পরমাণু অস্ত্র প্রতিযোগিতা প্রসঙ্গে ক্ষমতার শীর্ষে থাকার লক্ষ্য হিসেবে আণবিক বোমার অধিকারী পঞ্চশক্তি, অন্যান্য পরমাণু অস্ত্র, অন্যান্য পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র, প্রতিযোগিতা, অস্ত্র ব্যবসা ও পরমাণু অস্ত্র প্রতিযোগিতার ফল সম্পর্কে জানবো।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা প্রসঙ্গে ক্ষমতার শীর্ষে থাকার লক্ষ্যে পরমাণু অস্ত্র প্রতিযোগিতা, পারমণবিক বোমার অধিকারী পঞ্চশক্তি, পারমণবিক অস্ত্র ব্যবসা, পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র ও পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতার ফলাফল সম্পর্কে জানব।
পরমাণু অস্ত্র প্রতিযোগিতা
ঐতিহাসিক ঘটনা | পরমাণু অস্ত্র প্রতিযোগিতা |
প্রথম বোমা তৈরি | আমেরিকা |
প্রথম বোমা বর্ষণ | হিরোশিমা |
হাইড্রোজেন বোমা | রাশিয়া |
প্রথম অস্ত্র প্রতিযোগিতা | আমেরিকা ও রাশিয়া |
ভূমিকা :- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-এর শেষ লগ্নে আমেরিকা অক্ষশক্তির অন্যতম সদস্য জাপানের হিরোসিমায় ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ৬ আগস্ট এবং নাগাসাকিতে ৯ আগস্ট আণবিক বোমা বর্ষণ করে। জাপান-এ আণবিক বোমার ভয়ানক ধ্বংসলীলা দেখে বিশ্ববাসী স্তম্ভিত ও শিহরিত হয়। আমেরিকার পর বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রাষ্ট্র আণবিক অস্ত্র তৈরির কৌশল আয়ত্ত করতে সক্ষম হয়। অন্যের চেয়ে বেশি সামরিক শক্তি অর্জনের লক্ষ্যে সেই সব দেশ আণবিক অস্ত্র তৈরির প্রতিযোগিতা শুরু করে।
পরমাণু অস্ত্র প্রতিযোগিতা
- (১) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন যুদ্ধরত শক্তিশালী কয়েকটি দেশ বিজ্ঞানী অ্যালবার্ট আইনস্টাইন-এর আবিষ্কৃত সূত্র প্রয়োগ করে কে কার আগে আণবিক বোমা তৈরি করতে পারে সে বিষয়ে তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু করে। আমেরিকা উপলব্ধি করেছিল যে, জার্মানির হিটলার যদি সবার আগে বোমা তৈরির কাজে সফল হন তবে তার পরিণতি হবে মারাত্মক।
- (২) যাই হোক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আণবিক বোমা তৈরির উদ্দেশ্যে প্রচুর অর্থব্যয়ে যে, ম্যানহাটান প্রকল্পের কর্মসূচি গ্রহণ করে তার ফলে আমেরিকা ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ১ আগস্ট আণবিক বোমার সফল পরীক্ষা চালায়। আমেরিকা এই বোমা সর্বপ্রথম ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ৬ আগস্ট জাপানের হিরোসিমায় বর্ষণ করে। হিরোসিমায় যে আণবিক বোমাটি বর্ষণ করা হয় তার শক্তি ছিল ১৫ কিলোটন।
- (৩) পরবর্তীকালে আণবিক বোমার ক্ষমতা বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন আণবিক বোমার ক্ষমতা মাপা হয় মেগাটনে (১০০০ কিলোটন ১ মেগাটন)। বর্তমান কালের মাত্র ২০ মেগাটন ক্ষমতাসম্পন্ন একটি আণবিক বোমার ধ্বংস ক্ষমতা হিরোসিমায় নিক্ষিপ্ত বোমাটির চেয়ে ১ হাজার গুণ বেশি। এরূপ একটি বোমা ৪৮ বর্গমাইল এলাকা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করতে সক্ষম।
- (৪) আণবিক বোমা তৈরির পরবর্তীকালে একে একে হাইড্রোজেন বোমা, আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র, কৃত্রিম উপগ্রহ, ক্ষেপণাস্ত্র, বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র প্রভৃতি আবিষ্কার হয়েছে। পারমাণবিক অস্ত্রশক্তি বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন দেশ এইসব অস্ত্র তৈরির প্রতিযোগিতায় নেমেছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, সম্প্রতি বিভিন্ন দেশ জীবাণু অস্ত্র ও রাসায়নিক অস্ত্র তৈরি করছে যেগুলি পারমাণবিক অস্ত্রের মতোই মানবজাতির অস্তিত্বকে হুমকি দিচ্ছে।
ক্ষমতার শীর্ষে থাকার লক্ষ্য
১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আণবিক বোমা তৈরির পরবর্তীকালে অন্যান্য বেশ কয়েকটি দেশও এই বোমা তৈরিতে সাফল্য অর্জন করে। এ ছাড়াও বিভিন্ন দেশে নানা ধরনের পরমাণু অস্ত্র উৎপাদিত হতে থাকে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন দিক গুলি হল –
(ক) আণবিক বোমার অধিকারী পঞ্চশক্তি
- (১) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ লগ্নে জুলাই, ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে পটসডাম সম্মেলন চলাকালে আমেরিকা ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ১ আগস্ট সর্বপ্রথম সফল পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। আমেরিকার প্রতিদ্বন্দ্বী সোভিয়েত রাশিয়া ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ২৩ সেপ্টেম্বর আণবিক বোমার সফল পরীক্ষা চালায়।
- (২) এরপর একে একে ব্রিটেন (৩ অক্টোবর, ১৯৫২ খ্রি.), ফ্রান্স (১৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬০ খ্রি.), চিন (১৬ অক্টোবর, ১৯৬৪ খ্রি.) প্রভৃতি দেশ আণবিক অস্ত্রশক্তির অধিকারী হয়। আমেরিকা, রাশিয়া, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও চিন – এই পাঁচটি বৃহৎশক্তি সর্বপ্রথম ‘পারমাণবিক ক্লাবের’ সদস্য অর্থাৎ পারমাণবিক অস্ত্রশক্তির অধিকারী হয়।
(খ) অন্যান্য পরমাণু অস্ত্র
- (১) রাশিয়া ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে হাইড্রোজেন বোমা তৈরি করে। ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দের ৪ অক্টোবর সোভিয়েত রাশিয়া মহাকাশে স্পুটনিক-১ নামে একটি কৃত্রিম উপগ্রহের সফল উৎক্ষেপণ করে। এই ঘটনা আধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র যুগের সূচনা করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও কয়েক মাসের মধ্যেই একাজে সফল হয়।
- (২) সোভিয়েত রাশিয়া গ্যালস নামে ক্ষেপণাস্ত্র বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির দ্বারা মার্কিন মাইনিউটম্যান নামে আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধের কৌশল আয়ত্ত করে। এর পালটা হিসেবে আমেরিকাও নাইক-জিউস ও নাইক-এক্স নামে ক্ষেপণাস্ত্র বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করে রাশিয়ার আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধে সক্ষম হয়।
(গ) অন্যান্য পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র
বৃহৎ পঞ্চশক্তি ছাড়াও বিভিন্ন দেশ পরমাণু অস্ত্র প্রযুক্তির কৌশল আয়ত্ত করার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। ভারত, পাকিস্তান, ইজরায়েল, উত্তর কোরিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা প্রভৃতি দেশ বর্তমানে আণবিক বোমা-সহ বিভিন্ন পরমাণু অস্ত্র তৈরি করতে সক্ষম।
(ঘ) প্ৰতিযোগিতা
- (১) ঠান্ডা লড়াই পরিস্থিতির জনক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত রাশিয়ার মধ্যে সর্বপ্রথম অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়। পরবর্তীকালে অন্যান্য পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্রগুলির মধ্যেও এই প্রতিযোগিতার প্রসার ঘটে। এই ধ্বংসাত্মক প্রতিযোগিতার ফলে আধুনিক পরমাণু অস্ত্র প্রযুক্তির ভয়ানক উন্নতি ঘটেছে এবং বৃহৎ শক্তিগুলি পরমাণু অস্ত্রের গবেষণা ও উৎপাদনে বিপুল অর্থ ব্যয় করছে।
- (২) পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতার দিন শেষ হয়ে আরও মারাত্মক অস্ত্র প্রতিযোগিতার দিন এগিয়ে আসার আভাস পাওয়া যায় মার্কিন মহাশূন্যাধ্যক্ষ জেনারেল চালর্স হরনার-এর বক্তব্যে। তিনি ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে বলেছেন যে, “পারমাণবিক অস্ত্রশস্ত্র সেকেলে যুগের। আমি এর সবগুলি থেকে অব্যাহতি পেতে চাই।”
(ঙ) অস্ত্র ব্যাবসা
আমেরিকা ও অন্যান্য দু-একটি দেশ বিভিন্ন দেশের কাছে অস্ত্র বিক্রি করে নিজেদের অর্থনীতি মজবুত করে এবং বেকার সমস্যার কিছুটা সমাধান করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দের আর্থিক বছরে বিভিন্ন দেশের কাছে যে পরিমাণ অর্থমূল্যের অস্ত্রশস্ত্র বিক্রি করেছিল তার একটি পরিসংখ্যান নিচে উল্লেখ করা হলো –
দেশের নাম | অস্ত্র বিক্রি (ডলারে) |
---|---|
সৌদি আরব | ৪, ১৩৬,০০০,০০০ |
ইরান | ২,৫৮৬,০০০,০০ |
ইজরায়েল | ১,৭৪৯,০০০,০০০ |
মিশর | ৯৩৭,০০০,০০০ |
গ্রেট ব্রিটেন | ৪৮৫,০০০,০০০ |
পশ্চিম জার্মানি | ৪৩০,০০০,০০০ |
দক্ষিণ কোরিয়া | ৩৯০,০০০,০০০ |
তাইওয়ান | ৩৪৬,০০০,০০০ |
জাপান | ৩৩৮,০০০,০০০ |
অস্ট্রেলিয়া | ৩৩৭,০০০,০০০ |
পরমাণু অস্ত্র প্রতিযোগিতার ফল
বৃহৎ শক্তিগুলির পরমাণু অস্ত্র প্রতিযোগিতা মানব-সভ্যতাকে নানা সমস্যায় জর্জরিত করে চলেছে। এই প্রতিযোগিতার ফলাফলগুলি খুবই মারাত্মক ও ক্ষতিকারক। যেমন –
(১) সভ্যতার বিলুপ্তির আশঙ্কা
পরমাণু অস্ত্র প্রতিযোগিতা পৃথিবীর মানব সভ্যতার অস্তিত্বকে প্রশ্ন চিহ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। বৃহৎ শক্তিধর রাষ্ট্রগুলি ছাড়াও বর্তমানে মাঝারি শক্তিসম্পন্ন বহু দেশের হাতে বিপুল পরিমাণ পারমাণবিক অস্ত্রশস্ত্র রয়েছে যা সমগ্র পৃথিবী ধ্বংস করেও শেষ হবে না।
(২) দূষণ
পরমাণু অস্ত্র প্রতিযোগিতা পৃথিবীর পরিবেশদূষণের মাত্রাকে বহুগুণ বৃদ্ধি করেছে। জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে যেখানেই পরমাণু অস্ত্রের পরীক্ষা চালানো হোক না কেন পরমাণুর বর্জ্যপদার্থ প্রকৃতিতে মিশে গিয়ে সীমাহীন দূষণ ছড়াচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, সম্প্রতি জাপানের পরমাণু কেন্দ্র সুনামির দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হলে পরমাণু বর্জ্য প্রকৃতিতে মিশে জমির ধান, নদীর মাছ সবকিছুতেই প্রবেশ করেছে। মানুষ তার পরোক্ষ প্রভাবে ক্যান্সার-সহ নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুপথযাত্রী হচ্ছে বা হবে।
(৩) উত্তেজনাকর পরিস্থিতি
পরস্পরবিরোধী শক্তিজোটের বিরুদ্ধে অস্ত্রশস্ত্রের পরিমাণগত এবং গুণগত প্ৰাধান্য অর্জনের চেষ্টা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। তা ছাড়া পরমাণু অস্ত্র উৎপাদনকারী দেশগুলি তাদের অস্ত্রশস্ত্র অন্য দেশে বিক্রি করে সেই সব দেশের যুদ্ধাকাঙ্ক্ষা বাড়িয়ে দিচ্ছে।
(৪) অর্থনৈতিক ক্ষতি
অস্ত্র প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী দেশগুলি তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি রূপায়ণ করতে গিয়ে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে বাধ্য হচ্ছে। ফলে সেই সব দেশের বিরাট অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে এবং প্রকৃত উন্নয়ন কর্মসূচি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
(৫) তৃতীয় বিশ্বের দুর্দশা
বৃহৎ শক্তিগুলি পরমাণু অস্ত্র তৈরিতে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করছে সেই ব্যয় আদায় করার জন্য তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দরিদ্র দেশে নানাভাবে শোষণ চালাচ্ছে। ফলে এসব দেশের মানুষ দিনদিন দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হচ্ছে। এসব দেশের মানুষের জীবনযাত্রার মান নিম্নমুখী হতে বাধ্য হচ্ছে।
(৬) শক্তির অপব্যবহার
পরমাণু শক্তির মাত্রা খুবই ব্যাপক। এই শক্তিকে মানবকল্যাণে বহু কাজে ব্যবহার করা সম্ভব। বিদ্যুৎ উৎপাদন, চিকিৎসাবিদ্যা প্রভৃতি বিষয়ে পরমাণু শক্তির গুরুত্ব সীমাহীন। কিন্তু পরমাণু অস্ত্র প্রতিযোগিতায় নেমে বহু দেশ পরমাণু শক্তির শুভ দিকটিকে কাজে না লাগিয়ে এই শক্তির অপব্যবহার করছে।
উপসংহার :- আণবিক বোমার ধ্বংসলীলা দেখে মানুষ উপলব্ধি করতে থাকে যে, আন্তর্জাতিক বিরোধের প্রশমন ঘটিয়ে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে পৃথিবীতে মানব-সভ্যতার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা যাবে না। এই আতঙ্ক থেকে বিভিন্নভাবে শান্তি প্রক্রিয়া শুরু হয়।
(FAQ) পরমাণু অস্ত্র প্রতিযোগিতা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ৬ আগস্ট
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ৯ আগস্ট
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র
আমেরিকা, রাশিয়া, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও চিন
১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে