গুপ্ত বংশের প্রাক্কালে উত্তর ভারতের অবস্থা

গুপ্ত বংশের প্রাক্কালে উত্তর ভারতের অবস্থা প্রসঙ্গে অন্ধকার যুগ, রাজতান্ত্রিক রাজ্য কোশাম্ব, অযোধ্যা, যমুনা উপত্যকা, গোয়ালিয়র, রোহিলখণ্ড, মহারাষ্ট্র, প্রজাতান্ত্রিক রাজ্য পাঞ্জাব ও মালব সম্পর্কে জানবো।

গুপ্ত বংশের প্রাক্কালে উত্তর ভারতের অবস্থা

ঐতিহাসিক ঘটনাগুপ্ত বংশের প্রাক্কালে উত্তর ভারতের অবস্থা
পূর্ববর্তী সাম্রাজ্যকুষাণ সাম্রাজ্য
পরবর্তী সাম্রাজ্যগুপ্ত সাম্রাজ্য
শিশুনাগমগধ
গুপ্ত বংশের প্রাক্কাল্যে উত্তর ভারতের অবস্থা

ভূমিকা :- প্রখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ স্যার জন মার্শাল তার গাইড টু ট্যাক্সিলা (A Guide to Taxila) গ্রন্থে বলেছেন যে, “কুষাণ ও অন্ধ্র-সাতবাহন রাজবংশের বিলুপ্তি এবং সাম্রাজ্য স্থাপনকারী গুপ্ত রাজবংশের উত্থানের মধ্যবর্তীকাল হল এক গভীর অন্ধকারাচ্ছন্ন অধ্যায়।” চতুর্থ শতকে গুপ্তবংশের শাসন স্থাপিত হলে এই অন্ধকার দূর হয় এবং ভারত -এর ইতিহাসে এক নব অধ্যায়ের সূচনা হয়।

ভারতে অন্ধকার যুগ

  • (১) এই মধ্যবর্তী যুগ সম্পর্কে প্রভূত গবেষণার ফলে এখন বহু তথ্য পাওয়া যায়। সুতরাং গুপ্তবংশের পূর্ববর্তী এই যুগকে নতুন তথ্যের আলোকে ভালভাবে জানা সম্ভব হয়েছে। এখন এই যুগকে Dark Age বা অন্ধকারময় যুগ বলা চলে না।
  • (২) কোনো কোনো ঐতিহাসিক বলেন যে, গুপ্তযুগের সাম্রাজ্যবাদ ও সংস্কৃতির অগ্রগতি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। কুষাণ যুগেই এই সাম্রাজ্যবাদের সূত্রপাত হয়। কুষাণ যুগের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য গুপ্তযুগ লাভ করে।
  • (৩) এই মতের বিরুদ্ধে বলা যায় যে, কুষাণ যুগ ও গুপ্ত যুগের মধ্যে অন্তত ১৫০ বছরের ব্যবধান ছিল। সুতরাং কুষাণ যুগের ঐতিহ্য এই মধ্যবর্তী ১৫০ বছর রাখা যায়নি। অনেকের মতে, কুষাণ সাম্রাজ্য ছিল মূলত বৈদেশিক আক্রমণ থেকে উদ্ভূত। বিভিন্ন বৈদেশিক আক্রমণগুলির শেষ পর্যায়ে ছিল কুষাণ আক্রমণ।
  • (৪) গুপ্ত সাম্রাজ্য এরূপ কোনো বৈদেশিক আক্রমণ থেকে উদ্ভূত হয়নি। সুতরাং গুপ্ত সাম্রাজ্যে কুষাণ ঐতিহ্য পড়তে পারে না। অনেকের মতে, কুষাণ সাম্রাজ্যের ভারতীয় অংশ ছিল তার মূল বর্হিভারতীয় মধ্য এশিয়া সাম্রাজ্যের অঙ্গ।
  • (৫) সুতরাং কুষাণ সাম্রাজ্যবাদের প্রেরণা রাজ্য জয় ও অর্থনীতি থেকে এসেছিল। গুপ্ত সাম্রাজ্য ছিল মূলত ভারতীয় চরিত্র। কুষাণ সাম্রাজ্যের পতন-এর পর যে ১৫০ বছর অতিবাহিত হয়, সেই সময় ভারতে যে স্থানীয় রাজ্যগুলি স্থাপিত হয় তার ওপরে গুপ্ত সাম্রাজ্য স্থাপিত হয়।

গুপ্ত বংশের প্রাক্কাল্যে রাজতান্ত্রিক রাজ্য

কুষাণ সাম্রাজ্যের ধ্বংসস্তূপের ওপর যে রাজ্যগুলি গড়ে উঠে তা ছিল রাজতান্ত্রিক ও প্রজাতান্ত্রিক উভয় প্রকারের। রাজতান্ত্রিক রাজ্যগুলির মধ্যে ছিল –

(১) কোশাম্বি

কোশাম্বি অঞ্চলে ১৩০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ মঘ বা মাঘ বংশের উদ্ভদ হয়। উত্তরপ্রদেশের কোশাম্বি অঞ্চলে মহারাজা ভীমসেন এই রাজবংশের স্থাপন করেন। এর পর সিংহাসনে বসেন কোৎসিপুত্র পোতাশ্রী। তারপর সিংহাসনে বসেন ভদ্র মঘ বা ভদ্র মাঘ এই বংশের শেষ রাজার নাম ছিল রুদ্র দেব। অনেকেই এঁকে সমুদ্রগুপ্ত -এর এলাহাবাদ লিপির রুদ্রদেব বলে সনাক্ত করেছেন ।

(২) অযোধ্যা

অযোধ্যা অঞ্চলে ‘মিত্র’ উপাধিধারী এক রাজবংশের উদ্ভব হয়। সম্ভবত মিত্রবংশ কুষাণদের হাত থেকে ক্ষমতা অধিকার করে। এই বংশে ছিলেন সত্য মিত্র, আয়ু মিত্র, সঙ্ঘ মিত্র, বিজয় মিত্র, দেব মিত্র প্রমুখ রাজা। তবে অযোধ্যায় মিত্র বংশের স্বাধীন রাজত্ব ছিল কিনা সে সম্পর্কে ডঃ এস চট্টোপাধ্যায় সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।

(৩) যমুনা উপত্যকা

  • (ক) যমুনা উপত্যকায় নাগবংশীয় শাসকরা স্বাধীন রাজত্ব স্থাপন করেন। নাগ বংশীয় শাসকরা অনার্য বংশীয় ছিলেন বলে অনেকে মনে করেন। নাগ উপাধি থেকে একথা মনে করা হয়। অবশ্য মগধ-এর সিংহাসনে শিশু নাগ নামে এক ব্যক্তি বসেছিলেন বলে জানা যায়। অতীতে এরা অনার্য বংশসম্ভূত ছিলেন। কিন্তু এদের আর্যীকরণ সম্পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল।
  • (খ) পুরাণের মতে, নাগ বংশীয় শাসকরা বিদিশা, কান্তিপুরী, মথুরা ও পদ্মাবতী এই ৪টি কেন্দ্রে রাজত্ব করতেন। ডাঃ ডি. সি. সরকারের মতে, কুষাণ রাজত্বের অবসান হলে নাগ রাজারা খুবই ক্ষমতাশালী হয়েছিল। তবে গুপ্তদের ক্ষমতা বিস্তারের সময় মথুরা ও পদ্মাবতীর নাগ রাজাদের নাম সমুদ্রগুপ্তের এলাহাবাদ লিপি থেকে জানা যায়।

(৪) গোয়ালিয়র

  • (ক) বাকাটক লিপি থেকে পদ্মাবতীর রাজা ভবনাগের নাম পাওয়া যায়। ভবনাগের কন্যাকে বাকাটক রাজকুমারের সঙ্গে বিবাহ দেওয়া হয়। ভবনাগ অশ্বমেধযজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন বলে জানা যায়। গোয়ালিয়রে বা পদ্মাবতী অঞ্চলে ভবনাগের মুদ্রা পাওয়া গেছে। ভবনাগ ছিলেন শৈব। তাঁর বংশ ভরাশিব বংশ বলেও খ্যাতি পায়।
  • (খ) ডঃ এস চ্যাটার্জির মতে, এলাহাবাদ প্রশস্তির নাগসেন ও গণপতি নাগ ছিলেন সম্ভবত ভবনাগের বংশীয়। ডঃ কে. পি. জয়সোয়াল বলেছেন যে, মধ্যভারতে কুষাণ আধিপত্যের বিরুদ্ধে পদ্মাবতীর নাগবংশ মুক্তি যুদ্ধ চালিয়েছিল। কুষাণদের পরাস্ত করে তারা উত্তর ভারত ও দক্ষিণের একাংশ নিয়ে সাম্রাজ্য স্থাপন করে।
  • (গ) জয়সোয়ালের এই মত অধিকাংশ পণ্ডিত অগ্রাহ্য করেন। কারণ এ সম্পর্কে কোনো নিশ্চিত প্রমাণ নেই। ভবনাগের অশ্বমেধ যজ্ঞের দ্বারা একথা প্রমাণ হয়নি যে, তিনি এক বিশাল সাম্রাজ্য স্থাপন করেন।

(৫) রোহিলখণ্ড

অন্যান্য নাগবংশীয় রাজাদের মধ্যে অহিচ্ছত্র বা রোহিলখণ্ডের অধিপতি অচ্যুত, নাগসেন ও নন্দিন নামে তিন নাগবংশীয় রাজার নাম এলাহাবাদ প্রশস্তিতে পাওয়া যায়। নাগবংশীয় রাজকন্যা কুবের নাগের সঙ্গে গুপ্ত সম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত -এর বিবাহ হয় বলে জানা যায়। স্কন্দগুপ্ত -এর অন্যতম প্রধান কর্মচারী ছিলেন সর্বনাগ।

(৬) মহারাষ্ট্র

বাকাটক রাজবংশ দাক্ষিণাত্যের পশ্চিম ভাগ অর্থাৎ মহারাষ্ট্র অঞ্চলে স্থাপিত হয়। এক সময় বাকাটক রাজ্য নর্মদা তীর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। বাকাটক বংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন বিন্ধ্যশক্তি। প্রবরসেন ছিলেন এই বংশের পরাক্রমশালী রাজা। তারপর রুদ্রসেন সিংহাসনে বসেন। এলাহাবাদ লিপিতে তাঁর নাম পাওয়া যায়।

গুপ্ত বংশের প্রাক্কাল্যে প্রজাতান্ত্রিক রাজ্য

কুষাণ সাম্রাজ্যের ধ্বংসস্তূপের ওপর যে রাজ্যগুলি গড়ে উঠে তা ছিল রাজতান্ত্রিক ও প্রজাতান্ত্রিক উভয় প্রকারের। প্রজাতান্ত্রিক রাজ্যগুলির মধ্যে ছিল –

(১) পাঞ্জাব ও রাজপুতনা

প্রজাতান্ত্রিক রাজ্যগুলির মধ্যে যৌধেয় রাজ্যের নাম সর্বাগ্রে করা উচিত। পূর্ব পাঞ্জাব, রাজপুতানার কিছু অংশ নিয়ে যৌধেয়গণ বসবাস করত। যৌধেয়দের প্রজাতান্ত্রিক সংবিধান ছিল। এরা ১৭৫ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ কুষাণ আধিপত্য হতে মুক্ত হয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা করে।

(২) আলোয়ার ও ভরতপুর

অর্জুনায়নগণ রাজপুতানার আলোয়ার ও ভরতপুর অঞ্চলে বসবাস করত। এরা নিজেদের পাণ্ডব বংশীয় অর্জুনের বংশধর বলে দাবী করত। শক ও কুষাণরা অর্জুনায়নদের কিছুকাল বশীভূত করে। কুষাণ সাম্রাজ্যের পতন হলে অর্জুনায়নগণ তাদের পুরাতন প্রজাতন্ত্রকে পুনঃস্থাপন করে।

(৩) মালব

  • (ক) আলেকজাণ্ডার -এর আক্রমণের সময় মালব জাতি পাঞ্জাবে বসবাস করত। চতুর্থ খ্রিস্টাব্দে মালব জাতি রাজপুতানার জয়পুর অঞ্চলে বসবাস করত। সম্ভবত শক আক্রমণের ফলে তারা পাঞ্জাব ছেড়ে রাজপুতানায় চলে যায়।
  • (খ) তারা জয়পুরে মালব নগর নামে এক নগর স্থাপন করে। কুষাণ সাম্রাজ্যের পতন হলে মালবগণ স্বাধীনতা ঘোষণা করে। মালবংশ বিক্রম সম্বত মতান্তরে কৃত সম্মত ব্যবহার করত। কার্দমক শক-ক্ষত্রপদের সঙ্গে মালবরা দীর্ঘকাল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। অবশেষে তারা গুপ্ত রাজবংশের বশ্যতা স্বীকার করে।

উপসংহার :- গুপ্ত বংশের ক্ষমতা লাভের পূর্বে লিচ্ছবি, শক, সনকানিক, খরপারিক, প্রাজরুন প্রভৃতি প্রজাতান্ত্রিক গোষ্ঠীর কথা জানা যায়। এছাড়া পূর্ব ভারতে বাংলায় সমতট, দেবাক, ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় কামরূপ, হিমালয় অঞ্চলে নেপাল, কর্তৃপুর বা কুমায়ুন বা কাংড়া অঞ্চলের নাম জানা যায়।

(FAQ) গুপ্ত বংশের প্রাক্কালে উত্তর ভারতের অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. কুষাণ ও সাতবাহন রাজ্যের বিলুপ্তি ও গুপ্ত বংশের উত্থানের মধ্যবর্তী কালকে কি বলা হয়?

অন্ধকার যুগ।

২. গুপ্ত বংশের প্রাকাল্যে দুটি রাজতান্ত্রিক রাজ্যের নাম লেখ।

কোশাম্বি, অযোধ্যা।

৩. গুপ্ত বংশের প্রাকাল্যে দুটি প্রজাতান্ত্রিক রাজ্যের নাম লেখ।

মালব, আলোয়ার, ভরতপুর।

৪. ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় কোন রাজ্য ছিল?

কামরূপ রাজ্য

Leave a Comment