মনসা মঙ্গল কাব্যের নায়িকা চরিত্র বেহুলা প্রসঙ্গে জন্ম ও বেড়ে ওঠা, পুরাণ ও লোককথার বর্ণনা, চাঁদ সদাগর, দেবী মনসা, মনসার অনুরোধ, মনসার অভিশাপ, লখিন্দরের হত্যা, বেহুলার ভ্রমণ, বেহুলার স্বর্গ গমন, লখিন্দরের জীবন দান, শ্বশুরালয়ে প্রত্যাবর্তন, লক্ষ্যে অবিচল, আদর্শ চরিত্র, চরিত্রের গৌরব ও সতীত্ব বল সম্পর্কে জানবো।
মনসামঙ্গল কাব্যের নায়িকা বেহুলা
ঐতিহাসিক চরিত্র | বেহুলা |
জন্মস্থান | উজানিনগর |
পিতা | সায় বেনে |
পতি | লখিন্দর |
পরিচিতির কারণ | মনসামঙ্গল কাব্যের নায়িকা |
ভূমিকা :- প্রাচীন বাংলার বিখ্যাত মঙ্গলকাব্য মনসামঙ্গলের প্রধান চরিত্র এবং চাঁদ সদাগর -এর পুত্র লখিন্দরের স্ত্রী হলেন বেহুলা। তাকে কেন্দ্র করে বাংলার লোকসমাজে প্রচলিত আছে এক জনপ্রিয় কাহিনী।
বেহুলার জন্ম ও বেড়ে ওঠা
চাঁদ সওদাগরের পুত্র লখিন্দর ও তার ব্যবসায়ীক বন্ধু সায় বেনের কন্যা বেহুলার জন্ম হয় সমসাময়িক কালে। দুজনেই একসাথে বেড়ে ওঠে এবং একে অপরের জন্য সম্পূর্ণ উপযুক্ত বলে গণ্য হয়।
পুরাণ ও লোককথার বর্ণনা
পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী বেহুলা স্বর্গের অনিরুদ্ধের স্ত্রী ঊষা। আর লোককাহিনীর মতে তিনি ছিলেন উজানীনগরের সায়বেনের কন্যা এবং চম্পকনগরের চাঁদ সদাগরের কনিষ্ঠ পুত্র মনসামঙ্গল কাব্যের নায়ক লখিন্দরের স্ত্রী।
চাঁদ সদাগর
লখিন্দরের পিতা চন্দ্রবণিক বা চাঁদ সদাগর ছিলেন হিন্দু দেবতা শিবের একনিষ্ঠ পূজারী। তাই তিনি অন্য কোনো দেবতার আরাধনা করতেন না।
দেবী মনসা
অন্যদিকে শিবের কন্যা মনসা ছিলেন সর্পদেবী। কিন্তু তিনি কোথাও পূজা পেতেন না। তার পিতা শিব তাকে বলেন যে যদি কোনো ভক্তিমান শৈব অর্থাৎ শিবের উপাসক প্রথম মনসার পূজা করেন তাহলেই মর্ত্যে তার পূজার প্রচলন সম্ভব।
দেবী মনসার অনুরোধ
পিতার কথা শুনে মনসা চাঁদ সদাগর কে নির্বাচন করে তাকেই অনুরোধ করেন মনসা পূজার আয়োজন করার জন্য। কিন্তু শিবের উপাসক চাঁদ সদাগর মনসার প্রস্তাবে অস্বীকৃত হন।
চাঁদ সদাগর প্রতি মনসার অভিশাপ
চাঁদ সদাগর পূজা করতে রাজি না হলে ক্রোধোন্মত্ত মনসা তাকে শাপ দেন যে, তার প্রত্যেক পুত্রের জীবন তিনি বিনাশ করবেন। মনসার শাপে এইভাবে একে একে লখিন্দর ব্যতীত চাঁদ সদাগরের সকল পুত্রই সর্পাঘাতে নিহত হয়।
বেহুলার স্বামী লখিন্দরের হত্যা
লখিন্দরের বিবাহের সময় চাঁদ সদাগর অতিরিক্ত সতর্কতার সঙ্গে দেবতা বিশ্বকর্মার সাহায্যে এমন বাসর ঘর তৈরি করেন যা সাপের পক্ষে ছিদ্র করা সম্ভব নয়। কিন্তু মনসা তার উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সমর্থ হয়। তার পাঠানো একটি সাপ কালনাগিনী লখিন্দরকে হত্যা করে।
বেহুলা কর্তৃক লখিন্দরের ভেলা ভাসাই
প্রচলিত প্রথা অনুসারে যারা সাপের দংশনে নিহত হত তাদের সৎকার প্রচলিত পদ্ধতিতে না করে তাদের মৃতদেহ ভেলায় করে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হত। আশা করা হত যে ব্যক্তিটি হয়তো কোনো অলৌকিক পদ্ধতিতে ফিরে আসবে।
বেহুলার ভ্রমণ
- (১) বেহুলা সবার বাধা অগ্রাহ্য করে তার মৃত স্বামীর সাথে ভেলায় চড়ে বসে। ছয় মাস ধরে যাত্রা করে বেহুলা গ্রামের পর গ্রাম পাড়ি দিতে থাকে। এরপর মৃতদেহ পঁচে যেতে শুরু করে এবং গ্রামবাসীরা তাকে মানসিক ভারসাম্যহীন মনে করতে থাকে।
- (২) বেহুলা মনসার কাছে প্রার্থনা জানালে মনসা ভেলাটিকেই কেবল ভাসিয়ে রাখতে সাহায্য করে। এরপর ভেলাটি মনসার পালিতা মাতা নেতার কাছে আসে। তিনি নদীতীরে ধোপার কাজ করতেন। তিনি বেহুলার নিরবচ্ছিন্ন প্রার্থনা দেখে বেহুলাকে মনসার কাছে নিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেন।
বেহুলার স্বর্গগমন
ধোপানি নেতা তার ঐশ্বরিক ক্ষমতাবলে চোখের পলকে বেহুলা ও মৃত লখিন্দরকে স্বর্গে পৌছে দেন। মনসা বলেন যে, তুমি লখিন্দর ফিরে পাবার যোগ্য, কিন্তু এটা সম্ভব হবে যদি তুমি তোমার শ্বশুরকে আমার পূজারী করতে পার।
বেহুলার প্রচেষ্টায় লখিন্দরের জীবনদান
মনসার কথা মত বেহুলা প্রতিশ্রুতি দিলে তার স্বামীর মৃতদেহে জীবন ফিরে আসতে শুরু করে। তার ক্ষয়ে যাওয়া মাংস ফিরে আসে এবং লখিন্দর তার চোখ মেলে তাকায়। এরপর লখিন্দর বেহুলার দিকে তাকিয়ে থাকে
শ্বশুরালয়ে বেহুলার প্রত্যাবর্তন
বেহুলা তার স্বামী এবং মনসার কোপে অতীতে নিহত চাঁদ সদাগরের অন্য ছয়পুত্রের জীবন ও সম্পদ-সম্ভারসহ সপ্তডিঙ্গা উদ্ধার করে শ্বশুরালয়ে প্রত্যাবর্তন করেন।
বেহুলার কথায় চাঁদ সদাগরের মনসা পূজা
প্রতিমাসের কৃষ্ণা একাদশী তিথিতে চাঁদ সদাগর মনসা পূজা করতে রাজি হয়। কিন্তু যেহেতু তিনি শিবের ভক্ত ছিলেন সেহেতু তিনি বাম হাতে প্রতিমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে মনসাকে পূজা করতে থাকেন। মনসা অবশ্য তাতেই সন্তুষ্ট হন।
বেহুলার অভিশাপের অন্ত
মর্ত্যে মনসার পূজা প্রচলন করে লখিন্দর ও বেহুলারূপী স্বর্গের দম্পতি অনিরুদ্ধ ও ঊষা অভিশাপ থেকে মুক্ত হয়ে স্বর্গে গমন করেন।
লক্ষে অবিচল বেহুলা
আপনজনের অনুনয়-বিনয় ও সস্নেহ-অনুরোধ বেহুলাকে তাঁর লক্ষ্য থেকে বিচলিত করতে পারে নি। সব রকম প্রলোভন, ভয় ও অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট জয় করে তিনি তাঁর জীবনের পরম সম্পদ স্বামী লখিন্দরকে বাঁচিয়ে তুলেছেন।
আদর্শ চরিত্র বেহুলা
বাঙালি সনাতন নারী সমাজের অন্যতম আদর্শ চরিত্র বেহুলা। এই চরিত্রের মাধ্যমে বাঙালি রমণীদের শাশ্বত স্বামিভক্তির এক অসাধারণ চিত্র ফুটে উঠেছে। এর সঙ্গে বাংলার সহনশীল ও কোমলস্বভাব নারীদের মধ্যেও যে একটি সুপ্ত বিদ্রোহ ক্রিয়াশীল তারও প্রকাশ ঘটেছে বেহুলা চরিত্রের মধ্যে দিয়ে।
বেহুলার সতীত্ববল
শবের অনুগামিনী এই যুবতী পত্নীর প্রবাস-জীবন ছিল পবিত্র। সতীত্ব রক্ষায় তিনি অসাধারণ চারিত্রিক দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছেন। সতীত্ববলেই স্বামীর পুনর্জীবন লাভের আশায় বেহুলা অনেক দুর্জনের পাপ-অভিলাষ ব্যর্থ করে নিজের গন্তব্যে পৌঁছাতে সমর্থ হন।
বেহুলা চরিত্রের গৌরব
বাল্য-বৈধব্যের প্রতি উদাসীন থেকে পরিস্ফুট যৌবনে মৃত স্বামীর সঙ্গিনী হয়ে সুদূর প্রবাস থেকে স্বামীর পুনর্জীবন নিয়ে ফিরে আসায় বেহুলা চরিত্রটি বিশেষভাবে গৌরবান্বিত।
বেহুলার বাসর ঘর
বেহুলার বাসর ঘর বগুড়া সদরের গোকুল নামক স্থানে অবস্থিত বলে অনুমান করা হয়। বগুড়া শহর থেকে প্রায় ১১ কিমি উত্তরে এর অবস্থান।
উপসংহার :- বেহুলার দুঃখ-সহনশীলতার চেয়ে তাঁর নির্ভীক তেজস্বিতাই সবাইকে মুগ্ধ করে। আত্মশক্তিতে বলীয়ান বেহুলার একাগ্র সাধনার কাছে অত্যাচারী দৈব শক্তিও মাথা নত করেছে, এখানেই বেহুলা চরিত্রের শ্রেষ্ঠত্ব। নারীত্বের মহিমায় বেহুলা সীতা–সাবিত্রী–দময়ন্তীর মতোই বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল চরিত্র।
(FAQ) বেহুলা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
উজানিনগর।
সায় বেনে।
চাঁদ সদাগরের পুত্র লখিন্দরের সাথে।
বেহুলা।