ভারতের মোঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের অন্দরমহল প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীরের অন্দরমহলের পরিবেশ, জাহাঙ্গীরের অন্দরমহলের পত্নী-উপপত্নী, জাহাঙ্গীরের অন্দরমহলের পরিচারিকা ও জাহাঙ্গীরের অন্দরমহলের ইতিহাস সম্পর্কে জানব।
মোঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের অন্দরমহল
ঐতিহাসিক বিষয় | জাহাঙ্গীরের অন্দরমহল |
সাম্রাজ্য | মোঘল সাম্রাজ্য |
সম্রাট | জাহাঙ্গীর |
হিন্দু মহিষী | মানবাঈ |
প্রেমিকা | আনারকলি |
প্রধান মহিষী | নূরজাহান |
শেখ সেলিমের আশ্রয়ে আকবরের জ্যেষ্ঠ পুত্রের জন্ম হয়েছিল বলে সম্ৰাট আকবর তার পুত্রের নাম রেখেছিলেন সুলতান সেলিম। আর পিতা আকবরের মৃত্যুর (১৭ অক্টোবর ১৬০৫) এক সপ্তাহ পরে যুবরাজ সেলিমের রাজ্যাভিষেক হল হিজরি ১০১৪ সন, জামাদা-স্সানি মাসের ২০ তারিখ, বুহস্পতিবার – ইংরেজি ২৪ অক্টোবর ১৬০৫ খ্রিস্টাব্দ। আটত্রিশ বছরের এই নতুন সম্ৰাট নিজের নাম পরিবর্তন করতে চাইলেন রোম-এর সম্রাটদের অনুকরণে। তিনি ভাবলেন জাহাঙ্গীর অর্থাৎ তার নাম হওয়া উচিত পৃথিবীর অধীশ্বর এবং সম্মানজনক পদবী হওয়া উচিত নুরউদ্দীন। কারণ তার সিংহাসনে প্রথম উপবেশনের সময় সূর্য তুঙ্গস্থানে অবস্থান করে পৃথিবীতে উজ্জল আলোক বিকিরণ করে চলেছিল। তাছাড়া তিনি সাধুসন্তদের কাছে শুনেছিলেন যে সম্রাট জালালুদ্দীন আকবরের রাজত্ব শেষ হওয়ার পর জনৈক নুরউদ্দীন ভারত-এর সম্ৰাট হবেন। সেজন্য অভিষেকের সময় তিনি ‘নুরউদ্দীন মহম্মদ জাহাঙ্গীর পাদশাহ’ নাম নিয়ে সিংহাসনে আরোহণ করলেন।
তা বলে একথা ভাবার কারণ নেই যে এই আটত্রিশ বছর পর্যন্ত তিনি কৌমার্যব্রত ধারণ করে এসেছিলেন। আনারকলির সঙ্গে তার সুখ্যাত প্রেমের দীর্ঘ কাহিনী তার যৌবনাবস্থাতেই ঘটেছিল। কিন্তু সে কাহিনী আমরা ইচ্ছে করেই বিস্তৃত করছি না, কারণ জাহাঙ্গীরের হারেমে তার স্থান হল কই? জাহাঙ্গীরের বিশাল হারেমে বিবাহিত তার প্রথম পত্নী হয়ে যিনি এলেন, তিনি তার মায়ের মতই মুসলমান কন্যা নন, রাজপুত হিন্দু রমণী। নাম তার মানবাঈ। তিনি অন্বর-জয়পুরের অধিপতি রাজা ভগবানদাসের কন্যা। তার আরও একটা পরিচয় তিনি এক হিসেবে (পালিত) কুনওয়ার মান সিংহ-এর ভগ্নী। এই মহারাজা মানসিংহের পিসিমার সঙ্গেই তো সম্রাট আকবরের বিবাহ হয়। ভগবান দাস সে সময়ে ছিলেন পাঞ্জাবের শাসনকর্তাও।
ভগবানদাস নিজে থেকেই তার কন্যার বিয়ের প্রস্তাব দেন – আবুল ফজল এমন কথাই বলেছেন। তারপর এল সেই শুভদিন ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৫৮৫। স্বয়ং সম্ৰাট পুত্র জাহাঙ্গীর ও অন্যান্য বরযাত্রীদের নিয়ে রাজপুত রাজার রাজ্যে গেলেন শুভক্ষণ দেখে। দারুণ জাঁকজমক আর উৎসব-এর মধ্যে বিয়ে সমাপ্ত হল। হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ই কন্যাদান প্রত্যক্ষ করলেন। প্রথমেই কাজীদের উপস্থিতিতে নিকার কাজ সারা হল। সম্রাট দু কোটি তঙ্কা পণ হিসেবে কন্যার পিতার হাতে তুলে দিলেন।
এর পরেই বিয়ে হল হিন্দু মতে – অগ্নি প্রদক্ষিণ করা হল, মালাবদল হল। এবার ভগবানদাসের সম্মান জানানোর পালা। তিনিও পণ হিসাবে বহুমূল্য উপহারাদি দিলেন। এর মধ্যে ছিল অনেকগুলো ঘোড়া, একশো হাতী, অনেক পুরুষ ও স্ত্রী পরিচারক-পরিচারিকা (এরা কেউ ছিলেন ভারতীয়, অন্যেরা আবিসিনীয় অথবা রুশীয় ), রত্নাদিখচিত পাত্র-সমূহ, প্রচুর হীরাজহরৎ – সে সবের হিসেব করা অসম্ভব। প্রত্যেক জায়গীরদার যারা বরযাত্রী হিসেবে এসেছিলেন, পেলেন পাশা, তুৰ্কী, আরবী ঘোড়া – তাতে সোনার রেকাব লাগানো – পদমর্যাদা অনুসারে ৷ রাজার বাড়ি থেকে নিজের শিবির পৰ্যন্ত রত্নাদি আর টাকা ছড়াতে ছড়াতে বৌ নিয়ে ফিরে এলেন সম্ৰাট আকবর। দারুণ খাওয়াদাওয়া হল চারিদিকে উৎসবের সাড়া পড়ে গেল। এমন করে বরযাত্রী নিয়ে গিয়ে সসন্মানে কন্যাকে নিয়ে আসা বুঝি মোগল সম্রাটদের ইতিহাসে নেই। আর মুসলমান এবং হিন্দু উভয় রীতিকেই সম্মান দিয়ে বিয়ে দানের
ইতিহাসও বুঝি খুঁজে পাওয়া যাবে না। রাণা এবং রাণী দুজনে মিলে কন্যা দান করেছিলেন – আকবরের হিন্দুধর্মের প্রতি ঔদাৰ্যবশতঃই এসব কাজ সম্ভব হয়েছিল।
আর যে কন্যাটি বধূ হয়ে সেলিমের অন্তঃপুরে প্রবেশ করলেন তার রূপের কথা আর কি বলবো। তার বুকের অনন্ত প্রেম এবং রূপের অসীম সমুদ্র নিয়ে তিনি অচিরে জাহাঙ্গীরের প্রিয়তমা মহিষী হয়ে গেলেন। দুজনে মগ্ন হয়ে রইলেন এক গভীর স্বপ্নাবেশে প্রায় উনিশ বছরের ঘনিষ্ঠ জীবনে। সসম্মানে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তাঁর এই প্রথম বধূটিকে শাহ্ বেগম এই সম্মানজনক পদবী দিয়ে।
ঝিলামের কাছে এক শিবিরে জাহাঙ্গীর যখন এই বধুটিকে নিয়ে ছিলেন তখনই তার প্রথম কন্যার জন্ম দিলেন মানবাঈ ২৫ এপ্রিল ১৫৮৬ খ্রিস্টাব্দে, বিয়ের এক বছর দু মাস পরে। এই কন্যার নাম ছিল সুলতান-উন-নিসা বেগম। ষাট বছর বয়সে কুমারী অবস্থাতেই পরে এই কন্যার মৃত্যু হয়। আর তিনি জন্ম দিয়েছিলেন তার প্রথম পুত্রেরও। খশরুর। সেদিনটি ছিল ৬ আগস্ট ১৫৮৭ খ্রিষ্টাব্দ। হতভাগ্য খশরুর মা তিনি। হতভাগিনী নিজেও। পুত্র জন্ম দিয়েছেন বলে শাহ বেগম উপাধির যে আনন্দ, তা তো ঐ পুত্র থেকেই উপভোগে বঞ্চিত হয়েছিলেন। খশরু জ্যেষ্ঠপুত্ৰ হিসেবে বার বার দাবী করেছে পরবর্তী সিংহাসনাধিকারের অধিকার। খশরু পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন। বিপুল বাহিনী নিয়ে জাহাঙ্গীর এগিয়ে গেলেন বিদ্রোহী পুত্রকে সমুচিত শিক্ষা দিতে। এতো চঞ্চল হয়ে পড়েছিলেন তিনি যে আফিং-এর নেশা পর্যন্ত করতে ভুলে গেছিলেন সেদিন। পাঞ্জাবের কাছে জলন্ধরে যুদ্ধ হল। খশরু পরাস্ত হলেন। তাকে হাতে পায়ে বেঁধে নিয়ে আসা হল জাহাঙ্গীরের কাছে। প্রবল তিরস্কার করে সম্রাট পিতা তাকে নিক্ষেপ করলেন বন্দীশালায়। তারপর এক মর্মন্তদ কাহিনী।
এমন এক অসম ও অবাঞ্ছিত যুদ্ধ থেকে সরে আসার জন্য মানবাঈ বার বার পুত্রকে অনুরোধ করেন। বলেন বাবা বেঁচে থাকতে সিংহাসনের উপর লোভ করিস নে বাবা ৷ এদিকে নিজের ভাই মাধো সিং বিদ্রোহী পুত্রের পক্ষাবলম্বন করেছেন। দারুন তিরস্কার করেছিলেন বইকি জাহাঙ্গীর এজন্য প্রিয়তমা পত্নীকে এমনিতেই ঘরে আবার এনেছেন আরও একটি রাজপুত কন্যাকে তার সতীন করে। তার উপরে পুত্রের বিদ্রোহ, ভাইয়ের বিরুদ্ধতা এবং স্বামীর অপ্রেম উন্মাদিনী করে তুলল মানবাঈকে। কিছুতেই মনের ভারসাম্য রক্ষা করতে পারলেন না এই কোমল মনের অধিকারিণীটি।
সেদিন সেলিম গেছেন মৃগয়ায়। সতীন মানমতীর সঙ্গে মানবাঈ-এর চুড়ান্ত ঝগড়া হয়ে গেছে স্বামীর আফিমের ডিববাটি নামিয়ে আনলেন সন্তর্পণে। তারপর একটা বিশাল আফিমের দলা ডেলা পাকিয়ে মুখে পুরে দিলেন। তার উনিশ বছরের দাম্পত্য প্রেমের অবসান ঘটল এই আত্মহননে। খবর পেয়েই ছুটে চলে এলেন জাহাঙ্গীর মৃগয়া ছেড়ে। তরপর গভীর শোকে লুটিয়ে পড়লেন মৃতা পত্নীর মরদেহের উপর। তখনও তো তিনি সম্ৰাট হয়ে সিংহাসনে বসেন নি।
জাহাঙ্গীর লিখেছেন তার ‘জাহাঙ্গীরনামা’ আত্মচরিতে “পুত্রের ব্যবহারে ও চালচলনে এবং তার ভাই মাধো সিংহের কদর্য আচরণে ক্ষুব্ধ ক্ষুব্ধ হয়ে আমার স্ত্রী আমি সম্রাট পুত্র থাকাকালেই আফিং খেয়ে আত্মহত্যা করেন ৷ তার গুণাবলী ও মহত্বের কথা কি লিখব? অদ্ভুত বুদ্ধিমতী ছিলেন তিনি ৷ আমার প্রতি তার অনুরাগ এত গভীর ছিল যে আমার একটি কেশের জন্য তিনি হাজার পুত্র, হাজার ভাই ত্যাগ করতে পারতেন। খশরুকে তিনি প্রায়ই লিখে পাঠাতেন এবং বিশেষ জোর দিয়ে জানাতেন যেন সে আমার প্রতি অকপট হয় এবং আমাকে ভালোবাসে। যখন তিনি দেখলেন যে তার উপদেশে কোনও ফল হবে না এবং পুত্র যে কত দূর বিপথে যাবে তাও যখন অজ্ঞাত, তখনই তিনি রাজপুত চরিত্রের স্বভাবসিদ্ধ তেজের প্রাবল্যে ঘৃণায় প্রাণত্যাগ করাই মনস্থ করলেন। তার মন অনেক সময়েই বিক্ষিপ্ত হয়ে থাকত। এই ভাবটা তাদের বংশগত। তার পূর্বপুরুষ ও ভাইদের মধ্যে কারও কারও উন্মত্ততার লক্ষণ দেখা গেছে ৷ আবার কিছুদিন পরই এই ভাবটা চলে যেত। হিজরী ১০১৩ সনের জিলহিজ্জা মাসের ২৬ তারিখ (৬ মে ১৬০৫) যখন আমি শিকারের জন্য বাইরে আছি তখন তিনি মনের উত্তেজনায় খানিকটা আফিং খান এবং খুব তাড়াতাড়ি মারা যান ৷ তার অপদার্থ পুত্রের এখনকার ব্যবহার যেন তিনি তখনই জানতে পেরেছিলেন।
“আমার যৌবনের প্রারম্ভেই তার সঙ্গে আমার প্রথম বিবাহ। খসরুর জন্ম হলে তাকে আমি শা বেগম উপাধি দিই। তার ছেলে এবং ভাইয়ের আমার প্রতি অসদাচরণ তিনি সহ্য় করতে পারেন নি। জীবনে বীতস্পৃহ হয়ে তিনি আত্মহত্যা করলেন। এইভাবে তিনি এখানকার দুঃখ থেকে রেহাই পেয়ে গিয়েছেন। তার প্রতি, আমার প্রবল ভালবাসার জন্য এই মৃত্যুতে আমি এমন মুহ্যমান হয়ে পড়ি যে কয়েকদিন কোনও রকম আনন্দ উপভোগ করি নি, যেন আমার জীবনের অস্তিত্বই ছিল না। চারদিন, অর্থাৎ বত্রিশ প্রহর কোনও খাদ্য বা পানীয় গ্রহণ করি নি। আমার মহামান্য পিতা একথা জানতে পেরে আমাকে স্নেহপূর্ণ বাক্যে সান্তনা দিয়ে দুঃখ প্রকাশ করে চিঠি লেখেন৷”
যে সতীনের সঙ্গে মানবাঈ-এর কলহ হয়েছিল বলে ঐতিহাসিকেরা বলেছিলেন, তিনিও ছিলেন হিন্দু এবং রাজপুত রমণী। দুজনের নামের সঙ্গেও আশ্চৰ্য মিল। মানবাঈ আর মানমতী। মানমতী ছিলেন রাজা উদয় সিংয়ের কন্যা। মানমতী আর বালমতী যে নামই তার থাক, সে নাম পরে দেওয়া হয়েছিল মনে হয়। তার আসল নাম ছিল বেটাছেলের মত – জগৎ গৌঁসাই। তাই বুঝি নাম বদল করা হয়েছিল। ঐ সতীনের সঙ্গে ভালবেসে ঘর করবে বলেই হয়তো ৷ পরে অবশ্য যোধপুরের রাজকন্যা বলে যোধাবাঈ হিসেবেও তিনি সুপরিচিত হন।
দ্বিতীয় বধূ হিসেবে জাহাঙ্গীরের হারেমে মানমতী আসেন ১৫৮৬ খ্রিষ্টাব্দে-মানবাঈ-এর বিয়ের এক বছরের মধ্যেই। মানবাঈ নিশ্চয়ই পছন্দ করেন নি এই বিবাহ। একটা নিঃসপত্ন অধিকারে যখন বাধা পড়ল, তখনই তার মানসিক ভারসাম্য নষ্ট হতে আরম্ভ করেছিল। সতী নারী সব পারে, স্বামীকে সতীনের হাতে তুলে দিতে পারে না। কিন্তু মোগল সম্রাটের অন্দরমহল-এ ঢুকে সতীত্বের গর্ব করবো, সতীনের জ্বালা সইবো না, তা তো হতে পারে না। তাই নিজের জ্বালা তিনি নিজেই মিটিয়ে গিয়েছিলেন। মহিলাদের সম্পর্কে জাহাঙ্গীরের দুৰ্বলতা ছিল খুবই। পিতার উপযুক্ত পুত্র সেদিক থেকে।
মানমতী বা যোধাবাঈ ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন জাহাঙ্গীরের পুত্ৰ খুররমের জননী হিসাবে। প্রিয়তম ইনিই পরে শাহজাহান নামে খ্যাত এবং জাহাঙ্গীরের জ্যেষ্ঠ পুত্র না হয়েও মোগল সাম্রাজ্যের পরবর্তী সম্রাট। জাহাঙ্গীর তার এই রূপসী বধুটি সম্পর্কে আত্মজীবনীতে লিখেছেন – “মোটা রাজার কন্যা জগৎ গোঁসাইয়ের গর্ভে আমার পিতার রাজত্বের ছত্রিশ বছরে ৯৯৯ হিজরি সনে লাহোরে আমার পুত্র সুলতান খুররমের জন্ম হয়। তার জন্মে পৃথিবী আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। . . . . সে আমার অন্য সব ছেলেমেয়ের চেয়ে আমার পিতার দিকে বেশী দৃষ্টি দিত। আমার পিতাও তার ব্যবহারে অত্যন্ত সন্তুষ্ট ছিলেন ৷ আমাকে তাঁর গুণের কথা শুনিয়ে বলতেন যে তার সঙ্গে আমাদের অন্য কোনও ছেলেমেয়ের তুলনাই হয় না। সে-ই ছিল তার প্রকৃত নাতি ৷”
লক্ষ্য করার বিষয় জাহাঙ্গীরের সঙ্গে মানমতীর বিয়ে হয় ১৫৮৬ খ্রিষ্টাব্দে আর শাহজাহানের জন্ম হয় ৫ জানুয়ারি ১৫৯২ খ্রিষ্টাব্দে বিয়ের ছ’বছর পরে। কে জানে মানবাঈ মানমতীকে স্বামী অঙ্কশায়িনী হতে দিতে দেরী করেছিলেন কিনা !
আকবর প্রথম বার কাশ্মীরে যান ১৫৮৯ খ্রিষ্টাব্দে। সেখানকার রাজারা ভয় পেয়ে আকবরকে প্রভূত উপঢৌকন পাঠিয়ে তার বশ্যতা স্বীকার করলেন। ছোট তিব্বতের অধিপতি আলী রাই নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবে আকবরের কাছে এসে যুবরাজ সেলিমের সঙ্গে তার কন্যার বিবাহের প্রস্তাব করলেন। আকবর সানন্দে প্রস্তাব গ্রহণ করলেন। সেই মতো মেয়েটিকে নিয়ে আসা হল লাহোরে এবং ১ লা জানুয়ারি ১৫৯২ খ্রিষ্টাব্দে সেলিমের সঙ্গে তার বিয়ে হয়ে গেল। জাহাঙ্গীর হারেম আরও একটু বৃদ্ধি পেল।
এর ঠিক পরের বছরটিতেই তার হারেমে এলেন আর এক সুন্দরী, দাক্ষিণাত্যের কন্যা। তার বাবা ছিলেন খান্দেশের অধিপতি রাজা আলিখান। আলি রাই-এর পর আলিখানের কন্যা এলেন হারেমে। সেও ঐ বশ্যাতা স্বীকারের উপহার হিসেবে। এসব বিয়েতে সম্মান থাকে না, বধূর সসম্মান স্বীকৃতিও থাকে না। এসব কন্যা শুধু উপভোগের সামগ্রী হয়, মনের কোণেও এরা স্থান পান না।
কিন্তু প্রবল ভালবাসার দাবীতে এসেছিলেন জৈন খান কোকার কন্যা জাহাঙ্গীরের হারেমে। ১৫৯৬ খ্রিষ্টাব্দের জুন মাস। সেলিম মাঝে মাঝে পিতৃদ্রোহিতার লক্ষণ দেখাচ্ছেন। এরই মধ্যে এই মেয়েটির সঙ্গে গভীরভাবে প্রেমে পড়ে গেছেন জাহাঙ্গীর। পিতার কাছে বলে পাঠালেন এই মেয়েটিকে তিনি বিয়ে করতে চান। আকবর পুত্রের ঔদ্ধত্য দেখে দারুণ রেগে গেলেন। বললেন – না, হবে না এ বিয়ে। সেলিমও ক্ষুন্ন হলেন। পিতাকে একটুও কেয়ার না করে সুন্দরীর সঙ্গে মত্ত হলেন নর্ম বিলাসে। আকবর দেখলেন এই দুর্বিনীতটাকে বাগে আনা বচ্ছে না। বাধ্য হয়ে শেষে বিবাহে সম্মতি দিলেন। খুবই অসম্মান বোধ করলেন অবশ্য তিনি।
জাহাঙ্গীরের অন্দরমহলে অতএব এলেন আরও এক সুন্দরী। মানবাঈ বোধকরি আরও হতাশ হলেন। কারণ জাহাঙ্গীর যে তাঁকে ভালবেসে ঘরে আনলেন। শুধু তাই নয় সেই সুত্রে এলেন আরও এক এর অপরূপ সুন্দরী সাহিব জমাল। সাহিব জমাল হলেন ঐ জৈন খান কোকার জ্ঞাতি ভগ্নী। আর সাহিব জমাল শব্দের অর্থ সৌন্দর্যের রাণী। এরই গর্ভে কাবুলে জন্মগ্ৰহণ করেন জাহাঙ্গীরের দ্বিতীয় পুত্র পরভেজ।
এর মধ্যে হারেমে হাজির হয়েছে শতক খানেক উপপত্নী রক্ষিতার দল। তাদের কেউ কেউ জাহাঙ্গীরের সন্তানদেরও গর্ভে ধারণ করেছেন। এঁদের কারও কারও কথা আবার সগর্বে জাহাঙ্গীর ঘোষণাও করেছেন। আসলে যার যত উপপত্নী, তারই তো তত গর্ব আর সন্মান৷ জাহাঙ্গীর লিখেছেন, ‘খুরমের জন্মের পর আমার উপপত্নীদের গর্ভে আরও কয়েকটি সন্তান হয়। তাঁদের মধ্যে একজনের নাম দিই জাহান্দার ও আর এক জনের নাম শাহরিয়ার।’ শেষ জনকে সিংহাসন পাইয়ে দেওয়ার ব্যাপারটি নিয়েই জাহাঙ্গীরের শেষ জীবনের নাটক বেশ জমে উঠেছিল।
এঁরা ছাড়াও জাহাঙ্গীরের হারেমে প্রবেশাধিকার পেয়েছিলেন আরও বহু রাজপুত হিন্দু এবং মুসলমান নারীর দল। এদের মধ্যে দু-একজনের কথা বলি ৷ তারপর বলব তার আদরের নূরজাহানের কথা। বিকানীরের রায়বার সিং খুবই অনুগত হয়ে পড়েছিলেন জাহাঙ্গীরের। আমির-উল-উমারার সুপারিশে তিনি জাহাঙ্গীরের সাক্ষাৎলাভে সমর্থ হওয়ার পর জাহাঙ্গীরের প্রতি তার আনুগত্য এত বৃদ্ধি পায় যে আগ্রা ছেড়ে বিদ্রোহী পুত্র খশরুকে তিনি যখন শাস্তি দিতে চলে যান, তখন অগাধ বিশ্বাসে রায়বার সিংকে আগ্রা এবং সমগ্ৰ হারেমের ভার দিয়ে যান। এক সময়ে তিনি রায়বার সিংয়ের একটি কন্যাকেও বিবাহ করে হারেমে স্থান দিয়েছিলেন। তখন অবশ্য তিনি সম্ৰাট হয়ে সিংহাসনে বসেছেন।
তার রাজ্যাভিষেকের তৃতীয় বৎসরে তিনি বিয়ে করেন রাজা মানসিংয়ের পৌত্রীকে (পুত্র জগৎসিংয়ের কন্যা)। এ বিষয়ে জাহাঙ্গীর নিজেই লিখে গেছেন – “রাজা মানসিংয়ের জ্যেষ্ঠ পুত্র জগৎসিংয়ের কন্যাকে বিবাহ করবো দাবী করে ১৬ ই মহরম বিবাহের উপহার স্বরূপ আশি হাজার টাকা রাজার গৌরব বৃদ্ধির জন্য তার বাড়িতে পাঠিয়েছিলাম। ৪ ঠা রবিয়ল আওয়াল জগংসিংয়ের কন্যা আমার হারেমে আসেন। মরিয়ম জমানি বেগমের আবাসে বিবাহ উৎসব সম্পন্ন হয়। তার সঙ্গে যে সব যৌতুক রাজা মানসিংহ পাঠিয়েছিলেন তার মধ্যে ষাটটি
হাতিও ছিল ৷’ আর অনুরোধে পড়ে বিয়ে করেছিলেন রামচাঁদ বান্দিলার কন্যাকে। এই বিবাহ হয় তার রাজ্যাভিষেকের চতুর্থ বৎসরে ৷
এবার আসা যাক নূরজাহানের কথায়। আগেই বলে নেওয়া ভাল, ঐতিহাসিকদের মধ্যে এই আখ্যান নিয়ে মতভেদের অন্ত নেই। নূরজাহানের সঙ্গে জাহাঙ্গীরের প্রাকবিবাহ প্রেম এবং শের আফগানের হত্যা – দুটি বিষয়েই এভিহাসিকরা এখনও স্থির নিশ্চিত হতে পারেন নি। কিন্তু বেশির ভাগ ঐতিহাসিক যা মেনে নিয়েছেন তার কথা বলতে আমাদের অসুবিধা কোথায়?
মিৰ্জা ঘিয়াস বেগ ছিলেন তেহেরানের অধিবাসী খওয়াজা মহন্মদ শরীফের পুত্র। খুরাসানের শাসনকর্তা মহম্মদ খান টাকলুর অধীনে উজির ছিলেন শরীফ সাহেব। তিনি মারা গেলে পরবর্তী রাজা শাহ তাহমাস্প- এর অধীনেও তিনি উজির থাকেন। তিনি থাকতেন ইয়াজদ-এ। শরীফসাহেবের দুই পুত্ৰ, আকা তাহির আর এই ঘিয়াস বেগ। ১৫৭৭ খ্রিষ্টাব্দে তাদের বাবা মারা গেলেন। দুটি পুত্র আর একটি কন্যা নিয়ে ঘিয়াস বেগ পড়লেন দারুণ অসুবিধেয়। সম্ভ্রান্ত পিতার পুত্ৰ, কিন্তু এখন ভাগ্য হয়েছে বিপরীত। অতএব চলো সোনার দেশ ভারতে – যদি ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটে। তাই চলে এলেন হাঁটতে হাঁটতে পূৰ্ণগৰ্ভবতী স্ত্রী এবং পুত্র-কন্যাদের নিয়ে। পথে পথে দস্যু ভয়। একদিন দস্যুরা নিল তার সর্বস্ব লুণ্ঠন করে। কেঁদে গিয়ে পড়লেন যুথসাথী দলপতি মাসুদ মালিকের কাছে। তার অবস্থা দেখে দয়া হল মালিক মাসুদের। কারণ এর মধ্যে কান্দাহারের পথে যেতে যেতে ঘিয়াসের গর্ভবতী স্ত্রী জন্ম দিয়েছেন একটি শিশু-কন্যার (১৫৭৭)। এই কন্যার নাম দেওয়া হল মেহেরউন্নিসা। চোখে দেখতে পারেন না এই পরিবারের কষ্ট মালিক মাসুদ।
শেষে সকলে গিয়ে পৌছলেন ফতেপুরে, সম্রাট আকবরের দেশে ৷ প্রতিবারই বিত্তশালী মালিক মাসুদ আকবরের কাছে নানা উপহার নিয়ে হাজির হন। এবারের উপঢৌকন তেমন ভাল লাগল না আকবরের। মালিক মাসুদ মানুষ চিনতেন। তিনি বুঝেছিলেন এই ঘিয়াস বেগ সামান্য যাত্রী নয়, এর মধ্যে নানা গুণ আছে। তাই আকবরকে বললেন জহাপনা, আমার উপঢৌকন যদি ভাল না লেগে থাকে তবে কসুর মাফ করবেন। এবারে একটি ‘সজীব চীজ’ এনেছি দেখবেন নাকি ! এই বলে মির্জা ঘিয়াস বেগকে নিয়ে আকবরের কাছে হাজির হলেন। আকবর ঘিয়াস আর তার পুত্র আবদুল হাসানকে (পরে আগা খা নামেই বিখ্যাত) দেখে বাজিয়ে বুঝলেন তারা ‘আসলি চীজ’। অমনি ঘিয়াসকে একটা ভাল মাইনের চাকরি দিয়ে দিলেন আকবর। নিজের বুদ্ধিমত্তা দিয়ে ধীরে ধীরে মিৰ্জা সাহেব দেওয়ান পদে নিজেকে উন্নীত করলেন। ভারী মার্জিত এবং রুচিশীল মানুষ ছিলেন তিনি। লেখাপড়ার কাজ ভাল জানতেন, ছিল কবিতা পাঠের রসগ্রাহিতা। ধীরে ধীরে রাজত্বে এলেন জাহাঙ্গীর। তার আমলে তিনি উন্নীত হলেন তিনশতী মনসবদার থেকে দেড়হাজারী মনসবদারে আর খেতাব পেলেন ‘ইতমদ-উদ্-দৌলা’।
বাদশাহী হারেমে অনায়াস প্রবেশাধিকার ছিল মাসুদ-পত্নীর। হারেমে যাবার সময় মাঝে মাঝে সঙ্গে নিয়ে যেতেন কন্যাসম মেহেরকে আর তার মা আসমৎ বেগমকে। এর মধ্যে মেহের বড় হয়ে উঠেছেন। যে বছর সম্রাট হলেন জাহাঙ্গীর, তখন তো সে পূৰ্ণ যুবতী। কবে যে শৈশব, কৈশোর অতিক্রম করে যৌবনে পদার্পণ করেছে – তিনিও নিজে বুঝি জানেন না। অসামান্য সৌন্দর্যে ফুটে উঠেছেন মেহেরউন্নিসা – অনেকটা নিশার স্বপনের মতই ৷ যুবরাজ থাকতেই সেলিম তাকে দেখতেন। দেখতেন আর সেই মনোলোভা সৌন্দর্যে বিভোর হয়ে যেতেন। সেলিমও তো কম সুন্দর নয়, সম্রাটপুত্র বলে কথা ! দুজনের মধ্যেই কখন মদনদেবের আরতি শুরু হয়ে গেছিল কে জানে।
কথাটা ক্রমে ক্রমে কানে উঠল আকবরের। এর মধ্যে আকবর যখন লাহোরে ছিলেন সে সময়ে ইরাক থেকে দ্বিতীয় শাহ ইসমাইলের সঙ্গে এসেছিলেন আলি কুলি বেগ ইস্তাজলু। তিনি ছিলেন এডভেঞ্চারার। পারস্যাধিপতির
তিনি ছিলেন একজন সফরচি (ইংরেজিতে যাকে বলে টেবলসারভেন্ট)। তিনি এখন আকবরের রাজকীয় ভৃত্যশ্রেণীর মধ্যে একজন হলেন। ক্ৰমে তার ভাগ্যোদয় হল। যুবরাজ সেলিমের সহকারী হয়ে তিনি গেলেন মেবার-এর রানাকে জব্দ করতে। একদা একটি সিংহ (বাঘ বোধহয় নয়) মেরে জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে এই সাহসী সুদর্শন যুবক ‘শের আফগান’ (এই নামেই বিখ্যাত) উপাধি পান ৷ আকবরও এই ছেলেটিকে ভালবাসতেন ৷ তাই যখন শুনলেন যুবরাজ সেলিম গভীরভাবে প্রেমে পড়েছেন মেহেরউন্নিসার সঙ্গে, তখন সঙ্গে সঙ্গে তার মনে পড়ে গেল আলি কুলি ইস্তাজলুর কথা। আর ডেকে পাঠালেন মির্জা ঘিয়াসকে। দুজনের শলাপরামর্শ হল। তারপর যুবরাজের কথা একটুও না ভেবে মেহের-এর সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিলেন শের আকগানের ৷ ১৫৯৪ খ্রিষ্টাব্দে বিয়ে হয়ে গেল মেহের-এর। ২৪/২৫ বছরের যুবক জাহাঙ্গীর আশাহত হয়ে ফুলতে লাগলেন। আর আকবর শের আফগানকে জারগীর দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন দূর বর্ধমান-এ। দুজন দুজন থেকে অনেক দূরে গেলেন।
কিন্ত দূরে গিয়েই বোধ হয় প্রেমে বেগ আনল। জাহাঙ্গীরের হৃদয় আপাত শান্ত হলেও, অন্তরে জোয়ার বইতেই লাগল। শেষে সুযোগ এল। আকবর পাদশাহ মারা গেলেন। পরিত্যক্ত সিংহাসনে এসে বসলেন জাহাঙ্গীর পাদশাহ।
ডেকে পাঠালেন বিশ্বস্ত কুতব-উদ্দীনকে। বললেন – তাড়াতাড়ি চলে যাও বর্ধমান-এ। গিয়ে দেখা কর শের আফগানের সঙ্গে। আর সঙ্গোপনে দেখা করো মেহের-এর সঙ্গে। চুপি চুপি তাকে বলো আমার মনের গোপন ইচ্ছার কথা, তাকে চিরদিনের জন্য পাবার ইচ্ছার কথা। কুতব-উদ্দীন হলেন তার দুধভাই ৷ কুতব রওনা হয়ে গেলেন। প্রথম সুযোগেই শের আফগানকে দেখা করতে বলে পাঠালেন। কিন্তু শের তো মানুষ – তিনিও জানেন দিওয়ানা জাহাঙ্গীরের মহব্বতের কথা। মেহের তো সব ভুলে গেছে। সে তো কায়মনোবাক্যে স্বামীর প্রেমলগ্না আছে। কেন তবে সুখের সংসারে আবার আগুন জ্বালাতে কুতবকে পাঠিয়েছেন জাহাঙ্গীর। দেখা করবেন না ঠিক করেছেন তাই।
এদিকে অস্থির হয়ে পড়েছেন কুতব-উদ্দীন। তাই তার আগমনের প্রত্যাশা না করেই একদিন চলে গেলেন শের আফগানের জায়গীরে। কুতব তো নিজে বাংলার শাসনকৰ্তা এখন, ভয়ই বা কিসের। আর তারই অধীনস্থ জায়গীরদার হয়ে লোকটার এতো আস্পর্ধা যে ডেকে পাঠালে আসে না। দুর্বিনীত অবাধ্য লোকটাকে সমুচিত শিক্ষা দেবার জন্যই তিনি সসৈন্যে চলে এলেন বর্ধমান-এ (মার্চ ১৬০৭)।
শের আফগান যেন একটা দুরভিসন্ধির গন্ধ পেলেন সর্বত্র। কুতব এসে শের আফগানকে বেশ ধমক দিলেন। বোধকরি মেহেরউন্নিসাকে পাঠিয়ে দিতে বললেন জাহাঙ্গীরের হারেমেও। রক্ত ছলকে উঠল তুর্কি বীরের কলিজায়। কেউ কোনো কথা বলবার আগেই আস্তিনের নিচে লুকানো ছোরা বের করে শের আফগান আমূল বসিয়ে দিলেন কুতব-উদ্দীনের বুকে। ঢলে পড়লেন কুতব ৷ পীর অন্বাখান কাশ্মীরী বলে এক বীর সৈনিক ঝাঁপিয়ে পড়লেন শের আফগানের উপর আর তরবারি দিয়ে সোজা আঘাত হানলেন তার মাথায়। তুর্কী বীর এত সহজে হার মানে না। এক ঘুষিতে সরিয়ে দিলেন পীর খানকে। কিন্তু কুতব-এর আরও অনুচরেরা এগিয়ে এলো এবং শের আফগানের অনিবাৰ্য পতন ঘটালো। বর্ধমানের বুকে শের আফগানের কবর সেই নির্মম হত্যার সাক্ষ্য বহন করে চলেছে।
মেহেরকে অন্দরমহলে আনার প্রথম প্রয়াস ব্যর্থ করেছিলেন স্বয়ং পিতা। এবার? এবার দ্বিতীয় বাধা অপসারিত হল। শের আফগান নিহত। অতএব তার বিধবা পত্নী আর কন্যাকে নিয়ে আসা হল আগ্রায় এবং বৃদ্ধা রাণীমাতার তত্বাবধানে তাকে রাখা হল। এমনি করে দিন যেতে লাগল ৷ জাহাঙ্গীর হয়তো এরই মধ্যে কোনোদিন পাঠিয়ে দিলেন তার পূর্ব প্রণয়িনীর কাছে বিবাহের প্রস্তাব। স্বামী-হন্তাকে বিবাহের ব্যাপারে কোনো নারী কি সহজেই এই প্রস্তাব মেনে নিতে পারে ? কিন্তু ইতিমধ্যে রাজনীতিতে নতুন সমাচার দেখা দিতে আরম্ভ করেছে। মেহেরউন্নিসার ভাই আসফ খায়ের কন্যা আর্জমন্দবানু বেগমের সঙ্গে জাহাঙ্গীরের পুত্র শাহজাহান – ভবিব্যৎ ভারতের সম্রাটের বিয়ের কথা হয়েছে। এখন মেহের রাজী না হলে তো চলে না। সত্যিই জাহাঙ্গীর বাগদত্তা বধুটিকে ঘরে না এনে অন্য একটি নারীর সঙ্গে খুররমের বিয়ে দিয়ে দিলেন। তাহলে তো তার ভাইঝির পাটরাণী হওয়া যায় না। অতএব রাজী হতে হল মেহেরকে।
কথায় বলে সময় হল সবচেয়ে বড় বৈদ্য। ধীরে ধীরে স্বামীর মৃত্যুর শোক মেহেরের হৃদয়ে মন্দীভূত হতে আরম্ভ করেছিল। আর, একটা ক্ষমতার লোভ ক্রমশ তাকে গ্রাস করতে শুরু করছিল। ভারতের সম্ৰাজ্ঞী হবার প্রবল লোভ তাকে তাড়না করছিল। সামনে অজস্র সুখ হাতছানি দিতে লাগল ! সময় যত কাটে, তত ভিতরের আকাঙক্ষাটা নড়াচড়া করে ওঠে।
অবশেষে জাহাঙ্গীরের রাজ্যাভিষেকের ষষ্ঠ বর্ষে মেহেরউন্নিসার মত পরিবর্তন ঘটল। সেই উৎসব-এর একটি দিনে উভয়ের চোখে তৃষ্ণার বারি উপচে উঠল। সম্মতি পাওয়া গেল। ১৬১১ খ্রিষ্টাব্দের মে মাস। মেহের পঁয়ত্রিশ আর জাহাঙ্গীর বিয়াল্লিশ। হলেই বা পঁয়ত্ৰিশ, মেহেরের শরীরে তখন ষোড়শীর অজস্র রূপধার। মেহের, বাইরের মেহের প্রবেশ করলেন জাহাঙ্গীরের অন্দরমহলে। মানবাঈ আগেই চলে গেছেন। সেই পাটরাণীর শূন্য স্থানে অভিষিক্ত হলেন মেহের।
কিন্তু মেহের নামে তো শের আফগানের অবাঞ্ছিত স্মৃতি। জাহাঙ্গীর নিজে তো নূর। তার আলো এই রূপসী সুন্দরী। অতএব নতুন নামকরণ হল এই রূপ উজল করা মহিষীর। নাম হল নূরমহল – মহলের প্রদীপ ৷ তাই বা কেন? এতো ছোট নামে এই সুন্দরীকে তো ধরা যায় না। তিনি তো শুধু মহলের আলো নন, জগতের আলো ৷ একদিন তাই নূরমহল হয়ে গেলেন নুরজাহান। জাহাঙ্গীর এই প্রেয়সীর কাছে জীবনযৌবন ধনমান ইহসংসারের যাবতীয় আকাঙ্ক্ষা সমর্পণ করে শুধু একটু ‘সীর’ আর আফিমের নেশা আর একটু মাংসাহারেই তৃপ্ত হয়ে রইলেন ৷ চল্লিশ বছরের অনুপম সুন্দরী নূরজাহান নাম পেয়ে জগদ্বিখ্যাত হয়ে গেলেন।
মোগল হারেমের নির্বাচিত কক্ষে এবার শুরু হল জাহাঙ্গীর ও নূরজাহান-এর যৌথ জীবন। শয়নে স্বপনে নিশিজাগরণে উভয়ের প্রেম ক্রমাগত ঘনীভূত হতে থাকল ৷ শুধু রূপজ মোহ নয়, নূরজাহানের অজস্ৰ গুণেই বশীভূত হয়ে গেলেন জাহাঙ্গীর। শ্বশুর ঘিয়াস বেগ ‘ইতমদ- উদ্দৌলা’ উপাধি থেকে উন্নীত হলেন ‘বকিল-ই-কুন’ – সব কাজে সম্রাটের প্রতিনিধিত্বের দুর্লভ সম্মানে। নূরজাহানের নামেই নিনাদিত হতে থাকল ভেরীবাদন। ফারমান জারির অধিকারও পেলেন নুরজাহান। সম্রাট নামে মাত্র কার্য পরিচালনা করতে লাগলেন।
সুরাপায়ী সম্ৰাট। স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ছে। নূরজাহান চিন্তিত। ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারের কথাও ভাবছেন তিনি। শাহজাহান ক্রমাগত প্রবল হয়ে উঠছেন। ভাল লাগে না তার এই দুর্বিনীত সপত্নী পুত্ৰটিকে। তাই তার ক্ষমতালোপের চক্রান্তে নামলেন। জাহাঙ্গীরের দাসীপুত্র শাহরিয়রের সঙ্গে নিজের মেয়ে লাডলীর বিয়ে দিয়েছিলেন। তার প্রবল ইচ্ছা এই অপদাৰ্থটাকে কিভাবে সিংহাসনে বসান। জামাই বলে কথা ! একদিকে সতীনের ছেলে, প্রায় নিজের ছেলের মতোই ৷ তার সঙ্গে বিয়ে দিয়েছেন নিজের আত্মজা, শের আফগানের ঔরসজাত লড়লীর ৷ চমৎকার ! কাজেই ঐ ‘না-সুদনি’ কে (লোকে এই নামেই ডাকতো – ইংরেজিতে এর অর্থ গুড ফর নাথিং) সিংহাসনে বসানো যায় তাহলে তারই সুবিধে। জাহাঙ্গীরের মতো জামাইটিও তো তাহলে তার করতলগত থাকে। জাহাঙ্গীরের কানে তাই বিষ ঢালতে লাগলেন লাগলেন তিনি। ফলে শাহজাহানের বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীর নানা ব্যবস্থা নিতে লাগলেন। ‘বেদৌলত’ ভাগ্যহীন শাহজাহানকে তিনি সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করতে লাগলেন আর পরিবর্তে শাহরিয়ার কে নানা সম্মানে সম্মানিত করতে লাগলেন। তাকে দিলেন ঢোলপুর ৷ দিলেন বারো হাজারী জাট আর আট হাজারী সওয়ারের অধিকার আর কান্দাহার অভিযানের দারিত্ব। হায় জাহাঙ্গীর, তোমার প্রিয়তম পুত্রের বিরুদ্ধে এই চক্রান্ত তুমি বুঝতে পারলে না রূপের নেশায় বুঁদ হয়ে থেকে? শাহজাহান চিঠি লিখলেন বাবাকে সব কথা জানানোর জন্য। নূরজাহান অনুমতি দিতে দিলেন না।
কিন্তু নূরজাহানের ভাগ্যে তখন কলির অনুপ্রবেশ শুরু হয়েছে। ভাই আসফ খা নিয়েছেন শাহজাহানের পক্ষ। তবুও শাহজাহানকে বশ্যতা স্বীকার করতে হল। নূরজাহানের কাছে ক্ষমা চাইতে হল। খুব খুশী নূরজাহান ৷ অন্দরমহলের পর্দাকে তিনি মানেন না। সেই অন্দরমহলের আয়ত্তেই আসতে হল শাহজাহানকে।
কিন্ত তা এতো সহজে হল কই ! ভাই আসক খাঁর সঙ্গে সেনাপতি মহববৎ খাঁর ছিল মনোমালিন্য। তাই নিয়ে মহববৎ বন্দী করলেন একদিন জাহাঙ্গীরকে। ছদ্মবেশে পালিয়ে গিয়ে নূরজাহান সম্রাটকে বন্দীমুক্ত করতে চাইলেন। পারলেন না। তাই অশেষ বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে স্বেচ্ছা-বন্দিনী হয়ে সম্রাটস্বামীর সঙ্গে থাকতে লাগলেন।
এদিকে স্বামীর সঙ্গে শলাপরামর্শ করে চলেছেন নুরজাহান। সেই পরামর্শ মতো জাহাঙ্গীর প্রতিদিন নূরজাহানের নামে নানা কুৎসা রটনা করে তার মন জয় করতে লাগলেন। দারুণ বিশ্বাসে মহববৎ প্রহরী পৰ্যন্ত রাখলেন না। সেই সুযোগে দুজনে খোজা হুসিরার খার সাহায্যে মহববৎকে পরাভূত করে মুক্তিলাভ করল। মুক্তি পেলেন বটে কিন্তু স্বাস্থ্য ভেঙে গেল জাহাঙ্গীরের ৷ খসরুকে নির্মমভাবে হত্যা করেছেন। পরভেজও নেই। ভগ্ন হৃদয়ে ২৮ অক্টোবর ১৬২৭ খ্রিষ্টাব্দে ৫৮ বছর বয়সে জাহাঙ্গীর চলে গেলেন।
নূরজাহান আগেই হারেমের পর্দা উন্মোচন করেছিলেন। এই প্রথম মোগল সম্ৰাটের অন্দরমহলে বহির্মহলে ফারাক থাকল না। ফারাক রাখতে দেননি জাহাঙ্গীর নিজেই ৷ স্ত্ৰীর নামেই ফারমান জারির অধিকার দিয়েছিলেন। সোনার টাকায় মুদ্রিত থাকত নূরজাহানের নাম। সমস্ত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেবার অধিকারও ঐ স্ত্রীরই ছিল। জাহাঙ্গীর নেই। কিন্তু তা বলে ক্ষমতার মোহ যাবে কোথায় ? শাজাহানকে সিংহাসনে বসানো দূর অস্ত। ভাই আসফ খাঁ বিরোধিতা করে পরলোকগত খসরুর ছেলে বুলাকীকে (দওয়ার বখ্শ) সিংহাসনে বসানোর জন্য চক্রান্ত করতে শুরু করেছেন ৷ কিন্ত শেষ অবধি সিংহাসনে এসে বসেছেন সেই শাহজাহানই।
আর কেন সুখের জন্য লালসা ৷ স্বামীর মৃত্যুর পর আশ্চর্য সংযমে বিধবার ন্যায় শ্বেতবস্ত্রে নিজেকে সজ্জিত করে রাজনৈতিক জীবন থেকে অবসর গ্রহণ করলেন। জাহাঙ্গীরকে তিনি কোনো সন্তান পর্যন্ত উপহার দিতে পারেন নি।
আরও আশ্চর্য তার জীবনকে মানিয়ে নিয়ে চলার শক্তি। একদা শাজাহানের জয়লাভে যিনি বিশাল ভোজসভা আহ্বান করেছিলেন, যে শাহজাহান তাঁকে সম্মান করে প্রভূত দানে সম্মানিত করেছিলেন তার কাছেই পরম নিশ্চিন্ততায় আশ্রয় নিলেন। শাহজাহানও তাকে বার্ষিক দু লক্ষ টাকা বৃত্তির ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু ঐ পর্যন্ত। রামসর গ্রাম, টোডা পরগনা – নুরজাহানের নিজস্ব কোনো সম্পত্তি আর রইল না। শুধু রইল অজস্র স্মৃতি। তাকে আর অন্যান্য বেগমদের নিয়ে প্রকৃতি-প্রেমিক জাহাঙ্গীরের নানা স্থানে ভ্রমণের স্মৃতি। তার প্রাসাদে আহূত হাজারো ভোজসভার স্মৃতি। মনে পড়ে যায় নিজের হাতে বাঘ মেরেছিলেন বলে স্বামী খুশি হয়ে তাঁকে লক্ষ টাকা দামের একজোড়া হীরের ব্রেসলেট দেন। এমনি আরও শতক স্মৃতি ভার হয়ে তাকে বেদনা দেয়। পেটের মেয়েটা পর্যন্ত চলে গেছে ৷ তাই বিধবা আর দুখীদের দান দাক্ষিণ্য করে তার সময় কাটে। এক সময়ে কতো দুখী – অন্ততঃ ৫০০ জনের – মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। আর নিজেই এখন কতো দুঃখী। ৭০ বছরের দুঃখী উচ্চাকাঙ্ক্ষী এই মহিলার জীবনাবসান ঘটে ৮ ডিসেম্বর ১৬৪৫ খ্রিষ্টাব্দে। স্বামীর সমাধি মন্দিরের পাশে বাহুল্য-বর্জিত এক সমাধি মন্দিরে তিনি সমাহিতা রইলেন। সেখানে খোদিত রইল –
‘বর মজারে মা গরীবা না চিরাগে না গুলে
না পরে পওয়ানা আয়েদ্ না সজারে বুলবুলে।
দীনের গোরে দীপ দিও না
সাজায়ো না ফলফুলে
পোকায় যেন পোড়ায় না পাখ গায়ে না গাথা বুলবুলে।’
(ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুবাদ)
নূরজাহান চলে গেছেন অন্দরমহল ছেড়ে। কিন্তু ভারতীয় নারীর অন্দরমহলে রয়ে গেছে তার পোশাক-আশাক সাজসজ্জার বিশিষ্ট রীতি। কবিতা প্রিয় এই বীর রমণীর গাথা আজও কীর্তিত হয়ে চলেছে যুগ হতে যুগান্তরে।
(FAQ)
১। জাহাঙ্গীর কে ছিলেন? ভারতের মোঘল সাম্রাজ্যের চতুর্থ সম্রাট হলেন জাহাঙ্গীর।
২। জাহাঙ্গীরের প্রথম পত্নী হয়ে তার হারেমে কে আসে? মানবাঈ
৩। জাহাঙ্গীরের প্রেমিকার নাম কী? আনারকলি
৪। জাহাঙ্গীরের প্রধানা মহিষী বা পাটরানী কে ছিলেন? নূরজাহান।