মৌর্য পরবর্তী যুগের সভ্যতা ও সংস্কৃতি প্রসঙ্গে মিশ্র সংস্কৃতি, বৈদেশিক জাতির সঙ্গে সমন্বয়, শ্রেণি বিভাজন, জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মের জনপ্রিয়তা, বৌদ্ধ ধর্মের উন্নতি, মহাযান ধর্মমত, সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের অগ্ৰগতি সম্পর্কে জানবো।
মৌর্য পরবর্তী যুগের সভ্যতা ও সংস্কৃতি
ঐতিহাসিক ঘটনা | মৌর্য পরবর্তী যুগের সভ্যতা ও সংস্কৃতি |
শিল্প | গান্ধার শিল্প |
বৌদ্ধ ধর্ম | মিনান্দার, কণিষ্ক |
বুদ্ধচরিত | অশ্বঘোষ |
সংস্কৃতি | মিশ্র সংস্কৃতি |
ভূমিকা :- মৌর্য পরবর্তী যুগ বলতে ব্যাকট্রিয় গ্ৰীক, শক, পার্থিয় ও কুষাণ রাজাদের সময়কালকে বোঝানো হয়। এই সময় পূর্ববর্তী যুগের তুলনায় বহুত পরিবর্তন সাধিত হয়।
মৌর্য পরবর্তী যুগের মিশ্র সংস্কৃতি
- (১) মৌর্য পরবর্তী যুগে ব্যাকট্রীয়, পার্থীয়, কুষাণ ও শক জাতির অনুপ্রবেশ -এর ফলে ভারত -এ এক মিশ্র সংস্কৃতির উদ্ভব হয়। নবাগত জাতিগোষ্ঠীগুলি উন্নততর ভারতীয় সভ্যতা গ্রহণ করে ভারতীয় মহাজাতিতে মিশে যায়। কিন্তু নবাগত জাতিগুলির কিছু বৈশিষ্ট্য রয়ে যায়।
- (২) রাজপুত জাতির মধ্যে শক ও হূণ জাতির প্রভাব নৃতাত্ত্বিক পণ্ডিতেরা লক্ষ্য করেছেন। ভারতীয় ধর্ম, ভাষা, আচার এই নবাগত জাতিগুলি গ্রহণ করলেও, এই জাতিগুলির কিছু কিছু আচার ভারতীয় সমাজে ঢুকে পড়ে। এভাবে এক সমন্বয় ঘটে। বহিরাগত যোদ্ধা জাতির শৌর্য এবং ভারতীয় জাতির সংস্কৃতির মিলনে ভারতীয় জাতির পুষ্টি হয়।
বৈদেশিক জাতির সঙ্গে সমন্বয়
- (১) ভারতীয় সমাজ ছিল বর্ণ বা জাতিভেদের ওপর প্রতিষ্ঠিত। সেহেতু এই নবাগত জাতিগুলি ভারতে তাদের শাসন ও বসবাস স্থাপন করলে জাতিভেদ প্রথায় সঙ্কট দেখা দেয়। রক্ষণশীল ও গোঁড়া লোকেরা জাতি ও বর্ণকে রক্ষার জন্য কঠোর আইন রচনা করে। মনুর বিধান বিশেষভাবে প্রচলিত হয়।
- (২) কিন্তু ভারতীয় সভ্যতার প্রকৃতিই হল সমন্বয়বাদী। সুতরাং নবাগত জাতিগুলির সঙ্গে পুরাতন জাতির বৈবাহিক ও রক্ত সম্পর্ক ঘটে। গোড়া ব্রাহ্মণ সাতবাহন বংশ শক-ক্ষত্রপদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনে বাধ্য হয়। তাছাড়া নবাগত জাতিগুলি ক্ষত্রিয় বলে পরিচিতি লাভ করে।
- (৩) রাজপুতরা প্রধানত শত্রুদের বংশধর হলেও তারা গোঁড়া ক্ষত্রিয়ে পরিণত হয়। রাজপুতদের উৎপত্তি সম্পর্কে অগ্নিকুল মতবাদ পণ্ডিতদের মতে তাদের বিজাতীয় উৎপত্তি প্রমাণ করে। যজ্ঞ বা অগ্নিতে শুদ্ধ করে ব্রাহ্মণরা রাজপুতদের ক্ষত্রিয় বলে স্বীকৃতি দেন। মোট কথা, এই বৈদেশিক জাতিগুলির আগমনে ভারতীয় বর্ণভেদ প্রথায় পরিবর্তন ঘটে।
মৌর্য পরবর্তী যুগে শ্রেণি বিভাজন
- (১) মনু, যাজ্ঞবল্ক, মিলিন্দ পনহ প্রভৃতি থেকে শক কুষাণ যুগের সমাজে শ্রেণী বিভাগের কথা জানা যায়। সমাজে ব্রাহ্মণের স্থান ছিল সবার ওপরে। মনুর মতে, ব্রাহ্মণ ছিল বর্ণশ্রেষ্ঠ ও সকল মানুষের প্রধান। বেদ পাঠ হল ব্রাহ্মণের পবিত্র কর্তব্য। আপৎকালে ব্রাহ্মণ যজন ও অধ্যয়ন ছাড়া অন্য বৃত্তি নিতে পারত। তবে কৃষিকার্য নিষিদ্ধ ছিল। ব্রাহ্মণরা স্মৃতি শাস্ত্র অনুযায়ী সমাজে বহু অগ্রাধিকার ভোগ করত। অপরাধ করলে লঘু শাস্তি ভোগ করত।
- (২) মনুসংহিতার মতে গ্রীক, শক, কুষাণ প্রভৃতিরা ছিল ব্রাত্য ক্ষত্রিয়। এই যুগে গণ রাজ্যগুলির অবনতি ঘটেছিল। বৈশ্যের প্রধান কর্তব্য ছিল গো-পালন, কৃষি, বাণিজ্য। মিলিন্দ পনহের মতে, কৃষি ও বাণিজ্য ছিল বৈশ্যের প্রধান কর্তব্য। গহপতিরা ধনী বৈশ্য ছিলেন। তারা এই সময় সমাজে সম্মান পেতেন।
- (৩) সবার নীচে ছিল শূদ্র। উচ্চ তিন বর্ণের বিশেষত ব্রাহ্মণের সেবা করা ছিল তার প্রধান কাজ। শূদ্র ছিল দুই প্রকার – অ-নির্বাসিত ও নির্বাসিত। শেষের শ্রেণী গ্রাম বা শহরের বাইরে বসবাস করত।
মৌর্য পরবর্তী যুগে বৌদ্ধ ও জৈনধর্মের জনপ্রিয়তা
- (১) যেহেতু ব্রাহ্মণ্য ধর্ম নবাগত জাতিগুলিকে কিছুটা হীন চক্ষে দেখত, সেহেতু নবাগত জাতিগুলি বৌদ্ধ ও ভাগবত ধর্মে সমান অধিকার পেয়ে সেই ধর্মমতের প্রতি বেশী অনুরক্তি দেখায়। অবশ্য এ সম্পর্কে কোনো প্রমাণ নেই।
- (২) তবে একথা ভাবার কারণ আছে যে, গ্রীক ও কুষাণরা বৌদ্ধ ও ভাগবত ধর্মকে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম অপেক্ষা কেন বেশী গ্রহণ করেছিল? সম্ভবত এই ধর্মগুলিতে জাতিভেদ প্রথার তীব্রতা ও সঙ্কীর্ণতা না থাকায় এবং এই ধর্মগুলির উদার মতের জন্যই তারা আকৃষ্ট হয়। তাছাড়া শূদ্ররাও ভক্তিধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়।
মৌর্য পরবর্তী যুগে বৌদ্ধ ধর্মের উন্নতি
- (১) মৌর্য পরবর্তী যুগে বৌদ্ধধর্মের বহু রূপান্তর ঘটে। ব্যাকট্রীয় গ্রীক রাজা মিনান্দার ও কুষাণ সম্রাট কণিষ্ক বৌদ্ধধর্মের অনুরাগী ছিলেন। মিনান্দার বৌদ্ধ ভিক্ষু নাগসেনের সঙ্গে যে দার্শনিক প্রশ্ন আলোচনা করেন তা ‘মিলিন্দ প্রশ্ন’ নামে পরিচিত। এই গ্রন্থ পালি ভাষায় লিখিত।
- (২) কুষাণ সম্রাট কণিষ্ক বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন। পেশোয়ারে তিনি সর্বাস্তিবাদী ভিক্ষুদের জন্য একটি বিখ্যাত বিহার তৈরি করেন। এই বিহারে তিনি একটি ধাতুময় পেটিকায় বুদ্ধের পুত্র দেহাংশ রাখেন। এই পেটিকার গায়ে খরোষ্ঠীতে কণিষ্কের লিপি পাওয়া গেছে।
চতুর্থ বৌদ্ধ সঙ্গীতি
বৌদ্ধধর্মের মধ্যে মতভেদ দূর করার জন্য কণিষ্ক চতুর্থ বৌদ্ধ সঙ্গীতি ডাকেন। ১৮টি সম্প্রদায়ের মতভেদ দূর করে বৌদ্ধধর্মের এক সর্বসম্মত ব্যাখ্যা গ্রহণ করার জন্য এই সম্মেলনে চেষ্টা করা হয়। সম্মেলনের সিদ্ধান্ত তামার পাতে খোদাই করে রাখা হয়।
মহাযান বৌদ্ধধর্মের প্রসার
- (১) চতুর্থ বৌদ্ধসঙ্গীতির পর মহাযান বৌদ্ধধর্মের প্রসার ঘটে। আদি বৌদ্ধধর্ম বা থেরবাদী ধর্মের নাম হয় হীনযান। কারণ এই ধর্মে প্রতি ব্যক্তি কেবলমাত্র নিজের মুক্তির কথা ভাবত। এজন্য এর নাম ছিল “প্রত্যেকে বুদ্ধ যান”। একে নিন্দা করে হীনযান বলা হয়।
- (২) এর পরিবর্তে সমষ্টিগত মুক্তির কথা ভাবা হয়। এজন্য এই ধারার নাম হয় মহাযান। বৌদ্ধধর্মের আচার-পদ্ধতিতে পরিবর্তন ঘটে। গৌতম বুদ্ধ -এর মূর্তি কল্পনা করে সেই মূর্তির পুজো, বোধিসত্বের পুজো প্রভৃতি ছিল মহাযান ধর্মের অঙ্গ। আদি বৌদ্ধধর্মের কঠোর যুক্তিবাদের স্থলে ভক্তিবাদ স্থান পায়।
- (৩) বোধিসত্ত্বের ভাবনা ছিল মহাযান ধর্মের প্রধান অঙ্গ। অনেকে বলেন যে, মৌর্য যুগের পরে পারসিক জরাথুষ্ট্র ধর্মের প্রভাবে বোধিসত্বের কল্পনা বৌদ্ধধর্মে ঢুকে পড়ে। জরাথুস্ট্র ধর্মে তিনি হলেন ত্রাণ কর্তা। মহাযান ধর্মে বোধিসত্বকেও ত্রাণ কর্তা মনে করা হয়। জগতের সকল প্রাণী মুক্তি না পেলে বোধিসত্ব নির্বাণ লাভ করতেন না।
- (৪) বোধিসত্ব সকলের পাপের প্রায়শ্চিত্ব করেন। তিনি অবলোকিত্বেশ্বর, করুণার প্রতিমূর্তি। পতিত, বঞ্চিত জনের তিনি ত্রাণকর্তা। তিনি মৈত্রেয় – শিক্ষক। তিনি বজ্রপাণি – অন্যায়, পাপকে ধ্বংস করেন, দোষীকে বজ্র দ্বারা বিনাশ করেন। তিনি মঞ্জুশ্রী – মহাজ্ঞানী, যৌবনের প্রতীক।
- (৫) অন্ধ্রের নাগার্জুনীকোণ্ড ও অমরাবতীতে এই ধর্মমতের প্রধান কেন্দ্র হলেও, সম্রাট কণিষ্কের আমলে আসঙ্গ, বসুবন্ধু, তাঁদের দার্শনিক মত দ্বারা এই ধর্মকে পুষ্ট করেন। শক-কুষাণ যুগে পশ্চিম এশিয়ার ভাবধারা ভারতে ছড়িয়ে পড়ে এবং সম্ভবত এজন্য মহাযান বৌদ্ধধর্ম জরাথুষ্ট মতবাদ দ্বারা প্রভাবিত হয়। এর ফলে বৌদ্ধধর্ম প্রায় একটি নতুন ধর্মে পরিণত হয়।
- (৬) মহাযান ধর্ম গৃহীদের পক্ষে বিশেষ উপযোগী ছিল। মহাযান ছিল পরার্থতার, আশাবাদী ধর্মমত। এই ধর্মে বোধিসত্ব সকলের মুক্তি দিবেন একথা বলা হয়। মহাযান দার্শনিক তাঁর মাধ্যমিক কারিক নামে দর্শন গ্রন্থে শূন্যতার নতুন ব্যাখ্যা দেন। তিনি বলেন যে, একমাত্র সেই বস্তুর অস্তিত্ব আছে যার কোনো গুণ বা ধর্ম নেই এবং তা হল শূন্যতা।
- (৭) আসঙ্গ যোগাচার দর্শন প্রচার করেন। তিনি বলেন যে, এই বিশ্ব হল স্বপ্নের মতই মিথ্যা। শূন্যতাই একমাত্র সত্য। তিনি সূত্রালঙ্কার নামে গ্রন্থ রচনা করেন। মহাযান ধর্ম ভারতে ও ভারতের বাইরে অসাধারণ জনপ্রিয়তা পায়। মধ্য এশিয়ার খোটান, চীন, জাপান, কোরিয়া প্রভৃতি দেশে এই ধর্ম বিস্তৃত হয়।
মৌর্য পরবর্তী যুগে ভক্তিধর্ম ও লৌকিক ধর্ম
- (১) এই যুগে ভক্তিধর্ম ও জৈন ধর্ম -এরও অগ্রগতি ঘটেছিল। ব্যাকট্রীয় রাজা এ্যান্টিয়ালকিডাসের বিদিশার দূত যবন হেলিওডোরাস ভাগবত বা বৈষ্ণবধর্ম গ্রহণ করে ভগবান বিষ্ণুর উদ্দেশ্যে এক গুরুড় স্তম্ভ উৎসর্গ করেন।
- (২) বিম কদফিসেস ও বাসুদেবের মুদ্রায় শিব ও তাঁর বাহন ষাঁড়ের চিহ্ন পাওয়া যায়। এর থেকে শৈবধর্মের জনপ্রিয়তা বোঝা যায়। কার্তিকেয়, নাগ বা সর্প পুজোর প্রচলনও ছিল। কুষাণ যুগে জৈনধর্মের অগ্রগতি ঘটে। মথুরা ছিল কুষাণ যুগে জৈনদের প্রধান কেন্দ্র। এখানে দিগম্বর সম্প্রদায়ের বহু জৈন মূর্তি পাওয়া গেছে।
সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের অগ্রগতি
- (১) মৌর্য পরবর্তী যুগে সাহিত্যের অগ্রগতি বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়। মৌর্য যুগে প্রাকৃত ভাষা রাজ-আনুকূল্য পেয়েছিল। কিন্তু শুঙ্গ যুগ হতে সংস্কৃত ভাষার অগ্রগতি ঘটে।
- (২) ব্যাকট্রীয় গ্রীক রাজা মিনান্দারের সঙ্গে ভিক্ষু নাগসেনের আলোচনা সম্বলিত মিলিন্দ প্রশ্ন এযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ পালি গ্রন্থ। তাছাড়া অধিকাংশ রচনা সংস্কৃত ভাষায় করা হয়।
- (৩) এই যুগের অন্যতম বিশিষ্ট পণ্ডিত ছিলেন অশ্বঘোষ। পাটলিপুত্র -এ তাঁর জন্ম হয়। কণিষ্ক তাঁকে পেশোয়ার নিয়ে যান। অশ্বঘোষ বুদ্ধচরিত নামে এক অতি বিখ্যাত গ্রন্থ রচনা করেন। এছাড়া দার্শনিক তত্ত্ব ও জাতিভেদের সমালোচনামূলক বজ্রসূচী, সূত্রালংকার তিনি রচনা করেন। অশ্বঘোষের রচনা সারিপুত্র প্রকরণ একটি নাটক।
- (৪) নাগার্জুন ছিলেন এই যুগের বিশিষ্ট দার্শনিক। মাধ্যমিক সূত্র নামে দার্শনিক তত্ত্বগ্রন্থ তিনি রচনা করেন। প্রাজ্ঞাপারমিত সূত্র শাস্ত্র তাঁরই রচনা। নাগার্জুন দক্ষিণ ভারতের এক ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মহাযান বৌদ্ধধর্মের মূল তত্ত্বগুলি রচনা করেন।
- (৫) বসুবন্ধুর মতো বৌদ্ধ পণ্ডিতও এই যুগে খ্যাতি লাভ করেন। তাঁর রচিত বিজ্ঞপ্তি মাত্রতাসিদ্ধি একটি বিখ্যাত দার্শনিক গ্রন্থ। বসুবন্ধুর অন্যতম শিষ্য ছিলেন দিঙনাগ। তিনি ছিলেন তর্ক বিজ্ঞানের প্রবর্তক। প্রমাণ সমুচ্চয় তাঁর শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ। তিনি ছিলেন কাঞ্চীর লোক।
- (৬) ধর্মকীর্তি ছিলেন সাংখ্য দর্শনের ও তর্ক বিজ্ঞানের পণ্ডিত। ন্যায় বিন্দু তাঁর রচনা। চরক, শুশ্রুত প্রমুখ শারীর ও ভেষজ বিজ্ঞানে বিশেষ পারদর্শিতা দেখান।
মৌর্য পরবর্তী যুগের শিল্প
- (১) মৌর্য পরবর্তী যুগের শিল্পকলার বিকাশ খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। মৌর্য যুগে শিল্প ছিল মৌর্য সরকার দ্বারা উদ্ভাবিত, ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া, দরবারি শিল্প। জনসাধারণের সঙ্গে তার কোন নাড়ীর যোগ ছিল না।
- (২) মৌর্য পরবর্তী যুগে বহিরাগত শক-কুষাণ জাতির সঙ্গে ভারতীয়দের মিশ্রণ এবং বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে জনসাধারণের ব্যাপক সংযোগ শিল্পে প্রতিফলিত হয়। এই শিল্পে জীবনবোধ ও জন-জীবনের স্পর্শ সুস্পষ্ট। হরপ্পা সভ্যতার সঙ্গে শক-কুষাণ সংস্কৃতির মিশ্রণ এই শিল্পে লক্ষণীয়।
- (৩) শুঙ্গ-কাণ্ব শিল্পে তাই বৃহত্তর জনতার ভাবনাকে প্রকাশ করে। ডঃ নীহার রঞ্জন রায় এজন্য শুঙ্গ-কাণ্ব শিল্পকে ভারতীয় জাতীয় জীবনের এক উজ্জ্বল ভাষা বলেছেন।
মৌর্য পরবর্তী যুগের স্থাপত্য
- (১) স্থাপত্য শিল্পের ক্ষেত্রে বহু গুহা মন্দির, চৈত্য ও স্তূপ এই যুগে তৈরি হয়। মৌর্য যুগের গুহামন্দিরগুলি আয়তনে বড় ছিল না। মৌর্য পরবর্তী যুগে বিরাট আয়তনের গুহামন্দির তৈরি হয়। এর ভেতর থাকত ভিক্ষুদের বাসগৃহ এবং উপাসনার জন্য সঙ্ঘারাম।
- (২) নাসিক, অজন্তা, উদয়গিরি প্রভৃতি গুহাগুলি এই যুগে তৈরি হয়। পাহাড় কেটে এই মন্দিরগুলি তৈরি করা হয়। গুহার দেওয়ালগুলি ছিল মসৃণ এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ক্ষোদিত বা চিত্রিত। স্তূপগুলির তোরণ বা প্রবেশ দ্বার এবং বেষ্টনী এযুগে অসাধারণ শিল্পমণ্ডিত পাথরের কাজের দ্বারা সুশোভিত করা হয়।
- (৩) ভারহুতের স্তূপটি খ্রিস্ট পূর্ব দ্বিতীয় শতকে নির্মিত হয়। শুঙ্গ সম্রাটেরা এই স্তূপে একটি অসাধারণ পাথরের তৈরি বেষ্টনী নির্মাণ করেন। এছাড়া সাঁচীর স্তূপ ও বেষ্টনীর সম্প্রসারণ ও অলংকরণ করা হয়। সাঁচীর স্তূপটি খ্রিস্ট পূর্ব দ্বিতীয় শতকে নির্মিত হলেও খ্রিস্ট পূর্ব প্রথম শতকে এর চার কোণে চারটি তোরণ নির্মাণ করা হয়।
- (৪) চৈত্য বা বিহার নির্মাণ ছিল এই যুগের স্থাপত্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কণিষ্ক পেশোয়ারে এক বহুতল বিখ্যাত বিহার তৈরি করেন। ফা-হিয়েন -এর মতে, বহু শতাব্দী ধরে পর্যটকরা এই সব দেখতে আসতেন। তাছাড়া কাশ্মীরে কুণ্ডল বনবিহার, তক্ষশীলায় ধর্মরাজিকা বিহার ছিল বিখ্যাত। বেশ কয়েকটি স্তূপও এই যুগে তৈরি হয়।
মৌর্য পরবর্তী যুগের ভাস্কর্য শিল্প
(১) ভাস্কর্য শিল্পের ক্ষেত্রে গ্রীক ও ভারতীয় শিল্পরীতি মিলিয়ে গান্ধার শিল্পের বিকাশ ব্যাকট্রীয় যুগে সূচনা হয়, কুষাণ যুগে তার চূড়ান্ত বিকাশ ঘটে। ভারহুত, সাঁচি, বোধগয়ার মূর্তিগুলি এই যুগের ভাস্কর্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। ভারহুত শিল্পের ধারা হল নম্র, বিনীত ও সংযত। বর্ণনায় খুঁটিনাটি বিষয়ের ওপরও নজর দেওয়া হয়েছে।
(২) বোধগয়ার শিল্পের বিশদ দিক না থাকলেও গভীরতা ও ব্যঞ্জনা আছে। ভারহুতের বর্ণনা ধারাবাহিক। ভারহুত, বোধগয়ার মূর্তিগুলি জীবন্ত তবে বোধগয়ায় তা অনেকটা সফল ও অনায়াস লভ্য। সাঁচির স্তূপের বেষ্টনী ভাস্কর্য-বর্জিত। কিন্তু তোরণগুলি ভাস্কর্যে সুসজ্জিত। মানুষের জীবনের সকল ভাব সেই ভাস্কর্যে প্রকাশিত।
(৩) এই ভাস্কর্যে ভারহুতের সংযম ও বিনীতের বদলে আছে আনন্দ ও উচ্ছাসের প্রকাশ। সাঁচির শিল্পে মানবের মূর্তিগুলি বন্ধন মুক্ত, যক্ষিণীরা হাস্যময়ী, মানুষের শোভাযাত্রার দৃশ্যে রথ, হাতি, ঘোড়ার সমাবেশে জমজমাট, মৃগ, হস্তী, ফুল, লতাপাতা মানুষের জীবনযাত্রার সঙ্গে জড়িয়ে আছে। এই শিল্প বর্ণাঢ্য, মাধুর্যময়, উচ্ছল, জীবনের আনন্দঘন প্রকাশ।
(৪) এই শিল্পে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের প্রত্যয়িত পরিচয় উপস্থিত। এজন্য ভারহুত, বোধগয়া ও সাঁচিকে ভারতীয় জনগণের প্রথম সংগঠিত শিল্পের প্রকাশ বলা চলে। এই শিল্পে মৌর্য যুগের দরবারী ছাপ নেই। এই শিল্পে মানুষের সমষ্টিগত জীবনের পরিচয় বেশী দেখা যায়। অনেকের মতে এতে পারসিক ও মেসোপটেমীয় প্রভাব কাজ করেছিল।
মধ্যদেশের শিল্পের ছাপ
এই প্রসঙ্গে বলা যায় যে, উড়িষ্যায় পুরীর নিকটে উদয়গিরি ও খণ্ডগিরি পাহাড়ের ভাস্কর্যে মধ্যদেশের শিল্পের ছাপ পাওয়া যায়। উদয়গিরি ও খণ্ডগিরির জৈন গুহার কিছু অংশ খারবেল -এর আমলের এবং কিছু অংশ তাঁর পরবর্তী যুগের।
মৌর্য পরবর্তী যুগের স্তূপ
স্তূপ শিল্পের মধ্যে খ্রিস্টিয় ২০০ অব্দে নির্মিত কৃষ্ণা নদীর উপত্যকায় অমরাবতীর স্তূপ ও ভাস্কর্যের কথা বলা দরকার। অমরাবতীর ভাস্কর্যের বিষয়বস্তু হল বুদ্ধের জীবন কাহিনী। অমরাবতী, ভট্টি, প্রলু, নাগার্জুনীকোণ্ড প্রভৃতিতে উচ্চ চূড়া যুক্ত স্তূপ তৈরি করা হয়। এই স্তূপের শিল্পরীতিকে অমরাবতী রীতি বলা হয়। বৃক্ষ, পদ্ম, ফল এই শিল্পে মানুষের পাশে সুন্দরভাবে স্থান পেয়েছে।
উপসংহার :- মথুরা শিল্পরীতিতে পাথরের ওপর খোদাই কাজের বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। কণিষ্কের মস্তকবিহীন মূর্তি মথুরা শিল্পরীতির পরিচয় দেয়। জৈন সাধুসন্তদের মূর্তিও মথুরা শৈলীতে খোদাই করা হয়।
(FAQ) মৌর্য পরবর্তী যুগের সভ্যতা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
গান্ধার শিল্প।
কুষাণ সম্রাট কণিষ্ক।
মিনান্দার।
অশ্বঘোষ।