সাবিত্রী

পুরাকালের সতী সাধ্বী রমনী সাবিত্রী প্রসঙ্গে দেবতার রূপ প্রাপ্ত সাবিত্রী, বিবাহযোগ্যা সাবিত্রী, তপোবনের সাবিত্রী সত্যবান সাক্ষাৎ, সাবিত্রী কর্তৃক পিতাকে সত্যবানের কথা প্রকাশ, সাবিত্রীর বিবাহে নারদের অসম্মতি, সাবিত্রীর দৃঢ় প্রতিজ্ঞা, সাবিত্রী ও সত্যবানের বিবাহ, কাষ্ঠ সংগ্রহে সাবিত্রী ও সত্যবানের গমন, সাবিত্রী পতি সত্যবানের মৃত্যু, সাবিত্রীর সম্মুখে যমরাজের আগমন, সাবিত্রী প্রতি যমরাজের উক্তি, সাবিত্রী ও যমরাজের কথোপকথন, সাবিত্রীর প্রচেষ্টায় সত্যবানের জীবন লাভ, সাবিত্রী ও সত্যবানের কুটিরে আগমন এবং রাজ্য লাভ সম্পর্কে জানবো।

মহাভারতের সাবিত্রী ও সত্যবান কাহিনীর সতী নারী সাবিত্রী প্রসঙ্গে পুরাকালের সতী সাধ্বী রমনী সাবিত্রী, সাবিত্রীর দৃঢ় প্রতিজ্ঞা, সত্যবানের সাথে সাবিত্রীর বিবাহ, সত্যবানের মৃত্যু, সতী সাধ্বী রমনী সাবিত্রী কর্তৃক যমরাজের থেকে স্বামী সত্যবানের জীবন ফিরিয়ে নিয়ে আসা সম্পর্কে জানব।

পুরাকালের সতী সাধ্বী রমনী সাবিত্রী

ঐতিহাসিক চরিত্রসাবিত্রী
পরিচিতিপ্রাচীন ভারতের সাধ্বী রমনী
পিতাঅশ্বপতি
রাজ্যমদ্রদেশ
স্বামীসত্যবান
খ্যাতিমৃত স্বামীর প্রাণ ফিরিয়ে আনেন
পুরাকালের সতী সাধ্বী রমনী সাবিত্রী

ভূমিকা :- অতি পুরাকালে মদ্রদেশে অশ্বপতি নামে এক রাজা ছিলেন। রাজার কোনো সন্তানাদি হয় না। অবশেষে সাবিত্রীদেবীর উপাসনা করে এক কন্যা লাভ করলেন, নাম রাখলেন ‘সাবিত্রী’।

দেবতার রূপ প্রাপ্ত সাবিত্রী

সাবিত্রীর বরে জন্মগ্রহন করে ‘সাবিত্রী’ দেবতার রূপ প্রাপ্ত হলেন। ক্রমে ক্রমে সাবিত্রী যৌবনসীমায় পদার্পণ করলেন। রূপের প্রভায় যেন দিগন্ত আলোকিত হল।

বিবাহযোগ্যা সাবিত্রী

কন্যাকে বিবাহযোগ্যা দেখে অশ্বপতি উপযুক্ত পাত্রের সন্ধান করতে লাগলেন, কিন্তু সাবিত্রীর উপযুক্ত পতি মিলল না। অবশেষে নিরুপায় হয়ে অশ্বপতি কন্যাকে স্বয়ং পতি অনুসন্ধানে অনুরোধ করলেন। পিতার আদেশে সাবিত্রী স্বয়ং পতি অন্বেষণে বের হলেন।

তপোবনে সাবিত্রী-সত্যবান সাক্ষাৎ

বহুদেশ ভ্রমণ করে সাবিত্রী অবশেষে এক তপোবনে এসে উপনীত হলেন। শাল্বদেশের অন্ধরাজ দ্যুমৎসেন স্বরাজ্য হতে বিতাড়িত হয়ে পত্নী সুবর্চ্চা ও পুত্র সত্যবানকে নিয়ে সেই তপোবনে বাস করছিলেন। শুভমুহূর্তে সাবিত্রীর সাথে সত্যবানের সাক্ষাৎ হল। সাবিত্রী সেই মুহূর্তে তাঁকে মনে মনে স্বামীরূপে বরণ করলেন। সিদ্ধ মনোরথ হয়ে সাবিত্রী গৃহে ফিরে এলেন।

সাবিত্রী কর্তৃক পিতাকে সত্যবানের কথা প্রকাশ

একদিন মহর্ষি নারদ অশ্বপতির সাথে কথোপকথনে নিযুক্ত আছেন, এমন সময় সাবিত্রী সেখানে উপস্থিত হলেন ও “তপোবনবাসী সত্যবান তাঁহার স্বামী” এই কথা পিতাকে বললেন।

বিদুষী সাবিত্রীর বিবাহে নারদের অসম্মতি

নারদ এই বিবাহে অসম্মতি জানিয়ে বললেন, “সত্যবান অল্পায়ুঃ, অদ্য হইতে সম্বৎসরে তাহার মৃত্যু নিশ্চিত।”

সাবিত্রীর দৃঢ় প্রতিজ্ঞা

অশ্বপতিও সাবিত্রীকে অন্য কোনো পাত্র মনোনীত করতে বললেন। সাবিত্রী বললেন, “আমি মনে মনে সত্যবানকেই স্বামীরূপে বরণ করিয়াছি, পুনরায় অপরকে কিরূপে বিবাহ করিব? সত্যবান্ অল্পায়ু হইলেও, তিনিই আমার স্বামী।”

বিদুষী সাবিত্রী ও সত্যবানের বিবাহ

কন্যার এই দৃঢ় প্রতিজ্ঞা দেখে অশ্বপতি বাধ্য হয়ে সেই তপোবনে দ্যুমৎসেনের নিকট গমন করলেন এবং শুভক্ষণে সাবিত্রীকে সত্যবানের হস্তে সম্প্রদান করলেন। সাবিত্রী তপোবনেই রইলেন।

সাবিত্রীর মনে নারদের বাক্য জাগরুক

নারদের বাক্য সাবিত্রীর মনে সর্বক্ষণ জাগরূক আছে। তিনি সৰ্ব্বক্ষণই সেই দিনের প্রতীক্ষা করতে লাগলেন। নির্দিষ্ট দিনের ৩ দিন পূর্বে তিনি স্বামীর মঙ্গলকামনায় ত্রিরাত্রব্রত করলেন। অবশেষে সেই ভীষণ দিন উপস্থিত হল।

কাষ্ঠ সংগ্রহে সাবিত্রী ও সত্যবানের গমন

সত্যবান যথারীতি কাষ্ঠ সংগ্রহ করবার জন্য বনে চললেন। সাবিত্রী সঙ্গে যেতে চাইলেন, সত্যবান অনেক নিষেধ করলেন কিন্তু সাবিত্রী কিছুতেই নিরস্ত হলেন না। অগত্যা সত্যবান তাঁকে সঙ্গে নিলেন। স্বাধ্বী স্বামীকে যেন গণ্ডীর মধ্যে রেখে চললেন।

সাবিত্রী পতি সত্যবানের মৃত্যু

কাঠ কাটতে কাটতে সত্যবানের অত্যন্ত শিরঃপীড়া উপস্থিত হল। তিনি নিতান্ত অস্থির হয়ে সাবিত্রীর কোলে মাথা রেখে শয়ন করলেন। সত্যবানের চেতনা লোপ পেল। ভীষণ রাত্রি উপস্থিত হল। বনের অন্ধকার রাত্রির অন্ধকারকে যেন আরও ভীষণ করে তুলল।

বিদুষী সাবিত্রীর সম্মুখে যমরাজের আগমন

সেই দুর্ভেদ্য অন্ধকারের মধ্যে এক দেবজ্যোতিঃ বিকাশ পেল। সাবিত্রী চেয়ে দেখেন হস্তে দণ্ড, মস্তকে কিরীট, অঙ্গে জ্যোতিঃপুঞ্জ এক বিরাট মূৰ্ত্তি ! সাবিত্রী প্রণাম করলেন।

সাবিত্রী প্রতি যমরাজের উক্তি

“মা সাবিত্রি ! আমি ধর্ম্মরাজ যম, তোমার স্বামীর পরমায়ু শেষ হইয়াছে। আমার অনুচরেরা তোমার সতীত্ব তেজে অগ্রসর হইতে পারিল না, আমি স্বয়ং আসিয়াছি তোমার স্বামীকে ত্যাগ করিয়া তুমি গৃহে গমন কর। মর্ত্যবাসী সকল জীবের অদৃষ্টে মৃত্যু ঘটিয়া থাকে সেজন্য দুঃখ করা উচিত নয়,” এই বলে মৃত্যুরাজ সত্যবানের দেহ হতে অঙ্গুষ্ঠ প্রমাণ এক পুরুষমূর্তি বের করে চলতে লাগলেন।

যমরাজ ও সাবিত্রীর কথোপকথন

সাবিত্রী: যমরাজের অনুসরণ করতে করতে বললেন “পিতঃ, আপনি যেমন বলিলেন মৃত্যুই বিধির বিধান, আবার সেই বিধির বিধানেই নারী স্বামীর অনুসরণ করিতে বাধ্য। অতএব আপনি আমাকে নিবারণ করিতেছেন কেন ?”

ধর্ম্মরাজ: সন্তুষ্ট হয়ে বললেন, “আমি তোমার ধর্মজ্ঞানে পরম সন্তোষলাভ করিয়াছি। স্বামীর পুনর্জীবন ব্যতীত অন্য কোনো বর প্রার্থনা কর।”

সাবিত্রী: “আমার অন্ধ শ্বশুর চক্ষুলাভ করুন।”

যমরাজ: “তথাস্তু”। আবার কিছুদূর গিয়ে যম পশ্চাৎ ফিরে সাবিত্রীকে আসতে দেখে বললেন, “বৎসে! তোমার স্বামীর আয়ুঃশেষ হইয়াছে, তুমি গৃহে গমন কর, তোমার উপর আমি বড় সন্তুষ্ট হইয়াছি, পতি ভিন্ন অন্য বর প্রার্থনা কর।”

সাবিত্রী: বর প্রার্থনা করলেন, “আমার শ্বশুর হৃতরাজ্য উদ্ধার করুন।”

যমরাজ: “তথাস্তু”।

সাবিত্রী: পুনরায় চলতে লাগলেন।

যমরাজ: “অনর্থক কেন আসিতেছ? গৃহে যাও।”

সাবিত্রী: “আমি যাইতেছি না, কে যেন আমাকে টানিয়া লইয়া যাইতেছে। যেখানে স্বামী থাকিবে সেইখানেই স্ত্রী থাকিবে। আমার আত্মা তো পূর্বেই গিয়াছে, এখন দেহ লইতেছে।”

যমরাজ: “স্বামীর জীবন ভিন্ন অন্য কোনো বর প্রার্থনা কর।”

সাবিত্রী: “আমার পিতার পুত্র হউক।

যমরাজ: “তথাস্তু” বলে চলতে লাগলেন। সাবিত্রীকে আবার পশ্চাতে দেখে বললেন “মা তুমি বড় অবোধের ন্যায় কাজ করিতেছ। স্বামী পাপাচরণ করিয়া নরকে যাইলে স্ত্রীরও কি সেখানে যাইতে হইবে?”

সবিত্রী: “ধর্ম্মরাজ ! নিশ্চয় যাইব। স্বামী জীবিতই হউন, মৃতই হউন স্ত্রীলোক স্বামীর পূজা করিবে। স্ত্রীলোকের সঙ্গে স্বামীর ইহকাল পরকালের সম্পর্ক। স্ত্রী স্বামীর ধর্ম্মের সহায়, কর্মের সঙ্গিনী। অতএব স্ত্রীলোক স্বামীর পাপে নরকে যাইতেও প্রস্তুত হইবে কিন্তু পৃথক ভাবে স্বর্গে যাইতেও চাহিবে না।”

যমরাজ: “তোমার ধম্মজ্ঞানে আমি কতদূর সন্তুষ্ট তাহা বলিতে পারি না। কিন্তু কি করিব ? আয়ু শেষ হইলে কেহ তাহাকে বাঁচাইতে পারে না। অতএব তুমি স্বামীর জীবন ভিন্ন সব বর প্রার্থনা কর।”

সাবিত্রী: “পিতঃ, যখন এত অনুগ্রহ করিলেন তখন সত্যবানের পুত্র রাজা হইবে এই বর দিন।”

যমরাজ: সাবিত্রীর কথায় এত তন্ময় হয়েছিলেন যে তিনি তৎক্ষণাৎ বললেন “তথাস্তু”।

সাবিত্রী: আশ্বস্ত হলেন, স্বামীর প্রাণ রক্ষা করতে পারবেন বলে মনে করে পুনরায় যমরাজের পিছনে চলতে লাগলেন।

যমরাজ: বিরক্ত হয়ে “তোমার প্রার্থিত সমস্ত বরই দান করিয়াছি, আর কি তোমার প্রার্থনা করিবার আছে ? তোমার স্বামীর কাল শেষ হইয়াছে, এক্ষণে কোনো উপায় নাই, তুমি গৃহে গমন কর”।

সাবিত্রী: “ধর্ম্মরাজ, এইমাত্র আপনি বলিয়াছেন যে সত্যবানের পুত্র রাজা হইবে। তিনি মৃত! ইহা কিরূপে সম্ভব ? আপনার বাক্য কি অন্যথা হইবে ?”

বিদুষী সাবিত্রীর প্রচেষ্টায় সত্যবানের জীবন লাভ

যমরাজ চিন্তিত হলেন, বুঝলেন বালিকার নিকট তিনি পরাস্ত হয়েছেন। সন্তুষ্টচিত্তে তৎক্ষণাৎ তিনি সত্যবানকে পুনর্জীবিত করলেন।

সত্যবানের কাছে সাবিত্রীর বৃত্তান্ত বর্ণনা

বিদুষী সাবিত্রী সত্যবানকে নিয়ে হৃষ্টচিত্তে ফিরে এলেন। সত্যবান যেন ঘুম থেকে উঠলেন, তিনি এই পর্য্যন্ত কোনো কিছুই জানেন না। রাত্রি হয়েছে, অথচ সাবিত্রী তাঁর নিদ্রাভঙ্গ করেন নি বলে অনুযোগ করতে লাগলেন। পরে সাবিত্রীর মুখে তার মহানিদ্রার কথা ও তাঁর চেষ্টায় পুনর্জীবন লাভ করেছেন শুনে ধন্য হলেন।

বিদুষী সাবিত্রী ও সত্যবানের কুটিরে আগমন

সত্যবান ও সাবিত্রীকে বহুক্ষণ দর্শন না করে অন্ধ রাজা ও তার পত্নী বড়ই শোকাকুল হলেন। সহসা অন্ধের নয়ন উন্মীলিত হল, উভয়ে আশ্চৰ্য্যান্বিত হলেন। সত্যবান ও সাবিত্রী হর্ষোৎফুল্লচিত্তে কুটীরে আগমন করলেন। তাঁদের নিকট সমস্ত শ্রবণ করে সাধ্বী স্ত্রী সাবিত্রীকে সহস্রবার আশীর্বাদ করলেন।

উপসংহার :- শেষ পর্যন্ত ধর্মরাজের বরে ক্রমে দ্যুমৎসেন রাজ্যলাভ করলেন, অপুত্রক পিতার শতপুত্র হল। সাবিত্রীও পুত্রের জননী হয়ে রাজ্যভোগ করতে লাগলেন। সাধ্বী স্ত্রী স্বামীর জন্য যমের নিকটে যেতেও ভীত হন না।

(FAQ) পুরাকালের সতী সাধ্বী রমনী সাবিত্রী সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. সাবিত্রী কে ছিলেন?

প্রাচীন ভারতের মদ্রদেশের রাজা অশ্বপতির কন্যা।

২. সাবিত্রীর বিবাহ হয় কার সাথে?

রাজ্যচ্যুত রাজা দ্যুমৎসেনের পুত্র সত্যবানের সাথে।

৩. সাবিত্রীর খ্যাতির কারণ কি?

মৃত্যু দেবতা যমরাজের থেকে মৃত স্বামীর প্রাণ ফিরিয়ে এনে সাবিত্রী বিখ্যাত হয়ে আছেন।

অন্যান্য ঐতিহাসিক চরিত্রগুলি

Leave a Comment