ভারতের মোঘল সাম্রাজ্যের শ্রেষ্ঠ সম্রাট আকবরের অন্দরমহল প্রসঙ্গে আকবরের অন্দরমহলের পত্নী-উপপত্নী, আকবরের অন্দরমহলের পরিচারিকা, আকবরের অন্দরমহলের পরিবেশ ও আকবরের অন্দরমহলের ইতিহাস সম্পর্কে জানব।
মোঘল সম্রাট আকবরের অন্দরমহল
ঐতিহাসিক বিষয় | আকবরের অন্দরমহল |
সাম্রাজ্য | মোঘল সাম্রাজ্য |
শ্রেষ্ঠ সম্রাট | আকবর |
প্রথম পত্নী | রুকিয়া বেগম |
প্রধানা মহিষী | মানমতী |
জালাল-উদ-দীন মহম্মদ আকবর শাহ যখন সিংহাসনে গিয়ে বসলেন, তখন তার বয়স মাত্র তেরো বছর। জন্ম ১৫৪২, রাজ্য লাভ ১৫৫৬-সেই বিখ্যাত পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধ-এর অবসানে। তেরো বছরের বালক হলেও বুদ্ধি এবং কর্মদক্ষতায় পরিণত। বয়সটা অবশ্য বিয়ে করার উপযুক্ত নয় ঠিকই কিন্তু বইয়ের কথাবার্তা অনেক আগে থেকেই ঠিক হয়ে গিয়েছিল। সে ১৫৫১ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসের কথা ৷ আকবরের বয়স তখন কতো হবে? বছর আটেকের মতো। অবশ্য বিয়ের কথাই মাত্র হয়েছিল, বধূ বাগদত্তা মাত্র হয়েছিলেন। আর বধূ সন্ধানের জন্য হুমায়ুন বেশি দুরেও যান নি। এমনকি বাল্যপ্রণয় ঘটে থাকা বিচিত্র না হলেও প্রয়োজন ছিল না। আকবর, ভারতের মোগল বংশের অন্যতম কৃতী সম্ৰাট, প্রথম বিবাহ করেছিলেন এই বাগদত্তা বধুটিকেই। নাম রুকিয়া বেগম ৷ জাহাঙ্গীর তার আত্মজীবনী ‘জাহাঙ্গীরনামা’য় লিখেছেন “তিনি আমার পিতার সম্মানীয়া পত্নী ( প্রথম বিবাহিতা পত্নী)।”
কে এই রুকিয়া বেগম যার সঙ্গে সেই বাল্যবয়সেই আকবরের বিবাহ স্থির হয়েছিল? আকবর তো সামান্য পাত্র নন – পাদশাহ হুমায়ুনের প্রিয়তম পুত্র তিনি। রুকিয়া হিন্দালের কন্যা। হিন্দাল হলেন হুমায়ুনের বৈমাত্রেয় ভাই, বাবর আর দিলদার বেগমের সন্তান, গুলবদনের সহোদর ভাই। তারই মেয়ে রুকিয়া। আকবরের সঙ্গে সম্পর্কে আপন পিসতুতে বোন। তারই সঙ্গে প্রথম বিবাহ হল আকবরের। কিন্তু দুর্ভাগ্য রুকিয়ার। স্বামীকে তিনি কোনো সন্তান উপহার দিতে পারলেন না৷ তাই বুঝি তার পাটরাণীও হয়ে উঠতে পারলেন না। কিন্তু যে আকবর স্ত্রীর এই মনোবেদনা বুঝতে পারতেন। পারতেন বলেই যে মুহূর্তে পৌত্র যুবরাজ খুররমের (পরে শাহজাহান নামেই পরিচিত ও খ্যাত)। জন্ম হল – সানন্দে এবং সহর্ষে তিনি পৌত্রটিকে লালনপালনের জন্য রুকিয়ার শূন্য ক্রোড়ে এনে দিলেন।
কিছুদিন আগে থেকেই রুকিয়া জ্যোতিষীর কাছে ভাগ্যগণনা করিয়ে জেনেছিলেন তার ভাগ্যে মা হওয়ার সৌভাগ্য নেই। জ্যোতিষী গোবিন্দ অবশ্য তাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন – জাহাঙ্গীরের ঔরসে মানমতীর গৰ্ভে যে সন্তানটি এসেছে, সেটি হবে পুত্রসন্তান। তুমিই তাকে পালিতপুত্র হিসেবে নিয়ে মানুষ-টানুষ করো। সেই-ই হবে তোমার মাতৃত্বের উপকরণ। রুকিয়া স্বামীর কাছে সাদরে তার নিয়তির কথা জানিয়েছিলেন। আকবর এই সব ভাগ্যগণনায় বিশ্বাসী ছিলেন খুব। স্ত্রীকে আদর করে বলেছিলেন তাই হবে গো, তাই হবে।
যথাসময়ে দেখা গেল তার নাতিই জন্মগ্রহণ করেছে। আকবরের যতো আনন্দ, তার চেয়ে রুকিয়ার আনন্দ শতগুণ। রুকিয়াকে কেউ তো মা বলে ডাকবে। ছ’দিন পার হতেই ১১ জানুয়ারী ১৫৯২ তারিখে জাহাঙ্গীয় ডেকে পাঠালেন বাবাকে। তিনি এলে তাকে বললেন বাবা, এই সন্তানের নামকরণ করুন। আকবর নাম দিলেন খুররম। এই শব্দের অর্থ ‘আনন্দোচ্ছল’। তারপরেই পত্নী রুকিয়ার হাতে তুলে দিলেন নবজাতককে। চল্লিশ বছরের বিবাহিত জীবনে সেই প্রথম পেলেন মাতৃত্বের অপরোক্ষ স্বাদ। জাহাঙ্গীর ঠিকই লিখেছেন – খুররম যদি তার নিজের ছেলেও হতো তার চেয়েও হাজার গুণ ভালবাসা সে তার কাছে পেয়েছিল ৷
জাহাঙ্গীরও তাঁকে খুবই শ্রদ্ধা করতেন। সাখুলি খাঁর আগ্রাতে একটি চমৎকার বাগান ছিল। তার কোনো উত্তরাধিকারী ছিল না। তাই জাহাঙ্গীর সম্ৰাট হয়ে বাগানটিকে দান করেছিলেন তার এই বিমাতাকে। এই বাগানের বাড়িটিতে বাস করতে করতেই একদিন হারালেন স্বামীকে ১৬০৫ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে। তারপরে আরও ২১ বছর বেঁচেছিলেন এই সন্তানহীনা বিধবা রাণী। লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকতে থাকতেই প্রায় চুরাশি বছরের পরিণত বয়সে অবীরা এই নারীর মৃত্যু ঘটল ১৬২৬ খ্রিষ্টাব্দে।
তের বছর বয়সে যে কিশোর সাম্রাজ্যএর ভার গ্রহণ করতে পারেন, পনেরো বছর বয়সে তার জীবনে যৌবনের সমারোহ আসা অসম্ভব নয়। অতএব আকবরও তার পনেরো বছরের বয়সে মদনের উপস্থিতি অনুভব করেছিলেন আবশ্যিক ভাবে। ঘরে তার বালিকা-বধূ এখন কিশোরীটি হয়ে উঠেছেন বটে, আর সে তো তার সমবয়সীও। কিন্তু পনেরো বছরের আকবর সম্রাটের (সত্যি বলতে আকবর তখন সাড়ে চোদ্দ) অন্দরমহলে একটি মাত্র নারী থাকবে, এটা খুবই অশোভন। এ হেন সময়ে পাত্রীও উপস্থিত হয়ে গেলেন।
হুমায়ুনের এক বৈমাত্রেয় ভাই ছিলেন কামরান। তিনি বিয়ে করেছিলেন আবদুল্লা খান মুঘলের ভগ্নীকে। এই আবদুল্লা খানের একটি সুন্দরী কন্যা ছিল। আকবর তাঁকে বিয়ে করে বসলেন ১৫৫৭ খ্রিষ্টাব্দে। দারুণ অখুশী হয়ে উঠলেন তার অভিভাবক-কল্প সেনাপতি বৈরাম খান। কারণ আব্দুল্লা খান সাহেবের সঙ্গে তার একটা বৈরী ভাব ছিল। কিন্ত তাতে মদনদেবের অপ্রতিহত গতি তো বাধা পাবার কথা নয়। অতএব আকবরের ঘরে এলেন তার দ্বিতীয় স্ত্ৰী। কিন্তু হারিয়ে গেলেন তিনিও নিঃসন্তান বধূদের দলে।
এরপর হিসেব নেই তার পত্নী আর উপপত্নীদের সংখ্যার। কে রাখে তার হিসাব? আবুল ফজল জানিয়েছেন আকবরের হারেমে পাঁচ হাজার রমণী ছিল। তিনি আবার কৌতুক করে এও বলেছিলেন ঐ পাঁচ হাজার রমণীকে বশে রাখতে হলে যে কূটনীতি আর বিচক্ষণতার প্রয়োজন, তার পরিচয় দিয়ে মহামান্য সম্রাট নিজের জ্ঞান ও বুদ্ধিকেই আরও শাণিত করেছিলেন।
আকবরের হারেমের আরও খবর চান? ঐ পাঁচ হাজার মেয়ে যেখানে বাস করতো, আসলে সেটা একটা পুরোদস্তুর শহর ছিল। সরাইখানার মতো বা ইংরেজি ডরমেটরির মতো তারা এক জায়গায় শয়ন করতেন না। প্রত্যেকেরই ছিল আলাদা আলাদা ঘর। ঘর মানে বিলাসকক্ষ। ভাবুন তো ব্যাপারখানা কি রকম! এই পাঁচ হাজার রমণীদের কয়েকটি শ্রেণীতে তিনি ভাগ করে এক একজন মহিলা রক্ষী, যাদের নাম ছিল দারোগা তাদের অধীনে রাখতেন। বিশাল খরচ হত – তার হিসেব রক্ষার জন্য নিযুক্ত ছিলেন করণিকেরা।
অন্দরমহলের ভিতরের ঘরগুলি পাহারা দিতো সশস্ত্ৰ মহিলা রক্ষী দল। এর পরেই থাকতো খোজা-প্রহরীরা।তারপরে থাকতো বিশ্বস্ত-রাজপুত প্রহরীর দল। বেশ একটু দূরে সৈন্যরা থাকতো মোতায়েন। এমনি এক নিশ্ছিদ্র প্রহরার অতন্দ্র বিন্যাসের মধ্যে আকবর মেতে উঠতেন উপভোগের মন্ততায়। পাশা খেলায় জীবন্ত ঘুঁটি তিনি পছন্দ করতেন। উলঙ্গ উপপত্নীগুলোকে ব্যবহার করতেন ঘুঁটি হিসেবে আর তাই দিয়ে চলতো তার খেলা।
অতএব হিসেব করতে যাওয়া বিড়ম্বন৷ এদের কোনো ইতিহাস নেই। থাকতেও নেই ৷ এরা শুধু সম্রাটের নর্মসহচরী, ভোগের উপকরণ, বিলাসের সামগ্রী। এদের মন থাকতে নেই, এদের লজ্জা থাকতে নেই, জীবন
থাকতে নেই। সম্রাটের আকাঙ্ক্ষা পূরণই এদের লক্ষ্য়। পরিবর্তে আছে রুটির নিরাপত্তা। অবশ্য জীবনের নিরাপত্তা যে সর্বদা থাকতো, তা নয়। না পসন্দ হলেই হয় প্রত্যাখ্যান আর দূরীকরণ, নয় তো গর্দান লেও।
তবুও কিছু পত্নী-উপপত্নীর হিসাব ইতিহাস রেখেছে। পুত্র জাহাঙ্গীরও কারও কারও কথা উল্লেখ করেছেন। পত্নী-উপপত্নী নিৰ্বিশেষে। আসলে এতে তো লজ্জা নেই, আছে গৌরব। অতএব পিতার ‘গৌরব’, পুত্র ব্যাখ্যান
করবে – এতে আশ্চর্য কি! এঁদের অনেকে আকবরের পুত্র-কন্যার মা। উপপত্নীর গর্ভে জন্মেও এরা সন্মানিত। ইতিহাসে পাওয়া কিছু স্ত্রী ও রক্ষিতার কথা এখানে আমরা উল্লেখ করি। বলা প্রয়োজন এদের প্রায় সকলেই আকবরের মনের সাথী হতে পারেন নি। যারা পেরেছিলেন তাঁদের কথাও বলবো। আগে বলি বিবাহিত সম্ৰাজ্ঞীদের
কথা।
প্রিয়তমা মহিষী (প্রিয়তম পুত্ৰ জাহাঙ্গীর-সেলিমের গর্ভধারিণী) মানমতীর কথা পরে বলছি। তিনি ছাড়া আরও অনেক রাজপুত রমণী আকবরের হারেমের শোভা বৃদ্ধি করেছিলেন। এদের মধ্যে বিকানীর রাজা এবং জয়সলমীরের রাজা তাদের কন্যাকে বাদশাহের ঘরে পাঠিয়েছিলেন আকবরের বশ্যতা স্বীকার করে।
বিবাহ করেছিলেন তিনি খান্দেশের অধিপতি মিরন মুবারক শাহের কন্যাকেও। তারিখটা ছিল ১৫৬৪ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসের কোনো একটি দিন ৷ বিয়ে করেছিলেন জনৈক আরব শাহের কন্যা কাসিমা বানুকে। সে আরও পরের ঘটনা। বিয়ে করেছিলেন বিবি দৌলত সাদেকে। আকবরের পুত্র দানিয়েলের জন্মের পর বিবি দৌলত সাদের গর্ভে আকবরের একটি কন্যার জন্ম হয়। তার নাম ছিল সকরুণ-নিসা বেগম।
এই স্ত্রীটিকে আকবর ভালবাসতেন খুব। ভালবাসতেন এই কন্যাটি-কেও। নিজের কাছে রেখে মেয়েটিকে মানুষ করেছিলেন তিনি। জাহাঙ্গীরও সবচেয়ে বেশি ভালবাসতেন এই বোনটিকে। ছোট শিশুদের বুক টিপে একফোঁটা দুধ বের করার যে রীতি আছে, সেই অনুসারে সকরুণ-নিসার বুক টিপে দুধ বের করা হলে পিতা আকবর জাহাঙ্গীরকে বলেছিলেন ‘বাবা, তুই এই দুধ খা, যাতে তোর এই বোনকে মায়ের মতো মনে হবে ৷’
দৌলত সাদের গর্ভে আকবরের আরও একটি কন্যা জন্মগ্রহণ করে। সে তার দিদির বিপরীত স্বভাবের। ঠিক জাহানারা আর রোশনারার মতো। এর নাম রেখেছিলেন আকবর আরাম বানু বেগম। একটু রাগী, একটু উত্তেজনাপ্রবণ। তবুও আকবর তাঁকে ভালবাসতেন খুব। তাঁর ঔদ্ধত লক্ষ্য করেই সম্রাট পিতা সম্রাট পুত্রকে বলেছিলেন – ‘আমি যখন থাকবো না, এর সব দোষ ক্ষমাঘেন্না করে একে ভালবাসিস যেন’। জাহাঙ্গীরকে সে কথা রাখতে হয় নি। আল্লাহ-ই এই দুরন্ত অভিমানী মেয়েটিকে কাছে টেনে নিয়েছিলেন। কুমারী অবস্থাতেই মৃত্যু হয়েছিল আরাম বানু বেগমের। বিবাহিত সকরুণ-নিসা কতই না কেঁদেছিলেন বোনের মৃত্যুতে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে।
আকবর বিয়ে করেছিলেন দুই বিধবা রমণীকেও। একজন আবদুল ওয়াসার বিধবা স্ত্রী এবং অন্যজন পিতৃব্য-কল্প বৈরাম খানের বিধবা সালিমা সুলতান বেগম । ১৫৬১ খ্রিষ্টাব্দে বৈরাম খানের মৃত্যুর পর আকবর যে সালিমাকে বিয়ে করে ঘরে আনলেন আসলে তিনি ছিলেন হুমায়ুনেরই এক ভাগ্নী। সেদিক থেকে ইনিও আকবরের এক পিসতুতো বোন। ঘরের মেয়ে নিজের ঘরেই এলেন।
সালিমা আকবরের মনের কাছের মানুষ হয়ে উঠেছিলেন। তার রাজ্যনীতি নির্ধারণে এই মহিলার কিছু ভূমিকাও ছিল। এক সময়ে জাহাঙ্গীরকে তিনি নানাভাবে নিয়ন্ত্রণও করেছিলেন। আকবর এই পুত্রের বিরুদ্ধে গেলে ইনিই হামীদা বানুর নিরাপদ তত্ত্বাবধানে রেখে এই পুত্রকল্প ভবিষ্যৎ সম্রাটকে নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন আগ্রা থেকে এলাহাবাদ পর্যন্ত এগিয়ে গিয়ে।
আকবরের প্রথম হিন্দু পত্নী বিষয়ে সব শেষে বলার আগে আমরা তার অন্তত তিনজন উপপত্নী বিষয়ে যৎসামান্য তথ্যাদি নিবেদন করার সুবিধা নিচ্ছি। কিন্ত কেন আকবর এতগুলি বিবাহে ও উপপত্নীতে নিরত হয়েছিলেন তাও ভেবে দেখার ব্যাপার ৷ পুত্রসন্তানের জন্য আকবর একেবারে উন্মাদ হয়ে উঠেছিলেন যৌবনের প্রথম উদগম থেকেই । দুৰ্ভাগ্য তার – কোনো মহিষীই তাকে তুষ্ট করতে পারেন নি। তার মহিষীরা সন্তানের জম্ম দেন বটে, কিন্ত সকলেরই শিশুমৃত্যু ঘটে। একটি জীবিত পুত্রের জন্য আকবরকে তার সাতাশ বছর বয়স পৰ্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল। সে এক দীর্ঘ প্রতীক্ষা ৷ সে এক কুসংস্কারের ইতিহাস অথবা সে এক প্রার্থনার জবানবন্দী। সে কথায় পরে আসছি।
তার আগে বলি আকবরের দ্বিতীয় পুত্র মুরাদের জন্ম হয়েছিল জুন ১৫৭০ খ্রিস্টাব্দে তার এক উপপত্নীর গর্ভে। জাহাঙ্গীর এর নাম বলেছেন সা-মুরাদ। পাহাড়ী এলাকা ফতেপুরে (সিক্রি) এর জন্ম হয়েছিল বলে আকবর একে ডাকতেন পাহাড়ী বলে। মদ্যপ ও অনাচারী এই পুত্ৰ মাত্ৰ ত্ৰিশ বছর বয়সে মারা যায়। তার তৃতীয় পুত্র দানিয়ালের জন্মও এক রক্ষিতার গর্ভে ১৫৭২ খ্রিষ্টাব্দের দশই সেপ্টেম্বর তারিখে। এই নামকরণের কারণ এই পুত্রটি জন্মেছিলেন আজমীরে খাজা মুইনুদ্দীন চিস্তির পবিত্র সমাধিস্থানের পির শেখ দানিয়ালের গৃহে।
আরও এক উপপত্নীর গর্ভে আকবরের প্রথমা কন্যা খানাম সুলতানের জন্ম হয়। তিনি ছিলেন জাহাঙ্গীরের (ঠিক করে বলতে গেলে সেলিম বলাই উচিত আমাদের) চেয়ে তিন মাসের ছোট – জন্ম হয় ১৫৬৯ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে। এই কন্যাটিকে লালনপালনের ভার নেন আকবরের মা, কন্যার পিতামহী মরিয়ম মাকানি (হামীদা বানু বেগম)। আকবরের গৃহ এসব সন্তানের আগমনে অবশ্যই প্রত্যাশিত আনন্দে পূৰ্ণ হয়ে উঠেছিল।
তবে এই আস্বাদ তাকে প্রথম এনে দিয়েছিলেন যিনি, তিনিই আকবরের প্রথম হিন্দু মহিষী, এক রাজপুত রমণী। আকবর তখন পুত্র-সন্তানের জন্য উন্মাদপ্রায়। দুটি সন্তান তার জন্মেছিল বটে কিন্তু তারা বরণ করেছিল অকালমৃত্যু। সেজন্য মনে মনে তিনি ভাবছিলেন কোনো সাধুসন্ত পীর ফকিরের কাছে আশ্রয় নিলে হয়তো তার মনস্কামনা পুর্ণ, হতে পারে।
এই রকম যখন ভাবছিলেন, তখন একদিন ফতেপুর সিক্রিতে মৃগয়া করতে গিয়ে আগ্রা থেকে মাইল আটেক পশ্চিমে মিধাকুর নামে একটি গ্রামে একদল হিন্দুর মুখে একটা কাওয়ালি গানের বিষয়বস্তু শুনে ভার জীবনপথের যেন নির্দেশ খুঁজে পেলেন ৷ গানটিতে ছিল আজমীরের প্রয়াত পীর খাজা মইনুদ্দীন চিস্তির প্রশংসাবাণী। আকবর কৌতুহলী হয়ে গানটি শুনলেন। আর তার পরেই স্থির করলেন তিনি খাজা সাহেবের চিস্তিতে যাবেনই।
সেইমতো ১৫৬২ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ জানুয়ারি ছোট একদল সঙ্গীকে নিয়ে রওনা হলেন। ধাত্রীমাতা মাহম অনগকে বলে গেলেন তুমি হারেমের সবাইকে নিয়ে মেওয়াটের পথ ধরে আমাকে অনুসরণ কর ৷ যেতে যেতে টোডাতোন আর খরন্ডির মাঝখানে কলাওলী পৌঁছলে অন্বরাধিপতি রাজা, বিহারীমল (কেউ কেউ বলেছেন ভরমল) দূত পাঠিয়ে সম্রাটের সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা জ্ঞাপন করলেন। আকবর অনুমতি দিলেন এবং সঙ্গনের-এর কাছে (এখনকার জয়পুর শহরের সাত মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে) উভয়ের দেখা হল।
রাণা সম্রাটের বশ্যতা স্বীকার করলেন এবং তার জোষ্ঠা কন্যার সঙ্গে সম্রাটের বিবাহের প্রস্তাব করলেন ৷ সম্ৰাট, সন্তান-পিপাসু সম্ৰাট, প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সম্মতি দিলেন আর রাণাকে বললেন আপনি এখনই অন্বরে ফিরে গিয়ে বিয়ের সমস্ত আয়োজন করুন। এই বলে আকবর খাজার দরগায় ঘুরে এলেন।
ফেরার পথে তিনি সম্ভর-এ থামলেন। এই শহরেই দারুণ জাঁকজমকের সঙ্গে বিহারীমলের কন্যার বিয়ে হয়ে গেল আকবরের – একজন হিন্দুনারীর সঙ্গে এক মুসলমান সম্ৰাটের বিধিসম্মত বিবাহ! কি নাম কন্যার? কেউ বলেন নি। আশ্চৰ্য! যাই হোক ধুমধাম হল খুব আর রাণা নানা মহার্ঘ পণ দিয়ে সম্রাটকে করলেন সম্মানিত। মাত্র একদিন বাস করলেন তিনি সন্তর-এ। তারপর নববধূকে আর অন্যান্য রমণীদের নিয়ে রওনা হলেন আগ্রার দিকে। রণথন্ভোরে গিয়ে রাণার পুত্র, পৌত্ৰ, আত্মীয়স্বজনেরা সম্ৰাটের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন। রাণার নাতি মান সিংহ
(এরই পিসিমা হলেন আকবরের এই নববধুটি) সম্রাটের দরবারের অন্তর্ভুক্ত হলেন। বিয়ের পর বিহারীমলের কন্যা প্রথম আগ্রার হারেমে প্রবেশ করলেন ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৫৬২ খ্রিস্টাব্দে। কিন্তু বছর না ঘুরতেই সন্তান উপহার দিতে পারেন নি এই রাজপুতানী বেগম ৷ সেজন্য আরও সাত বছরেরও বেশি কাল অপেক্ষা করতে হয়েছিল আকবরকে।
সুতরাং আরও অনেকবার আকবরকে পীর-ফকিরদের আশ্রয়ে যেতে হয়েছে, প্রার্থনা জানাতে হয়েছে সন্তানের জন্য। সেই সময়ে দরবেশ সেখ সেলিম জীবনের নানা পর্যায় অতিক্রম করে এসে আগ্রার সন্নিকটে সিক্রির কাছে এক পাহাড়ের উপর বাস করছিলেন। আকবর বার বার তার কাছে আসতে লাগলেন। একদিন ভারাক্রান্ত হৃদয়ে দরবেশকে জিজ্ঞেস করেই বসলেন – তার কি কোনে পুত্রসন্তান হবে না ? হলে কটি সন্তান হবে। সেখ জবাব দিলেন – ঈশ্বরের অনুগ্রহে তিনটি পুত্রসন্তান তোমার হবে। শুনে একমুখ উজ্জলতা নিয়ে সম্রাট বললেন তা যদি হয় তবে আমার শপথ আমার প্রথম পুত্র জন্মালে তাকে আমি তোমার নামে সঁপে দেবো ৷ সেখ আকবরকে অগ্রিম অভিনন্দন জানিয়ে বললেন তোমার পুত্র জন্মালে আমি আমার নিজের নাম তাকে দেবো।
এমন সময় জানা গেল রাজপুতানী বেগম সন্তানসম্ভাবিতা। আকবর একটুও দেরী না করে মহিষীকে সেখের আবাসে পাঠিয়ে দিলেন। সেখানেই জন্ম হল আকবরের প্রথম জীবিত থাকা পুত্রের – যার নাম হল মহম্মদ সেলিম (যিনি পরে নিজের নামকরণ করেন নুরউদ্দিন জাহাঙ্গীর পাদশাহ )। সেলিম নামকরণ করা হল ঐ সেখের ইচ্ছা অনুযায়ীই। আকবর অবশ্য পুত্রকে সৰ্বদা ডাকতেন ‘সেখ বাবা’ নামে। আগ্রা শহরটিকে আকবরের মনে হল বড্ড অপয়া। তাই সিক্রিতেই নিজের নতুন রাজধানী স্থাপন করলেন। রাজপুতানী বেগমের আদরের আর পরিসীমা রইল না।
সুলতান সেলিম মীর্জার যেদিন জন্ম হল, সেদিন আকবর ছিলেন ফতেপুর সিক্রি থেকে দূরে আগ্রায়। সেখ সালিমের জামাই সেখ ইব্রাহিম গিয়ে তাকে সুসংবাদ জানিয়ে এলেন। আনন্দে উদ্বেল হয়ে আকবর যেন রাজকোষ উন্মুক্ত করে দিলেন। বন্দীরা পেলেন মুক্তির ফরমান ৷ বিশাল বিশাল ভোজ উৎসব হল। কবিরাও পেলেন নগদ অর্থ। একজন কবি – তার নাম খাজা হুসেন, সেলিমের জন্ম নিয়ে দারুণ একটা গাথা-কবিতা রচনা করলেন। আকবর তা পাঠ করে খুশি হয়ে দু লক্ষ তঙ্কা তাকে উপহার দিয়ে বসলেন।
শুধু তাই নয় সম্রাট নিজে হেঁটে মইনুদ্দীন চিস্তির মুরাদুল অনওয়র কুতবুল ওয়াসিলীন পর্যন্ত গেলেন। প্রতিদিন তিনি ৮ ক্রোশ করে হাঁটতেন। একই সঙ্গে আল্লাহ এবং বেগম – দুজনের কাছেই সম্রাট কৃতজ্ঞ রয়ে গেলেন। বেগম যে তাকে তার পরবর্তী উত্তরাধিকারীর জন্ম দিতে সাহায্য করেছেন! হিন্দুসমাজের প্রতিই হয়তো তিনি কিছু সময়ের জন্য কৃতজ্ঞ থেকে গেলেন। আকবর গর্বিত, গর্বিত তার এই স্ত্রীও।
শুধু কি সম্রাটের পত্নী হিসাবেই তিনি নন্দিত হয়েছিলেন? না, তা নয় শুধু। সম্রাট জননী হিসেবেও তার স্থান ছিল উচ্চে। আত্মজীবনীতে জাহাঙ্গীর একবারের কথা উল্লেখ করে সসন্মানে লিখেছেন – ‘১২ই তারিখ শুক্রবার … লাহোরের কাছাকাছি পৌঁছলে আমি নৌকোয় উঠে ধর নামে এক গাঁয়ে আমার মায়ের সঙ্গে দেখা করতে যাই। আমার মহা-সৌভাগ্য যে তিনি আমাকে সাদরে গ্রহণ করেন ৷ চেঙ্গিজের রীতি, তৈমুরের বিধি এবং সাধারণ নিয়ম অনুসারে বয়ঃকনিষ্ঠরা বয়স্কদের যে ভাবে সন্মান প্রদর্শন করে থাকে সেইভাবে নতজানু হয়ে অভিবাদন ও
সম্মান জানিয়ে এবং পৃথিবীর অধীশ্বর মহান আল্লার কাছে প্রার্থনা নিবেদন করার পর আমি ফেরার অনুমতি লাভ করি৷’
আকবরের এই হিন্দু স্ত্রীর দেহাবশেষ সমাধিস্থ হয়ে আছে সেকান্দ্রায় আকবরের সমাধিস্থলের পাশে একটি অনবদ্য সমাধি মন্দিরে। মৃত্যুর পর তাকে রাজকীয় উপাধি দেওয়া হয়েছিল মরিয়ম (উজ) জমানি – যার
অর্থ ‘the Mary of the Age’. মরিয়ম মাকানির যোগ্য পুত্রবধূর যোগ্য সম্মান ।
(FAQ) আকবরের অন্দরমহল সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য
১। আকবর কে ছিলেন? ভারতের মোঘল সাম্রাজ্যের শ্রেষ্ঠ সম্রাট হলেন আকবর।
২। আকবরের হারেমে কত রমণী ছিলেন? পাঁচ হাজার রমণী।
৩। আকবরের প্রথম বিবাহিত পত্নী কে ছিলেন? রুকিয়া বেগম।
৪। আকবরের প্রিয়তমা মহিষী কে ছিলেন? মানমতী।
৫। আকবরের একজন হিন্দু মহিষীর নাম লেখ। মানমতী।