দেবী মনসা প্রসঙ্গে বিভিন্ন নাম, পূজিত অঞ্চল, পূজার উদ্দেশ্য, মনসার পরিচয়, দেবীত্ত্ব অস্বীকার, মনসা দেবীর উৎস, দেবী রূপে মনসা, ঋগ্বেদে উল্লেখ, মহাভারতের কাহিনী, পুরাণের বর্ণনা, মনসা মঙ্গল কাব্যের বর্ণনা, প্রতিমা কল্পনা, মনসা ঘট ও মন্দির সম্পর্কে জানবো।
নাগদেবী দেবী মনসা
দেবী | মনসা |
পিতা | মহাদেব |
স্বামী | জরৎকারু মুনি |
পুত্র | আস্তিক |
পরিচিতি | নাগদেবী |
ভূমিকা :- পৌরাণিক সনাতন ধর্মাবলম্বীদের দেবী হলেন মনসা। ভাগবত পুরাণ সহ আরও অনেক পুরাণে দেবী মনসার উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি নাগদেবী। মনসা নাগরাজ বা সর্পরাজ বাসুকীর ভগিনী এবং ঋষি জরৎকারুর স্ত্রী।
দেবী মনসার বিভিন্ন নাম
মনসা দেবীর অপরাপর নামগুলি হল বিষহরি বা বিষহরা অর্থাৎ বিষ ধ্বংসকারিণী, নিত্যা বা চিরন্তনী ও পদ্মাবতী।
দেবী মনসার পূজিত অঞ্চল
প্রধানত পূর্বভারতীয় অঞ্চল অর্থাৎ অবিভক্ত বঙ্গ, ঝাড়খণ্ডের অঙ্গ-প্রদেশ, বিহারের মিথিলাঞ্চল, আসামে মনসা দেবীর পূজা অতি প্রচলিত তবে উত্তর এবং দক্ষিণ ভারতীয় অন্যান্য অঞ্চলেও তার পূজা হয় এবং মন্দির আছে।
মনসা পূজার উদ্দেশ্য
প্রধানত যে কোনো বিষধর প্রাণীর হাত থেকে রক্ষা ও বিষের প্রতিকার পেতে, প্রজনন ও ঐশ্বর্যলাভের উদ্দেশ্যে তার পূজা করা হয়। ঘট স্থাপন করে মনসার পুজো করা হয়।
দেবী মনসার পরিচয়
বিশিষ্ট দেবী মনসা শিবের স্বীকৃতকন্যা ও ঋষি জরৎকারুর পত্নী। ঋষি জরৎকারু মনসাকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। মনসার মা চণ্ডী বা পার্বতী তাঁকে ঘৃণা করতেন। অবশ্য পরবর্তীতে মাতা চণ্ডী মনসাকে নিজের মেয়ের স্বীকৃতি দিয়েছিলেন।
মনসার দেবীর নির্দয়তা
কোনো কোনো ধর্মগ্রন্থ অনুযায়ী শিব নয়, ঋষি কাশ্যপ হলেন মনসার পিতা। মনসাকে ভক্তবৎসল বলে বর্ণনা করা হলেও তিনি ছিলেন নির্দয়। কেউ পূজা করতে অস্বীকার করলে তার প্রতি তিনি নির্দয়ভাবে আচরণ করতেন।
সর্পদেবী মনসার দেবীত্ব অস্বীকার
জন্মগত কারণে মনসার পূর্ণ দেবীত্ব প্রথমে অস্বীকার করা হয়। তাই মনসার উদ্দেশ্য ছিল দেবী হিসেবে নিজের কর্তৃত্ব স্থাপন করা এবং একনিষ্ঠ ভক্তমণ্ডলী গড়ে তোলা। তার সাথে মিশর -এর দেবী আইসিসের মিল রয়েছে।
নাগ-জননী মনসা দেবীর উৎস
- (১) মনসাকে পুরাণে ঋষি কাশ্যপ ও নাগ-জননী কদ্রুর কন্যা বলা হয়েছে। চতুর্দশ শতক নাগাদ মনসা প্রজনন ও বিবাহের দেবী হিসেবে চিহ্নিত হন এবং শিবের আত্মীয় হিসেবে শৈব দেবমণ্ডলীর অন্তর্ভুক্ত হন। কিংবদন্তি অনুযায়ী শিব বিষ পান করার পর মনসার মধ্যে তা সঞ্চার হয় এবং মনসা ‘বিষহরী’ নামে পরিচিত হন।
- (২) এরপর মনসার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়ে তা দক্ষিণ ভারত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে মনসা-কেন্দ্রিক ধর্মীয় গোষ্ঠীটি শৈবধর্মের প্রতিদ্বন্দ্বীতে পরিণত হয়। এর ফলে শিবের কন্যা রূপে মনসার জন্মের উপাখ্যানটি রচিত হয় এবং শেষ পর্যন্ত এই আদিবাসী দেবীকে মূলধারার হিন্দুধর্মের ব্রাহ্মণ্য ধারার অন্তর্ভুক্ত করে।
দেবী রূপে মনসা
- (১) মনসাদেবী মনসা, কেতকা, পদ্মাবতী নামেই সমধিক প্রসিদ্ধ। তিনিই মনসামঙ্গল বা পদ্মাপুরাণ কাব্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। তাই এই কাব্য মনসামঙ্গল বা পদ্মাপুরাণ নামে পরিচিত। মনসা প্রাক্-পৌরাণিক দেবী বলে প্রাচীন পুরাণে স্থান পাননি।
- (২) তিনি লোকব্যবহারে ও লোকসাহিত্যে অর্বাচীন বৈদিক সভ্যতা থেকে বিভিন্ন রূপ পরিবর্তন করে চলে আসছেন। অবশ্য কোনো কোনো প্রাচীন হিন্দু পুরাণ ও বৌদ্ধ গ্রন্থের সর্প দেবী রূপে মনসার বর্ণনা আছে। পদ্মাপুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ ও দেবীভাগবতে মনসার উল্লেখ রয়েছে।
- (৩) সংস্কৃত পুরান সাহিত্যে মনসা একবার মহাভারতের আদিপর্বে জন্মেজয়ের সর্পসত্রের পূর্বপ্রসঙ্গক্রমে ধরা দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রাচীন পুরাণ ও মহাভারতে যে সর্প দেবীর উল্লেখ আছে সেখানে তিনি হলেন জরৎকারু, আস্তিক তার ছেলে। মহাভারতে মনসার ও তার স্বামীর নাম একই – জরৎকারু।
ঋগ্বেদে মনসা দেবীর উল্লেখ
‘মনসা’ দেবতার ভাবনা ঋগ্বেদ -এর অজ্ঞাত ছিল না। ঋগ্বেদের একটি শ্লোকে মনসা দেবীর ইঙ্গিত পাওয়া যায়। –
“ত্রী সপ্ত ময়ুর্যঃ সপ্ত স্বসারো অগ্রু বঃ।
তাস্তে বিষং বিজভ্রির উদকং কুম্ভিনীরিব॥”
মনসা দেবী সম্পর্কে মহাভারতের বর্ণনা
- (১) মহাভারত মহাকাব্যে মনসার বিবাহের উপাখ্যান রয়েছে। জরৎকারু নামে এক ঋষি কঠোর তপস্যা করছিলেন। তিনি বিবাহ করবেন না বলে স্থির করেছিলেন। একবার তিনি তার পূর্বপুরুষদের কয়েকজনকে একটি গাছ থেকে উর্ধ্বপদ অবস্থায় ঝুলতে দেখেন।
- (২) তাদের সন্তানসন্ততিগণ তাদের পারলৌকিক ক্রিয়াদি সম্পন্ন না করার কারণে তাদের এই অবস্থা হয়েছিল। তাই তারা জরৎকারুকে বিবাহ করে একটি পুত্রসন্তান জন্ম দেবার পরামর্শ দেন, যাতে সেই পুত্র তাদের পারলৌকিক ক্রিয়াদি সম্পন্ন করে তাদের মুক্তি দিতে পারেন।
- (৩) এরপর বাসুকী তার বোন মনসার সঙ্গে জরৎকারুর বিবাহ দেন। মনসার একটি পুত্রসন্তান হয়। তার নাম রাখা হয় আস্তিক। তিনি তার পূর্বপুরুষদের মুক্ত করেন। রাজা জনমেজয় যখন সর্পকুল বিনষ্ট করার উদ্দেশ্যে যজ্ঞ করছিলেন তখন আস্তিক নাগ বংশকে রক্ষাও করেছিলেন।
দেবী মনসা সম্পর্কে পুরাণের বর্ণনা
- (১) মনসার জন্ম সংক্রান্ত উপাখ্যান পুরাণেই প্রথম পাওয়া যায়। পুরাণ অনুসারে মনসা ঋষি কাশ্যপের সন্তান তথা কাশ্যপ গোত্রজ। মঙ্গলকাব্যে শিবকে মনসার পিতা বলা হলেও পুরাণে এই তথ্যের সমর্থন পাওয়া যায় না।
- (২) একবার সাপ ও সরীসৃপরা পৃথিবীতে উৎপাত শুরু করলে ঋষি কাশ্যপ নিজের মন থেকে মনসা দেবীর জন্ম দেন। মন থেকে জন্ম বলে তার নাম হয় মনসা। সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা তাকে সর্প ও সরীসৃপদের দেবী করলে মনসা তার মন্ত্রবলে পৃথিবীতে নিজের কর্তৃত্ব বিস্তার করেন।
- (৩) এরপর মনসা শিবকে প্রসন্ন করলে শিব তাকে নারায়ণকে প্রসন্ন করতে বলেন। মনসার প্রতি প্রসন্ন হয়ে নারায়ণ তাকে সিদ্ধি নামক দৈবী ক্ষমতা প্রদান করলে দেবী হিসেবে মনসার কর্তৃত্ব সুবিদিত হয়।
- (৪) কাশ্যপ ঋষি জরৎকারুর সঙ্গে মনসার বিবাহ দেন। জরৎকারু মনসাকে বিবাহ করতে রাজি হয়েছিলেন। তবে মনসা তার কথার অবাধ্য হন তাহলে তিনি মনসাকে পরিত্যাগ করবেন । একবার মনসা জরৎকারুর নিদ্রাভঙ্গ করতে দেরি করেছিলেন বলে সেদিন জরৎকারুর পূজা করা হয়ে ওঠেনি।
- (৫) এই ঘটনায় দুঃখিত হয়ে জরৎকারু মনসাকে ত্যাগ করেন। পরে অবশ্য দেবতাদের অনুরোধে তিনি মনসার কাছে ফিরে আসেন। এরপর তাদের আস্তিক নামে এক পুত্রের জন্ম হয়।
প্রাচীন মনসা মঙ্গল কাব্যের বর্ণনা
- (১) ত্রয়োদশ থেকে অষ্টাদশ শতকের মধ্যবর্তী সময়ে ভারতীয় উপমহাদেশের বাংলা অঞ্চলে মনসা ও অন্যান্য দেবদেবীদের নিয়ে মঙ্গলকাব্য নামক এক শ্রেণির ভক্তিমূলক লৌকিক গাথাকাব্য রচিত হয়েছিল। এর মধ্যে বিজয়গুপ্তের মনসামঙ্গল কাব্য ও বিপ্রদাস পিপলাইয়ের মনসাবিজয় কাব্যে দেবী মনসার উৎপত্তি ও কিংবদন্তি বর্ণিত হয়েছে।
- (২) মনসাবিজয় কাব্য অনুসারে বাসুকীর মাতা একটি বালিকার মূর্তি নির্মাণ করেছিলেন। সেই মূর্তিতে শিবের বীর্য নিক্ষিপ্ত হলে তা থেকে মনসার জন্ম হয়। বাসুকী মনসাকে নিজ বোন বলে স্বীকার করে নেন।
- (৩) রাজা পৃথু যখন গাভীরূপী পৃথিবীকে দোহন করছিলেন তখন তা থেকে বিষের উৎপত্তি হয়। বাসুকী মনসাকে সেই বিষের কর্তৃত্ব প্রদান করেন। মনসা নিজ পিতৃপরিচয় দান করলে শিব মনসাকে গৃহে নিয়ে আসেন।
- (৪) শিবের স্ত্রী চণ্ডী বা পার্বতী মনে করেন মনসা শিবের অপর স্ত্রী। তাই তিনি মনসাকে অপমান করে তার একটি চোখ নষ্ট করে দেন। এরপর মনসা একচক্ষু বিশিষ্ট দেবীতে পরিণত হন। সমুদ্রমন্থনের সময় হলাহল বিষের প্রভাবে শিব যখন মৃতপ্রায় তখন মনসা তার প্রাণরক্ষা করেন।
- (৫) একদিন দেবী চণ্ডী মনসাকে পদাঘাত করেন। মনসা তখন বিষদৃষ্টি দিয়ে চণ্ডীকে অজ্ঞান করে দেন। চণ্ডী ও মনসার এই বিবাদে বীতশ্রদ্ধ হয়ে শিব মনসাকে একটি গাছের নিচে পরিত্যাগ করেন। তিনি মনসার চোখের জল থেকে নেতো বা নেতা নামে মনসার এক সঙ্গিনীকে সৃষ্টি করেন।
- (৬) পরে ঋষি জরৎকারু মনসাকে বিবাহ করেন। কিন্তু চণ্ডী মনসার ফুলশয্যার রাত নষ্ট করে দেন। তিনি মনসাকে সর্পালঙ্কার পরিধান করতে বলেছিলেন এবং ঘরে ব্যাঙ ছেড়ে দেন। ফলে সাপগুলি ঘরময় ছুটে বেড়াতে শুরু করে। ভয় পেয়ে জরৎকারু ঘর ছেড়ে পালিয়ে যান। পরে অবশ্য তিনি ফিরে আসেন। এরপর তাদের পুত্র আস্তিকের জন্ম হয়।
- (৭) নেতার পরামর্শে মানব ভক্ত সংগ্রহের উদ্দেশ্যে মনসা মর্ত্যে নেমে আসেন। প্রথম দিকে মানুষ তাকে উপহাস করত। কিন্তু যারা মনসার ক্ষমতা অস্বীকার করে তাদের জীবন দুর্বিসহ করে তুলে মনসা তাদের বাধ্য করেন তার পূজা করতে।
- (৮) মুসলমান শাসক হাসানের মতো বিভিন্ন জাতির মানুষকে মনসা তার ভক্ত করে তুলেন। কিন্তু চাঁদ সদাগর তার পূজা করতে রাজি হন না। মনসা লক্ষ্মী ও দেবী সরস্বতীর মতো একজন দেবী হতে চেয়েছিলেন। এই কাজে সফল হওয়ার জন্য চাঁদ সদাগরের হাতে পূজাগ্রহণ তার কাছে বাধ্যতামূলক ছিল।
- (৯) এদিকে চাঁদ সদাগর সঙ্কল্প করেছিলেন তিনি মনসার পূজা করবেন না। মনসা চাঁদ সদাগরকে ভয় দেখানোর জন্য একে একে তার ছয় পুত্রকে হত্যা করেন। শেষে মনসা ইন্দ্রের রাজসভার দুই নর্তক-নর্তকীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেন। এঁদের নাম ছিল অনিরুদ্ধ ও ঊষা।
- (১০) অনিরুদ্ধ চাঁদ সদাগর ও তার স্ত্রী সনকার সপ্তম পুত্র রূপে জন্মগ্রহণ করেন। তার নাম হয় লখিন্দর। ঊষা বেহুলা নামে জন্মগ্রহণ করেন সায় বেনের ঘরে। যথা সময়ে লখিন্দর ও বেহুলার বিবাহ হয়। মনসা কৌশলে বাসর ঘরে লখিন্দরকে হত্যা করেন।
- (১২) এরপর বেহুলা স্বামীর মৃতদেহ নিয়ে নদীতে ভেসে চলেন। শেষে তিনি স্বর্গে পৌঁছে দেবতাদের প্রতিশ্রুতি দিয়ে মর্ত্যে ফিরে আসেন। চাঁদ মনসার দিকে না তাকিয়েই বাঁ হাতে তার দিকে ফুল ছুঁড়ে পূজা করেন। মনসা এতেই খুশি হন। তিনি চাঁদের পুত্রদের জীবন এবং তার হারানো সম্পদও ফিরিয়ে দেন। মঙ্গলকাব্যে রয়েছে এরপর মনসার জনপ্রিয়তাও বৃদ্ধি পায়।
মনসার পূজা তিথি
আষাঢ় মাসের কৃষ্ণাপঞ্চমী তিথিকে বলা হয় নাগ পঞ্চমী। এই সময় বাড়ির উঠানে সিজগাছ স্থাপন করে মনসাদেবীর পূজা করা হয়। ভাদ্রমাসের কৃষ্ণাপঞ্চমী তিথিতেও মনসা পূজার বিধান আছে।
সর্বজনীন মনসা পূজা
বর্তমানে সর্বজনীনভাবে মনসাদেবীর মন্দিরে মনসা পূজা করা হয়। পারিবারিক পর্যায়ে পারিবারিক মন্দিরেও মনসাদেবীর পূজা হয়। প্রধানত সর্পাঘাতের হাত থেকে রক্ষা পেতে বা সর্পদংশনের প্রতিকার পেতে মনসার পূজা করা হয়।
বাংলায় মনসা পূজা
মনসার পূজা বাংলা অঞ্চলেই সর্বাধিক জনপ্রিয়। এখানকার অনেক মন্দিরেও বিধিপূর্বক মনসার পূজা হয়। বর্ষাকালে সাপের উপদ্রব বৃদ্ধি পেলে মনসার পূজা মহাসমারোহে হয়ে থাকে।
নিম্নবর্ণের হিন্দুদের মনসা পূজা
বাংলায় নিম্নবর্ণের হিন্দুদের কাছে মনসা একজন গুরুত্বপূর্ণ প্রজনন দেবী। তারা বিবাহের সময় ও সন্তান কামনায় মনসার পূজা করেন। বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে মনসার সঙ্গে নেতার, যিনি নেতা, নেতিধোপানি, নেতলসুন্দরী ইত্যাদি নামেও পরিচিত তার পূজাও করা হয়।
পশ্চিমবঙ্গের গ্ৰামে মনসা পূজা
আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে পুরো শ্রাবণ মাস ধরে মনসা পূজা হয়। পূজা উপলক্ষে হয় পালা গান ‘সয়লা’। এই পালার বিষয় হল পদ্মপুরাণ বা মনসা মঙ্গল। সারা রাত ধরে গায়ক পালা আকারে ‘সয়লা’ গান গায়। পুরুলিয়ার মনসা পূজায় হাঁস বলি দেওয়া হয়।
বাঁকুড়ার মনসা পূজা
জেলা বাঁকুড়ায় জ্যেষ্ঠ মাসের শুক্লপক্ষের দশমী তিথিতে দশহরা ব্রত পালন করে মনসা পূজা করা হয়। তখন এখানে ঘুড়ি ওড়ানো হয়। এখানে মনসা পূজার অঙ্গ হল অরন্ধন।
রাঢ় বাংলায় মনসা পূজা
পশ্চিমবঙ্গের রাঢ় বাংলায় চৈতন্যদেব -এর সময়ে মনসাকে মা দূর্গার এক রূপ মনে করা হত। তাই কোনো কোনো জায়গায় পূজায় বলি দেওয়া হত। আজও অনেক জায়গায় পূজায় পাঠা বলি হয়।
উত্তরবঙ্গে মনসা পূজা
উত্তরবঙ্গ অঞ্চলে রাজবংশী জাতির কাছে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ দেবদেবীদের অন্যতম হলেন মনসা। এখানে প্রায় প্রত্যেক কৃষক গৃহেই মনসার ‘থান’ বা বেদী দেখা যায়। দক্ষিণ দিনাজপুরের ফুলঘড়ায় শরৎকালে দুর্গাপূজার পরিবর্তে মনসা পূজা হয়। ৩০০ বছরের বেশি সময় ধরে এই পূজা হয়ে আসছে।
বাংলাদেশে মনসা পূজা
পূর্ববঙ্গের অর্থাৎ অধুনা বাংলাদেশ -এর নিম্নবর্ণীয় হিন্দুদের মধ্যেও মনসাপূজা বিশেষ জনপ্রিয়।
মনসা পূজায় বণিকদের অংশগ্রহণ
বাংলার বণিক সম্প্রদায়ের মধ্যেও মনসা পূজা বিশেষ প্রচলিত। কারণ, মনসামঙ্গল কাব্যের চাঁদ সদাগর, যিনি প্রথম মনসার পূজা করেছিলেন, তিনি ছিলেন একজন বণিক। এই কাব্যের নায়িকা বেহুলাও সাহা বা সায় বেনে নামক এক শক্তিশালী বণিক সম্প্রদায়ের গৃহে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
অসমে মনসা পূজা
ভারতের অসম রাজ্যেও মনসা পূজা বিশেষ জনপ্রিয়। এই রাজ্যে ওজা পালি নামে একধরনের সংগীতবহুল যাত্রাপালা সম্পূর্ণ মনসার কিংবদন্তিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।
সর্পকেন্দ্রিক উৎসব মনসা পূজা
নাগপঞ্চমী তিথি, শ্রাবণ সংক্রান্তি, ডাক সংক্রান্তি ও অন্য দিনে মনসার বিধিপূর্বক পূজা প্রচলিত। এই উৎসবটি হল একটি সর্পকেন্দ্রিক উৎসব। হিন্দু পঞ্জিকা অনুসারে শ্রাবণ (জুলাই-অগস্ট) মাসে এই উৎসব পালিত হয়। বাঙালি মেয়েরা এই দিন উপবাস করে ব্রত পালন করেন এবং সাপের গর্তে দুধ ঢালেন।
দেবী মনসার প্রতিমা কল্পনা
- (১) মনসার মূর্তি বা প্রতিমায় তাকে সর্প-পরিবেষ্টিত নারী রূপে দেখা যায়। তিনি একটি হংস বা পদ্মের উপর বসে থাকেন। হাঁস ও সাপ তার বাহন। তার চারটি হাতের উপরের দুটিতে থাকে পদ্ম ও নিচের দুটি হাতে থাকে সাপ।
- (২) এক বা একাধিক সাপের ফনা তার মাথার উপর ছাউনির আকারে বিরাজ করে। কোনো কোনো মূর্তিতে তার কোলে একটি শিশু দেখা যায়। এই শিশু তার পুত্র আস্তিক। তাকে ‘একচক্ষু-বিশিষ্ট দেবী’ বলা হয়। মনসার মা চণ্ডী ক্রোধের বসে তার একটি চোখ নষ্ট করে দিয়েছিলেন।
মনসা ঘট
গর্ভবতী নারীর প্রতীক হল মনসা ঘট। যেখান থেকে প্রাণ সঞ্চার হয়ে মানব জীবন ক্রম বিবর্তনের মাধ্যমে এগিয়ে চলেছে। মনসা ঘট যেমন গর্ভবতী নারীর প্রতীক তেমনি ফসলের উর্বরতার প্রতীক, যাকে প্রজনন শক্তির প্রতীক হিসাবে কল্পনা করা হয়েছে।
দেবী মনসার কাহিনী
- (১) পঞ্চদশ শতক শেষ হবার পূর্বেই মনসার কাহিনী পরিপূর্ণ পাঁচালিরূপ ধারণ করেছিল। এর ইঙ্গিত পাওয়া যায় বিপ্রদাস পিপলাইয়ের ‘মনসাবিজয়’ কাব্যে। বাস্তুদেবতা, আরোগ্যের দেবতা বা সম্পদের দেবতা নামে মনসার পূজা এদেশে বরাবর চলে এসেছে। এখন বিশেষ করে তিনি সাপের দেবতা, তবে নিজে সাপ নন।
- (২) আরোগ্য ও পুষ্টির রূপকাশ্রিত দেব ভাবনা বলে তার মহিমা বেদের সময় থেকেই গীত হয়। মনসা মূলত সরস্বতী। এরই নামান্তর ইলা, পুষ্টি, শ্রী। তিনি গৌরী, যিনি জল কেটে একপদী, দ্বিপদী, চতুষ্পদী, অষ্টাপদী, নবমপদী সৃষ্টি করেছিলেন। তিনিই বাক্ যিনি নারীরূপে গন্ধর্বদের ছলনা করে দেবতাদের সোম বা অমৃত এনে দিয়েছিলেন।
- (৩) ঋগ্বেদের একটি রূপক ভাবনাও পরে দেবীত্বের রূপ পেয়েছিল। তিনি দুর্গম অরণ্যের দেবতা। পৌরাণিক সাহিত্যে তিনি দুর্গতের দেবতা দুর্গা (পার্বতী, চণ্ডী)। আরও পূর্বে তিনি সরস্বতী ও শ্রীর সঙ্গে অভিন্ন ছিলেন।
- (৪) পৌরাণিক যুগের পূর্বেই সরস্বতী ও শ্রীর সঙ্গে বাস্তুনাগ দেবতার পূজা মিশে গিয়েছিল। তখন থেকে মনসা নিজে নাগ না হয়েও সর্পরাজ্ঞী। সরস্বতী ও শ্রী দুই পৃথক দেবতায় (মনসা ও লক্ষ্মী) পরিণত হবার পূর্বেই নাগ-পূজার সঙ্গে দেবীর যোগাযোগ হয়েছিল।
- (৫) পরবর্তীতে সরস্বতী ও শ্রী যখন ভাগাভাগি হয় তখন মনসার ভাগে পড়ে সর্পনাগ আর লক্ষ্মীর ভাগে হস্তীনাগ। মনসা ও লক্ষ্মীর মৌলিকতার অনেক প্রমাণ আছে। দুই জনেরই নামান্তর কমলা ও পদ্মা। পদ্মদলে মনসার উৎপত্তি আর কমলার আসন পদ্মে। লক্ষ্মীর উৎপত্তি সাগরে, মনসার উৎপত্তি হ্রদে।
সরস্বতী ও মনসার মৌলিকত্ব
অর্বাচীন পৌরাণিক সাহিত্যে মনসা ও সরস্বতীর প্রাচীনত্বের ও মৌলিকত্বের বৈশিষ্ট্য অত্যন্ত স্পষ্ট। যেমন –
- (১) সরস্বতী অবিবাহিত, মনসাও স্বাধীন নারী (জরৎকারুর সঙ্গে তার বিবাহ দেবসমাজে কেবল মুখরক্ষা মাত্র)।
- (২) সরস্বতীকে স্রষ্টা (ব্রহ্মা) কামনা করেছিলেন, মনসাকে পিতা (শিব) কামনা করেছিলেন।
- (৩) সরস্বতী বিদ্যাদেবী, মনসা প্রথমে বাক্ পরে মূর্তিমতী বিষবিদ্যা।
- (৪) সরস্বতী গীতবাদ্যের দেবী, মনসা গীতবাদ্যপ্রিয়, কারণ গান-বাজনা না হলে তার পূজা হয় না এবং এই গীতনৃত্য করেই বেহুলা মনসার প্রসাদ লাভ করেছিলেন।
দেবী মনসার কাহিনীর সূত্রপাত
এদেশে মনসা-কাহিনীর সূত্রপাত বৈদিক যুগে। কিন্তু পূর্ব-ভারতে বৈদিক যুগ শেষ হওয়ার পূর্বেই মনসা বাস্তুদেবতায় ও গ্রামদেবীতে পরিণত হয়েছিলেন। তারপর ধাপে ধাপে তার অবনতি ঘটে।
মনসা দেবীর মন্দির
দেবী মনসার উল্লেখযোগ্য মন্দির গুলি হল হরিদ্বারের মনসা দেবী মন্দির, চণ্ডীগড়ের পঞ্চকুলার মাতা মনসা দেবী মন্দির, ঝাড়খণ্ডের মনসা দেবী মন্দির, পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার ছোট পোষলার ঝাঁকলাই দেবী মন্দির, বাংলাদেশের বরিশাল জেলার গৈলা বা ফুল্লশ্রী গ্রামে মধ্যযুগের কবি বিজয় গুপ্তের প্রতিষ্ঠিত মনসা মন্দির।
উপসংহার :- আধুনিক সময়ে দেবী মনসা ভদ্র দেবসমাজ-বহিস্কৃত নারীপূজিত দেবী রূপেই রয়ে গিয়েছেন। গ্রামদেবীরূপে তিনি পশ্চিমবঙ্গ -এ চণ্ডী বা বিশালাক্ষী নাম করে ফেলেছেন।
(FAQ) দেবী মনসা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
দেবী মনসা।
জরৎকারু মুনি।
আস্তিক।
চাঁদ সদাগর।