সমর বা সামরিক বিপ্লব

ইউরোপে সমর বা সামরিক বিপ্লব প্রসঙ্গে সমর বিপ্লবের ক্ষেত্রে নতুন ধরনের সামরিক সংগঠন ও যুদ্ধ কৌশল, বারুদের ব্যবহার, বন্দুকের প্রচলন, নতুন যুদ্ধাস্ত্র ও রণকৌশল, সমর বিপ্লব সম্পর্কে মাইকেল রবার্টস-এর ব্যাখ্যা, নতুন যুদ্ধ প্রক্রিয়া, ধাতুর চাহিদা বৃদ্ধি, সমর বিপ্লবের ক্ষেত্রে অস্ত্র ও সৈন্য ব্যবস্থায় পরিবর্তন এবং সমর বিপ্লবের ক্ষেত্রে সামুদ্রিক বিদ্যা সম্পর্কে জানবো।

সমর বা সামরিক বিপ্লব প্রসঙ্গে, সামরিক কৌশল এবং কৌশলগুলিতে আমূল পরিবর্তন, নতুন যুদ্ধাস্ত্র ও রণকৌশল, বন্দুকের প্রচলন, সমর বিপ্লবের ক্ষেত্রে সামুদ্রিক বিদ্যা ও সমর বিপ্লবের ক্ষেত্রে নতুন ধরনের সামরিক সংগঠন ও যুদ্ধ কৌশল সম্পর্কে জানব।

ইউরোপে সমর বা সামরিক বিপ্লব

ঐতিহাসিক ঘটনাসমর বিপ্লব
গোলা বারুদের ব্যবহারযুদ্ধ ক্ষেত্রে বিপ্লব
বারুদের ব্যবহারের কৌশলরোজার বেকন
বারুদের ব্যাপক ব্যবহার১৪৫৩-১৫৫০ খ্রি
যুদ্ধ হাতুড়ি ব্যবহারইতালি
মহার্ঘ্য ধাতুতামা, ব্রোঞ্জ, লোহা
সমর বা সামরিক বিপ্লব

ভূমিকা :- সমর বিপ্লরের মূল কথাই হল যুদ্ধ প্রক্রিয়া পাল্টে যাওয়া এবং উন্নততর যুদ্ধাস্ত্রের আবির্ভাব। Engine F. Rice, Euan Cameron প্রমুখ ঐতিহাসিকরা বলেছিলেন মুদ্রণ যন্ত্রের ব্যবহার যেমন সংস্কৃতিতে বিপ্লব আনে তেমনই যুদ্ধ প্রক্রিয়ার জগতে তীব্র বিপ্লব এনেছিল গোলা বারুদের ব্যবহার।

সমর বিপ্লবের ক্ষেত্রে নতুন ধরনের সামরিক সংগঠন ও যুদ্ধ কৌশল

পঞ্চদশ শতকে মধ্যভাগে ইউরোপ-এ যুদ্ধ পরিচালনার কৌশল পরিবর্তিত হয়। নতুন প্রযুক্তির প্রয়োগ, সামরিক কৌশলের পরিবর্তন, বন্দুক কামানের ব্যবহার, সামরিক ক্ষেত্রে এক আমূল পরিবর্তনের আভাষ পাওয়া যায়। নতুন ধরণের সামরিক সংগঠন ও যুদ্ধকৌশল তৎকালীন রাজনীতি ও সমাজকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে।

সমর বিপ্লবের ক্ষেত্রে বারুদের ব্যবহার

এই নতুন যুদ্ধ প্রক্রিয়ায় বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছিল বারুদের ব্যবহার। ১৪৫৩ থেকে ১৫৫০ সালের মধ্যে বারুদের ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়েছিল। রজার বেকন কিভাবে ধ্বংসাত্মক কাজে বারুদের ব্যবহার হয় তার শিক্ষা দেন। এর আগে বারুদ শুধুমাত্র শিশুদের বাজি তৈরির বিষয়ে সীমাবদ্ধ ছিল। চতুর্দশ শতক থেকে এর ব্যবহার শুরু হলেও পঞ্চদশ শতকে বারুদের বহুল প্রচলন হয়।

সমর বিপ্লবের ক্ষেত্রে বন্দুকের প্রচলন

ষোড়শ শতাব্দী থেকে বন্দুকের প্রচলন বেশী হওয়ায় পদাতিক সৈন্যদের গুরুত্ব বেড়ে যায়। রাষ্ট্রনায়করা ও যুদ্ধবিদরা পদাতিক বাহিনীকে বেশী গুরুত্ব দিতে শুরু করে।

সমর বিপ্লবের ক্ষেত্রে নতুন যুদ্ধাস্ত্র ও রণকৌশল

  • (১) পদাতিক সৈন্যরা ও গোলন্দাজরা ক্রমশ সেনাবাহিনীতে প্রাধান্য ও প্রতিপত্তি লাভ করতে থাকে। দীর্ঘ আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধ আগ্নেয়াস্ত্রের কল্যাণে অনেক জায়গায় পরিণত হয়েছিল আক্রমণাত্মক যুদ্ধে। গোলা বারুদের ব্যবহার দুর্গের নির্মাণ কার্যকে প্রভাবিত করে।
  • (২) যুদ্ধে ধাতুর গুরুত্ব বাড়ে। লোহা উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। যুদ্ধজনিত ক্ষয়ক্ষতি বেড়ে যায়। রাজার আধিপত্য বৃদ্ধি হয় এবং নিয়মিত সামরিক বাহিনী তৈরী ও তাদের নিয়মিত শিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। নাইটদের তরবারি ও বর্শা শোভিত মূর্তি আর সেভাবে মানুষকে ভরসা দিতে পারে নি।
  • (৩) গোলার লড়াই-এর জন্য দৈহিক শক্তি সম্পন্ন মানুষের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। মধ্যযুগীয় বীরত্বে নৈতিকতার অবসান ঘটে। কৌশলই একমাত্র মাত্রা হয়ে দাঁড়ায়। নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার, নব নব যুদ্ধাস্ত্র, যুদ্ধ প্রক্রিয়া নৈতিকতাকে নষ্ট করে যুদ্ধকে আরও ধ্বংসাত্মক ও নৃশংস করে তোলে।

সমর বিপ্লব সম্পর্কে মাইকেল রবার্টস-এর ব্যাখ্যা

মাইকেল রবার্টস সমর বিপ্লবের প্রথম পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তার মতে সমর বিপ্লব সীমাবদ্ধ ছিল ১৫৬০-১৬৬০ সালের মধ্যে। তাঁর বর্ণনায় বিপ্লবের চারটি দিক লক্ষ্যণীয়। যথা –

  • (১) যুদ্ধের কৌশল-এ বৈপ্লবিক পরিবর্তন।
  • (২) সামগ্রিকভাবে রণকৌশলের পরিবর্তন।
  • (৩) যুদ্ধের মাত্রার ব্যাপকতা বৃদ্ধি।
  • (৪) যুদ্ধের বর্ধিত আকার এবং সৈন্য সংখ্যার ব্যাপক বৃদ্ধির ফলে যুদ্ধের প্রভাবও অনেক গভীর হয়।

সমর বিপ্লবের ক্ষেত্রে নতুন যুদ্ধ প্রক্রিয়া

যুদ্ধক্ষেত্রে পদাতিক সৈন্যদের গুরুত্ব ক্রমশ বৃদ্ধি পায়। ম্যাকিয়াভেলি পদাতিক সেনাবাহিনীকে উল্লেখযোগ্য অংশ বলে বর্ণনা করেছেন। পদাতিক বাহিনী ছিল বন্দুক দ্বারা সজ্জিত। রাজার নিজস্ব সৈন্যবাহিনী গড়ে ওঠে। সেনা বাহিনীর সংখ্যা বৃদ্ধি হলে নিম্নবর্গের সংখ্যা বেড়ে যায়। রণকৌশলে আসে নতুন আঙ্গিক। যুদ্ধজনিত ক্ষয়ক্ষতি বৃদ্ধি পেয়েছিল। যুদ্ধের কারণে ব্যয় ভার বৃদ্ধি পেয়েছিল। প্রত্যক্ষ করের পরিমাণ বেড়ে গিয়েছিল। যুদ্ধের খরচ মেটাতে গিয়ে ইংল্যান্ড, ফ্রান্সস্পেন-এর অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হয়ে গিয়েছিল।

সমর বিপ্লবের ক্ষেত্রে ধাতুর চাহিদা বৃদ্ধি

আলোচ্য সময়ে ইউরোপের খনিগুলি থেকে ধাতু নিষ্কাশন বৃদ্ধি পায়। তামা ব্রোঞ্জ ও লোহা মহার্ঘ্য হয়ে উঠতে থাকে। ষোড়শ শতাব্দী থেকে কামানের গোলা তৈরির জন্য প্রচুর লোহা লাগতে শুরু করে, লোহার উৎপাদন বেড়ে যায়। পাশাপাশি তামার উৎপাদন বাড়ে। হালের ও শিরস্ত্রাণের ব্যবহারে পরিবর্তন আসে।

সমর বিপ্লবের ক্ষেত্রে অস্ত্র ও সৈন্য ব্যবস্থায় পরিবর্তন

  • (১) দুর্গের নির্মাণ পদ্ধতি ও প্রতিরক্ষাব্যূহ সাজানোর কৌশলে পরিবর্তন আসে। অস্ত্র ও সৈন্য সজ্জায় বিশেষ পরিবর্তন আসে। ইতালিতে ‘যুদ্ধ হাতুড়ি’ ব্যবহার করা শুরু হয়। চতুর্দশ থেকে সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যে তরোয়াল ও তীর ধনুকে পরিবর্তন আসে। ভাড়াটে সৈন্যের পরিবর্তে নিয়মিত সামরিক বাহিনী গড়ে তোলার দিকে নজর দেওয়া হয়।
  • (২) নতুন ধরণের লম্বা নলওলা পিস্তল আবিষ্কৃত হয়। দুর্গ ভাঙার জন্য বিশেষ ধরণের গোলা ও গোলা নিক্ষেপক কামানের ব্যবহার শুরু হয়। সুইশ ও জার্মানিদের দক্ষতায় গোলন্দাজ বাহিনীর বিশেষ উন্নতি ঘটে। ইউরোপের প্রায় প্রতিটি দেশেই সৈন্যবাহিনী বৃদ্ধি পায়।
  • (৩) নৌ সেনাদের প্রশিক্ষণ শুরু হয়। স্পেন, পর্তুগাল, ডেনমার্ক সামরিক দিক থেকে বলবান হয়ে ওঠে। সামরিক শক্তি বৃদ্ধি সমস্ত ইউরোপ জুড়ে অস্ত্রশস্ত্রের প্রতিযোগিতা শুরু করেছিল।
  • (৪) গোলন্দাজ বাহিনীর উন্নতি দুর্গ গঠনে পরিবর্তন নিয়ে আসে। দুর্গকে আরও মজবুত করে তৈরি করা হয়। দুর্গের ভিতরে বসে গোলন্দাজদের আক্রমণ ঠেকানো, যুদ্ধ করা ও প্রত্যুত্তরে কামান দাগা সহজ ছিল।

সমর বিপ্লবের ক্ষেত্রে সামুদ্রিক বিদ্যা

  • (১) পঞ্চদশ থেকে ষোড়শ শতক জুড়ে সামুদ্রিক বিদ্যার ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসে। যুদ্ধ জাহাজগুলির পরিবর্তন ঘটতে থাকে। একতলা দাঁড়টানা দীর্ঘ আকৃতির রণতরীর যুগ শেষ হয়ে যায়। দাঁড় টানবার জন্য অসংখ্য শ্রমিকের আর প্রয়োজন হত না। ডেকে কামানের সারি বসানোর ব্যবস্থা হয়েছিল এবং দূরে গোলা নিক্ষেপ করবার মত কামান তৈরি হয়েছিল।
  • (২) ডেনমার্ক, সুইডেন প্রভৃতি দেশগুলি নানারকম জাহাজ তৈরি করেছিল। নৌ বাহিনীর সাজ সরঞ্জাম ও অস্ত্রশস্ত্রে ইউরোপে সমুদ্রোপকূলবর্তী দেশগুলি উন্নত হয়ে উঠেছিল। পদাতিক অশ্বারোহী, তীরন্দাজ বাহিনী, কুঠার তীর, ধনুক, বর্শা ও তলোয়ারের যুগ পেরিয়ে ইউরোপ পঞ্চদশ শতকে এক নতুন যুগে প্রবেশ করেছিল।

উপসংহার :- সমরাস্ত্র উৎপাদনের আর একটি ফল বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য মনে করা হয়। আগ্নেয়াস্ত্রের ধ্বংসাত্মক প্রবণতা যেমন একদিকে শান্তি আন্দোলনকে প্রভাবিত করেছিল। অন্যদিকে চিন্তাশীল মানুষ বিশেষ প্রয়োজনে যুদ্ধের প্রয়োজনীয়তাকে স্বাগত জানিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত মানুষ পরস্পর বিরোধী আদর্শের সামঞ্জস্য বিধান করে যুদ্ধ ও শান্তি দুটিই সমভাবে প্রয়োজনীয় বলে মেনে নেয়।

(FAQ) সমর বা সামরিক বিপ্লব সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. যুদ্ধ হাতুড়ি ব্যবহার করা শুরু করে কোন দেশ?

ইতালি।

২. সমর বিপ্লবের সময় কোন কোন ধাতু মহার্ঘ্য হয়ে ওঠে?

তামা, ব্রোঞ্জ ও লোহা।

৩. ধ্বংসাত্মক কাজে বারুদের ব্যবহার সম্পর্কে শিক্ষা দেন কে?

রোজার বেকন।

৪. কোন জিনিসের ব্যবহার যুদ্ধ প্রক্রিয়ার জগতে বিপ্লব এনেছিল?

গোলা বারুদের ব্যবহার।

অন্যান্য ঐতিহাসিক ঘটনাগুলি

Leave a Comment