বিক্রমাদিত্য ছিলেন প্রাচীন ভারতের একজন কিংবদন্তি সম্রাট, যিনি তার বীরত্ব, প্রজ্ঞা এবং ন্যায়পরায়ণতার জন্য পরিচিত। তিনি সংস্কৃতি, শিল্প, এবং শিক্ষার পৃষ্ঠপোষক হিসেবে খ্যাত ছিলেন। বিক্রমাদিত্যের রাজসভায় নবরত্ন নামে পরিচিত বিখ্যাত কবি ও পণ্ডিতদের একটি দল ছিল, যা সেই যুগে জ্ঞান ও সাহিত্যের স্বর্ণযুগ সৃষ্টি করেছিল। তার শাসনকাল এবং গৌরবময় কাহিনিগুলো ভারতীয় লোককাহিনী ও সাহিত্যে আজও বিশেষভাবে স্মরণীয়।
রাজা বিক্রমাদিত্য
ঐতিহাসিক চরিত্র | বিক্রমাদিত্য |
সময়কাল | প্রাচীন ভারত, সাধারণত ১ম শতাব্দী |
রাজ্য | উজ্জয়িনী (বর্তমান উজ্জয়িন, মধ্যপ্রদেশ) |
খ্যাতি | ন্যায়পরায়ণ সম্রাট, সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক |
উল্লেখযোগ্য কর্ম | সংস্কৃত সাহিত্য ও জ্যোতিষশাস্ত্রে অবদান |
কিংবদন্তি | বিক্রমাদিত্য এবং তার কাহিনী |
ভূমিকা :- বিক্রমে যিনি আদিত্য বা সূর্যভুল্য তিনিই বিক্রমাদিত্য। এই বিক্রমাদিত্য ভারত ইতিহাসের এক বর্ণময় পুরুষ। তাঁকে ঘিরে বহু কিংবদন্তী প্রচলিত। তাই থেকে ঐতিহাসিকদের মধ্যে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে রাজা বিক্রমাদিত্য এবং কিংবদন্তীর বিক্রমাদিত্য কি একই ব্যক্তি?
কিংবদন্তীর বিক্রমাদিত্য
অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, বিক্রমাদিত্য নামে এক প্রতাপশালী রাজা খ্রিঃ পূঃ প্রথম শতাব্দীতে উজ্জয়িনীতে রাজত্ব করতেন। তিনি শক হানাদারদের পরাজিত করে শকারি উপাধি প্রহণ করেছিলেন। বিক্রম সংবত তিনিই প্রচলিত করেছিলেন। শকারি বিক্রমাদিত্য ছিলেন সুঙ্গ বংশীয় রাজা। মহাকবি কালিদাস তাঁরই নবরত্ন সভা অলঙ্কৃত করতেন। এই ঐতিহাসিক বিক্রমাদিত্য কিংবদন্তীর বিক্রমাদিত্য। কিন্তু মুশকিল হল, সুঙ্গবংশীয় কোনো রাজা যে বিক্রমাদিত্য উপাধি গ্রহণ করেছিলেন এমন কোনো তথ্য-প্রমাণ নেই। অথবা কিংবদন্তীর বিক্রমাদিত্য সুঙ্গবংশজাত ছিলেন এমন প্রমাণেরও অভাব।
দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্য
- (১) অনেক ঐতিহাসিকের মতে, গুপ্তবংশের রাজা দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তই বিক্রমাদিত্য উপাধি গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর সভাকবি ছিলেন কালিদাস। কালিদাসের রচনাবলীতে সেই প্রমাণ রয়েছে। কালক্রমে নানা কাহিনীকারের প্রলেপে তিনিই হয়ে উঠেছেন কিংবদন্তীর বিক্রমাদিত্য।
- (২) কালিদাসের রচনাবলী থেকে জানা যায় গুপ্তরাজাদের সময়ে অনেক পৌরাণিক সংস্কার সাধিত হয়েছিল। খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীতে মহাযান বৌদ্ধ মতবাদ প্রচলিত হলে নানা দেবদেবীর সৃষ্টি ও প্রচলন হয়। কালিদাসের রচনাবলীতেও বহু দেবদেবীর উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি গঙ্গা-যমুনার মূর্তির বর্ণনা দিয়েছেন। এই দুই নদী- দেবীকে দেবতাদের চামরধারিণীরূপে কল্পনা করা হয়েছে। এই ধরনের রূপকল্পনা কুষানযুগের শেষে এবং গুপ্ত যুগে হতে দেখা যায়।
- (৩) এছাড়া গুপ্তযুগের শিলালিপিতে যে ধরনের ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে সেই ভাষার সাদৃশ্য রয়েছে কালিদাসের রচনাবলীর ভাষার সঙ্গে। এই সব প্রমাণ থেকে ঐতিহাসিকগণ নিশ্চিত হয়েছেন যে কিংবদন্তীর রাজা বিক্রমাদিত্য, যাঁর সভাকবি ছিলেন কালিদাস, তিনি নিশ্চিত ভাবেই দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত।
বিক্রমাদিত্য উপাধি
দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকাল ছিল ৩৮০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৪১৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। তিনি বিক্রমাদিত্য উপাধি গ্রহণ করেছিলেন। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের পিতা সমুদ্রগুপ্ত ভারতে সর্বপ্রথম সার্বভৌম শক্তির প্রবর্তন করেন। তাঁর সামরিক প্রতিভা ও রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ছিল কিংবদন্তী তুল্য। সেই বিচারে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ বীরদের মধ্যে তিনি অন্যতম বলে গণ্য হন। বস্তুতঃ বিক্রমাদিত্য উপাধি গ্রহণ না করলেও তাঁর প্রতাপ বা বিক্রম ছিল অবিসংবাদিত। পরোক্ষভাবে তাঁর সময় থেকেই কিংবদন্তীর ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল।
রাজা সমুদ্রগুপ্ত
সমুদ্রগুপ্ত সমগ্র উত্তর ভারতের রাজ্যগুলি জয় করে নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত করেছিলেন। কিন্তু দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলির ক্ষেত্রে তিনি যুদ্ধনীতি বদল করেছিলেন। সেখানকার রাজাদের আনুগত্য নিয়েই তিনি সন্তুষ্ট থাকেন। সিংহলরাজ তাঁর আনুগত্য স্বীকার করেছিলেন এবং পেশোয়ার পর্যন্ত তাঁর প্রতি রাজআনুগত্য বিস্তৃত ছিল। হিমালয় নর্মদা এবং যমুনা থেকে ব্রহ্মপুত্র সমুদ্রগুপ্তর প্রত্যক্ষ শাসনাধীন ছিল। তিনি ছিলেন দিগ্বিজয়ী সম্রাট, সুদক্ষ শাসক, সর্ব বিষয়েই উদার নীতি অবলম্বন করতেন তিনি। কবি ও সঙ্গীতজ্ঞ রূপেও তাঁর খ্যাতি ছিল।
রাজ্য উদ্ধারে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত
সমুদ্রগুপ্তের মৃত্যুর পরে তাঁর পুত্র দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত সিংহাসনে আরোহণ করেন। অন্য এক ঐতিহাসিক সূত্র থেকে জানা যায় সমুদ্রগুপ্তর মৃত্যুর পর তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র রামগুপ্ত সম্রাট হন। শক রাজার কাছে আকস্মিক পরাজয়ের পরে সন্ধি স্থাপনের প্রয়োজনে তিনি তাঁর রূপসী রানী ধ্রুবদেবীকে শকরাজার হাতে তুলে দেন। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার এই অসম্মানজনক আচরণে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। তিনি রামগুপ্তকে হত্যা করে সিংহাসনের অধিকার ছিনিয়ে নেন এবং শকরাজার কবল থেকে ধ্রুবদেবীকে উদ্ধার করে নিজে বিবাহ করেন।
দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্যের সাম্রাজ্য বিস্তার
দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত যে সিংহাসন অধিকার করার পরেই বিক্রমাদিত্য উপাধি গ্রহণ করেছিলেন, সে বিষয়ে অনেক ঐতিহাসিকই একমত হয়েছেন। গুপ্তরাজাদের রাজনীতি ও পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে বৈবাহিক নীতি এক বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। এই বিবাহনীতি অনুসরণ করে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্য আরব সাগর পর্যন্ত সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিলেন।
বিক্রমাদিত্য দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের বিবাহ নীতি
তিনি মধ্যভারতের নাগবংশের রাজকন্যা কুবেরনাগকে বিবাহ করেছিলেন। নিজ কন্যা প্রভাবতীকে বিবাহ দিয়েছিলেন বকাটকরাজ দ্বিতীয় রুদ্রসেনের সঙ্গে। এই বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের কিছুকাল পরেই তিনি শক ক্ষত্রপ সৌরাষ্ট্রের তৃতীয় রুদ্রসেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। এই অভিযানে জামাতা রুদ্রসেন তাঁর সাহায্যে এগিয়ে আসেন।
গুপ্ত সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি
শকরাজ্যের অভ্যন্তরীণ গোলযোগের পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত নিশ্চিতভাবে শত্রু দমন করলেন। তিনি গুজরাট ও সৌরাষ্ট্র জয় করার ফলে তাঁর সাম্রাজ্য আরব সাগর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত জলপথে পাশ্চাত্য দেশগুলির সঙ্গে ব্যবসাবাণিজ্যের প্রসার ঘটাতে সাহায্য করেন। ফলে গুপ্ত সাম্রাজ্য অর্থনৈতিক দিক থেকে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে।
দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের দ্বিতীয় রাজধানী
শকবংশ উচ্ছেদ করার পর দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত শকারি উপাধি গ্রহণ করেন এবং বিশাল সাম্রাজ্য নিজের প্রত্যক্ষ শাসনাধীনে রাখার সুবিধার জন্য উজ্জয়িনীতে স্থাপন করেন দ্বিতীয় রাজধানী। ঐতিহাসিকদের মতে গুপ্ত সাম্রাজ্যের সৌভাগ্য ও শ্রীবৃদ্ধির মূলে ছিল গুপ্ত রাজাদের অনুসৃত বৈবাহিক নীতি।
গুপ্ত বংশের জয়যাত্রা
গুপ্তসাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ঘটোৎকচের পুত্র প্রথম চন্দ্রগুপ্ত। তিনি শক্তিশালী হয়ে উঠেছিলেন বৈশালীর লিচ্ছবি বংশের কন্যা কুমারদেবীকে বিবাহ করে। লিচ্ছবিরা ছিলেন অত্যন্ত প্রতাপশালী। তাঁদের সাহায্য নিয়েই প্রথম চন্দ্রগুপ্ত মগধ-এর সিংহাসন অধিকার করেছিলেন এবং পরে প্রতিষ্ঠা করেন গুপ্ত বংশের। সেই থেকেই শুরু হয় গুপ্ত বংশের জয়যাত্রা।
প্রাচীন গুপ্ত রাজাদের শ্রীবৃদ্ধি
লিচ্ছবি বংশের প্রতি প্রথম চন্দ্রগুপ্ত এতটাই কৃতজ্ঞতা বোধ করেছিলেন যে তাঁর মুদ্রায় নিজের প্রতিকৃতির সঙ্গে কুমারদেবীর প্রতিকৃতিও উৎকীর্ণ করেছিলেন। পরবর্তীকালে সেই মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়। সেইকালে এভাবে শ্বশুরকুলকে প্রাধান্য দিয়ে অন্য কোনো প্রাচীন নরপতি মুদ্রার প্রচলন করেন নি। প্রথম চন্দ্রগুপ্তর পর থেকে অনুরূপ বৈবাহিক রীতি গুপ্তবংশের সকল নৃপতিই কমবেশি অনুসরণ করেছেন। সমুদ্রগুপ্ত এবং দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত এই রীতি অনুসরণ করে বরাবরই নিজেদের শ্রীবৃদ্ধি করতে পেরেছেন।
অসাধারণ বীর দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত
ঐতিহাসিকগণ মুক্ত কণ্ঠে স্বীকার করেছেন, দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত ছিলেন অসাধারণ বীর ও রাজনৈতিক প্রতিভার অধিকারী। রাজ্যশাসন ও প্রজাপালনের ক্ষেত্রে তাঁর দৃষ্টি সর্বদাই ছিল সজাগ ও তৎপর। বিশাল সাম্রাজ্য রক্ষা করার সবরকম যোগ্যতাই তাঁর ছিল। তাঁর সুশাসনে গুপ্তসাম্রাজ্য চরম সমৃদ্ধি ও গৌরব লাভ করেছিল।
দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্যের রাজত্বকালে ফা হিয়েনের আগমন
চৈনিক পরিব্রাজক ফা হিয়েন দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্যের রাজত্বকালেই বৌদ্ধ পান্ডুলিপি সংগ্রহের জন্য ভারতবর্ষে এসেছিলেন। তিনি দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তকে সুশাসক, প্রজানুরঞ্জক, সমস্ত ধর্মের প্রতি সমদৃষ্টি সম্পন্ন এবং বিদ্যোৎসাহী নরপতি বলে বর্ণনা করেছেন।
রাজা সমুদ্রগুপ্তের কৃতিত্ব
সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের চরিত্রে বিবিধ গুণের সমাবেশ ঘটেছিল। তিনি ছিলেন তৎকালীন ভারতের অদ্বিতীয় বীর। বীরত্ব ও রাজনৈতিক প্রতিভার সঙ্গে তাঁর মধ্যে কবিত্বশক্তি ও সঙ্গীতবিদ্যারও স্ফুরণ ঘটেছিল। তাঁর বীণাবাদনরত ছবি- যুক্ত মুদ্রা পাওয়া গেছে। সমুদ্রগুপ্তের পঞ্চাশ বছরের রাজত্বকালে সাম্রাজ্যের ভিত সুদৃঢ় হয়েছিল। দীর্ঘ সময় যুদ্ধবিগ্রহে ব্যয়িত হলেও তিনি সম্রাজ্যে শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
বিক্রমাদিত্য ও উজ্জয়িনী প্রায় সমার্থক
দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্য উত্তরধিকার সূত্রেই পিতার গুণাবলীর অধিকারী হয়েছিলেন। স্বীয় বাহুবলে তিনি পৈতৃক রাজ্যের স্থিতি স্থায়ী করেছিলেন। তবে পিতার মতো তাঁকে যুদ্ধবিগ্রহে কালক্ষেপ করতে হয় নি বলে তাঁর রাজত্বে একটি সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন। তাঁর অসামান্য জনপ্রিয়তাকে কেন্দ্র করে নানা কিংবদন্তীর উদ্ভব হয়েছিল। তাঁর দ্বিতীয় রাজধানী উজ্জয়িনী এ সকল গল্প-কথার উপকরণের সঙ্গে অনিবার্যভাবে যুক্ত হয়েছিল। বস্তুতঃ কিংবদন্তীর গল্প-কথায় বিক্রমাদিত্য ও উজ্জয়িনী প্রায় সমার্থক হয়ে উঠেছে।
উজ্জয়িনী এবং বিক্রমাদিত্য উপলক্ষ্যে কাহিনী
প্রাচীন মুদ্রাগুলোতেও দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তকে নানা ভূমিকায় প্রতিফলিত করা হয়েছে। অশ্বারোহী, শিকারী, বীণবাদনরত কিংবা সিংহদলনকারী রূপে তাঁকে প্রাচীন মুদ্রায় চিত্রিত করা হয়েছে। বলাবাহুল্য এই সব চিত্র থেকেই তাঁর নামে প্রচলিত কিংবদন্তীগুলির উপকরণসংগৃহীত হয়েছে। উজ্জয়িনী এবং বিক্রমাদিত্যকে উপলক্ষ্য করে রচিত হয়েছে বেতাল পঞ্চবিংশতি ও বত্রিশ সিংহাসনের আশ্চর্য কাহিনীগুলো।
মহাকবি কালিদাসের রচনা
জনশ্রুতি এই রকম যে, এই কাহিনীমালা রচনা করেছিলেন মহাকবি কালিদাস। এ বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছবার মতো প্রামাণ্য তথ্য এখনো পাওয়া যায় নি। তবে অনুমান হয়, কালিদাস নিজে না লিখলেও প্রাচীন কাহিনীগুলো সংকলন ও সংস্কার করে থাকবেন।
গুপ্তযুগ ভারতের ইতিহাসে সুবর্ণযুগ
প্রাচীন কালে গুপ্তরাজাদের আমলেই ভারতবর্ষ চূড়ান্ত গৌরবের অধিকারী হয়েছিল। সেইকারণে গুপ্তযুগকে ভারতের ইতিহাসে সুবর্ণযুগ বলা হয়ে থাকে। বিশেষ করে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত ভারতের সনাতন ঐতিহ্যের লালন ও প্রসারে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করায় তাঁর রাজত্বকালে, শিল্প, সাহিত্য, ভাস্কর্য ইত্যাদি ক্ষেত্রের চরম উৎকর্ষ ঘটেছিল।
দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্য কিংবদন্তীর নায়কের রূপ পরিগ্রহ
গুপ্তযুগেই ব্রাহ্মণ্যধর্মের পুনরুত্থান সম্ভব হয়েছিল। গুপ্তরাজারা ছিলেন ব্রাহ্মণ্যধর্মের পৃষ্ঠপোষক। কিন্তু দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের সমকালে পর্বতগাত্রে অজন্তা ইলোরায় হিন্দুপুরাণ ও বৌদ্ধজাতক কাহিনী অবলম্বন করে জগৎবিখ্যাত চিত্রগুলি অঙ্কিত হয়। হিন্দুপুরাণগুলিরও সংস্কার সাধিত হয়। এভাবেই দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্য কিংবদন্তীর নায়কের রূপ পরিগ্রহ করতে থাকেন।
কিংবদন্তীর বিক্রমাদিত্য চরিত্র
বৌদ্ধ ধর্ম-এ মহাযান সম্প্রদায়ের উদ্ভবের ফলে মূর্তিপূজা প্রচলিত হয়। সেই সঙ্গে ব্রাহ্মণ্য ধর্মেও বহুসংখ্যক দেবদেবীর পূজা প্রচলিত হতে থাকে। হিন্দুধর্মের নানা ক্ষেত্রে উম্মাদনা সৃষ্টির প্রেরণার মূলে ছিল দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের জীবন ও কীর্তিকলাপ। এই আবহ থেকে এবং সমুদ্র গুপ্তের জীবন ও কীর্তিকাহিনী থেকে উপকরণ সংগৃহীত হয়ে সৃষ্টি হল কিংবদন্তীর বিক্রমাদিত্য চরিত্র। সমস্ত উপকাহিনীরই নায়ক উজ্জয়িনীরাজ বিক্রমাদিত্য। এ থেকে অনুমান হয়, উপগল্পগুলো বৌদ্ধজাতকের প্রভাবেও প্রভাবিত ছিল।
বৌদ্ধধর্মের মাহাত্ম্য
জাতক কাহিনীতে বুদ্ধদেব-এর জীবনকে কেন্দ্র করে বৌদ্ধধর্মের মাহাত্ম্য প্রচারিত হয়েছিল। আর গুপ্তযুগে হিন্দুধর্মের পুনরুত্থান ঘটলে কিংবদন্তীর বিক্রমাদিত্যকে কেন্দ্র করে হিন্দু ধর্মের মাহাত্ম্য ও মর্মকথা প্রচারের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। কেননা তিনি ছিলেন প্রজাহিতৈষী, বীর এবং জনপ্রিয়।
বীর, সাহসী বিক্রমাদিত্য
বেতাল পঞ্চবিংশতি ও বত্রিশ পুতুলের গল্পগুলোতে যে বিক্রমাদিত্যকে পাওয়া যায় তিনি হলেন বীর, সাহসী, বুদ্ধিমান এবং কর্মকুশল। দেবদ্বিজে ভক্তি তাঁর অচলা। তন্ত্রসাধনায় সিদ্ধিলাভ করে তিনি বেতালসিদ্ধ হয়েছেন। শৌর্য, বীর্য, দান ও ত্যাগে তিনি ছিলেন অতুলনীয়। তাঁর চরিত্র অতিমানবীয় গুণাবলীতে মন্ডিত। ভোজরাজ বিক্রমাদিত্যের গুণের কথা স্মরণ করে নিজেকে তাঁর সিংহাসনে বসার উপযুক্ত মনে করেন নি।
রাজা বিক্রমাদিত্যের রাজসভায় নবরত্ন
দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্যের সময়েই হিন্দুধর্ম চরম উৎকর্ষ লাভ করেছিল। সেই সূত্রেই তাঁর কীর্তিবহুল জীবনের সঙ্গে অলৌকিকত্বের মিশেল ঘটেছে। কিংবদন্তীতে আরো বলা হয়েছে, বিক্রমাদিত্যের রাজসভায় নবরত্ন বিরাজ করতেন। এই নবরত্ন হলেন, মহাকবি কালিদাস, বররুচি, অমরসিংহ, ধন্বন্তরি, বরাহমিহির, বেতালভট্ট, শঙ্কু, ক্ষপণক ও ঘটখর্পর। নবরত্বের সকলেই যে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্যের রাজসভায় ছিলেন তেমন কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ পাওয়া যায় না। তবে একথা সত্য, তাঁরা সকলেই গুপ্তযুগের কোনো না কোনো সময়ে জীবিত ছিলেন। কিংবদন্তী এঁদের সকলকে বিক্রমাদিত্যের বিদ্যোৎসাহিতা ও গুণগ্রাহিতা সম্পাদনের জন্য তাঁর রাজসভার উজ্জ্বল জ্যোতিষ্করূপে একত্রিত করেছে। এবং এই কিংবদন্তীর বিক্রমাদিত্য চরিত্রের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে হিন্দুধর্মের নীতি-মাহাত্ম্য।
উপসংহার :- বিক্রমাদিত্য ভারতীয় ইতিহাসের এক অসামান্য ব্যক্তিত্ব, যার জীবন ও কাজগুলি আজও আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা জোগায়। তার ন্যায়পরায়ণ শাসন এবং সংস্কৃতির প্রতি ভালবাসা তাকে সম্রাটদের মধ্যে একটি বিশেষ স্থানে অধিষ্ঠিত করেছে। তিনি কেবল একজন যুদ্ধবিদ্যা এবং শক্তিশালী রাজা ছিলেন না, বরং একজন সংস্কৃতিকর্মী যিনি তাঁর সময়ের বিজ্ঞান, সাহিত্য ও শিল্পকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। বিক্রমাদিত্যের কাহিনী আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, সত্যিকারের নেতৃত্ব শুধু বাহুবলের মাধ্যমে নয়, বরং নৈতিকতা, প্রজ্ঞা এবং সাংস্কৃতিক পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমেও প্রমাণিত হয়। তার জীবনকথা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে স্মরণীয় হয়ে থাকবে এবং ভারতীয় সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে গণ্য হবে।
(FAQ) বিক্রমাদিত্য সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
বিক্রমাদিত্য ছিলেন প্রাচীন ভারতের একটি কিংবদন্তি সম্রাট, যিনি তার ন্যায়পরায়ণতা, প্রজ্ঞা এবং সাংস্কৃতিক পৃষ্ঠপোষকতার জন্য খ্যাত।
তিনি প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসে ১ম শতাব্দীর দিকে রাজত্ব করেছিলেন এবং তার শাসনকাল সাংস্কৃতিক ও বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্রে একটি স্বর্ণযুগ হিসেবে গণ্য হয়।
নবরত্ন হলেন বিক্রমাদিত্যের রাজসভায় থাকা নয়জন বিশিষ্ট পণ্ডিত ও কবি, যারা সাহিত্য, বিজ্ঞান, এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে বিশিষ্ট কাজ করেছিলেন।
তার ন্যায়পরায়ণ শাসন, বীরত্ব, এবং সংস্কৃতির উন্নয়নে অবদান রাখার জন্য তিনি সম্রাট হিসেবে স্মরণীয়।
বিক্রমাদিত্য ও তার রাজ্য উজ্জয়িনী নিয়ে নানা কিংবদন্তি ও কাহিনী প্রচলিত আছে, যা তার মহত্ত্ব ও নৈতিকতার প্রতীক।