ভারতের মোঘল সম্রাট শাহজাহানের অন্দরমহল প্রসঙ্গে শাহজাহানের অন্দরমহলের পত্নী-উপপত্নী, শাহজাহানের অন্দরমহলের প্রহরী ও পরিচারিকা, শাহজাহানের অন্দরমহলের ইতিহাস সম্পর্কে জানব।
মোঘল সম্রাট শাহজাহানের অন্দরমহলের
ঐতিহাসিক বিষয় | শাহজাহানের অন্দরমহল |
সাম্রাজ্য | মোঘল সাম্রাজ্য |
সম্রাট | শাহজাহান |
প্রথম মহিষী | মমতাজমহল |
প্রধান মহিষী | মমতাজমহল |
নূরউদ্দীন মহম্মদ জাহাঙ্গীর বাদশাহ গাজী এবারে বেশ নিশ্চিন্ত হয়েছেন। নিজের বিদ্রোহী পুত্র খসরুকে অন্ধ করে দিয়েছেন – আপাতত আর সিংহাসন নিয়ে তাই ভাবনা রইল না জাহাঙ্গীরের। এবার দরকার পারসিকদের দমন। পুত্রের বিদ্রোহকে কড়া হাতে মোকাবিলা করে জাহাঙ্গীর তাই গেলেন লাহোরে। তারিখটা ছিল ৯ মে ১৬০৬। লাহোরে থাকতে থাকতেই ভাবলেন একবার কাবুলে যাওয়ার দরকার। যাবার আগে খবর পাঠালেন তৃতীয় পুত্র আদরের খুররমকে। পুত্র, যথাশীঘ্র তোমার মা আর বেগম মরিয়ম-উজ-যমানি ও অন্যান্য অন্তঃপুরিকাদের সঙ্গে নিয়ে লাহোরে চলে এসো। রাজকুমার খুররম সেই মতো এলেন লাহোরে।
খুররমের আচার-আচরণে ক্রমশই জাহাঙ্গীর প্রীতিলাভ করে চলেছেন ৷ ১৬০৭-এর মার্চ মাসে তিনি প্রিয়পুত্রকে আট হাজার জাট আর পাঁচ হাজার সৌওয়ারির মনসবদারি দিয়ে সন্মানিত করলেন। এখন পুত্রটি বেশ ডাগর হয়ে উঠেছেন। বয়সেও নয় নয় করে পনেরো বছরের কৈশোরে প্ৰসফ্ঊটিত ৷ ঐ মার্চেরই শেষ সপ্তাহে জাহাঙ্গীর পুত্রের বিয়ের কথা তুললেন। ইতিমধ্যে তিনি খোঁজ নিয়ে জেনেছেন ইতিকাদ খাঁর কন্যা আৰ্জুমন্দ বানু বেগম-এর সৌন্দর্যের কথা।
কে এই ইতিকাদ খাঁ ? তিনি তেহেরানের খাজা মহম্মদ শরীফ-এর পুত্র মিরজা গিয়াস বেগের একমাত্র পুত্র সন্তান। অবস্থার বিপাকে পড়েছিলেন মিরজা গিয়াস বেগ ৷ ভাগ্যান্বেবণে বের হয়ে এলেন হিন্দুস্তানে তার গর্ভবতী পত্নীসহ। কান্দাহারে পৌছেই তাঁর পত্নী একটি কন্যাসন্তান প্রসব করলেন। এই কন্যাই মেহেরউন্নিসা – যার বিয়ে হয়েছিল বর্ধমান-এর জায়গীরদার আলিকুলি ইস্তাজলু নামে এক পারসিক ভ্রমণকারীর সঙ্গে। আলিকুলি নামটা অপরিচিত লাগছে? তাহলে বলি ইনিই সেই ইতিহাস-খ্যাত শের আফগান – যার মৃত্যুর পর জাহাঙ্গীর তার বিধবা পত্নীকে বিয়ে করে নূরমহল ও নূরজাহান উপাধিতে ভূষিত করেন। দ্বিতীয় বিবাহের সময় নূরজাহানের বয়স ছিল পঁয়ত্রিশ।
এই মেহেরুন্নিসার একটি ভাই ছিলেন। তিনিই এই ইতিকাদ খাঁ। ইতিহাসে পরে যিনি খ্যাত হন ‘আসফ খাঁ’ এই উপাধি – নামে। ইতিকাদ খাঁর মেয়েটি ইতিমধ্যে চতুর্দশীর চাঁদের লাবণ্যে ভরপুর। জাহাঙ্গীরের প্রস্তাবে স্বভাবতই খুশী হলেন ইতিকাদ। কন্যা-চাক্ষুষের দিন জাহাঙ্গীর স্নেহভরে নিজের হাতে আর্জুমন্দ বানু বেগমের হাতে আংটি পরিয়ে দিলেন। তিনি যে তার প্রিয়তম পুত্র খুররমের ভাবী বধু। ভাবী পুত্রবধূর মঙ্গল কামনায় বিশাল উৎসব-এরও আয়োজন করলেন সম্রাট জাহাঙ্গীর। পুত্রের সম্মান বৃদ্ধির জন্য কাবুল থেকে ফেরার পথে ঐ বছরের নভেম্বর মাসেই জাহাঙ্গীর শাজাহানকে উজ্জয়িনীর একটি জায়গীর হিসার ফিরোজার সরকার এবং লাল তাবু খাটাবার অধিকার দিলেন। আরও দিলেন রাজকীয় শীলমোহর ব্যবহারের ঢালাও অধিকার। এসব খবর কি আর্জুমন্দ বানুর কানে পৌছল ? স্বামীগর্বে তিনি কি গর্ব অনুভব করতে লাগলেন? খুররমও কি তার এই চতুর্দশী ভাবী পত্নীর কল্পনায় নিমগ্ন হলেন?
আসলে ইতিহাস মাঝে মাঝে কথা বলে না। শুধু বলে জাহাঙ্গীর ছেলে বড়ো হয়েছে দেখে তাকে উরতাবাগের প্রাসাদটি দান করে দেন। খুররম সেটিকে মনোমত করে সাজিয়ে গুছিয়ে তুলেছেন। দেখে ভারী খুশী
হয়েছেন পিতা। পিতার বদান্যে তার ভাগ্যে আরও সম্মান স্তূপীকৃত হয়েছে। ১৬০৮-এ জাহাঙ্গীর পুনশ্চ ফিরে এসেছেন আগ্রার রাজপ্রাসাদে। পুত্র এখন ষোল বছরে পা দিয়েছে। ভাবী বধূর জন্য সংসার পাতার প্রয়োজন। তাই পৃথক মহলের ব্যবস্থা – মহম্মদ মুকীম-এর মহলটি তাই তাকে দিয়েছেন। আর দিয়েছেন চল্লিশ হাজার টাকা মূল্যের একটি আশ্চর্য পান্না ও দুটি মুক্তো। খুররম হয়তো এসব নিয়ে মনে মনে আর্জুমন্দের ভূষণ নির্মাণ করছেন। এমন সময় এল এক নতুন সংবাদ। সে সংবাদে চাঘতাই বংশের বহির্মহল আর অন্দরমহল কেঁপে ওঠেনি নিশ্চয়ই। মুঘলদের একাধিক পত্নী কোনো বিশিষ্ট সংবাদ নয়। তবুও এই নতুন খবরে খুররমের মনে কি কোনো প্রতিক্রিয়া জাগেনি ?
১৬১০-এর গোড়ায় আবার নতুন করে সন্বন্ধের কথা উঠল ৷ বাগদত্তা আর্জুমন্দ দূরে পড়ে রইলেন। পারস্যের শাহ ইসমাইল-এর বংশধর মির্জা মুজফফর হুসেন সফাবির মেয়ের সঙ্গে নতুন করে বাগদানের কথা তুললেন জাহাঙ্গীর। কিন্তু কেন? আর্জুমন্দের সঙ্গে তবে কি কোনো মনান্তর ঘটেছে খুররমের ? হোক না তার একাধিকবার বিয়ে, কিন্তু আজুমন্দকে দুরে সরিয়ে রেখে কেন এই নতুন বিয়ের প্রস্তাব? তবে কি খুররম নতুন করে এই মেয়েটির প্রণয়পাশে আবদ্ধ হয়েছেন?
ঐ যে ইতিহাস সব কথা বলে না। কিন্তু ঘটনা কথা কয়ে চলে। ১৬০৭- এর তিরিশের মার্চে বাংলার শাসনকর্তা কুতবউদ্দীনের হাতে জাহাঙ্গীরের আদেশে শের আফগান নিহত হয়েছেন। শের আফগান যে তার বাড়া ভাতে ছাই দিয়েছেন। একদা তো এই মেহেরউন্নিসাকে সেলিমই বিয়ে করতে চেয়েছিলেন। পিতা আকবর সে ইচ্ছা পূরণ না করে আলিকুলির হাতে তুলে দিয়েছিলেন তার বাঞ্ছিত ধন। ১৬০৫-এ আকবরের মৃত্যু হয়েছে। অতএব সেই অপহৃত ধনকে ফিরিয়ে আনতে চেয়েছেন জাহাঙ্গীর নিজের নিঃসপত্ন অধিকারে। শের আফগান নিহত – কণ্টক অপসারিত। মেহেরউন্নিসাকে নিয়ে এলেন নিজের প্রাসাদে। কতো সাধ্য-সাধনা করেন জাহাঙ্গীর ৷ কিন্তু স্বামীহন্তার প্রতি মেহেরউন্নিসা বিমুখ। অথচ ভিতরে ভিতরে ক্ষমতার একটা লোভ তখন এই বিধবাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল। জাহাঙ্গীরও ক্রমাগত সেই ইচ্ছায় বারি সিঞ্চন করে চলেছেন। তবুও মেহেরউন্নিসা মুখ ফিরিয়ে। কৌশলে ফাঁদে তাকে তখন বন্দী করতে চেয়েছেন জাহাঙ্গীর। আরজুমন্দ বেগম হলেন মেহেরউন্নিসার নিজের ভাইঝি, ইতিকাদ খাঁর কন্যা। অন্য মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে জাহাঙ্গীর মেহেরউন্নিসাকে বোঝাতে চাইলেন – সুন্দরী, আমাকে ভজনা কর, নইলে তোমার ভাইঝির কপালে অশেষ দুর্গতি। এটা শুধু তার কথার কথা রইল না, সত্যিই তিনি ২৯ অক্টোবর ১৬১০ খ্রিস্টাব্দে পুত্রের বিয়ে দিয়ে বসলেন মির্জা মুজফফর হুসেন সফাবির মেয়ের সঙ্গে। ঘরে এলেন পুত্রবধূ হয়ে কান্দাহারী বেগম – খুররমের প্রথম স্ত্ৰী।
এবার বুঝি মন গলল মেহেরউন্নিসার। সন্তানের বিয়ের পর জাহাঙ্গীর মেহেরউন্নিসাকে বিয়ে করলেন ১৬১১-এর ২৫ মে। মেহেরউন্নিসা হলেন নূরমহল থেকে নূরজাহান, জগতের আলো। এবার তিনি জাহাঙ্গীরকে বললেন, আর্জুমন্দকে ঘরে আনো। আর খুররমকে বুঝিয়ে দিলেন শুধু ভাইঝিটিকেই তিনি দিচ্ছেন না – তাকে আরও দিচ্ছেন বারো হাজারী জাট এবং পাঁচ হাজারী সোয়ারের মনসবদার। খুররমের ভাগ্য এখন নুরজাহানের করতলগত – একথা যেন ভুলে না যায় খুররম।
এর প্রায় মাসখানেক পরেই সেই ঐতিহাসিক মিলনের লগ্ন এগিয়ে এল। পাঁচ বছর তিন মাস আগে যে বাগদান সম্পাদিত হয়েছিল তার পূরণ ঘটল। পনেরো বছরের সেদিনের খুররম এখন কুড়ি বছর তিন মাস। কিশোরী আর্জুমন্দও বেড়ে ওঠে এখন ভরা যৌবন – উনিশ বছর এক মাস। ইতিমাদুদ্দৌলার (গিয়াস) পুত্ৰ ইতিকাদ খাঁর কন্যা আর্জুমন্দ-এর এই বিয়েতে রাত কাটাতে স্বয়ং সম্রাট এলেন ১৮ই খুরদাদ বৃহস্পতিবার খুররমের বাড়িতে। এক দিন এক রাত সেখানে থাকলেন। আনন্দমগ্ন খুররম পিতা, বেগম, মা, সৎমা হারেমের বাঁদিদের আর আমিরদের নানা মণিমুক্তা উপহারে তোষণ করলেন। অজস্ৰ অর্থব্যয়ে বিবাহ-উৎসব সর্বকালীন শ্রেষ্ঠ আনন্দোৎসবে পৰ্যবসিত হল। শোভা-যাত্রা, বাজী পোড়ানোর উজ্জলতায় দিন ও রাত্রি মোহিত হল ৷ সমগ্র আগ্রা নগরীও যুবতীর শোভায় শোভিতা। ধন্য হল ১৬১২-এর এপ্রিলের সন্ধ্যা।
এর পাঁচ বছর পরে খুররমের হারেমে এলেন তার তৃতীয় বেগম – সুখ্যাত আবদুর রহিম খান খানানের পুত্র শাহনওয়াজ খানের কন্যা। কিন্তু এই সব পত্নীরা (এবং অবশ্যই রক্ষিতাগণ) কি আর্জুমন্দের সৌভাগ্যসূর্যকে রাহুগ্রস্ত করতে পারল? পারেনি। মুঘল বংশের ইতিহাসে এমন প্রায় একপত্নীলগ্ন সম্রাট পুত্র আর কেউ হতে পারলেন না। স্বামীর নিসপত্ন অধিকারে আর্জুমন্দ বাণুর দিন কাটাতে লাগল ৷ না, ভুল বললাম – এখন তিনি আহমদনগর বিজয়ী শাহজাহানের পত্নী। নিজেও আর আর্জুমন্দ নন – মহলের প্রবেশের অধিকার পেয়েছেন, সন্তানবতীও হয়েছেন। এখন তিনি মমতাজমহল – মমতাজ-ই-মহল ‘chosen one of the palace’. সুন্নী-শিয়ার দূরত্ব গেছে দুরে – গভীর প্রেমে মগ্ন দোঁহে – জীবন-যৌবন সফল করি মানলু – দশদিশ ভেল নিরদ্বন্দ্বা।
মমতাজ-এর গভীর ভালবাসার অত্যুজ্জল আলোকে শাহজাহানের অন্য পত্নীরা আবৃত হয়ে গেছেন। প্রথম মহিষী কান্দাহার বেগমের, একটি কন্যা জন্মে ১৬১১-এর -১২ই আগস্টে। রুকিয়া বেগম এই কন্যাটিকে মানুষ করেন। কিন্ত এই পারহেজ বানু নামে সম্ৰাট কন্যাটি সম্পর্কে কতটুকুই বা আমরা জানি।
মমতাজই শাজাহানের সৰ্বস্ব। তার প্রেম এবং প্রেমের অত্যাচার, সবই তিনি তাঁকে দিয়ে ধন্য সার্থক। এরই ফলে শাজাহানের চোদ্দটি সন্তানবাহনের দুঃসহ বেদনা এই সর্বকালের সুন্দরী শ্রেষ্ঠাকে বহন করতে হয়েছিল। আর ক্রমাগত এই শারীরিক ক্ষয় তাকে নিয়ে চলেছিল মৃত্যুর অবধারিত লক্ষ্যে। চোদ্দটি সন্তানের সাতটি মাত্র জীবিত ছিল তার জীবৎকালের মধ্যে। চোদ্দটির মধ্যে আটটি ছিলেন পুত্র, ছটি কন্যা সন্তান। প্রথমে জন্মগ্রহণ করেন একটি কন্যা – নাম, খুব সম্ভব চমানি বেগম। জাহানারা (১৬১৪-৮১) তার দ্বিতীয় সন্তান, জন্ম হয় আজমীরে ২৩ মাৰ্চ ১৬১৪ খ্রিষ্টাব্দে। দারা শিকোহ তার তৃতীয় সন্তান এবং প্রথম পুত্ৰ (মৃত্যু ১৬৫৯) জন্মগ্রহণ করেন ২০ মার্চ ১৬১৫ খ্রীষ্টাব্দে আজমীরে l এই আজমীরেই জন্মগ্রহণ করেন শাহ সুজা (মৃত্যু ১৬৬০) ২৩ জুন ১৬১৬ তারিখে। তৃতীয় কন্যা সন্তান রোশন আরা বেগমের জন্ম বুরহানপুরে (মৃত্যু ১৬৭১), জন্ম তারিখ ২৪ আগস্ট ১৬১৭। ষষ্ঠ সন্তান ঔরঙ্গজেব (মৃত্যু ১৭০৭) জন্মগ্রহণ করেন ১৬১৮, ২৪ অক্টোবর। তার জন্মস্থান দৌহাদ। দশম সন্তান মুরাদের (মৃত্যু ১৬৬১) জন্মস্থান রোহটাস, জন্ম তারিখ ২৯ আগস্ট ১৬২৪। ১৩ এপ্রিল ১৬৩০-এ জন্ম লাভ করেন স্বল্পজীবী কন্যা হাসন আরা বেগম বুরহানপুরে। বুধবার শেষ সন্তান এল কন্য়া রূপে ৭ জুন ১৬৩১-এর রাতে। মা এবং চতুৰ্দশ সন্তানটির মৃত্যুলগ্ন সুচিত হল সেইক্ষণেই।
১৬১২-১৬৩১ উনিশ বছরের গাঢ় দাম্পত্য জীবনে চোদ্দটি সন্তানের উপহার শাহজাহানকে তৃপ্ত করতে পেরেছিল কিনা জানি না, কিন্তু অবধারিত ক্ষয় মমতাজকে ক্লিন্ন করে তুলছিল ক্রমাগত। মমতাজমহল সম্ৰাজ্ঞী হলেও তার বড়ো পরিচয় তিনি মা। ইতিপূৰ্বে ছ’টি সন্তানের অকালমৃত্যুর বেদনা তাকে সইতে হয়েছে গোপনে – ঠোঁট চেপে। শাহজাহান সে বেদনায় সঙ্গী হয়েছিলেন কিনা জানি না, কিন্ত অপরিসীম স্নেহে শ্বশুর জাহাঙ্গীর পূর্ববৎ পাশে দাঁড়াতে চেয়েছেন সহানুভূতির অজস্ৰ সান্তনা নিয়ে। শোকবিহ্বল জাহাঙ্গীর নিজের আত্মজীবনী পর্যন্ত মমতাজের
কন্যা চমানি বেগমের মৃত্যুতে শোকাহত হয়ে লিখতে পারেননি। তার আদেশে ইতিমাদুদ্দৌলা লিখেছিলেন – ‘এই হৃদয়বিদায়ী দুখবর্ধনকারী ঘটনা আল্লার ছায়া সেই পবিত্র পুরুষের (জাহাঙ্গীরের) কি অবস্থা ঘটেছে সে সম্বন্ধে আর কি লিখব। পৃথিবীর আত্মার (জাহাঙ্গীর) যখন এই অবস্থা তখন আল্লার অন্য সেবকদের (খুররম ও তীর পত্নী) – যাদের জীবন এই পবিত্র প্রাণের সঙ্গে আবদ্ধ – তাদের মনের অবস্থা কি হতে পারে?’ মেয়ে চলে গেল – মমতাজমহল ডাক ছেড়ে কাঁদতেও পারেননি। মেয়েও গেল ১৫ জুন ১৬১৬ আর তার মাত্র আট দিন পরে তিনি জন্ম দিলেন শাহসুজার। মৃত্যু ও জন্মের আলো-ছায়ায় মমতাজের জীবনের সায়াহ্ন তাই ধীরে ঘনিয়ে এল। অঙ্গুরীবাগের বাগানে মমতাজের পদচারণা আগেই বন্ধ হয়েছিল, এবার স্তব্ধ হল চিরতরে।
উনিশ বছর দাম্পত্য জীবনে মমতাজমহলের প্রেম নূরজাহানের চেয়ে সুগভীর ছিল। রাজ্য আর অর্থের লালসা তাকে ক্ষুদ্ৰচেতা করতে পারেনি। তাই দক্ষিণ ভারত থেকে ওড়িশা, বাংলা-বিহারে স্বামীর প্রেমের অতল বৈভবে মগ্ন থেকে দুখময় শিবির জীবনকে বরণ করে নিতে পেরেছিলেন। কোনো সময়েই তিনি শূন্য গর্ভ থাকতেন না, স্বামীর প্রণয়ের জান্তব চিহ্ন ধারণ করেই তাকে শিবির জীবনের পীড়ন-উদ্বেগ সহজভাবে গ্রহণ করতে হয়েছিল। কিন্তু একটা সান্তনা ছিল তার। তার গৰ্ভজাত পুত্ৰ-কন্যাই শাজাহানের অন্তরের স্বীকৃতি পেয়েছে সর্বাধিক – তার সপত্নীদের সন্তানেরা নয়। একটি পত্নীতে এমন সমলগ্ন থাকাটাই বোধহয় তার প্রতি শাহজাহানের প্রেমের একনিষ্ঠতার জাজ্বল্য উদাহরণ। শাহজাহান যে মদ্যপানে অনাসক্তি দেখাতেন তার কারণ তিনি মমতাজের রূপমদে মগ্ন ছিলেন আকণ্ঠ। সাম্রাজ্যের প্রথম তিন বছরের মধ্যেই আগ্রাদুর্গের মধ্যে মমতাজকে একটি সর্বাঙ্গসুন্দর প্রাসাদে স্থাপন করে শাহজাহান প্রেমের সিংহাসন রচনা করেছিলেন।
তার বত্রিশ বছরের রাজত্বে অর্ধেকের বেশি সময় শাহজাহানকে কাটাতে হয়েছে রাজধানী থেকে দূরে। এমনি ঘুরতে ঘুরতে ১ মার্চ ১৬৩০-এ তিনি সপরিবারে এলেন বুরহানপুরে। এখানে দু বছর স্থিতির মধ্যে মমতাজমহল পর পর দুটি কন্যার জন্ম দিলেন। শেষের দুর্ভাগা কন্যাটি এল ১৬৩১-এর ৭ই জুনের রাত্রে।
দিনটা ছিল বুধবার। এবার আর প্রসবের ধকল সইতে পারলেন না রক্তহীন চতুৰ্দশ সন্তানের রূপবতী জননী মমতাজ। প্রসবের পর মুহূর্তেই তিনি ক্রমাগত মৃত্যুর গহ্বরে তলিয়ে যেতে লাগলেন। সপ্তদশী কন্যা – ঠিক মায়ের মতই দেখতে জাহানারা বেগম – মায়ের পাশটিতেই ছিলেন। মমতাজের কণ্ঠ যেন কোন অতল থেকে তাকে পাশে ডেকে বলল – ওঁকে একবার ডেকে দে তো মা। জাহানারা ছুটে গিয়ে পিতাকে পাশের ঘর থেকে ডেকে আনলেন। ভীতত্রস্তজড়িত পদে শাহজাহান এসে দেখলেন – এ কী তার আদরের আলিয়া বেগম এমন নিস্পন্দ কেন? গভীর প্রেমে জড়িয়ে ধরলেন প্রিয়তমার শীতল পদ্মহাত দুটি। একরাশ ক্লান্তি জড়ানো অসিতকৃষ্ণ চক্ষুপল্পব দুটি কোনোক্রমে একটু উন্মোচিত করে দূরাগত স্বরে মমতাজ স্বামীকে বললেন – আমার তোমার ছেলে-মেয়েরা রইল তুমি দেখো, আমি যাই, যেতে দাও, যাই।
শাহজাহান চুপ করে বসে রইলেন। তিনি কি বুঝতে পারছেন না তার মালিক-ই-জামানি তাকে ছেড়ে দিনদুনিয়ার মালিকের চরণ প্রান্তে আশ্রয় নিতে কখন চলে গেছেন। গভীর প্রেমে শাহজাহান কি তখনও দেখছেন তাঁর মমতাজমহল – তার আদরের আলিয়া বেগম – একটু যেন সাদা হয়ে গেছেন – গালের দু পাশের সেই লালিমা কেমন যেন ফিকে হয়ে গেছে ৷ ও বোধহয় ঘুমুচ্ছে। আহা ঘুমুক।
জাহানারার অস্ফূট কান্নার আওয়াজে শাহজাহানের বুঝি সম্বিত ফিরলো। তাহলে সে নেই। ডুকরে কেঁদে উঠলেন তিনি। তারপর সমগ্ৰ রাজ্য কাঁদল – শাহজাহান আর দররারে যান না। পুত্রেরা বিদ্রোহ করে ধ্বংস হল। তাজমহল নির্মিত হল – প্রেমের সমাধি।
তবে কি মমতাজ শুধু শাহজাহানের পত্নী প্রিয়তমা আর তার সন্তান ধারণের পাত্রীবিশেষ? এতেই মমতাজ শেষ? তাজমহলের আভ্যন্তরীণ প্রেমের সুরভি কি অতিরিক্ত কোনো কথা বলে না? বলে বই কি! কি বলে?
মমতাজ সুন্দরী ছিলেন? সাজতে ভালবাসতেন ? সাজলে তাকে ঠিক বেহেস্তের হুরী মনে হত? আটত্রিশ বছরে চোদ্দটি সন্তানের জননীর যৌবন মনোলোভা ছিল ? না, মমতাজ এসবের উর্ধ্বে ছিলেন। শাহজাহান তাকে মালিক-ই-জামানি উপাধি দিয়েছিলেন। এমন কি তাঁকে রাজকীয় শীলমোহরের অধিকারিণী করেছিলেন। মমতাজ নিজের নামে ফরমানও ব্যবহার করতেন। কিন্তু ক্ষমতা তাঁকে মদমত্ত করেনি। অপরিসীম দয়া সেই অর্থের সদ্যবহার করতে শিখিয়েছিল। কত অনাথ শিশু, কত বিধবা রমণী, কত অন্ধ আতুর প্রতিদিন নিয়মিত তার দানে পুষ্ট হতো – তার হিসাব ইতিহাস রাখেনি। তার প্রধান সহচরী সতী-উন-নিসা খানম তর সমস্ত বদান্যতায় তাঁকে উৎসাহিত করতেন প্রবলভাবে। আজও এই সহচরীর পার্শ্ববতী কবরে থেকে মমতাজ সে-সব দিনের কথা
বলেন কিনা যদি শুনতে পেতাম!
পুত্র কন্যাদের দায়িত্ব পালন করতে পারতেন কি এই বিদুষী মহিলা ? স্নেহ ছিল তার অপরিসীম, কিন্ত সেই স্নেহে শাসনের বন্ধন ছিল না। কেবল দারাশিকোর বিয়ের একটা ব্যবস্থা করে গিয়েছিলেন তিনি।
আসলে মমতাজমহলের অভ্যন্তরে একটি মানুষই চিরকাল আধিপত্য করতে পেরেছেন তার প্রেমের রাজদন্ড হাতে। তারই জন্য তিনি শিবিরে শিবিরে ঘুরেছেন। তারই হাত থেকে বার বার উপহার পেয়ে গৌরবান্বিত হয়েছেন।
সেই উপহার ১৬৩০ এর অভাবিত দুর্ভিক্ষে বিলিয়ে দিয়ে কৃতাৰ্থ বোধ করেছেন। তারই প্রেমে শিয়া ধর্মের সঙ্গে সুন্নীর বিষমধাতুতে মিলন ঘটেছে। তাকেই মমতাজ ধর্মব্যাপারে প্রভাবিত করেছিলেন – সেজন্য়ই কি শাহজাহান এত হিন্দু এবং খ্রীষ্টবিরোধী হয়ে পড়েছিলেন ? অথচ মমতাজের অন্তরে তো একটি পবিত্র ভক্তিমতি প্রাণ নিবাস করতো গভীর বিনম্ৰতায়, উপবাস-আচারে নিজেকে পবিত্র করে রাখতো।
একবার পোতুৰ্গীজ দস্যুরা মমতাজমহলের দুটি বাঁদীকে অপহরণ করে নিয়ে গিয়েছিল। শাজাহান তাদের কি শাস্তিটাই না দিয়েছিলেন। তার গভীর প্রেমের জন্যই শ্বশুর আসফ খাঁ-কে শাহজাহানের রাজকীয় পাঞ্জা ব্যবহার পর্যন্ত করতে দিয়েছিলেন। তার অন্য স্ত্রীরা শাহজাহানের শক্তি ক্ষয় করেছিল মাত্ৰ।
(FAQ) শাহজাহানের অন্দরমহল সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য
১। শাহজাহান কে ছিলেন? ভারতের একজন বিখ্যাত মোঘল সম্রাট হলেন শাহজাহান।
২। শাহজাহানের অন্দরমহলের পাটরানী কে ছিলেন? মমতাজমহল।
৩। কার স্মৃতিতে শাহজাহান তাজমহল নির্মাণ করাণ? তার প্রিয়তমা পত্নী মমতাজমহলের স্মৃতিতে।
৪। শাহজাহানের প্রথম বিবাহিত পত্নী কে ছিলেন? মমতাজমহল