দূরপ্রাচ্যে সাম্রাজ্যবাদ

দূরপ্রাচ্যে সাম্রাজ্যবাদ প্রসঙ্গে দূরপ্রাচ্যের দেশ জাপানে সাম্রাজ্যবাদের প্রসার, পেরির জাপানে আগমন, জাপানের থেকে অতিরাষ্ট্রিক অধিকার আদায়, বিদেশিদের প্রতিরোধ, দূরপ্রাচ্যের দেশ চিনে সাম্রাজ্যবাদের প্রসার, প্রথম ইঙ্গ-চীন যুদ্ধ, নানকিং এর সন্ধি, দ্বিতীয় ইঙ্গ-চীন যুদ্ধ, চীন জাপান যুদ্ধ, চীনে রুশ আগ্রাসন, চিনের খণ্ডকরণ, আমেরিকার মুক্তদ্বার নীতি ও জাপানের পরবর্তী উদ্যোগ সম্পর্কে জানবো।

দূরপ্রাচ্যে সাম্রাজ্যবাদ

ঐতিহাসিক ঘটনাদূরপ্রাচ্যে সাম্রাজ্যবাদ
দূরপ্রাচ্যচীনজাপান
প্রথম আফিমের যুদ্ধ১৮৩৯-৪২ খ্রি
নানকিং এর সন্ধি১৮৪২ খ্রি
দ্বিতীয় আফিম যুদ্ধ১৮৫৬-৫৮ খ্রি
চিন-জাপান যুদ্ধ১৮৯৪-৯৫ খ্রি
মুক্তদ্বার নীতি১৮৯৯ খ্রি
দূরপ্রাচ্যে সাম্রাজ্যবাদ

ভূমিকা :- দূরপ্রাচ্য বলতে সাধারণভাবে জাপান ও চিনকে বোঝায়। এই দুই দেশের মানুষ নিজেদের দেশের সভ্যতা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে অত্যন্ত গর্ববোধ করত। এজন্য তারা বহির্বিশ্বের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখতে আগ্রহী ছিল না। তা সত্ত্বেও এই দুই দেশ সম্পর্কে বিদেশি সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলির আগ্রহ বৃদ্ধি পায়।

দূরপ্রাচ্যের দেশ জাপানে সাম্রাজ্যবাদের প্রসার

জাপান বহির্জগত থেকে দীর্ঘদিন বিচ্ছিন্ন ছিল। জাপানের গুরুত্বপূর্ণ ভৌগোলিক অবস্থান এবং প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য বিদেশিদের জাপানের প্রতি প্রলুদ্ধ করে। উনিশ শতকের মাঝামাঝি এই বিচ্ছিন্নতার অবসান ঘটলে ইউরোপীয়রা জাপানে প্রবেশ করতে থাকে। –

(ক) পেরির জাপানে আগমন

মার্কিন সেনাপতি কমোডোর ম্যাথু পেরি চার হাজার মার্কিন সৈন্য এবং সাতটি যুদ্ধজাহাজ নিয়ে ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে জাপানের ইয়েডো বন্দরে হাজির হন। জাপানের ভীত শোগুন-সরকার ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকার সঙ্গে অপমানজনক কানাগাওয়ার সন্ধি স্বাক্ষরে বাধ্য হয়। সন্ধির শর্তানুসারে শিমোগা ও হাকোডাটা বন্দর দুটি আমেরিকার বাণিজ্য জাহাজের জন্য খুলে দেয়।

(খ) জাপানের থেকে অতি রাষ্ট্রিক অধিকার আদায়

আমেরিকার অনুকরণে ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ড, ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়া এবং ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে হল্যান্ড বা নেদারল্যান্ডস জাপানকে অনুরূপ চুক্তি স্বাক্ষরে বাধ্য করে। তারা জাপানের কাছ থেকে বিভিন্ন ‘অতি-রাষ্ট্রিক অধিকার’ আদায় করে।

(গ) বিদেশিদের প্রতিরোধ

ইতিমধ্যে জাপানে আধুনিকীকরণের আন্দোলন শুরু হয়। বিভিন্ন সংস্কার প্রবর্তনের মাধ্যমে জাপান একটি আধুনিক শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। জাপান বিদেশি আধিপত্য প্রতিরোধ করতে শুরু করে এবং বিদেশিদের সঙ্গে বিভিন্ন বৈষম্যমূলক চুক্তি বাতিল করে। ক্রমে জাপানই বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী পদক্ষেপ গ্রহণ করে।

দূরপ্রাচ্যের দেশ চিনে সাম্রাজ্যবাদের প্রসার

চিনের বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ ইউরোপীয় বণিক জাতিগুলিকে প্রলুব্ধ করে। ষোড়শ শতকে পোর্তুগিজ এবং সপ্তদশ শতকে ওলন্দাজ, ইংরেজ ও স্পেনীয়রা চিনে বাণিজ্য কুঠি নির্মাণ করে। চিনারা এসব বিদেশিদের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনে মোটেই আগ্রহী ছিল না। তাই বিভিন্ন বিধিনিষেধ ও অপমানজনক শর্তাদি মেনে ইউরোপীয়রা চিনের একমাত্র ক্যান্টন বন্দরে বাণিজ্য করার অধিকার পায়। ইউরোপীয়রা চিনের কাউ-তাউ প্রথা মানতে রাজী ছিল না। –

(ক) প্রথম ইঙ্গ-চিন যুদ্ধ

ইতিমধ্যে আফিং বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে ইংরেজদের সঙ্গে চিনের বিরোধ বাধে শুরু হয় যুদ্ধ। ১৮৩৯-৪২ খ্রিস্টাব্দে প্রথম ইঙ্গ-চিন বা প্রথম অহিফেন যুদ্ধে চিনের দুর্বল মাঞ্চু শাসকরা ইংরেজদের কাছে পরাজিত হয়।

(খ) নানকিং-এর সন্ধি

পরাজিত চিন ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দে অপমানজনক নানকিং-এর সন্ধি স্বাক্ষরে বাধ্য হয়। সন্ধির শর্তানুসারে,

  • (১) ইংরেজরা হংকং লাভ করে।
  • (২) ইউরোপীয়দের বাণিজ্যের জন্য ক্যান্টন-সহ পাঁচটি বন্দর খুলে দেওয়া হয়।
  • (৩) এই পাঁচটি বন্দরে ইংরেজরা ‘অতি-রাষ্ট্রিক অধিকার’ লাভ করে। ইংল্যান্ডের সাফল্য আমেরিকা, ফ্রান্স, নরওয়ে, সুইডেন প্রভৃতি দেশকে চিনের সঙ্গে বাণিজ্যিক চুক্তি স্বাক্ষরে উৎসাহিত করে।

(গ) দ্বিতীয় ইঙ্গ-চিন যুদ্ধ

ইংল্যান্ডের সঙ্গে ফ্রান্সও দ্বিতীয় ইঙ্গ-চিন বা দ্বিতীয় অহিফেন যুদ্ধে (১৮৫৬-৫৮ খ্রি.) চিনের বিরুদ্ধে যোগ দেয়। চিন যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের সাথে তিয়েনসিন-এর সন্ধি (১৮৫৮ খ্রি.) স্বাক্ষরে বাধ্য হয়।

(ঘ) তিয়েনসিন -এর সন্ধির শর্ত

এই সন্ধির শর্তানুসারে,

  • (১) চিনের এগারোটি বন্দর বিদেশিদের জন্য খুলে দেওয়া হয়।
  • (২) চিনের বিদেশি বণিকরা চিনা আইনের এক্তিয়ার থেকে মুক্ত হন।
  • (৩) চিনে বিদেশি দূতাবাস স্থাপন ও খ্রিস্টধর্ম প্রচারের অধিকার দেওয়া হয়।

(ঙ) চিন-জাপান যুদ্ধ

শক্তিবৃদ্ধির পর জাপান নিজেই ক্রমে সাম্রাজ্যবাদী নীতি গ্রহণ করে। চিনের অধীনস্থ কোরিয়া দখলের উদ্দেশ্যে জাপান ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে চিন আক্রমণ করে। চিন-জাপান যুদ্ধে (১৮৯৪-৯৫ খ্রি.) চিন পরাজিত হয়।

(চ) শিমনোসেকির সন্ধি

পরাজিত চিন ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে জাপানের সঙ্গে শিমনোসেকির সন্ধি স্বাক্ষরে বাধ্য হয়। এই সন্ধির দ্বারা-

  • (১) চিনের মাঞ্চুরিয়া প্রদেশের লিয়াও-টুং উপদ্বীপ, ফরমোজা ও পেসকাডোরেস দ্বীপপুঞ্জ জাপান দখল করে।
  • (২) চিনের কয়েকটি বন্দর জাপানের বণিকদের জন্য খুলে দেওয়া হয়।
  • (৩) জাপানের নাগরিকরা চিনে কারখানা ও শিল্প স্থাপনের অধিকার পায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, এই সন্ধির দ্বারা কোরিয়া একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃত হলেও তা জাপান শীঘ্রই দখল করে নেয়।

(ছ) চিনে রুশ আগ্রাসন

  • (১) জাপান চিনের মাঞ্চুরিয়া প্রদেশের লিয়াও-টুং উপদ্বীপ দখলের চেষ্টা করলে জাপানকে প্রতিহত করে রাশিয়া সেই উপদ্বীপ দখল করে নেয়। রাশিয়া চিনের উত্তর সীমান্তে অবস্থিত মোঙ্গালিয়ার আমুর উপত্যকা দখল করে সেখানে ভ্লাডিভোস্টক বন্দর স্থাপন করে।
  • (২) এরপর রাশিয়া চিনের লিয়াও-টুং-এর পোর্ট আর্থার দখল করে। ভ্লাডিভোস্টক বন্দরকে রেলপথের দ্বারা সেন্ট পিটার্সবার্গ-এর সঙ্গে এবং পোর্ট আর্থার বন্দরকে ট্রান্স-সাইবেরীয় রেলপথের সঙ্গে যুক্ত করা হয়।

(জ) চিনের খণ্ডকরণ

চিনের ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে রুশ-জাপান প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হলে ইউরোপীয় শক্তিগুলিও নতুন করে চিনের ওপর ঝাপিয়ে পড়ে। যেমন  – (১) জার্মানি কিয়াওচাও বন্দর দখলের পর শান্টুং প্রদেশেও নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে। (২) ইংল্যান্ড ইয়াংসি উপত্যকায় নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। (৩) ফ্রান্স ইন্দোচিন-এর আনাম থেকে চিনের অভ্যন্তরভাগ পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের অধিকার পায়। এভাবে চিনে বিদেশি ঔপনিবেশিক শক্তিগুলির আধিপত্য যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়।

(ঝ) আমেরিকার মুক্তদ্বার নীতি

  • (১) চিনে ইউরোপীয় শক্তিগুলির আধিপত্যের ফলে আমেরিকা আশঙ্কিত হয় যে, ভবিষ্যতে চিনে হয়তো মার্কিন বাণিজ্যের কোনো সুযোগ থাকবে না। এজন্য মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব স্যার জন হে ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে তাঁর বিখ্যাত ‘মুক্তদ্বার নীতি’ ঘোষণা করেন।
  • (২) এই নীতিতে বলা হয় যে, বিভিন্ন শক্তির দ্বারা অধিকৃত চিনের বিভিন্ন অঞ্চলে আমেরিকাকে বাণিজ্যের সমান সুযোগ দিতে হবে। এভাবে চিনে আমেরিকা অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদ চালায়। পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু এই নীতিকে ‘অদৃশ্য সাম্রাজ্যবাদ’ বলে অভিহিত করেছেন।

(ঞ) জাপানের পরবর্তী উদ্যোগ

  • (১) ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে চিনে বক্সার বিদ্রোহ-এর সময় মাঞ্চুরিয়ার রেলপথ রক্ষার অজুহাতে রুশ সেনাদল চিনে প্রবেশ করে মাঞ্চুরিয়া দখল করে নেয়। এর ফলে রাশিয়ার বিরুদ্ধে জাপান যুদ্ধ ঘোষণা করলে রুশ-জাপান যুদ্ধ (১৯০৪-১৯০৫ খ্রি.) শুরু হয়। যুদ্ধে রাশিয়া পরাজিত হয়ে পোর্টসমাউথের সন্ধি (১৯০৫ খ্রি.) স্বাক্ষরে বাধ্য হয়। এর দ্বারা জাপান লিয়াও-টুং ফিরে পায়।
  • (২) জাপান ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে সমগ্র কোরিয়া দখল করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-এর সময় চিনের জার্মান উপনিবেশ শান্টুং জাপান দখল করে চিনের ওপর ‘একুশ দফা দাবি’ (১৯১৫ খ্রি.) চাপিয়ে দেয়। চিন এর অধিকাংশ দাবি মেনে নিয়ে জাপানকে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দিতে বাধ্য হয়।

উপসংহার :- ঐতিহাসিক ভিনাকের মতে বিদেশি উপনিবেশিক শক্তি গুলি চীনা তরমুজকে খন্ড খন্ড করে নিজেদের মধ্যে বন্টন করতে থাকে। এই ঘটনা চিনা তরমুজের খন্ডিকরন নামে পরিচিত।

(FAQ) দূরপ্রাচ্যে সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. দূরপ্রাচ্য বলতে কোন কোন দেশকে বোঝায়?

চিন ও জাপান।

২. জাপানে প্রথম পদার্পণ করে কোন সেনাপতি?

আমেরিকার কমোডোর ম্যাথু পেরি।

৩. প্রথম অহিফেন যুদ্ধ সংঘটিত হয় কখন?

১৯৩৯-৪২ খ্রিস্টাব্দে।

৪. নানকিং এর সন্ধি স্বাক্ষরিত হয় কখন?

১৮৪২ খ্রিস্টাব্দে।

৫. চিন জাপান যুদ্ধ সংঘটিত হয় কখন?

১৮৯৪-৯৫ খ্রিস্টাব্দে।

৬. রুশ জাপান যুদ্ধ সংঘটিত হয় কখন?

১৯০৪-০৫ খ্রিস্টাব্দে।

Leave a Comment