বহুবিদ্যাবিশারদ ইবনে রুশদি প্রসঙ্গে তার জন্ম, বংশ পরিচয়, শিক্ষা, রাজ চিকিৎসক, ভোগবিলাসের বিরোধী, কঠোর অধ্যয়ণ, নির্ভীক ও স্পষ্টবাদী, নির্বাসন, পুনরায় পদে নিয়োগ, গ্ৰন্থ রচনা ও তার মৃত্যু সম্পর্কে জানবো।
বহুবিদ্যাবিশারদ ইবনে রুশদি
ঐতিহাসিক মনীষী | ইবনে রুশদি |
জন্ম | ১১২৬ খ্রি: |
দেশ | স্পেন |
পরিচিতি | বহুবিদ্যাবিশারদ |
মৃত্যু | ১১৯৯ খ্রি: |
ভূমিকা :- ইউরোপীয় পণ্ডিতগণ মুসলিম সভ্যতাকে বিশ্ব জনমনের স্মৃতিপট থেকে চিরতরে মুছে ফেলার জন্য উদ্দেশ্যমূলকভাবে বিশ্ব বিখ্যাত যে সকল মুসলিম মনীষীদের নামকে বিকৃত করে লিপিবদ্ধ করেছে, তাদের মধ্যে ইবনে রুশদির নাম অন্যতম। তারা অধিকাংশ মনীষীর নাম এমনভাবে বিকৃত করেছে, নাম দেখে বুঝার উপায় নেই যে উনি একজন খাঁটি মুসলমান এবং খোদা ভীরু ছিলেন।
ইবনে রুশদির নাম বিকৃতি
ইউরোপীয় পণ্ডিতগণ ইবনে রুশদির নাম বিকৃত করে ‘এভেরোস’ লিপিবদ্ধ করেছে। তাঁর প্রকৃত নাম আবুল ওয়ালিদ মহম্মদ ইবনে আহমদ ইবনে মহম্মদ ইবনে রুশদি।
ইবনে রুশদির জন্ম
১১২৬ খ্রিস্টাব্দে স্পেনের কর্ডোভা নগরীতে একটি বিখ্যাত অভিজাত পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।
ইবনে রুশদির বংশ পরিচয়
তাঁর পূর্ব পুরুষগণ স্পেনের রাজনীতিতে বিশেষভাবে জড়িত ছিলেন। তাঁর পিতামহ ছিলেন কর্ডোভার প্রধান বিচারপতি। এছাড়া তিনি কর্ডোভা জামে মসজিদের ইমাম ছিলেন এবং মালেকী মাজহারের একজন প্রখ্যাত পণ্ডিতও ছিলেন।
ইবনে রুশদির শিক্ষা
- (১) ইবনে রুশদি ছিলেন একজন নিষ্ঠাবান আধ্যাত্মবাদী। কথায় ও কাজে ছিলেন আল্লাহ পাকের এক অনুগত বান্দা। বাল্য ও কৈশোরে তিনি কর্ডোভা নগরীতে শিক্ষা গ্রহণ করেন। তিনি যে সকল শিক্ষকের নিকট জ্ঞান অধ্যয়ন করেছিলেন তাঁদের মধ্যে দু’জনের নাম হল ইবনে বাজা এবং আবু জাফর হারুন।
- (২) জ্ঞান সাধনার প্রতি তাঁর ছিল অসীম আগ্রহ। তিনি তাঁর মেধা ও প্রতিভার বলে খুব কম সময়ের মধ্যেই কোরআন, হাদিস, বিজ্ঞান, আইন, চিকিৎসায় তাঁর পাণ্ডিত্য ও কর্ম দক্ষতার সুনাম সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
রাজ চিকিৎসক ইবনে রুশদি
তাঁর চিকিৎসার খ্যাতি ও প্রতিপত্তিতে মুগ্ধ হয়ে খলিফা আবু ইয়াকুব ইউসুফ ১১৮২ খ্রিস্টাব্দে প্রখ্যাত দার্শনিক ও চিকিৎসক ইবনে তোফায়েলের মৃত্যুর পর তাঁকে রাজ চিকিৎসক হিসেবে নিয়োগ করেন এবং পরবর্তীতে ইয়াকুবের পুত্র খলিফা ইয়াকুব আর মনুসুরও ইবনে রুশদিকে রাজ চিকিৎসক পদে বহাল রাখেন।
ভোগ বিলাসের বিরোধী ইবনে রুশদি
এরূপ রাজকীয় পদমর্যাদা ও প্রভাব প্রতিপত্তি থাকা সত্ত্বেও এই মহান মনীষী ভোগ বিলাসের মধ্যে ডুবে যাননি। সরকারি বিভিন্ন দায়িত্ব পালনের পর তিনি জীবনের সমস্ত অবসর সময়ে মানুষের কল্যাণে জ্ঞান সাধনা, দর্শন, অংকশাস্ত্র, চিকিৎসা বিজ্ঞান, পদার্থ বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ে গবেষণা করতেন।
ইবনে রুশদির কঠোর অধ্যয়ণ
কথিত আছে, তিনি বিবাহ ও পিতার মৃত্যুর রাত্রি ব্যতীত আর কোন রাত্রিতেই অধ্যয়ন ত্যাগ করেননি।
নির্ভীক ও স্পষ্টবাদী ইবনে রুশদি
তিনি কখনো অন্যায় ও অসত্যের সামনে সত্য ও ন্যায়কে প্রকাশ করতে ভয় করতেন না। তিনি তাঁর দর্শন ও ধর্মীয় বিষয়ে বলিষ্ঠ মতবাদ ব্যক্ত করতেন। এতে কখনো কখনো খলিফারা তাঁর নির্ভীক ও স্পষ্ট মতবাদে বিরক্ত ও ক্রোধান্বিত হয়ে উঠতেন। অপরদিকে খ্রিস্টান পাদ্রীরা প্রচার করেন, “তাঁর নাম পাপের প্রতি শব্দ।”
ইবনে রুশদির নির্বাসন
অবশেষে খলিফা ইয়াকুব আল মনসুর তাঁকে প্রধান বিচারপতি’র পদ থেকে অপসারণ করেন। এতেও খলিফা সন্তুষ্ট হলেন না। ১১১৯ সালে খলিফা তাঁকে কর্ডোভার নিকটবর্তী ইলিসাস নামক স্থানে নির্বাসন দেন। তাঁর জ্যোতির্বিজ্ঞান, অংকশাস্ত্র, পদার্থ বিজ্ঞান ও বৈজ্ঞানিক ইবনে রুশদি চরম অপমান ও আর্থিক দূরবস্থায় পতিত হন।
ইবনে রুশদিকে পুনরায় পদে নিয়োগ
১১৯৮ খ্রিস্টাব্দে খলিফা তাঁর ভুল বুঝতে পেরে লোক পাঠিয়ে ইবনে রুশদকে ফিরিয়ে আনেন এবং পূর্ব পদে পুর্নবহাল করেন। কিন্তু তিনি এই সুযোগ বেশি দিন ব্যবহার করতে পারেননি।
ইবনে রুশদির গ্ৰন্থ রচনা
- (১) এই মনীষী দর্শন, ধর্মতত্ত্ব, আইন, জ্যোতির্বিজ্ঞান, ব্যাকরণ, চিকিৎসা বিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়ে বহু গ্রন্থ রচনা করে যান। কিন্তু তাঁর প্রণীত অনেক গ্রন্থই সংরক্ষণের অভাবে আজ বিলুপ্ত প্রায় । তাঁর প্রণীত প্রায় ৮৭টি বই এখনো পাওয়া যায়।
- (২) তিনি গোলকের গতি সম্বন্ধে একটি গ্রন্থ রচনা করেন, যার নাম ‘কিতাবু ফি হারকাতুল ফালাক’। গ্রন্থটি জ্যাকব আনাতোলি কর্তৃক ১৯৩১ সালে হিব্রু ভাষায় অনূদিত হয়।
- (৩) চিকিৎসা বিজ্ঞান সম্পর্কে তাঁর লেখা বইয়ের সংখ্যা প্রায় ২০টি। এগুলোর অধিকাংশই ইংরেজি, ল্যাটিন ও জার্মান ভাষায় অনূদিত হয়েছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের উপর তাঁর প্রণীত একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হচ্ছে ‘কিতাব আল কুলিয়াত ফি আততীব’। এই গ্রন্থটিতে তিনি অসংখ্য রোগের নাম, লক্ষণ ও চিকিৎসা প্রণালী বর্ণনা করেছেন।
- (৪) ধর্ম ও দর্শনের উপর তাঁর রচিত একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হল তাহদজুল আল তাহদজ্বল’ যার ইংরেজি অনুবাদের নাম হল, ‘The Incoherence of the Incoherence’ এছাড়া ইবনে রুশদি সঙ্গীত ও ত্রিকোণমিতি সম্বন্ধেও গ্রন্থ রচনা করেন।
ইবনে রুশদির মৃত্যু
১১৯৯ খ্রিস্টাব্দে এই মুসলিম মনীষী ইহলোক ত্যাগ করেন।
উপসংহার :- ইবন রুশদি এরিস্টটল-এর মতাদর্শের এক উৎসাহী সমর্থক ছিলেন। তিনি এরিস্টটলের মূল শিক্ষা পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রয়াস করেছিলেন।
(FAQ) বহুবিদ্যাবিশারদ ইবনে রুশদি সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
একজন মুসলিম বহুবিদ্যাবিশারদ এবং আইনবিদ যিনি দর্শন, ধর্মতত্ত্ব, চিকিৎসাবিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, গণিত, ইসলামি আইনশাস্ত্র এবং ভাষাবিজ্ঞানসহ বহু বিষয়ে লিখেছেন।
স্পেন।
‘কিতাব আল কুলিয়াত ফি আততীব’।