রোম-বার্লিন-টোকিও অক্ষচুক্তি প্রসঙ্গে স্পেনের গৃহযুদ্ধ, রোম-বার্লিন অক্ষচুক্তি, কমিন্টার্ন বিরোধী চুক্তি ও রোম-বার্লিন-টোকিও অক্ষচুক্তি স্বাক্ষর সম্পর্কে জানবো।
রোম-বার্লিন-টোকিও অক্ষচুক্তি
ঐতিহাসিক ঘটনা | রোম-বার্লিন-টোকিও অক্ষচুক্তি |
সময়কাল | ৬ নভেম্বর, ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দ |
দেশ | ইতালি, জার্মানি ও জাপান |
ইতালির প্রধান | মুসোলিনি |
জার্মানির প্রধান | হিটলার |
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া | দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ |
ভূমিকা:- ইতালি ও জার্মানি – দুটি একনায়কতন্ত্রী দেশ হলেও মুসোলিনি কিন্তু হিটলারের উত্থানকে ভালো চোখে দেখেন নি, এমনকী অস্ট্রিয়া দখলের প্রশ্নে মুসোলিনি হিটলারের বিরোধী ছিলেন।
পাল্টা জোট গঠন
হিটলার চাইছিলেন ইঙ্গ-ফরাসি জোটের বিপক্ষে ইতালি-জার্মানির একটি পাল্টা জোট গড়ে তুলতে। হিটলারের এই ধরনের ইচ্ছার পশ্চাতে কয়েকটি কারণ ছিল। যেমন –
(১) ভার্সাই সন্ধি
জার্মানি ও ইতালি উভয়েই ছিল ভার্সাই চুক্তি-বিরোধী। ভার্সাই চুক্তি কেবল জার্মানির উপরেই যে অন্যায় করেছিল তা নয়, ইতালিকেও নানাভাবে বঞ্চিত করেছিল। এই কারণে ইতালি ভার্সাই সন্ধি সম্পর্কে প্রবল ক্ষুব্ধ ছিল।
(২) নিঃসঙ্গতা
ভার্সাই সন্ধির পর ইঙ্গ-ফরাসি জোট জার্মানিকে কোণঠাসা করে রেখেছিল। এই নিঃসঙ্গতা থেকে মুক্তি পেতে প্রয়োজন ছিল ইতালির সঙ্গে জোট গঠন।
(৩) শত্রু ফ্রান্স
জার্মানির ঘোরতর শত্রু ফ্রান্স ছিল ইতালিরও শত্রু। সুতরাং কোনও অবস্থায় জার্মানি ফ্রান্স কর্তৃক আক্রান্ত হলে, ইতালিও ফ্রান্সকে আক্রমণ করতে পারবে। এইসব কথা চিন্তা করে হিটলার ইতালির সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনে উদ্যোগী হন।
ইতালিকে জার্মানির সাহায্য
১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে ইতালি আবিসিনিয়ার উপর আক্রমণ হানলে জাতিসঙ্ঘ ইতালির উপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এই সময় ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স দ্বিমুখী নীতি অনুসরণ করলেও জার্মানি জাতিসঙ্ঘ -এর নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ইতালির সাহায্যে এগিয়ে আসে। এর ফলে ইতালি জার্মানির প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং হিটলারের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।
স্পেনের গৃহযুদ্ধ
১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে স্পেন -এ কমিউনিস্ট প্রভাবিত প্রজাতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় এবং রাশিয়া সর্বতোভাবে এই সরকারকে সাহায্য করতে থাকে। জেনারেল ফ্রাঙ্কো এই সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং স্পেনের গৃহযুদ্ধ শুরু হলে সাম্যবাদ-বিরোধী দুই রাষ্ট্র ইতালি ও জার্মানি তাঁর পাশে দাঁড়ায়। এইভাবে দুই রাষ্ট্রের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে।
জার্মান সাহায্যের প্রতিশ্রুতি
জার্মানির সমরসজ্জা ও বিমান বাহিনীর শক্তি দেখে মুসোলিনি মুগ্ধ হন। ভূমধ্যসাগর ও আফ্রিকায় ইতালির সম্প্রসারণের ব্যাপারে জার্মান সাহায্যের প্রতিশ্রুতিও ইতালিকে খুশি করে।
রোম-বার্লিন অক্ষচুক্তি
এই পরিস্থিতিতে ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে ‘রোম-বার্লিন অক্ষচুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, মুসোলিনিই প্রথম ‘অক্ষ’ শব্দটি ব্যবহার করেন। তিনি সদর্পে ঘোষণা করেন, “বার্লিন-রোমের যোগ একটি নতুন অক্ষরেখা রচনা করল।”
কমিন্টার্ন বিরোধী চুক্তি
১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দের ২৫শে নভেম্বর জার্মানি ও জাপান ‘কমিটার্ন-বিরোধী চুক্তি স্বাক্ষর করে। এর মূলে কয়েকটি কারণ ছিল। যেমন –
(১) জাপানের জাতিসংঘ ত্যাগ
১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে জাপান মাঞ্চুরিয়া আক্রমণ করে এবং এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে জাতিসঙ্ঘের সদস্যপদও ত্যাগ করে। এর ফলে কূটনৈতিক দিক থেকে জাপান বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, যা তার নিরাপত্তার পক্ষে বাঞ্ছনীয় ছিল না।
(২) জাপানে জঙ্গীবাদ
১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে ‘কমিটার্ন’ একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে যুক্তফ্রন্ট গঠনের প্রস্তাব দেয়। এই সময় জার্মানি ও ইতালিতে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত ছিল। জাপানে গণতন্ত্রের একটি আবরণ থাকলেও সমরনায়কদের অধীনে জঙ্গিবাদই ছিল প্রধান।
কমিন্টার্ন বিরোধী চুক্তি স্বাক্ষর
এর ফলে জার্মানি ও জাপান নিজ নিজ রাষ্ট্রে গোপন কমিউনিস্ট তৎপরতার আশঙ্কা করে ১৯৩৬ সালের ২৫শে নভেম্বর কমিন্টার্ন-বিরোধী চুক্তি’-তে স্বাক্ষর করে। এই চুক্তি দ্বারা স্থির হয় যে,
- (১) উভয় পক্ষই কমিউনিজমের বিরুদ্ধে পরস্পরকে সাহায্য করবে,
- (২) কমিউনিজমের অগ্রগতি সম্পর্কে তথ্য বিনিময় করবে এবং
- (৩) কখনোই রাশিয়ার সঙ্গে কোনওরকম চুক্তিতে আবদ্ধ হবে না।
রোম-বার্লিন-টোকিও অক্ষচুক্তি
১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দের ৬ই নভেম্বর ইতালি কমিন্টার্ন-বিরোধী মিত্রজোটে যোগ দিলে ইতালি-জার্মানি-জাপান এই তিন রাষ্ট্রের জোট গড়ে ওঠে। ইতিহাসে এই জোট ‘রোম-বার্লিন-টোকিও অক্ষচুক্তি’ নামে পরিচিত। স্থির হয় যে, এই জোট চতুর্থ কোনও শক্তি কর্তৃক আক্রান্ত হলে পরস্পরকে সাহায্য করবে এবং এই চুক্তি দশ বছর স্থায়ী হবে।
উপসংহার:- এইভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে বিশ্ব দুটি মৈত্রীজোটে বিভক্ত হয়ে পড়ে – একটি হল রোম-বার্লিন-টোকিও অক্ষশক্তি এবং অপরটি হল ব্রিটেন-ফ্রান্স-সোভিয়েত ইউনিয়ন মিত্রশক্তি।
(FAQ) রোম-বার্লিন-টোকিও অক্ষচুক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
৬ নভেম্বর, ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে।
ইতালি, জার্মানি ও জাপান।
অক্টোবর, ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে ইতালি ও জার্মানির মধ্যে।
২৫ নভেম্বর, ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে জার্মানি ও জাপান।