ঠান্ডা লড়াইয়ে সামরিক জোট

ঠান্ডা লড়াইয়ে সামরিক জোট প্রসঙ্গে জোট গঠনের প্রেক্ষাপট, ব্রাসেলস চুক্তি, ট্রুম্যানের ঘোষণা, আমেরিকান নেতৃত্বে গঠিত সামরিক জোট হিসেবে ন্যাটো, সিয়েটো, সেনটো, রাশিয়ার নেতৃত্বে গঠিত সামরিক জোট হিসেবে ওয়ারশ চুক্তি সংস্থা ও কমিকন সম্পর্কে জানবো।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইউরোপে সংঘটিত ঠান্ডা লড়াইয়ে সামরিক জোট প্রসঙ্গে ঠান্ডা লড়াইয়ে সামরিক জোট গঠনের প্রেক্ষাপট, ঠান্ডা লড়াইয়ের প্রেক্ষিতে ট্রুম্যানের ঘোষণা, ঠান্ডা লড়াইয়ে সামরিক জোট ন্যাটো, ঠান্ডা লড়াইয়ে সামরিক জোট সিয়েটো, ঠান্ডা লড়াইয়ে সামরিক জোট সেনটো, ঠান্ডা লড়াইয়ে সামরিক জোট ওয়ারশ চুক্তি সংস্থা ও ঠান্ডা লড়াইয়ে সামরিক জোট কমিকন সম্পর্কে জানব।

ঠান্ডা লড়াইয়ে সামরিক জোট

ঐতিহাসিক ঘটনাঠাণ্ডা লড়াইয়ে সামরিক জোট
ন্যাটো১৯৪৯ খ্রি
সিয়েটো১৯৫৪ খ্রি
সেনটোআমেরিকা
আনজাস১৯৫১ খ্রি
ওয়ারশ চুক্তি সংস্থা১৯৫৫ খ্রি
কমিকনরাশিয়া
ঠান্ডা লড়াইয়ে সামরিক জোট

ভূমিকা :- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-এর পর আমেরিকা ও রাশিয়ার নেতৃত্বে যে ছায়া যুদ্ধ বা ঠান্ডা লড়াই শুরু হয়। এই পরিস্থিতিতে দুটি দেশই নিজের নিজের সামরিক জোট গঠন করতে উদ্যত হয়।

সামরিক জোট গঠনের প্রেক্ষাপট

  • (১) ইউরোপ-এ সোভিয়েত রাশিয়ার আধিপত্য ও সাম্যবাদের প্রসার রোধের উদ্দেশ্যে আমেরিকা ট্রুম্যান নীতিমার্শাল পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল। ইতিমধ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্টের দপ্তরে ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে জমা দেওয়া এক গোপন গোয়েন্দা রিপোর্টে জানানো হয় যে, রুশ লালফৌজ পশ্চিম ইউরোপে আঘাত হানতে প্রস্তুত।
  • (২) এ ছাড়া সাম্যবাদী আগ্রাসনের ফলে ইতিমধ্যে ঘটে যাওয়া চেকোশ্লোভাকিয়ার অভ্যুত্থান (১৯৪৮ খ্রি.), রাশিয়া কর্তৃক বার্লিন অবরোধ (১৯৪৮ খ্রি.), রাশিয়ার সফল আণবিক বোমার পরীক্ষা (১৯৪৯ খ্রি.), চিনে সমাজতান্ত্রিক সরকারের প্রতিষ্ঠা (১৯৪৯ খ্রি.) প্রভৃতি ঘটনায় পাশ্চাত্য রাষ্ট্রগুলি আতঙ্কিত হয়।
  • (৩) এই পরিস্থিতিতে তারা সমবেতভাবে রুশ ও সাম্যবাদী আগ্রাসনের মোকাবিলা করার উদ্দেশ্যে একে একে কয়েকটি সামরিক জোট গঠন করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে রাশিয়ার নেতৃত্বেও পাল্টা সামরিক জোট গড়ে ওঠে।

ব্রাসেলস চুক্তি

সোভিয়েত রাশিয়ার আধিপত্য ও পূর্ব ইউরোপে সাম্যবাদী ভাবধারার সম্প্রসারণে আতঙ্কিত হয়ে ব্রিটেন, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ড, লুক্সেমবুর্গ প্রভৃতি দেশগুলি ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে ব্রাসেলস চুক্তি স্বাক্ষর করলে আমেরিকা এই চুক্তিকে স্বাগত জানায়।

ট্রুম্যানের ঘোষণা

মার্কিন রাষ্ট্রপতি ট্রুম্যান ঘোষণা করেন, “আমি নিশ্চিত যে, ইউরোপের মুক্ত দেশগুলির নিজেদের আত্মরক্ষার দৃঢ় সংকল্পকে আমাদের পক্ষ থেকে অনুরূপ দৃঢ়তা সহকারে সহায়তা করা হবে।”? যুদ্ধের সময় পারস্পরিক সহযোগিতাই ছিল ব্রাসেলস চুক্তির উদ্দেশ্য।

আমেরিকার নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট

আমেরিকা উপলব্ধি করে যে, পশ্চিমি রাষ্ট্রগুলির নিরাপত্তার জন্য শুধু আর্থিক সহযোগিতা যথেষ্ট নয়, পারস্পরিক সামরিক সাহায্যও বিশেষ প্রয়োজন। এই প্রেক্ষাপটে চুক্তির মাধ্যমে আমেরিকার নেতৃত্বে কয়েকটি সামরিক জোট প্রতিষ্ঠিত হয়। এগুলির মধ্যে অন্যতম হল –

(ক) ন্যাটো

এক্ষেত্রে বিভিন্ন দিক গুলি হল –

(১) ন্যাটো গঠন

ইউরোপের বেলজিয়াম, কানাডা, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, আইসল্যান্ড, ইতালি, লুক্সেমবার্গ, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, পোর্তুগাল, ব্রিটেন এবং উত্তর আমেরিকা মহাদেশের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতি ১২টি দেশ ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ৪ এপ্রিল ওয়াশিংটনে সমবেত হয়ে উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংস্থা বা ন্যাটো (NATO) গঠন করে। গ্রিসতুরস্ক ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে এবং পশ্চিম জার্মানি ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে এর সদস্য হয়। সদস্য রাষ্ট্রগুলি শান্তিপূর্ণ পথে আন্তর্জাতিক বিবাদের মীমাংসা করার প্রতিশ্রুতি দেয়।

(২) চুক্তির শর্তাবলি

ন্যাটো চুক্তির দ্বারা স্থির হয় যে, কোনো সদস্য রাষ্ট্র বৈদেশিক শক্তির দ্বারা আক্রান্ত হলে সকল সদস্য রাষ্ট্র যৌথভাবে সেই আক্রমণ প্রতিহত করবে। পারস্পরিক আর্থিক সাহায্যের আদানপ্রদানের মাধ্যমে সদস্য রাষ্ট্রগুলি নিজেদের অর্থনৈতিক উন্নতির চেষ্টা করবে।

(৩) সামরিক পদক্ষেপ

রাষ্ট্রপতি ট্রুম্যান ন্যাটোকে অস্ত্র সরবরাহ করার উদ্দেশ্যে মার্কিন কংগ্রেসে প্রস্তাব তোলেন। ন্যাটোর কার্যকারিতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে ন্যাটোর সদস্যভুক্ত পশ্চিম জার্মানির অস্ত্র বৃদ্ধিকে সমর্থন করা হয়। আমেরিকার দিক থেকে ন্যাটোকে একটি প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা বলে উল্লেখ করা হলেও ন্যাটোর কার্যাবলি থেকে এর সামরিক আগ্রাসনের দিকটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মার্কিন সেনাপ্রধান আইজেনহাওয়ার মন্তব্য করেন যে, সাম্যবাদী সোভিয়েত রাশিয়া কর্তৃক পৃথিবীর শান্তি ও নিরাপত্তা ধ্বংস করার চেষ্টার বিরুদ্ধে ন্যাটো গঠিত হয়।

(খ) সিয়াটো

এক্ষেত্রে বিভিন্ন দিক গুলি হল –

(১) সিয়াটো গঠন

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলকে কমিউনিস্ট আগ্রাসন থেকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে আমেরিকার নেতৃত্বে ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে কেন্দ্র করে ‘দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া চুক্তি সংস্থা’ বা ‘সিয়াটো’ (SEATO) গড়ে ওঠে।

(২) সদস্য

সিয়াটোর সদস্য আটটি রাষ্ট্র হল আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড ও ফিলিপিনস। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে কমিউনিস্ট আগ্রাসন থেকে রক্ষার উদ্দেশ্যে এই সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হলেও এই অঞ্চলের মাত্র দুটি দেশ থাইল্যান্ড ও ফিলিপিনস এর সদস্য ছিল।

(গ) সেনটো

এক্ষেত্রে বিভিন্ন দিক গুলি হল –

(১) সেনটো গঠন

মধ্যপ্রাচ্যে রুশ আগ্রাসন প্রতিরোধ করা এবং এখানকার তৈল সম্পদের ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে আমেরিকার মদতে মধ্যপ্রাচ্যকে কেন্দ্র করে ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে ‘মধ্যপ্রাচ্য প্রতিরক্ষা সংস্থা বা ‘মেডো’ (Middle East Defence Organisation বা MEDO) গঠিত হয়। বাগদাদে স্বাক্ষরিত এই চুক্তি ‘বাগদাদ চুক্তি’ নামেও পরিচিত। পরবর্তীকালে এই চুক্তির নাম হয় ‘মধ্য এশিয়া চুক্তি সংস্থা’ বা ‘সেনটো’ (Central Treaty Organisation বা CENTO)।

(২) সদস্য

‘মধ্য এশিয়া চুক্তি সংস্থা’ বা ‘সেনটো’র সদস্য ছিল ব্রিটেন, পাকিস্তান ও ইরান।

(ঘ) অন্যান্য সংস্থা

উক্ত সামরিক সংস্থাগুলি ছাড়াও আমেরিকা বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যেসব আঞ্চলিক চুক্তি স্বাক্ষর করে সেগুলি হল –

  • (১) আমেরিকা ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে লাতিন আমেরিকার দেশগুলির সঙ্গে আন্তঃ-আমেরিকা পারস্পরিক সহায়তা চুক্তি’ (Inter-American Treaty of Reciprocal Assistance) বা রিও চুক্তি (RIO Treaty) স্বাক্ষর করে।
  • (২) আমেরিকা প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে ‘আনজাস’ (ANZUS) চুক্তি স্বাক্ষর করে।
  • (৩) এ ছাড়া আমেরিকা ফিলিপিনস (১৯৫১ খ্রি.), জাপান (১৯৫১ খ্রি.), দক্ষিণ কোরিয়া (১৯৫৩ খ্রি.), তাইওয়ান (১৯৫৪ খ্রি.) প্রভৃতি দেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক নিরাপত্তা চুক্তি স্বাক্ষর করে।

রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট

রুশ সম্প্রসারণ ও সাম্যবাদের অগ্রগতি রোধ করার উদ্দেশ্যে মার্কিন নেতৃত্ব ও মদতে ন্যাটো, সিয়াটো-সহ কয়েকটি সামরিক জোট গঠিত হলে সোভিয়েত রাশিয়া-সহ পূর্ব ইউরোপের কমিউনিস্ট দুনিয়া নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কায় ভুগতে শুরু করে। এই পরিস্থিতিতে তারাও রাশিয়ার নেতৃত্বে সামরিক জোট গড়ে তোলে। সোভিয়েত রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট হিসেবে উল্লেখযোগ্য হল –

(ক) ওয়ারশ চুক্তি

এক্ষেত্রে বিভিন্ন দিক গুলি হল –

(১) চুক্তি স্বাক্ষর

রাশিয়ার নেতৃত্বে পূর্ব ইউরোপের কয়েকটি কমিউনিস্ট রাষ্ট্র এবং ইউরোপের বাইরে অবস্থিত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র চিনকে নিয়ে ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দের ১৪ মে গঠিত হয় ‘ওয়ারশ চুক্তি সংস্থা’ (Warsaw Treaty Organization বা WTO) যা সাধারণভাবে ‘ওয়ারশ চুক্তি’ নামে পরিচিত।

(২) সদস্য রাষ্ট্র

ওয়ারশ চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্রগুলি হল সোভিয়েত রাশিয়া, পোল্যান্ড, রুমানিয়া, বুলগেরিয়া, আলবেনিয়া, পূর্ব জার্মানি, হাঙ্গেরি, চেকোশ্লোভাকিয়া, চীন প্রভৃতি রাষ্ট্র।

(৩) চুক্তির শর্তাবলি

ওয়ারশ চুক্তিতে বলা হয়েছিল –

  • [i] সদস্য রাষ্ট্রগুলি তাদের সেনাবাহিনী একটি ‘সম্মিলিত কমান্ড’-এর অধীনে রাখবে।
  • [ii] চুক্তিভুক্ত দেশগুলি কোনো বহিঃশত্রুর দ্বারা আক্রান্ত হলে তারা পরস্পরকে সাহায্য করবে।
  • [iii] চুক্তিভুক্ত সদস্য রাষ্ট্রগুলি অন্য কোনো সামরিক চুক্তিতে যোগ দিতে পারবে না।
(৪) সদস্যপদ ত্যাগ

সদস্যপদ প্রত্যাহারের বিষয়ে ওয়ারশ চুক্তিভুক্ত দেশগুলির স্বাধীনতা ছিল না। ফলে হাঙ্গেরি এবং চেকোশ্লোভাকিয়া এই চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার উদ্যোগ নিলে রাশিয়া সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে তা প্রতিহত করেছিল। অবশ্য আলবেনিয়ার গুরুত্ব তুলনামূলকভাবে কম হওয়ায় সে ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে এই চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছিল।

(খ) কমিকন

রাশিয়ার নেতৃত্বে ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে গঠিত হয় ‘পারস্পরিক অর্থনৈতিক সহযোগিতা সংস্থা’ বা ‘কমিকন’ (Council for Mutual Economic Assistance বা COMECON)। এটি সামরিক সংস্থা না হলেও সামরিক জোটের সহায়ক হিসেবে কাজ করত।

উপসংহার :- প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে সোভিয়েত রাশিয়ার ভাঙনের পর তার শক্তি বহুল পরিমাণে হ্রাস পায়। ফলে বিশ্বে দ্বিমেরুতার অবসান ঘটে এবং আমেরিকার নেতৃত্বে একমেরু বিশ্ব গড়ে ওঠে। রাশিয়া ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দের ২০ মে আমেরিকার নেতৃত্বাধীন ন্যাটো জোটের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং ৮ জুলাই পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি এবং চেক প্রজাতন্ত্রও ন্যাটোর সদস্যপদ লাভ করে। ২০০৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ন্যাটোর সদস্য সংখ্যা ছিল ২৮।

(FAQ) ঠান্ডা লড়াইয়ে সামরিক জোট সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. ন্যাটো গঠিত হয় কখন?

৪ এপ্রিল ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে।

২. সিয়েটো গঠিত হয় কখন?

১৯৫৪ খ্রি।

৩. সেনটো গঠিত হয় কখন?

১৯৫৫ খ্রি।

৪. আনজাস গঠিত হয় কখন?

১৯৫১ খ্রি।

৫. ওয়ারশ চুক্তি সংস্থা গঠিত হয় কখন?

১৪ মে ১৯৫৫ খ্রি।

৬. কখন কার নেতৃত্বে কমিকন গঠিত হয়?

১৯৪৯ খ্রি।

Leave a Comment