প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ

প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ প্রসঙ্গে ভারতের ধর্মগ্রন্থ, ইরানের ধর্মগ্রন্থ, ইজরায়েলের ধর্মগ্রন্থ পুরাণ, মিশরের পুরাণ, মেসোপটেমিয়ার পুরাণ, গ্রিসের পুরাণ, ভারতের পুরাণ, মহাকাব্য, সুমেরের মহাকাব্য, গ্রিসের মহাকাব্য ও ভারতের মহাকাব্য সম্পর্কে জানবো।

প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ

ঐতিহাসিক গ্ৰন্থপ্রাচীন ধর্মগ্রন্থ
জেন্দ আবেস্তাইরান
হিব্রু বাইবেলইজরায়েল
প্যাপিরাসমিশর
গিলগামেশসুমের
ইলিয়াডগ্ৰিস
রামায়ণভারত
প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ

ভূমিকা :- ধর্ম মানবজীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। একারণে ধর্মীয় সাহিত্য থেকে ইতিহাসের অনেক তথ্যাদি পাওয়া যায়। বিভিন্ন দেশের ধর্মীয় সাহিত্য গুলি ধর্মগ্ৰন্থ হিসেবে পরিচিত।

ভারতের ধর্মগ্ৰন্থ

প্রাচীন ভারতের বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, রামায়ণ-মহাভারত, বিভিন্ন স্মৃতিশাস্ত্র, বৌদ্ধগ্রন্থ ত্রিপিটক, জাতক, জৈনগ্রন্থ ‘ভগবতী সূত্র, আচারঙ্গ সূত্র, ভদ্রবাহু রচিত ‘কল্পসূত্র’ প্রভৃতি ধর্মগ্রন্থ যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।

ইরানের ধর্মগ্ৰন্থ

অনুরূপভাবে প্রাচীন ইরানে জরথুস্ট্র জরথুস্ট্রীয় ধর্ম প্রবর্তন করেন। খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতকে তাঁর আবির্ভাব হয়। তাঁর উপদেশাবলি জেন্দ-আবেস্তায় সংকলিত আছে। জরথুস্ট্রের মতে, পৃথিবীতে সর্বদা ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, সত্য-মিথ্যা এবং আলো-অন্ধকারের মধ্যে যুদ্ধ চলছে। আহুর মাজদা হলেন আলোকের দেবতা, মঙ্গলের দেবতা – তিনি সত্য, ধর্ম ও জ্ঞানের প্রতীক। অহির্মান হলেন অন্যায়, অসত্য ও অমঙ্গলের প্রতীক। সে সর্বদাই মানুষকে বিপথে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে।

ইজরায়েলের ধর্মগ্ৰন্থ

প্রাচীন ইহুদিদের কথা জানতে গেলে প্রাচীন হিব্রু বাইবেল অপরিহার্য। এই গ্রন্থ থেকে ইহুদিদের উৎপত্তি, আইন-কানুন, পৃথিবীর উৎপত্তি, তাদের ধর্মমত ও ইতিহাস-সংক্রান্ত বহু কথাই জানা যায়। অর্ধ যাযাবর ইহুদিদের জীবনসংগ্রাম, তাদের মিশরে প্রবেশ, সেখানে তাদের দাসত্ব-জীবন, মুশার নেতৃত্বে তাদের দক্ষিণ সিরিয়ার কন্নান দেশ বা প্যালেস্টাইন দখল প্রভৃতি কাহিনি ‘বাইবেলের প্রাচীন বিধানে’ আলোচিত হয়েছে। ধর্মগ্রন্থগুলির মধ্যে পুরাণ ও মহাকাব্য থেকে ইতিহাসের অনেক তথ্য পাওয়া যায়।

পুরাণ

পুরাণগুলি প্রাচীন ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। পৃথিবীর প্রত্যেক সভ্যতায় পুরাণের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। পুরাণগুলিতে স্থান পেয়েছে নানা প্রাচীন দেবদেবী ও রাজা-মহারাজা সম্পর্কে বিভিন্ন কল্পিত কাহিনি ও কিংবদন্তি। এ সত্ত্বেও পুরাণগুলি থেকে রাজাদের বংশতালিকা, বিভিন্ন রাজবংশের উৎপত্তি, রাজাদের কার্যকলাপ, বিভিন্ন দেবদেবীর উৎপত্তি ও কার্যকলাপ, প্রাচীন নদনদী, পাহাড়পর্বত, প্রাচীন শহর ও তীর্থস্থানগুলির কথা জানা যায়। তবে পুরাণ বর্ণিত কালানুক্রম বেশ বিভ্রান্তিকর।

(ক) মিশর

প্রাচীন মিশরের পুরাণ সম্পর্কিত বিভিন্ন দিক গুলি হল –

(১) পৌরাণিক কাহিনি

প্রাচীন মিশরে ‘প্যাপিরাসে’ লিপিবদ্ধ এই ধরনের প্রচুর পৌরাণিক কাহিনি পাওয়া গেছে। এতে বিভিন্ন দেবদেবী, বীর নায়ক-নায়িকা ও ফ্যারাওদের কাহিনি গল্পাকারে রচিত ছিল। এগুলির মধ্যে বিশেষভাবে প্রসিদ্ধ ছিল দেবতা ওসিরিস সম্পর্কিত কাহিনি।

(২) হিতোপদেশ

পুরাণগুলির মাধ্যমে ‘হিতোপদেশ’-ও দেওয়া হত। সর্বত্র এর প্রচলন ছিল খুব বেশি। এই পুরাণগুলিতে মিশরের জনসাধারণকে ফ্যারাও ও উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের আজ্ঞাবাহী হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

(৩) দরিদ্রদের কথা

অন্যদিকে, বিত্তহীন গরিব মানুষদের মধ্যে প্রচলিত সংগীত, প্রবাদ প্রভৃতি সংরক্ষিত হয়ে আধুনিক মানুষদের হাতে পৌঁছোয় নি, কারণ অত্যাচার ও দারিদ্র্যের জন্য তারা কিছু লিপিবদ্ধ করে রাখতে পারে নি। তাদের কিছু কিছু কথা পুরাণ থেকে পাওয়া যায়।

(খ) মেসোপটেমিয়া

পুরাণ সম্পর্কিত মেসোপটেমিয়ার বিভিন্ন দিক গুলি হল –

(১) পৌরাণিক কাহিনি

মেসোপটেমিয়াতেও কাদা-পাটার মধ্যে নানা পুরাণ-কথা ছড়িয়ে আছে। একটি পুরাণে একটি জলপ্লাবনের কাহিনি বর্ণিত হয়েছে। কোনো পুরাণে দেবতা ও অসুরের দ্বন্দ্ব, মানুষের ওপর দেবতার রোষ, জলপ্লাবন এবং শেষপর্যন্ত একটি পরিবার বাদে সব মানুষের মৃত্যু প্রভৃতি কাহিনি বিস্তৃত হয়েছে। মেসোপটেমিয়ার এই কাহিনি অন্যান্য দেশেও ছড়িয়ে পড়ে।

(২) ধর্মের গুরুত্ব প্রকাশ

প্রমাণিত হয় যে, প্রকৃতির সামনে মানুষ বড়ো অসহায়। এর ফলে দেবদেবীর প্রতি ভক্তি সুদৃঢ় হয়। এর সুযোগ নিয়ে পুরোহিতরা প্রচার করতে থাকে যে, দেবতার নির্দেশ অমান্য করলে পৃথিবীতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও অন্যান্য বিপর্যয় নেমে আসবে।

(গ) গ্রিস

পুরাণ সম্পর্কিত গ্ৰিসের বিভিন্ন দিক গুলি হল –

(১) পৌরাণিক কাহিনি

প্রাচীন গ্রিসের ইতিহাস জানতেও পুরাণ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পুরাণের বহু চরিত্র ও তাদের কীর্তিকলাপ কল্পিত হলেও সেখানে প্রকৃতির বিরুদ্ধে গ্রিকদের সংগ্রাম, তাদের দৈনন্দিন জীবনধারা, শ্রমের হাতিয়ার, সামাজিক রীতিনীতি, বিদেশযাত্রা, ধর্মবিশ্বাস ও দেবদেবী সম্পর্কে নানা কথা জানা যায়।

(২) গ্রিকদের পছন্দ

গ্রিকরা হেরাক্লেস, আর্গোনৌতেসদের কাহিনি এবং দাইদালাস ও ইকারাসের কাহিনি খুব পছন্দ করত।

(ঘ) চিন

পুরাণ সম্পর্কিত চিনের বিভিন্ন দিক গুলি হল –

(১) তথ্যের স্বল্পতা

প্রাচীন চিন-এ প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার হয়েছে খুব সামান্য। এর ফলে প্রাচীন চিনের সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার কথা প্রায় কিছুই জানা যায় না। এই অভাব পূরণ করেছে চিনের প্রাচীন উপাখ্যানগুলি। উপাখ্যানগুলিতে বর্ণিত ঘটনাবলি প্রমাণিত সত্য নয়, তবুও এগুলির মধ্যে থেকে চিনের মোটামুটি একটি ধারাবাহিক ইতিহাস পাওয়া যায়।

(২) পৌরাণিক কাহিনি

চিনের পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে, স্বর্গ ও মর্তের সৃষ্টিকর্তা পান-কু হলেন পৃথিবীর প্রথম মানুষ। সম্রাট সুইজেন হলেন আগুনের আবিষ্কারক। সম্রাট ফু সি হলেন চিনে প্রথম শিকার ও পশুপালনের প্রবর্তক। চাষবাসের প্রবর্তক হলেন শেন-নুং। খাল কেটে, বাঁধ দিয়ে হোয়াং হো নদীর প্রবল বন্যা থেকে দেশকে রক্ষা করেছিলেন সম্রাট য়ু। চাষবাসের জন্য সুপরিকল্পিত সেচব্যবস্থার সূত্রপাতও করেছিলেন তিনি।

(ঙ) ভারত

পুরাণ সম্পর্কিত ভারতের বিভিন্ন দিক গুলি হল –

(১) বিভিন্ন পুরাণ

ভারতে পুরাণের সংখ্যা আঠারোটি। এগুলির মধ্যে বিষ্ণুপুরাণ, বায়ুপুরাণ, মৎস্যপুরাণ, ব্রহ্মপুরাণ ও ভবিষ্যপুরাণ বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

(২) তথ্য

এইসব পুরাণ থেকে ভারতের প্রাকৃতিক পরিবেশ ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের অনেক তথ্যই পাওয়া যায়।

(৩) রাজবংশের বিবরণ

রাজবংশগুলির বর্ণনা ও ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাস রাচনায় পুরাণের গুরুত্ব অসীম। হর্ষঙ্ক, শিশুনাগ, মৌর্য, শৃঙ্গ, কাম্ব, সাতবাহন, গুপ্ত প্রভৃতি রাজবংশগুলি সম্পর্কে পুরাণ যথেষ্ট তথ্যাদি সরবরাহ করে। পুরাণ থেকে শক, যবন, আভীর, হুন প্রভৃতি বৈদেশিক জাতি সম্পর্কেও নানা মূল্যবান তথ্য পাওয়া যায়।

(৪) সমাজ ও ধর্ম

পুরাণে ঈশ্বরতত্ত্ব, মূর্তিপূজা, সমাজ, স্থাপত্য, সংগীত, জ্যোতিষ, নদনদী, পাহাড়পর্বত, তীর্থস্থান প্রভৃতি বহু বিষয়ের ওপরেই আলোচনা আছে।

(৫) সাবধানতা অবলম্বন

তবে আমাদের মনে রাখতে হবে যে, পুরাণ মূলত ধর্মগ্রন্থ। পুরাণ থেকে সাবধানে ঐতিহাসিক তথ্য সংগ্রহ করা উচিত। কেননা, পুরাণ ইতিহাস নয় – ইতিহাসের উপাদান।

মহাকাব্য

ইতিহাসের উপাদান হিসেবে মহাকাব্যের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। প্রাচীন সুমের, গ্রিস, ভারত প্রভৃতি দেশের মহাকাব্যগুলি ইতিহাসের মূল্যবান উপাদান।

(১) সুমেরের মহাকাব্য

পোড়ামাটির টালিতে লিখিত ‘গিলগামেশ’ মহাকাব্যে একটি জলপ্লাবনের কাহিনি বর্ণিত হয়েছে। গিলগামেশ নামে নায়কের নামানুসারে এর নাম ‘গিলগামেশ’। এই উপাখ্যানটি সুমেরীয় ভাষায় লিখিত। ইহুদিদের বাইবেলেও এই কাহিনির উল্লেখ আছে। ভারতীয় সাহিত্য ‘শতপথ ব্রাহ্মণ’-এও এর উল্লেখ আছে।

(২) গ্রিসের মহাকাব্য

বিশ্বসাহিত্যের অনন্য সৃষ্টি মহাকবি হোমার-রচিত ‘ইলিয়াড’ ও ‘ওডিসি’ মহাকাব্য দুটিতে গ্রিকদের সঙ্গে ট্রয় নগরীর যুদ্ধের কাহিনি বিবৃত হয়েছে। এই মহাকাব্য দুটি থেকে প্রাচীন গ্রিসের সমাজ ও রাষ্ট্রজীবনের নিখুঁত চিত্র পাওয়া যায়। ইলিয়াড ও ওডিসিতে যদিও নানা কল্পকাহিনি ও অতিরঞ্জন স্থান পেয়েছে, তা সত্ত্বেও এই মহাকাব্য দুটির গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না।

(৩) ভারতের মহাকাব্য

প্রাচীন ভারতের দুই মহাকাব্য – ‘রামায়ণ’ ও ‘মহাভারত’ থেকে প্রাচীন ভারতীয় রাজবংশগুলির কীর্তিকলাপ, আর্য-অনার্য সংঘর্ষ, দাক্ষিণাত্যে আর্য সংস্কৃতির বিস্তার এবং এই যুগের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবন, বিভিন্ন সামাজিক প্রথা, বর্ণব্যবস্থা, সমাজে নারী ও শূদ্রের স্থান প্রভৃতি বিষয়ের পরিচয় পাওয়া যায়। মহাকাব্যে বর্ণিত ঘটনাবলি অতিরঞ্জনদোষে দুষ্ট হলেও সমকালীন যুগের প্রতিচ্ছবি হিসেবে এদের গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না।

উপসংহার :- প্রাচীন ধর্মগ্ৰন্থ গুলি ইতিহাস রচনার অমূল্য সম্পদ। মানুষের ধর্মীয় জীবন ও অতিরঞ্জিত কাহিনী বর্ণনা হলেও প্রাচীন ধর্মগ্ৰন্থগুলিতে ইতিহাসের বহু উপাদান বর্তমান থাকে।

১. চিনের পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে পৃথিবীর প্রথম মানুষ কে?

পান-কু।

২. কোন দেশের ধর্মগ্ৰন্থ জেন্দ আবেস্তা।

ইরান।

৩. ইজরায়েলের ধর্মগ্ৰন্থ কোনটি?

হিব্রু বাইবেল।

৪. ভারতে কতগুলি পুরাণ আছে?

১৮ টি।

৫. সুমেরের মহাকাব্যের নাম কি?

গিলগামেশ।

৬. ইলিয়াড ও ওডিসি কার লেখা?

গ্ৰিক কবি হোমার।

Leave a Comment