পিথাগোরাস

দার্শনিক ও গণিতবিদ পিথাগোরাস প্রসঙ্গে তার জন্ম, বংশ পরিচয়, শিক্ষা, মিশর গমন, পিরামিড দর্শন, মৌলিক রচনা, সংখ্যার উপর গুরুত্ব, পৃথিবীর আকার সম্পর্কে ধারণা, জন্মান্তরবাদে বিশ্বাস, জনপ্রিয়তা, মিথ্যা প্রচার ও তার হত্যা সম্পর্কে জানবো।

দার্শনিক ও গণিতবিদ পিথাগোরাস

ঐতিহাসিক চিন্তাবিদপিথাগোরাস
জন্ম৫২৭ খ্রিস্টপূর্ব
দেশগ্ৰিস
পরিচিতিদার্শনিক ও গণিতবিদ
মৃত্যু৪৯৭ খ্রিস্টপূর্ব
দার্শনিক ও গণিতবিদ পিথাগোরাস

ভূমিকা :- গণিতশাস্ত্রের ইতিহাসে যিনি আদিপুরুষ হিসাবে চিহ্নিত হয়ে আছেন তাঁর নাম পিথাগোরাস। তিনি ছিলেন একাধারে গণিতজ্ঞ চিন্তাবিদ দার্শনিক।

পিথাগোরাসের জন্ম

প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে বর্তমান তুরস্ক-এর পশ্চিমে ইজিয়ান সাগরের সামস দ্বীপে পিথাগোরাসের জন্ম। এই সামস ছিল গ্রীসের ক্রোতনা দ্বীপের অন্তর্ভুক্ত।

পিথাগোরাসের শিক্ষা

ছেলেবেলা থেকেই বিদ্যা অনুরাগের প্রতি প্রবল আকর্ষণ ছিল পিথাগোরাসের। তিনি বিশ্বাস করতেন কোনো একজন গুরুর কাছে জ্ঞান সম্পূর্ণ হয় না। জ্ঞানের ভাণ্ডার ছড়িয়ে আছে পৃথিবীব্যাপী।

পিথাগোরাসের মিশর গমন

তাই সামস শহরে তাঁর শিক্ষা শেষ করে বার হলেন দেশভ্রমণে। সেই সময় গ্রীস দেশের বাণিজ্যতরীগুলি বিভিন্ন দেশে বাণিজ্য করতে যেত। এমনি একটি জাহাজে করে তিনি রওনা হলেন মিশরে। প্রাচীন গ্রীসের মত প্রাচীন মিশরও ছিল জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার কেন্দ্রভূমি। এখানে প্রধানত গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের শিক্ষালাভ করেন।

পিথাগোরাসের পিরামিড দর্শন

  • (১) মিশরে অবস্থানের সময় পিরমিড দর্শন করে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে যান। বিশাল পিরামিড নির্মাণের সময় যে গাণিতিক নিয়ম অনুসারে পাথরগুলিকে সাজান হয়েছিল তা থেকেই সম্ভবত তাঁর মনে প্রথম জ্যামিতির সম্বন্ধে চিন্তা-ভাবনা জেগে ওঠে।
  • (২) যদিও জ্যামিতির জনক ইউক্লিড (আনুমানিক ৩২০-২৭৫ খ্রিস্টপূর্ব)। তিনিই প্রথম জ্যামিতির জন্য সুসংহতভাবে নির্দিষ্ট পদ্ধতি প্রবর্তন করেন। কিন্তু তাঁর অন্তত দুশো বছর আগে পিথাগোরাস জ্যামিতি বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা শুরু করেন।
  • (৩) এরই পরণতি তাঁর বিখ্যাত উপপাদ্যটি সমকোণী ত্রিভুজের অতিভুজের উপর অঙ্কিত বর্গ ওই ত্রিভূজের অপর দুই বাহুর উপর বর্গের যোগফলের সমান।

পিথাগোরাসের মৌলিক রচনা

  • (১) এই বিষয়ে ভিন্ন মত প্রচলিত আছে। পিথাগোরাস দেশভ্রমণ করতে করতে ভারতবর্ষে এসে উপস্থিত হন। প্রাচীন মিশরের মত প্রাচীন ভারতবর্ষও ছিল জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার কেন্দ্রভূমি।
  • (২) পিথাগোরাসের আবির্ভাবের অন্তত একশ বছর ভারতীয় পণ্ডিত বৌধায়ন জ্যামিতি সম্বন্ধে চিন্তা-ভাবনা শুরু করেন। সম্ভবত তাঁর কোনো সূত্র থেকে পিথাগোরাস এই উপপাদ্যটি রচনা করেন।
  • (৩) কোন সূত্র থেকে তিনি এই রচনাটি করেছিলেন তা জানা না গেলেও এটি যে তার মৌলিক রচনা এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

সংখ্যার উপর পিথাগোরাসের গুরুত্ব

বিবাহ ও বন্ধু নির্বাচনের সময় তিনি সংখ্যার খুবই গুরুত্ব দিতেন। শোনা যায় কোনো এক যুবরাজ তাঁর মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। বিবাহের সময় তিনি গণনা করে দেখলেন তাঁর নামের সংখ্যা ২৮৪ । তিনি ঘোষণা করলেন যে কন্যার নামের সংখ্যা হবে ২২০, সেই হবে তাঁর আদর্শ স্ত্রী। তবে পিথাগোরাস তাঁর নিজের বিবাহের সময় এই সংখ্যার উপর বিশেষ গুরুত্ব দেননি।

পিথাগোরাসের বিবাহ

  • (১) তিনি তাঁরই এক ছাত্রী থিয়ানোকে বিবাহ করেছিলেন। থিয়ানো শুধু তাঁর যোগ্য ছাত্রী ছিলেন তাই নয়, তিনি ছিলেন আদর্শ স্ত্রী। থিয়ানোর গর্ভে পিথাগোরাসের একটি কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করে। তার নাম ড্যামো।
  • (২) ড্যামো ছিলেন পিতার মতই পণ্ডিত দার্শনিক। পিথাগোরাস সমস্ত জীবন ধরে যা কিছু রচনা করেছিলেন তা গুপ্ত রাখবার জন্য কন্যাকে নির্দেশ দিয়ে যান। আমৃত্যু কন্যা নেই নির্দেশ পালন করেছিল।

পিথাগোরাসের সঙ্গীত বিষয়ক কাহিনী

  • (১) সংগীতের সঙ্গে সংখ্যার যে নিবিড় সম্পর্ক অর্থাৎ সংগীতের সাথে তাল ও লয়ের যে ঐক্য তা পিথাগোরাসেরই আবিষ্কার। এই প্রসঙ্গে একটি কাহিনী প্রচলিত আছে।
  • (২) তিনি একদিন রাজপথ দিয়ে হাঁটছিলেন, পথের ধারে এক কামারের দোকান। অকস্মাৎ তাঁর কানে এল হাতুড়ি ঠোকার শব্দ। একটি শব্দের সাথে আরেকটি শব্দের কোনো ঐক্য খুঁজে পাচ্ছিলেন না।
  • (৩) তিনি দোকানে সব কটি হাতুড়ি ওজন করে দেখলেন। তাদের ওজন হল ৬, ৮, ৯.৭, এই সংখ্যাগুলির সম্পর্ক নির্ণয় করলেন (২৩) অর্থাৎ ৬ (২×৪) = ৮ (৩×৩) = ৯।
  • (৪) এই তিনটি হাতুড়ির আওয়াজের মধ্যে মিল খুঁজে পেলেন কিন্তু চতুর্থ হাতুড়িটির ওজন ছিল সামঞ্জস্যহীন, তাই তার আওয়াজও ছিল বেসুরো।

সংগীত ও ঔষধের মধ্যে সম্পর্ক

  • (১) সংগীত ও ঔষধের মধ্যে একটি পারস্পরিক সম্পর্ক খুঁজে বার করেছিলেন পিথাগোরীয়ানরা। তাদের মতে মানুষের দেহও বাদ্যযন্ত্রের মত নিয়ন্ত্রিত হওয়া উচিত। সংগীতের উচ্চ স্বর নিম্ন স্বরের মতই দেহ কখনো শীতন কখনো উত্তপ্ত হয়।
  • (২) নির্দিষ্ট সুরে যখন বাদ্যযন্ত্র বাঁধা থাকে তখনই তার থেকে সংগীতের উদ্ভব হয়। মানব দেহ যদি যন্ত্রের তারের মত চড়া পর্দায় বাঁধা হয় কিম্বা টান শিথিল হয়ে পড়ে তখন শরীরে নানান রোগের উদ্ভব হয়।
  • (৩) বিপরীত বস্তুর প্রকৃত সংমিশ্রণের ফলে যে সুর ও ঐক্যের ভাব সৃষ্টি হয় তাই সত্যিকারের স্বাস্থ্য। সাস্থ্য বিষয়ে তাঁর বহু বক্তব্য আজও সমান প্রাসঙ্গিক।

পৃথিবীর আকার গোল সম্পর্কে পিথাগোরাসের মন্তব্য

পিথাগোরাসই প্রথম বলেছিলেন পৃথিবীর আকার গোল। আমাদের চারপাশের গ্রহ-নক্ষত্র এই পৃথিবী আবর্তিত হচ্ছে। কোপার্নিকাস তাঁর রচনায় অপকটে পিথাগোরাসের কাছে ঋণ স্বীকার করেছেন।

জন্মান্তরবাদে বিশ্বাসী পিথাগোরাস

  • (১) প্রাচীন ভারতীয় ঋষিদের মত পিথাগোরাস জন্মান্তরবাদে বিশ্বাস করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন আত্মা অমর-তার লয় নেই। মৃত্যুর পর আত্মা নতুন দেহে জন্ম নেয়।
  • (২) একদিন পিথাগোরাস দেখলেন একটি লোক কুকুরটিকে মারছে। যন্ত্রণায় কুকুরটি চিৎকার করছে। কুকুরটির চিৎকারে বিচলিত হয়ে পড়লেন পিথাগোরাস। তাঁর মনে হল ঐ কণ্ঠস্বর তাঁর মৃত বন্ধুর। মৃত্যুর পর সে কুকুর হয়ে জন্মগ্রহণ করেছে।

পিথাগোরাস সম্পর্কে হেরোক্লিটাসের মন্তব্য

গণিতে তাঁর অবদানের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে হেরোক্লিটাস স্বীকার করেছেন বৈজ্ঞানিক গবেষণায় অন্য সকলকে তিনি অতিক্রম করে গিয়েছেন। ধর্ম ও বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে নির্ণয়ের প্রসঙ্গে তিনি বলতেন, বিজ্ঞানের মধ্যেই আছে সর্বশ্রেষ্ঠ বিশুদ্ধতা এবং যে মানুষ এই বিশুদ্ধতাতেই নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন তিনিই শ্রেষ্ঠ দার্শনিক।

পিথাগোরাস সম্পর্কে অ্যারিস্টটলের মন্তব্য

এরিস্টটল তাঁর প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন, “পিথাগোরাসই প্রথম পাটিগণিতকে বাণিজ্যিক প্রয়োজনের সীমারেখার গণ্ডি অতিক্রম করে স্বতন্ত্র মর্যাদা দিয়েছিলেন”। তিনি ত্রিভুজের ব্যবহার জানতেন এবং ৩, ৪, ৫ সংখ্যার সাহায্যে সমকোণী ত্রিভুজ অঙ্কন করতে জানতেন। পরবর্তীকালে এটি পিথাগোরীয় ত্রিভুজ নামে পরিচিত হয়।

পিথাগোরাসের জনপ্রিয়তা

জীবনকালে গ্রীস দেশে পিথাগোরাসের জনপ্রিয়তা ছিল বিরাট। তাঁর ছাত্র শিষ্য ছাড়াও দেশের বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি তাঁর পাণ্ডিত্যের জন্য তাঁকে গভীর শ্রদ্ধা করত। ক্রমশই পিথাগোরাসের অনুগামীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে।

পিথাগোরাসের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচার

  • (১) তার অনুসারীদের মধ্যে অনেকে জ্ঞানচর্চার চেয়ে রাজনীতির চর্চায় বেশি মনোযোগী হয়ে ওঠে। দেশের রাজশক্তি এতে চিন্তিত হয়ে ওঠে। তাছাড়া কিছু বুদ্ধিজীবীও পিথাগোরাসের খ্যাতির জনপ্রিয়তা সম্মানে ঈর্ষান্বিত হয়ে উঠেছিল।
  • (২) তারা রাজশক্তির সাথে একত্রিত হয়ে পিথাগোরাসের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচার করতে আরম্ভ করল। এই প্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে জনসাধারণ পিথাগোরাসের শিক্ষাকেন্দ্র আক্রমণ করল। পিথাগোরাসের শিষ্য যারা বাধা দিতে এল তারা মারা পড়ল, অনেকে পালিয়ে প্রাণ বাঁচাল ।

পিথাগোরাসের হত্যা

  • (১) শিষ্যদের অনুরোধে পিথাগোরাসও পালাতে আরম্ভ করলেন। তিনি বিক্ষুব্ধদের প্রায় নাগালের বাইরে চলে গিয়েছিলেন। হঠাৎ সামনে পড়ল কলাই জাতীয় এক শস্যের ক্ষেত। তিনি ইচ্ছে করলেই ক্ষেতের উপর দিয়ে চলে যেতে পারতেন। কিন্তু তিনি থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন।
  • (২) তিনি বিশ্বাস করতেন-কলাইয়েরও প্রাণ আছে। একটি জীবন্ত কলাইয়ের উপর পা দেওয়ার অর্থ একটি জীবনকে হত্যা করা। নিজের জীবন বিপন্ন জেনেও কলাইয়ের উপর পা রাখলেন না। সেই সুযোগে বিপক্ষ দলের লোকেরা এসে তাঁকে হত্যা করল। নিজের জীবন দিয়ে নিজের আদর্শকে রক্ষা করলেন পিথাগোরাস।

উপসংহার :- গণিতে পিথাগোরাসের উপপাদ্য বা পিথাগোরিয়ান থিউরেম হল ইউক্লিডীয় জ্যামিতির অন্তর্ভুক্ত সমকোণী ত্রিভুজের তিনটি বাহু সম্পর্কিত একটি বিশেষ সম্পর্ক। এই উপপাদ্যটি গ্রিক গণিতবিদ পিথাগোরাসের নামানুসারে করা হয়েছে, যাকে ঐতিহ্যগতভাবে এই উপপাদ্যদের আবিষ্কারক ও প্রমাণকারী হিসেবে গণ্য করা হয়।

(FAQ) দার্শনিক ও গণিতবিদ পিথাগোরাস সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. পিথাগোরাস কে ছিলেন?

একজন আয়োনীয় গ্রিক দার্শনিক, গণিতবিদ এবং পিথাগোরাসবাদী ভ্রাতৃত্বের জনক যার প্রকৃতি ধর্মীয় হলেও তা এমন সব নীতির উদ্ভব ঘটিয়েছিল যা পরবর্তীতে প্লেটো এবং এরিস্টটলের মত দার্শনিকদের প্রভাবিত করেছে।

২. কে প্রথম বলেছিলেন পৃথিবীর আকার গোল?

পিথাগোরাস।

৩. জ্যামিতির জনক কাকে বলা হয়?

ইউক্লিড।

৪. পিথাগোরাসের উপপাদ্য কার নামে পরিচিত?

পিথাগোরাস।

Leave a Comment