতী ছিলেন।
  • (১০) এই সময় মীরজাফর আবারও বিশ্বাসঘাতকতা করে তার সৈন্যবাহিনীকে শিবিরে ফেরার নির্দেশ দেন।
  • (১১) এই সুযোগে ইংরেজরা নবাবকে আক্রমণ করে। যুদ্ধ বিকেল পাঁচটায় শেষ হয় এবং নবাবের ছাউনি ইংরেজদের অধিকারে আসে।
  • (১২) ইংরেজদের পক্ষে সাতজন ইউরোপিয়ান এবং ১৬ জন দেশীয় সৈন্য নিহত হয়।
  • (১৩) কোনো উপায় না দেখে সিরাজ উদ দৌলা রাজধানী রক্ষা করার জন্য দুই হাজার সৈন্য নিয়ে মুর্শিদাবাদের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। কিন্তু রাজধানী রক্ষা করার জন্যও কেউ তাকে সাহায্য করেনি।
  • (১৪) সিরাজউদ্দৌলা তার সহধর্মিণী লুৎফান্নেসা ও ভৃত্য গোলাম হোসেনকে নিয়ে রাজধানী থেকে বের হয়ে স্থলপথে ভগবানগোলায় পৌঁছে যান এবং সেখান থেকে নৌকাযোগে পদ্মা ও মহানন্দার মধ্য দিয়ে উত্তর দিক অভিমুখে যাত্রা করেন।
  • (১৫) সিরাজ উদ দৌলার আশা ছিল পশ্চিমাঞ্চলে পৌঁছাতে পারলে ফ্রান্স -এর সেনাপতি মসিয়েঁ লা-এর সহায়তায় পাটনা পর্যন্ত গিয়ে রামনারায়ণের কাছ থেকে সৈন্য সংগ্রহ করে ফরাসি বাহিনীর সহায়তায় বাংলাকে রক্ষা করবেন।

বন্দি সিরাজউদ্দৌলা

সিরাজ উদ দৌলার বন্দী হওয়ার বিষয়ে ভিন্ন মত আছে।

  • (১) মীরজাফর রাজধানীতে পৌঁছে নবাবকে খুঁজে না পেয়ে চারদিকে লোক পাঠান।
  • (২) ১৭৫৭ সালের ৩ জুলাই সিরাজউদ্দৌলা মহানন্দা নদীর স্রোত অতিক্রম করে এলেও তাতে জোয়ার ভাটার ফলে হঠাৎ করে জল কমে যাওয়ায় নাজিমপুরের মোহনায় এসে নৌকা চড়ায় আটকে যায়।
  • (৩) এরপর নৌকা থেকে নেমে সিরাজ উদ দৌলা খাবার সংগ্রহের জন্য একটি মসজিদের নিকটবর্তী বাজারে আসেন। মসজিদের কিছু লোক তাকে চিনে ফেলে অর্থের লোভে মীরজাফরের সৈন্যবাহিনীকে খবর দেয়।
  • (৪) ভিন্ন আরেকটি মত আছে যে এক ফকির নবাব কে দেখে চিনে ফেলে। এই ফকির পূর্বে নবাব কর্তৃক শাস্তিপ্রাপ্ত হয়ে তার এক কান হারিয়েছিল। তাই সে নবাবের খবর জানিয়ে দেয়।
  • (৫) মীরজাফরের সৈন্য সিরাজ উদ দৌলাকে বন্দি করে রাজধানী মুর্শিদাবাদে পাঠিয়ে দেয়। বন্দী হবার সময় নবাবের সাথে ছিলেন তার স্ত্রী লুতফা বেগম এবং চার বছর বয়সী কন্যা উম্মে জহুরা।

নবাব সিরাজউদ্দৌলার মৃত্যু

৪ জুলাই (মতান্তরে ৩রা জুলাই) মীরজাফরের আদেশে তার পুত্র মিরনের তত্ত্বাবধানে মুহম্মদিবেগ নামের এক ঘাতক সিরাজ উদ দৌলাকে হত্যা করে।

সিরাজউদ্দৌলা সম্পর্কে মুর্শিদাবাদের কথিত কাহিনী

কথিত আছে, সিরাজ উদ দৌলার মৃত্যুর পর তার মৃতদেহ হাতির পিঠে চড়িয়ে সারা শহর ঘোরানো হয়। মুর্শিদাবাদের খোশবাগে নবাব আলিবর্দী খানের কবরের কাছে তাকে কবর দেওয়া হয়।

বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরিবারের পরিণতি

নবাব সিরাজ উদ দৌলার পরিবারের কাউকেই রেহাই দেওয়া হয় নি।

  • (১) সিরাজ উদ দৌলার স্ত্রী লুৎফান্নেসা এবং তার শিশুকন্যাকে মীর জাফরের পুত্র মীরনের নির্দেশে ঢাকায় বন্দি করে রাখা হয়েছিল।
  • (২) সিরাজের পতনের পূর্ব পর্যন্ত ষড়যন্ত্রকারীরা ঘষেটি বেগমকে ব্যবহার করলেও সিরাজের পতনের পর আর তাকে কোনো সুযোগই দেয়া হয়নি।
  • (৩) এই সময় সিরাজ উদ দৌলার মা আমিনা, খালা ঘষেটি বেগম, সিরাজের স্ত্রী লুৎফান্নেসা ও তার শিশুকন্যা সবাইকে ঢাকার জিঞ্জিরা প্রাসাদে বন্দি করে রাখা হয়।
  • (৪) ঢাকার বর্তমান কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরা প্রাসাদে তারা বেশ কিছুদিন বন্দি জীবন যাপন করার পর মীরনের নির্দেশে ঘষেটি বেগম ও আমিনা বেগমকে নৌকায় করে নদীতে ডুবিয়ে মারা হয়।
  • (৫) ক্লাইভের হস্তক্ষেপের ফলে সিরাজের স্ত্রী লুৎফান্নেসা এবং তার শিশুকন্যা রক্ষা পান। পরবর্তীতে তাদেরক মুর্শিদাবাদে আনা হয়। ইংরেজ কোম্পানি সরকার কর্তৃক প্রদত্ত সামান্য বৃত্তির ওপর নির্ভর করে তাদেরকে জীবন ধারণ করতে হয়। সিরাজের মৃত্যুর দীর্ঘ ৩৪ বছর পর লুৎফান্নেসা ১৭৯০ সালে মৃত্যুবরণ করেন।
  • (৬) সিরাজউদ্দৌলাকে হত্যার পর মীরজাফর ও মীরন আমিনা এবং পরিবারের অন্যান্য মহিলাদের কয়েকটি নিকৃষ্ট নৌকায় চড়িয়ে অত্যন্ত অপমানজনকভাবে ও অবহেলার সঙ্গে জাহাঙ্গীর নগরে পাঠিয়ে দেন।
  • (৭) সিয়ারুল মুতাখখেরিন গ্ৰন্থে গোলাম হোসাইন তাবাতাবাই বলেছেন যে, সিরাজ উদ দৌলার পরিবারকে জাহাঙ্গীরনগর পাঠানোর কিছুদিন পর মীরন জাহাঙ্গীরনগরের শাসনকর্তা ও অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তি যশরথ খানকে লিখিত নির্দেশ দেয় যে, তিনি যেন দু’জন হতভাগ্য বয়স্কা মহিলাকে (ঘষেটি বেগম ও আমিনা) হত্যা করেন।
  • (৮) তিনি মীরনের এই ঘৃণ্য নির্দেশ পালন করতে অসম্মতি জানালে ঢাকার জিঞ্জিরা প্রাসাদে সিরাজের মা আমিনা ও খালা ঘষেটি বেগম দীর্ঘদিন বন্দী রাখা হয়। পরে তাদের জলে ডুবিয়ে হত্যা করা হয়।

সিরাজদ্দৌলার সমালোচনা

বিভিন্ন ভাবে সিরাজউদ্দৌলার সমালোচনা করা হয়।

(১) কোনো কোনো কলকাতাবাসী ইংরেজ সিরাজ উদ দৌলাকে নির্মম অত্যাচারী শাসক হিসেবে দেখেছেন।

(২) সিরাজদ্দৌলার প্রতিদ্বন্দ্বী সৌকত জঙ্গের গৃহশিক্ষক গোলাম হোসেন সিরাজের চরিত্রের অন্ধকার দিকগুলি নিয়ে লিখেছেন। তিনি সিরাজের নিষ্ঠুরতা, অর্থলোভ ও লাম্পট্যের বিষয়ে লিখেছিলেন।

(৩) জাঁ লাঁ তাঁর স্মৃতিচারণায় সিরাজ সম্পর্কে লিখেছেন যে, “সিরাজ চরিত্র সর্বকালের এক নিকৃষ্ট চরিত্র। সবরকম ব্যভিচারেই তিনি নিজেকে লিপ্ত করেছিলেন। সিরাজউদ্দৌলার চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ভয়ানক নিষ্ঠুরতা যখন নদীর দুকূল ছাপিয়ে যেত তিনি লোকজনের সাহায্যে খেয়া নৌকা উল্টিয়ে মজা দেখতেন কেমনভাবে একশোজনের মতো লোক অসহায় নর-নারী ও শিশু আর্তনাদ করছে।”

(৪) উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ের একজন বাঙালি লেখক ভোলানাথ চন্দ্রও সিরাজ উদ দৌলার চরিত্র সম্পর্কে এই একই মত পোষণ করেন।

(৫) কাশিমবাজারের ফরাসি কুঠির অধ্যক্ষ মঁসিয়ে লার কথা উদ্ধৃত করে ডঃ যদুনাথ সরকার মন্তব্য করেন যে,

  • (ক) ভবিষ্যৎ কর্তব্য সম্পর্কে সিরাজ উদ দৌলা কোনো শিক্ষা পান নি। তাঁর উদ্দাম ভাবাবেগ সংযত করতে শেখেননি। সিরাজ উদ দৌলার ধারণা সংশোধন করতে কেউ সাহস করত না।
  • (খ) সমস্ত রকম পুরুষোচিত ও সামরিক অনুশীলন থেকে তাঁকে নিবৃত্ত করা হয়েছিল। বৃদ্ধ আলিবর্দির নয়নের মণি নীতিহীন, উদ্ধত, বেপরোয়া ও ভীতিগ্রস্ত কাপুরুষ হিসাবে গড়ে উঠেছিলেন সিরাজ উদ দৌলা।

(৬) স্ক্রাফটনের মতে আলিবর্দি মৃত্যুশয্যায় সিরাজ উদ দৌলাকে ডেকে তাঁকে মদ ছাড়ার উপদেশ দেন। সিরাজ উদ দৌলা কথা রেখেছিলেন।

(৭) স্ক্রাফটন সিরাজের অস্থিরমতিত্ব ও খামখেয়ালিপনার কথা বিশেষভাবে লিখেছিলেন। পূর্ব জীবনের অতিরিক্ত অনাচারের ফলে তাঁর কল্পনাশক্তি বিবৃত হয়ে গিয়েছিল। সিরাজউদ্দৌলা আবেগ উন্মত্ত হয়ে কখনও তাঁর সহচর ও পারিষদদের ওপর নিষ্ঠুর আচরণ করতেন আবার উচ্চ কারণে আদর করতেন। তাঁর কথা ও কাজ ছিল উগ্র বদমেজাজি।

নবাব সিরাজদ্দৌলার চরিত্র

তাঁর শাসনের প্রথম কয়েকমাস সিরাজউদ্দৌলা তাঁর শৌর্য ও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক ম্যালেশন সিরাজ উদ দৌলার মহত্ত্বের কথা গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করেছেন।

  • (১) সিরাজ উদ দৌলা মিরজাফরের চেয়ে অনেক বেশি ভাগ্যবান। সিরাজউদ্দৌলা মিরজাফরের চেয়ে অবশ্যই কম নিন্দনীয়। সিরাজের যাই দোষ-গুণ থাকুক না-কেন তিনি প্রভুর প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেন নি। তিনি দেশকে বিক্রি করে দেননি।
  • (২) ৯ ফেব্রুয়ারি ও ২৩ জুনের মাঝখানকার ঘটনাগুলোর বিচারে কোন নিরপেক্ষ ইংরেজ অস্বীকার করতে পারবেন না যে সম্মানের মানদণ্ডে ক্লাইভ অপেক্ষা সিরাজ উদ দৌলার নাম অনেক উঁচুতে। সেই বিয়োগান্তক নাটকের মুখ্য অভিনেতাদের মধ্যে একমাত্র তিনিই কাউকে প্রতারণা করার চেষ্টা করেননি।

সিরাজদ্দৌলার আদর্শ

নবাব সিরাজউদ্দৌলার রাজত্বের সমাপ্তি বাঙালির স্বায়ত্তশাসনের অবসান ঘটায় এবং ভারতে ব্রিটিশ ক্ষমতার সূচনা করে। তার শাসনের শেষের বাংলা সংস্করণে, মীরজাফর এবং রবার্ট ক্লাইভ ছিল ভিলেন এবং সিরাজ ছিল শিকার।

  • (১) সিরাজ-উদ্-দৌলাকে খুব কমই আকর্ষণীয় ব্যক্তি হিসেবে দেখানো হলেও তাকে পাপী হিসেবে না দেখে তার বিরুদ্ধে পাপ করা হয়েছে বলে গণ্য করা হয়।
  • (২) ভারতীয় স্বাধীনতার আন্দোলন যখন শক্তিশালী হয় সিরাজ উদ দৌলা, টিপু সুলতান এবং শেষ মোগল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ ভারতীয় স্বাধীনতার প্রথম যুদ্ধের নায়ক যারা সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন প্রতিরোধকারী ব্যক্তি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ মর্যাদা লাভ করেন।
  • (৩) বাংলাদেশ -এ সিরাজউদ্দৌলাকে শেষ বৈধ শাসক হিসেবে গণ্য করা হয় যতক্ষণ না পর্যন্ত শেখ মুজিবর রহমান ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতার পর নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন।
  • (৪) সিরাজ উদ দৌলার আদর্শ তাদের মধ্যে সাংস্কৃতিক যুদ্ধের বিষয় হয়ে উঠেছে যারা পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন।

উপসংহার :- ব্রিটিশ স্বার্থসিদ্ধি এবং স্থানীয় কুচক্রীদের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য সিরাজ উদ দৌলার অপসারণ ছিল একান্তই অপরিহার্য। তাই সংঘটিত হয় পলাশীর যুদ্ধ, যার মাধ্যমে সিরাজ উদ দৌলার পতন এবং মীরজাফর ও পরে ব্রিটিশ রাজের উত্থান ঘটে।

(FAQ) সিরাজউদ্দৌলা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. সিরাজউদ্দৌলা কখন বাংলার সিংহাসনে আরোহণ করেন?

১৭৫৬ সালে ২৩ বছর বয়সে।

২. সিরাজউদ্দৌলা কোথায় বন্দী হন?

ঢাকায়।

৩. সিরাজউদ্দৌলার পিতার নাম কি?

জৈনুদ্দিন আহমদ।

৪. সিরাজদ্দৌলার স্ত্রীর নাম কি?

লুৎফান্নেসা।

অন্যান্য ঐতিহাসিক চরিত্রগুলি

Leave a Comment