সুয়েজ সংকট প্রসঙ্গে পশ্চিমি শক্তিবর্গের সঙ্গে নাসেরের বিরোধ, সুয়েজ খাল খনন, সুয়েজ খাল মিশরের কর্তৃত্ব হীন, নাসেরের আসওয়ান বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প, ঋণ সংক্রান্ত ঝামেলা, সুয়েজ খালের জাতীয়করণ ঘোষণা, সুয়েজ খাল জাতীয়করণের প্রতিক্রিয়া, লন্ডন সম্মেলন, জাতিপুঞ্জের উদ্যোগ, মিশর আক্রমণ, যুদ্ধবিরতি, সুয়েজ সংকটের প্রভাব ও সুয়েজ সংকটে ভারতের ভূমিকা সম্পর্কে জানবো।
মিশরে সুয়েজ সংকট প্রসঙ্গে সুয়েজ সংকটের সময়কাল, সুয়েজ সংকটে বিবাদমান পক্ষ, সুয়েজ খাল খনন, সুয়েজ খালের জাতীয়করণ ঘোষণা, সুয়েজ সংকটের প্রেক্ষাপটে লন্ডন সম্মেলন, সুয়েজ সংকটে জাতিপুঞ্জের উদ্যোগ, সুয়েজ সংকটে ভারতের ভূমিকা ও সুয়েজ সংকটের প্রভাব সম্পর্কে জানব।
সুয়েজ সংকট
ঐতিহাসিক ঘটনা | সুয়েজ সংকট |
সূচনাকাল | ১৯৫৬ খ্রি |
সুয়েজ খাল খনন | ১৮৫৯ খ্রি |
প্রথম জাহাজ চলাচল | ১৮৬৯ খ্রি |
জাতীয়করণ | ১৯৫৬ খ্রি |
মিশরের রাষ্ট্রপতি | নাসের |
ভূমিকা :- প্রথম বিশ্বযুদ্ধ -এর পর ব্রিটিশ সরকার মিশর-এ নিজেদের তাঁবেদার শাসক প্রতিষ্ঠা করে সেখানে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার চেষ্টা চালায়। কিন্তু ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে মিশরে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন চলতে থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-এর পরও মিশরে ব্রিটিশ আধিপত্যের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন শুরু হয়।
রাষ্ট্রপতি নাসের
১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে জেনারেল নেগুইব মিশরের শাসনক্ষমতা দখল করেন। তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করে তাঁর সহযোগী গামাল আবদেল নাসের ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে মিশরের ক্ষমতা দখল করেন। নাসের ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে মিশরের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।
পশ্চিমি শক্তিবর্গের সঙ্গে নাসেরের বিরোধ
গামাল আবদেল নাসের মিশরের ক্ষমতা দখলের পর থেকে বিভিন্ন কারণে পশ্চিমি শক্তিবর্গের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের অবনতি ঘটে। এর প্রধান প্রধান কারণগুলি হল –
- (১) ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে মিশরের সঙ্গে স্বাক্ষরিত এক চুক্তির দ্বারা ব্রিটেন মিশরের সুয়েজ খালের রক্ষণাবেক্ষণের উদ্দেশ্যে ওই অঞ্চলে ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ব্রিটিশ সেনা মোতায়েনের অধিকার পায়। ব্রিটেন এই চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধি করতে চাইলেও নাসের তাতে রাজি না হওয়ায় ব্রিটেন ক্ষুব্ধ হয়।
- (২) আফ্রিকায় অবস্থিত ফরাসি উপনিবেশ আলজিরিয়ায় ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে বিদ্রোহ শুরু হলে নাসের বিদ্রোহীদের সাহায্য করেন। এতে নাসেরের ওপর ফ্রান্স ক্ষুদ্ধ হয়।
- (৩) মধ্যপ্রাচ্যে রুশ আগ্রাসন প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে আমেরিকার নেতৃত্বে ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে বাগদাদ চুক্তি (মধ্য এশিয়া চুক্তি সংস্থা’ বা ‘সেনটো’) স্বাক্ষরিত হলে মিশর এই চুক্তি থেকে দূরে থাকে। এতে পশ্চিমি শক্তিজোট অসন্তুষ্ট হয়।
- (৪) মধ্যপ্রাচ্যে আরব জাতীয়তাবাদের বিরোধী ইজরায়েলের উত্থান নাসের মেনে নিতে পারেন নি।
- (৫) পশ্চিমি শক্তিবর্গের কাছে বারংবার আর্থিক ও সামরিক সহায়তা চেয়েও মিশর ব্যর্থ হয়। ফলে রাশিয়ার সঙ্গে মিশরের ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি পায়।
সুয়েজ খাল খনন
প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে কম সময়ে যাতায়াত ব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে মিশরের ভূখণ্ডের মধ্য দিয়ে ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে সুয়েজ খাল খনন শুরু হয়। ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে সুয়েজ খাল দিয়ে বাণিজ্যিকভাবে জাহাজ চলাচল শুরু হয় এবং ইউনিভার্সাল সুয়েজ ক্যানাল কোম্পানি এক চুক্তির ভিত্তিতে ৯৯ বছরের মেয়াদে এই খাল পরিচালনার দায়িত্ব পায়।
সুয়েজ খালে মিশরের কর্তৃত্ব নেই
মিশরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হলেও সুয়েজ খাল থেকে আদায় হওয়া অর্থের খুব সামান্য অংশ মিশর পেত। খালের নিরাপত্তার জন্য এই অঞ্চলে ব্রিটিশ সেনা মোতায়েন থাকায় সুয়েজ খাল ও তার নিকটবর্তী অঞ্চলে মিশরের কোনো কর্তৃত্ব ছিল না।
নাসেরের আসওয়ান বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প
এদিকে গামাল আবদেল নাসের মিশরের নীলনদের ওপর আসওয়ান বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ করেন। এই বাঁধ নির্মিত হলে মিশরের ৮,৬০,০০০ হেক্টর জমি আবাদযোগ্য হত এবং বিভিন্ন শিল্পক্ষেত্রে বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্ভব হত।
ঋণ সংক্রান্ত ঝামেলা
আসওয়ান বাঁধ নির্মাণের জন্য আনুমানিক ব্যয় ধরা হয় ১৪০০ মিলিয়ন ডলার। এই প্রকল্পের জন্য ইংল্যান্ড, আমেরিকা ও বিশ্বব্যাংক প্রাথমিকভাবে ৭০ মিলিয়ন ডলার ঋণ দিতে রাজি হয়। কিন্তু এক বছর দীর্ঘ আলোচনার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের পরামর্শে বিশ্বব্যাংক ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের ২০ জুলাই ঋণ-প্রস্তাব বাতিল করে দেয়।
সুয়েজ খালের জাতীয়করণ ঘোষণা
বাঁধ নিমার্ণের জন্য ঋণ-প্রস্তাব বাতিল হলে মিশরে তীব্র প্রতিক্রিয়া ও গণরোষ দেখা দেয়। এই পরিস্থিতিতে নাসের ২৬ জুলাই ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে সুয়েজ খাল ও সুয়েজ ক্যানাল কোম্পানি জাতীয়করণ করার যে কথা ঘোষণা করেন তাতে জানান যে,
- (১) সুয়েজ খাল থেকে সংগৃহীত অর্থ আসওয়ান বাঁধ নির্মাণে ব্যয় করা হবে।
- (২) কোম্পানির বিদেশি অংশীদারদের প্রচলিত বাজারদর অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে।
- (৩) আন্তর্জাতিক যোগসুত্র হিসেবে সব দেশের জাহাজ এই জলপথ ব্যবহার করতে পারবে।
সুয়েজ খাল জাতীয়করণের প্রতিক্রিয়া
মিশরের রাষ্ট্রপতি নাসের সুয়েজ খাল জাতীয়করণের কথা ঘোষণা করলে সারা বিশ্বে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। কারণ, এতে পশ্চিমি জোটের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ বিপন্ন হয়ে পড়ে। ঐতিহাসিক উইলফ্রিড ন্যাপ বলেন যে, এই জাতীয়করণের ঘোষণার ফলে পাশ্চাত্য দেশগুলির মধ্যে ভীতি, বিরোধিতা ও কর্মতৎপরতা শুরু হয়ে যায়। এক্ষেত্রে বিভিন্ন দিক গুলি হল –
(১) ব্রিটেনের ক্ষোভ
ব্রিটেন সুয়েজ খালের পথে মধ্যপ্রাচ্য থেকে কাঁচা তেল আমদানি করত। ইউনিভার্সাল সুয়েজ ক্যানাল কোম্পানির ৪৪ শতাংশ শেয়ারও ছিল ব্রিটেনের। এজন্য খাল জাতীয়করণের ফলে ব্রিটেন ক্ষুদ্ধ হয়। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী অ্যান্টনি ইডেন মিশরের রাষ্ট্রপতি নাসেরকে হিটলার ও মুসোলিনির সঙ্গে তুলনা করে বলেন যে, হিটলারের ক্ষেত্রে যখন তোষণ নীতি ফলপ্রসূ হয় নি, তখন নাসেরের ক্ষেত্রেও এই নীতির প্রয়োজন নেই। প্রাক্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিলও নাসেরের তীব্র নিন্দা করেন এবং মিশর আক্রমণ করে নাসেরকে অপসারণের কথা বলেন।
(২) ফ্রান্স ও ইজরায়েলের ক্ষোভ
নাসের ফ্রান্স-এর উপনিবেশ আলজিরিয়ার বিদ্রোহীদের সহায়তা করায় ফ্রান্স আগেই নাসেরের ওপর ক্ষুদ্র ছিল। ইজরায়েল মধ্যপ্রাচ্যে নাসেরের ক্ষমতা ধ্বংস করে সুয়েজ খাল দিয়ে তাদের জাহাজ চলাচল সুনিশ্চিত করতে চেয়েছিল। এজন্য ব্রিটেন, ফ্রান্স ও ইজরায়েল একজোট হয়ে মিশর আক্রমণের প্রস্তুতি শুরু করেছিল।
(৩) আমেরিকার লক্ষ্য
মিশরের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগ করলে মধ্যপ্রাচ্য ও তৃতীয় বিশ্বে অসন্তোষ দেখা দিতে পারে, এই আশঙ্কায় আমেরিকা মিশরের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগের বিরোধী ছিল। সুয়েজ খালকে আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণে আনাই ছিল আমেরিকার লক্ষ্য। উইলফ্রিড ন্যাপ মনে করেন যে, ফ্রান্স বা ইংল্যান্ডের মতো আমেরিকা সুয়েজ খালের ওপর ততটা নির্ভরশীল ছিল না। এজন্য তার দৃষ্টিভঙ্গি কিছুটা পৃথক ছিল।
লন্ডন সম্মেলন
- (১) সুয়েজ খাল জাতীয়করণ করার সিদ্ধান্তে যে সমস্যা দেখা দেয় তার সমাধানের উদ্দেশ্যে আমেরিকার উদ্যোগে ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের ১৬-২৩ আগস্ট লন্ডনে সুয়েজ খাল ব্যবহারকারী দেশগুলির এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। লন্ডন সম্মেলনে সুয়েজ খাল ব্যবহারকারী ২২টি দেশ যোগদান করে। মিশর যোগদানে অসম্মতি জানায়।
- (২) ব্রিটেন, ফ্রান্স-সহ ১৮টি দেশ জাতীয়করণের পরিবর্তে সুয়েজ খালের ওপর আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণের প্রস্তাব দেয়। রাশিয়া, ভারত, শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশ এই খাল জাতীয়করণের পক্ষে মত দেয় এবং এই জলপথ ব্যবহারকারী দেশগুলিকে নিয়ে একটি পরামর্শদাতা কমিটি গঠনের প্রস্তাব দেয়।
- (৩) এরপর মার্কিন পররাষ্ট্র-সচিব জন ফস্টার ডালেস সুয়েজ খাল ব্যবহারকারীদের সংস্থা গঠন করে এই সংস্থার মাধ্যমে জাহাজ চলাচল নিয়ন্ত্রণের প্রস্তাব দেন। ব্রিটেন ও ফ্রান্স এই প্রস্তাবে আপত্তি জানায়।
জাতিপুঞ্জের উদ্যোগ
মিশরের রাষ্ট্রপতি নাসের ৫ অক্টোবর ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ-এর কাছে সুয়েজ সমস্যা পেশ করেন। জাতিপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদে ব্রিটেন ও ফ্রান্স সুয়েজ খালের ওপর আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণের কথা বলে। নাসেরের আপত্তি ও সোভিয়েত রাশিয়ার ‘ভেটো’ প্রয়োগের ফলে এই প্রস্তাব বাতিল হয়ে যায়।
মিশর আক্রমণ
জাতিপুঞ্জে সুয়েজ খালের আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণের প্রস্তাব বাতিল হলে মিশরে আক্রমণ শুরু হয়। এক্ষেত্রে বিভিন্ন দিক গুলি হল –
(১) গোপন পরিকল্পনা
১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও ইজরায়েল মিশর আক্রমণের গোপন পরিকল্পনা করে। স্থির হয় যে, প্রথমে ইজরায়েল মিশরের সিনাই উপত্যকা আক্রমণ করে সুয়েজ খালের দিকে এগিয়ে যাবে। তখন ব্রিটেন ও ফ্রান্স উভয় পক্ষকে যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য একটি চরমপত্র দেবে। ইজরায়েল এই পত্রের কোনো জবাব দেবে না। তখন খাল রক্ষা বা দখল করার জন্য ব্রিটেন ও ফ্রান্স হস্তক্ষেপ করবে।
(২) আক্রমণের সূচনা
গোপন পরিকল্পনা অনুযায়ী ইজরায়েল ২৯ অক্টোবর ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে মিশর আক্রমণ করে কয়েক দিনের মধ্যেই সিনাই উপত্যকা দখল করে নেয়। আক্রমণের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই জাতিপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব উঠলে ব্রিটেন ও ফ্রান্স তাতে ‘ভেটো’ দেয়। ৩০ অক্টোবর মিশরের রাজধানী কায়রোর ওপর ব্রিটেন ও ফ্রান্সের বিমানবাহিনী বোমা বর্ষণ করে।
(৩) চরমপত্র
ব্রিটেন ও ফ্রান্স ইজরায়েলের সঙ্গে তাদের গোপন বোঝাপড়া আড়াল করার উদ্দেশ্যে মিশর ও ইজরায়েলকে চরমপত্র দেয়। এতে উভয় পক্ষকে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির নির্দেশ দেওয়া হয় এবং সুয়েজ খাল থেকে ১০ মাইল দূরে সরে যেতে বলা হয়। মিশর এই প্রস্তাব অগ্রাহ্য করে, কারণ সুয়েজ খাল মিশরের সীমানার ১০০ মাইল ভেতরে অবস্থিত।
(৪) আমেরিকার নিরপেক্ষতা
ব্রিটেন ও ফ্রান্স আমেরিকার কাছে মিশর আক্রমণের পরিকল্পনা সম্পূর্ণ গোপন করায় আমেরিকা প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়। সুয়েজ সমস্যায় আমেরিকা কোনো পক্ষ অবলম্বন না করে আরব জাতীয়তাবাদকে খুশি করতে চেয়েছিল।
(৫) যুদ্ধবিরতির আবেদন
সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সাধারণ সভা ২ নভেম্বর যুদ্ধবিরতির আবেদন জানায়।
(৬) যুদ্ধবিরতি
৫ নভেম্বর ব্রিটেন ও ফ্রান্সের প্যারাসুট বাহিনী মিশরে আক্রমণ চালায়। পরদিন ব্রিটিশ বাহিনী মাল্টা থেকে মিশরে অবতরণ করে। এরপর ব্রিটেন হঠাৎ যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব মেনে নেয়। আসলে যুদ্ধের বিরুদ্ধে তীব্র জনমত, অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ক্ষেত্রে চাপ প্রভৃতি কারণে ব্রিটেন যুদ্ধবিরতিতে বাধ্য হয়। ফ্রান্সও বাধ্য হয়ে যুদ্ধবিরতি মেনে নেয়। ২২ ডিসেম্বর ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে জাতিপুঞ্জের নির্দেশে মিশর থেকে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও ইজরায়েল তাদের সৈন্য অপসারণে বাধ্য হয়।
সুয়েজ সংকটের প্রভাব
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সুয়েজ সংকটের প্রভাব ছিল গভীর। যেমন –
(১) নাসেরের মর্যাদা বৃদ্ধি
সুয়েজ সংকটের ঘটনায় শেষপর্যন্ত আরব জাতীয়তাবাদ জয়যুক্ত হয়। নাসেরের ব্যক্তিগত মর্যাদা ও জনপ্রিয়তা যথেষ্ট পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। তিনি আরব জগতে বীরের মর্যাদা লাভ করেন। তিনি নিজেকে আরব জাতীয়তাবাদের আধুনিক সালাদিন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। মিশর ও সিরিয়া দুটি দেশ ঐক্যবদ্ধ হয়ে ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে সংযুক্ত আরব প্রজাতন্ত্র গঠিত হয়। এই প্রজাতন্ত্রের প্রথম রাষ্ট্রপতি হন নাসের। তিনি জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন-এর অন্যতম স্তম্ভে পরিণত হন।
(২) ইংল্যান্ডের আর্থিক ক্ষতি
মিশরের যুদ্ধে ব্রিটেনকে প্রচুর অর্থনৈতিক ক্ষতি স্বীকার করতে হয়। ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের শেষ তিন মাসে ব্রিটেনের অর্থব্যয়ের পরিমাণ ছিল ৪০০ মিলিয়ন ডলার। বিপুল আর্থিক ক্ষতির ফলে ব্রিটেনের অর্থনীতিতে ধস নামে। উইলফ্রিড ন্যাপ মনে করেন যে, মিশরের যুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যে ব্রিটিশ প্রাধান্যের অবসান ঘটায়।
(৩) ইডেনের মর্যাদা হ্রাস
সুয়েজ সংকটের ঘটনায় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী অ্যান্টনি ইডেনের ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি যথেষ্ট পরিমাণে নষ্ট হয়। ব্রিটেনকে অহেতুক একটি যুদ্ধে জড়িয়ে দেওয়ার জন্য ব্রিটেনে তার বিরুদ্ধে তীব্র জনমত গড়ে ওঠে। ফলে তিনি ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দের ৯ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিতে বাধ্য হন।
(৪) ফান্সের মর্যাদা হ্রাস
সুয়েজ সংকটের ফলে মধ্যপ্রাচ্যে ব্রিটেনের মতো ফ্রান্সেরও কর্তৃত্বের অবসান ঘটে। এই সূত্রে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যেই ফ্রান্সের কর্তৃত্ব ধ্বংস হয় এবং মর্যাদা ধ্বংস হয়।
(৫) মিশর ও ইজরায়েলের শত্রুতা
সুয়েজ সংকটের ফলে মিশর ও ইজরায়েলের মধ্যে শত্রুতা বৃদ্ধি পায়। পরবর্তীকালে ইজরায়েলকে কেন্দ্র করে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি জটিলতর হয়ে ওঠে।
(৬) রাশিয়ার সুবিধা
সুয়েজ সংকটের ঘটনায় সোভিয়েত রাশিয়া সবচেয়ে লাভবান হয়। এই সংকটে রাশিয়া মিশরকে সমর্থন করায় আরব দুনিয়ায় রাশিয়ার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। আসওয়ান বাঁধ নির্মাণে অর্থ সাহায্য, সামরিক সাহায্য এবং আরব জাতীয়তাবাদকে সমর্থন করে রাশিয়া মধ্যপ্রাচ্যে নিজের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করে তোলে। ফলে মধ্যপ্রাচ্যে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের কর্তৃত্বের অবসানের ফলে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছিল তা রাশিয়া সহজেই দখল করে।
(৭) মধ্যপ্রাচ্যে ঠাণ্ডা লড়াইয়ের সূত্রপাত
মধ্যপ্রাচ্যে রুশ প্রভাব প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে মার্কিন রাষ্ট্রপতি আইজেনহাওয়ার ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দের ৫ জানুয়ারি বিখ্যাত ‘আইজেনহাওয়ার নীতি’ ঘোষণা করেন। এতে বলা হয় যে, আন্তর্জাতিক সাম্যবাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত কোনো দেশ (অর্থাৎ রাশিয়া) কর্তৃক আক্রান্ত দেশকে আমেরিকা সহায়তা করবে। এই নীতি কার্যকর করার উদ্দেশ্যে আমেরিকা দু-বছরের জন্য ৪০০ থেকে ৫০০ মিলিয়ন ডলার অর্থ বরাদ্দ করে। এর ফলে মধ্যপ্রাচ্য ঠাণ্ডা লড়াই রাজনীতির আবর্তে নিক্ষিপ্ত হয়। পিটার কালডোকোরেসি-র মতে আইজেনহাওয়ার নীতি হল মধ্যপ্রাচ্যে রুশ-বিরোধী পুরোনো পরিকল্পনার নতুন ভাষ্য।
সুয়েজ সংকটে ভারতের ভূমিকা
১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের সুয়েজ সংকটের সমাধানে ভারতের ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। যেমন –
(১) খাল উন্মুক্ত রাখার প্রয়াস
ভারত সুয়েজ খাল ব্যবহারকারী একটি দেশ। তাই এই খাল উন্মুক্ত রাখার জন্য ভারত চেষ্টা চালিয়েছিল।
(২) সুয়েজ খালে মিশরের সার্বভৌমত্ব
ভারত মনে করত যে, ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দের ‘কনস্ট্যান্টিনোপল কনভেনশন’ অনুসারে সুয়েজ খাল মিশরের অবিচ্ছেদ্য অংশ। খালের ওপর মিশরের সার্বভৌমত্ব মেনে নিয়েও এমন ব্যবস্থা করা দরকার যাতে জাতিপুঞ্জের সনদ অনুসারে খাল সংক্রান্ত সব সমস্যার সমাধান করা হয়।
(৩) যোগসূত্রকারীর ভূমিকা
ভারতের তৎকালীন বিদেশমন্ত্রী কৃষ্ণমেনন ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে লন্ডন সম্মেলনে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেন। এই সম্মেলনে মিশরের কোনো প্রতিনিধি যোগদান না করায় ভারত দু-পক্ষের মধ্যে যোগসূত্রের ভূমিকা পালন করে।
(৪) মিশরের ওপর আক্রমণের নিন্দা
ভারত মিশরে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের আক্রমণের তীব্র নিন্দা করে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু একে ‘নগ্ন আক্রমণ’ বলে অভিহিত করেন।
(৫) যুদ্ধবিরতিতে ভূমিকা
মিশরে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করা এবং বিদেশি সৈন্য অপসারণের বিষয়ে আলোচনায় ভারত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
(৬) শান্তিরক্ষা বাহিনীতে যোগদান
ভারত জাতিপুঞ্জের শান্তিরক্ষাকারী বাহিনী হিসেবে মিশরে সেনা পাঠায়।
উপসংহার :- মিশরের সুয়েজ সংকটের সূত্র ধরেই মধ্যপ্রাচ্য ঠাণ্ডা লড়াই রাজনীতির আবর্তে নিক্ষিপ্ত হয়। মার্কিন রাষ্ট্রপতি আইজেনহাওয়ার ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দের ৫ জানুয়ারি বিখ্যাত ‘আইজেনহাওয়ার নীতি’ ঘোষণা করলে পরিস্থিতি জটিল হয়ে ওঠে।
(FAQ) সুয়েজ সংকট সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
গামাল আবদেল নাসের।
১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে।
১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে।
১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে।
২৬ জুলাই ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে।
১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে।