জ্যোতিষশাস্ত্র প্রসঙ্গে জ্যোতিষশাস্ত্র কথার অর্থ ও ব্যবহার, জ্যোতিষশাস্ত্রের সূত্রপাত, আধুনিক জ্যোতিষশাস্ত্র, ভারতে জ্যোতির্বিজ্ঞান, ইউরোপে ভ্রান্ত জ্যোতির্বিজ্ঞান ও ইউরোপে আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কে জানবো।
রাশিফলক জ্যোতিষশাস্ত্র প্রসঙ্গে জ্যোতিষশাস্ত্র কী বলে, রাশিফলক জ্যোতিষশাস্ত্র, জ্যোতিষশাস্ত্রের সূত্রপাত, ভারতে জ্যোতির্বিজ্ঞান, জ্যোতিষশাস্ত্র-এ নভোমণ্ডলে বিভিন্ন জ্যোতিষ্ক অর্থাৎ গ্রহ-নক্ষত্র ইত্যাদির অবস্থান বিবেচনা, মানুষের ভাগ্যগণনা তথা ভাগ্য নিরূপণকারী জ্যোতিষশাস্ত্র সম্পর্কে জানব।
জ্যোতিষশাস্ত্র
ঐতিহাসিক গ্ৰন্থ | জ্যোতিষশাস্ত্র |
ইংরেজি শব্দ | Astrology |
অর্থ | জ্যোতিষ্ক সম্বন্ধে বিচার |
প্রাচীন গণিতজ্ঞ | পিথাগোরাস |
সূর্যসিদ্ধান্ত | আর্যভট্ট |
পঞ্চসিদ্ধান্তিকা | বরাহমিহির |
ব্রহ্মস্ফুট | ব্রহ্মগুপ্ত |
ভূমিকা :- বহু প্রাচীন কাল থেকেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মহাকাশের জ্যোতিষ্ক সম্পর্কে মানুষের কৌতূহল ছিল। প্রাচীন গ্রিস-এ জ্যোতির্বিজ্ঞান বা Astronomy-র চর্চা প্রচলিত ছিল। Astronomy কথাটির অর্থ হল জ্যোতিষ্কসমূহের বিন্যাস (Nomos)। তবে প্রাচীন এই চর্চাকে জ্যোতির্বিজ্ঞান না বলে জ্যোতিষশাস্ত্র বা Astrology বলাই যুক্তিসংগত।
জ্যোতিষশাস্ত্র কথার অর্থ ও ব্যবহার
জ্যোতিষশাস্ত্র বা Astrology কথাটির অর্থ হল জ্যোতিষ্ক সম্বন্ধে বিচার (Logos)। জ্যোতির্বিজ্ঞান বা Astronomy কথাটির পরিবর্তে স্বয়ং প্লেটো জ্যোতিষশাস্ত্র বা Astrology কথাটির প্রবর্তন করেন।
জ্যোতিষশাস্ত্রের সূত্রপাত
- (১) প্রাচীন গণিতজ্ঞ পিথাগোরাস ধারণা করেছিলেন যে, সংখ্যা (Digit) ও জ্যামিতিক আকারের অলৌকিক তাৎপর্য রয়েছে। পিথাগোরাসের এই ধারণাকে গ্রহণ করে প্লেটো গণিতের সঙ্গে জ্যোতির্বিজ্ঞানকে যুক্ত করেন। জ্যোতিষ্ক বাস্তবে কেমন তা প্লেটোর এই জ্যোতিষশাস্ত্রের আলোচনায় উঠে আসে নি।
- (২) জ্যোতিষ্ক কেমন হলে তা মানুষের ভাগ্যের পক্ষে ভালো হবে, তা-ই ছিল প্লেটোর চর্চার বিষয়। এই চর্চা থেকেই ইউরোপ-এর মানুষ সূর্য, চন্দ্র ও অন্যান্য গ্রহগুলির ঐশ্বরিক শক্তি আছে বলে ভাবতে থাকে। এভাবেই প্রাচীন জ্যোতিষশাস্ত্রের সূত্রপাত ঘটে।
- (৩) পরবর্তীকালে জ্যোতিষশাস্ত্রের সহায়তায় যুক্তিবিজ্ঞান বর্জিত পদ্ধতিতে জ্যোতিষ্ক গণনার ফলে এই শাস্ত্রের অত্যন্ত বদনাম হয়ে যায়। ফলে আবার জ্যোতির্বিজ্ঞান বা Astronomy কথাটিই ফিরিয়ে আনা হয়। তবে জ্যোতিষশাস্ত্র ভ্রান্ত এবং কুসংস্কারে আচ্ছন্ন হলেও প্রাচীন যুগ থেকে এই শাস্ত্রের মাধ্যমেই মহাকাশের জ্যোতিষ্ক নিয়ে চর্চা অব্যাহত থাকে।
আধুনিক জ্যোতিষশাস্ত্র
- (১) পঞ্চদশ শতকের পরবর্তীকালেও ইউরোপের অনেক জ্যোতির্বিজ্ঞানী জ্যোতিষশাস্ত্রের চর্চা করতেন। জ্যোতিষশাস্ত্র বিজ্ঞান না হলেও কিংবা মানুষের ভাগ্যের উপর গ্রহের প্রভাব পড়ে বলে বিজ্ঞান স্বীকার না করলেও জ্যোতিষশাস্ত্রের সঙ্গে জ্যোতির্বিদ্যার একপ্রকার যোগসূত্র ছিল।
- (২) টাইকো ব্রাহে বা জোহানেস কেপলার-এর মতো বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ সম্রাট রুডলফের রাজসভায় নিযুক্ত হয়েছিলেন জ্যোতিষী হিসেবেই। নিউটনও জ্যোতিষশাস্ত্রের প্রতি আগ্রহ থেকেই গণিতচর্চা আরম্ভ করেন।
- (৩) বিভিন্ন জ্যোতিষী তাঁদের গণনাকে নির্ভুল করার জন্য জ্যোতির্বিজ্ঞানের পদ্ধতি ব্যবহার করতেন। এই ভাবে জ্যোতিষশাস্ত্রের মাধ্যমে জ্যোতির্বিজ্ঞানের চর্চার অগ্রগতি ঘটেছিল। এই চর্চা থেকেই পরবর্তীকালে আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের আত্মপ্রকাশ সম্ভব হয়।
ভারতে জ্যোতির্বিজ্ঞান
প্রাচীন ভারত-এ গুপ্ত যুগে জ্যোতির্বিদ্যার যথেষ্ট অগ্রগতি ঘটেছিল। আর্যভট্ট ও বরাহমিহির ছিলেন এই যুগের অন্যতম জ্যোতির্বিজ্ঞানী।
(১) আর্যভট্ট
আর্যভট্ট তাঁর সূর্যসিদ্ধান্ত গ্রন্থে বলেন যে, পৃথিবী গোলাকার এবং সে সর্বদা সূর্যকে কেন্দ্র করে নির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘুরছে। তিনিই প্রথম হিসেব করেন যে বছরে ৩৬৫ টি দিন আছে। তিনি আহ্নিক গতি, বার্ষিক গতি, সূর্যগ্রহণ এবং চন্দ্রগ্রহণের কারণও আবিষ্কার করেন।
(২) বরাহমিহির
এই যুগের উল্লেখযোগ্য জ্যোতির্বিজ্ঞানী ছিলেন বরাহমিহির। জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ক পঞ্চসিদ্ধান্তিকা এবং ফলিত জ্যোতিষ-বিষয়ক বৃহৎসংহিতা তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। বৃহৎসংহিতায় সূর্য, চন্দ্র, পৃথিবী ও অন্যান্য গ্রহনক্ষত্রের অবস্থান সম্পর্কে আলোচনা রয়েছে।
(৩) ব্রহ্মগুপ্ত
এ ছাড়া এই যুগে জ্যোতির্বিজ্ঞানী ব্রহ্মগুপ্ত তাঁর ব্রহ্মস্ফুট সিদ্ধান্ত গ্রন্থে বিভিন্ন গ্রহের অবস্থান, সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণের কারণ প্রভৃতির আলোচনা করেন।
ইউরোপে ভ্রান্ত জ্যোতির্বিজ্ঞান
প্রাচীন ইউরোপে ভ্রান্ত জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চার বিভিন্ন দিক গুলি হল –
(১) পৃথিবীর ঘূর্ণনতত্ত্বের প্রাচীন প্রবক্তাগণ
খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে গ্রিসের অ্যারিস্টারকাস সূর্যের চারিদিকে পৃথিবীর ঘূর্ণনের কথা বলেছিলেন। কিছুকাল পর সিসেরো, হিকিটাস প্রমুখও সূর্যের চতুর্দিকে পৃথিবীর আবর্তনের কথা বলেন।
(২) প্রাচীন কালে ভ্রান্ত ধারণাকে সমর্থন
প্রাচীন কালে ইউরোপের মানুষ সূর্যের চারদিকে পৃথিবীর ঘূর্ণনের কথা বিশ্বাস করে নি। বরং টলেমি, অ্যা এরিস্টটল প্রমুখ প্রাচীন চিন্তাবিদ ভ্রান্ত ধারণা প্রচার করেছিলেন যে, বিশ্বব্রহ্মান্ডের কেন্দ্রস্থলে পৃথিবী অবস্থান করছে এবং পৃথিবীকে কেন্দ্র করে সূর্য, চন্দ্র ও অন্যান্য গ্রহনক্ষত্র নির্দিষ্ট কক্ষপথে সর্বদা ঘুরে চলেছে।
(৩) খ্রিস্টান চার্চের ধারণা
খ্রিস্টান চার্চ এই ভ্রান্ত ধারণাকেই সমর্থন করেছিল। দ্বাদশ শতকের পূর্ব পর্যন্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের গঠন সম্পর্কে খ্রিস্টান চার্চের মতবাদই ইউরোপীয় সমাজে বদ্ধমূল ছিল। তখন পৃথিবী ও অন্যান্য গ্রহনক্ষত্র সম্পর্কে নানা আজব ধারণা মানুষের মধ্যে প্রচলিত ছিল। কেউ কেউ মনে করতেন যে, পৃথিবীর আকৃতি হল চ্যাপটা থালার মতো।
ইউরোপে আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞান
পঞ্চদশ শতক থেকে ইউরোপে জ্যোতির্বিদ্যার অভূতপূর্ব অগ্রগতি ঘটে। ফলে মহাকাশের জ্যোতিষ্কগুলি সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণার বিরুদ্ধে নানা নতুন মতবাদ প্রচারিত হতে থাকে। নিকোলাস কোপারনিকাস, জিওরদানো ব্রুনো, টাইকো ব্রাহে, গ্যালিলিও গ্যালিলি, জোহানেস কেপলার, স্যার আইজ্যাক নিউটন প্রমুখের বিজ্ঞানসম্মত মতবাদ চার্চের ভ্রান্ত ধারণার মূলে কুঠারাঘাত করে।
উপসংহার :- কোপারনিকাস, গ্যালিলিও প্রমুখের মতবাদ থেকে মানুষ জানতে পারে যে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্রে পৃথিবী নয়, সূর্য অবস্থান করছে এবং সূর্যকে কেন্দ্র করে পৃথিবী-সহ সৌরজগতের অন্যান্য গ্রহ-উপগ্রহগুলি নির্দিষ্ট কক্ষপথে সর্বদা ঘুরে চলেছে। এই ভাবে ইউরোপে ক্রমে আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের জন্ম হয়।
(FAQ) জ্যোতিষশাস্ত্র সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
জ্যোতিষ্কসমূহের বিন্যাস।
Astrology কথাটির অর্থ হল জ্যোতিষ্ক সম্বন্ধে বিচার।
আর্যভট্ট ও বরাহমিহির
পিথাগোরাস।