প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর প্রতিষ্ঠিত জাতিসংঘের ব্যর্থতার কারণ হিসেবে ধারণার অভাব, ভার্সাই চুক্তির অংশ, বৃহৎ শক্তি গুলির অনুপস্থিতি, ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের প্রাধান্য, আন্তরিকতা ও ঐক্যের অভাব, সাংগঠনিক দুর্বলতা, সামরিক শক্তির অভাব, অস্ত্রের প্রতিযোগিতা, অঘোষিত যুদ্ধ, একনায়কতন্ত্রের উত্থান, ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের তোষণ নীতি, জাতিসংঘের বিলুপ্তি ও কৃতিত্ব সম্পর্কে জানবো।
জাতিসংঘের ব্যর্থতার কারণ
ঐতিহাসিক ঘটনা | জাতিসংঘের ব্যর্থতার কারণ |
প্রতিষ্ঠা | প্রথম বিশ্বযুদ্ধ -এর পর |
প্রতিষ্ঠা দিবস | ২৮ শে এপ্রিল |
প্রথম অধিবেশন | ১০ জানুয়ারি, ১৯২০ খ্রিস্টাব্দ |
প্রথম মহাসচিব | এরিক ড্রুমন্ড |
বিলুপ্তি | দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ -এর পর |
ভূমিকা:- প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিধ্বংসী হত্যাকাণ্ড ও ভয়াবহতার পর আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা বিধানের উদ্দেশ্যে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়। সূচনা-পর্বে কিছু সফলতার পর জাতিসঙ্ঘ তার উদ্দেশ্য সাধনে ব্যর্থ হয় এবং ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে কার্যত তার বিলুপ্তি ঘটে। জাতিসঙ্ঘের এই ব্যর্থতার মূলে নানা কারণ ছিল। যেমন –
(১) ধারণার অভাব
আন্তর্জাতিক শাস্তি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে লিগ প্রতিষ্ঠিত হয়, কিন্তু পৃথিবীর মুষ্টিমেয় কয়েকটি রাষ্ট্রই এর সদস্য ছিল। আন্তর্জাতিক সংগঠন নয়- এটি ছিল মূলত একটি ইউরোপীয় সংগঠন। এই সংগঠনের ভবিষ্যৎ বা ভালো-মন্দ সম্পর্কে কোনও রাষ্ট্রেরই কোনও সুস্পষ্ট ধারণা ছিল না। এই কারণে এই প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করে তোলার দিকেও কারও কোনও নজর ছিল না। এই অবস্থায় এর ব্যর্থতা ছিল স্বতঃসিদ্ধ।
(২) ভার্সাই চুক্তির অংশ
জাতিসঙ্ঘের চুক্তিপত্র-টি ভার্সাই সন্ধির অঙ্গীভূত ছিল বা তা ভার্সাই সন্ধির একটি অংশ ছিল। জার্মানি, রাশিয়া, আমেরিকা এবং বেশ কিছু দেশ ভার্সাই সন্ধিকে মানতে পারে নি। তাদের কাছে ভার্সাই সন্ধি ছিল প্রতিশোধমূলক ও অপমানজনক। এই কারণে অনেক রাষ্ট্রই জাতিসঙ্ঘকে সুনজরে দেখে নি।
(৩) বৃহৎ রাষ্ট্রগুলির অনুপস্থিতি
- (ক) পৃথিবীর বেশ কয়েকটি শক্তিশালী রাষ্ট্র লিগের বাইরে থাকায় লিগ দুর্বল হয়ে পড়ে। লিগের প্রতিষ্ঠায় আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করলেও আমেরিকা কিন্তু লিগের সদস্যপদ গ্রহণ করে নি। এতে লিগ দুর্বল হয়ে পড়ে।
- (খ) জার্মানি ও রাশিয়াকে প্রথমে লিগের সদস্যপদ দেওয়া হয় নি। পরে ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে জার্মানি এবং ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়াকে লিগের সদস্য করা হয়।
- (গ) ইতিমধ্যে আবার ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে জার্মানি ও জাপান এবং ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে ইতালি লিগের সদস্যপদ ত্যাগ করে। রাশিয়াকেও বহিষ্কার করা হয়। এর ফলে লিগ দুর্বল হয়ে পড়ে।
(৪) ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের প্রাধান্য
- (ক) আমেরিকা, রাশিয়া, ইতালি, জার্মানি, জাপান প্রভৃতি রাষ্ট্রের অনুপস্থিতিতে জাতিসঙ্ঘের কর্তৃত্ব থাকে মূলত ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স-এর হাতে এবং লিগ কার্যত ওই দুই রাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।
- (খ) এর ফলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলি কখনোই লিগকে নিজেদের সংগঠন বলে মনে করে নি। এছাড়া, ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স—এই দুই রাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থ ও পররাষ্ট্রনীতিও ছিল পৃথক ধরনের।
- (গ) জার্মানি ও জাতিসঙ্ঘ সম্পর্কে তাদের ধারণা ছিল ভিন্ন ভিন্ন। ফ্রান্সের উদ্দেশ্য ছিল জার্মানিকে দুর্বল করে রাখা। অপরদিকে, গণতান্ত্রিক ইংল্যান্ডের লক্ষ্য ছিল জার্মানির স্বাভাবিক বিকাশ।
(৫) আন্তরিকতা ও ঐক্যের অভাব
- (ক) জাতিসঙ্ঘের সাফল্যের জন্য প্রয়োজন ছিল সদস্য রাষ্ট্রগুলির আন্তরিকতা ও একতা। কার্যক্ষেত্রে কিন্তু তা দেখা যায় নি। আন্তর্জাতিক স্বার্থের খাতিরে তারা কখনোই জাতীয় স্বার্থ খর্ব করতে রাজি ছিল না।
- (খ) বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা অপেক্ষা রাষ্ট্রগুলি নিজ নিজ স্বার্থরক্ষাতেই তৎপর ছিল। অনেক রাষ্ট্র আবার লিগকে নিজ জাতীয় স্বার্থ ও ঔপনিবেশিক স্বার্থরক্ষার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিল। রাষ্ট্রগুলির স্বার্থের দ্বন্দ্ব ও অনৈক্য লিগকে দুর্বল করে দেয়।
(৬) সংগঠনিক দুর্বলতা
কয়েকটি সাধারণ বিষয় ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ সব বিষয়েই লিগ পরিষদের সিদ্ধান্ত সর্বসম্মত হওয়ার প্রয়োজন ছিল। লিগ পরিষদের কোনও সিদ্ধান্ত কোনও সদস্য রাষ্ট্রের স্বার্থহানিকর হলেই, সে তাতে আপত্তি জানিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ বানচাল করে দিত। এর ফলে লিগের কার্যকলাপ ব্যাহত হত।
(৭) সামরিক শক্তির অভাব
- (ক) লিগের কোনও নিজস্ব সেনাবাহিনী ছিল না। লিগ তার সামরিক শক্তির জন্য সদস্য রাষ্ট্রগুলির সেনাদলের উপর নির্ভরশীল ছিল। সদস্য রাষ্ট্রগুলির পক্ষে সেনা সরবরাহ করাও বাধ্যতামূলক ছিল না।
- (খ) এর ফলে লিগের সিদ্ধান্ত ভঙ্গকারী কোনও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লিগের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ সর্বদা সম্ভব ছিল না। লিপসন বলেন যে, “লিগ ছিল যেন এক অসহায় বৃদ্ধা বিধবা যার দংশন করার মতো দন্ত ছিল না।”
(৮) অস্ত্রের প্রতিযোগিতা
- (ক) বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে অস্ত্রসজ্জার প্রতিযোগিতা বন্ধ করার প্রয়োজন ছিল, কিন্তু বাস্তবে তা সম্ভব হয় নি। সবার লক্ষ্য ছিল জার্মানির অস্ত্রের পরিমাণ হ্রাস করা—নিজেদের নয়।
- (খ) ১৯৩২-১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে জেনেভা নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলনে জার্মানি অন্তত ফ্রান্সের সমপরিমাণ অস্ত্র রাখার দাবি জানালে তীব্র মতপার্থক্য দেখা দেয়। এর ফলে জার্মানি সম্মেলন ত্যাগ করে এবং লিগের সদস্যপদও ছেড়ে দেয়। বিভিন্ন রাষ্ট্র তখন অস্ত্র প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে। এর ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ত্বরান্বিত হয়।
(৯) অঘোষিত যুদ্ধ
- (ক) লিগ চুক্তিপত্রে যুদ্ধ সম্পূর্ণ বেআইনি বলে ঘোষিত হলেও সামরিক শক্তির ব্যবহারকে নিষিদ্ধ করা হয় নি। আত্মরক্ষার্থে যুদ্ধ নিষিদ্ধ ছিল না। অঘোষিত যুদ্ধ, যুদ্ধ ছিল না। যুদ্ধ ঘোষণা করে কারও বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগ করলে তবেই তা যুদ্ধ বলে ঘোষিত হত।
- (খ) অঘোষিত যুদ্ধের ক্ষেত্রে লিগের কিছু করার ছিল না। জাপানের মাঞ্চুরিয়া আক্রমণ ছিল এমনই এক অঘোষিত যুদ্ধ। এক্ষেত্রে আক্রমণকারীর বিরুদ্ধে লিগের কিছু করার ছিল না।
(১০) একনায়কতন্ত্রের উত্থান
- (ক) প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর সারা বিশ্ব জুড়ে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয় এবং মানুষের অর্থনৈতিক দুর্দশা চরমে ওঠে। এই অবস্থার সুযোগ নিয়ে জার্মানি, ইতালি, স্পেন, জাপান প্রভৃতি রাষ্ট্রে একনায়কতন্ত্রের আবির্ভাব হয়।
- (খ) এই নতুন শাসকরা সাম্রাজ্যবাদী কার্যকলাপ শুরু করলে লিগের পক্ষে তা প্রতিরোধ করা সম্ভব হয় নি। ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে জাপান মাঞ্চুরিয়া দখল করলে লিগ কোনও কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থ হয় এবং শেষ পর্যন্ত জাপান লিগের সদস্যপদ ত্যাগ করে (১৯৩৩ খ্রিঃ)।
- (গ) ইতালি কর্তৃক আবিসিনিয়া দখলকে কেন্দ্র করে ইতালিও লিগ ত্যাগ করে (১৯৩৫ খ্রিঃ)। জার্মানি ক্ৰমাগত ভার্সাই চুক্তি লঙ্ঘন করে একের পর এক বিভিন্ন দেশ জয় করতে থাকে।
(১১) ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের তোষণ নীতি
- (ক) জার্মানি, ইতালি ও জাপানের প্রতি ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের তোষণ নীতিও লিগের পতনের অন্যতম কারণ। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স শুরু থেকেই এই রাষ্ট্রগুলির প্রতি তোষণ নীতি গ্রহণ করেছিল। এর ফলে এই রাষ্ট্রগুলির মনোবল বেড়ে যায়।
- (খ) ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স যদি প্রথম থেকেই এইসব রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কঠোর মনোভাব গ্রহণ করত, তা হলে তাদের শক্তিবৃদ্ধি ঘটত না এবং তারা নিজেদের সংযত করত।
জাতিসংঘের বিলুপ্তি
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে কার্যত লিগের পতন ঘটে—যদিও ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে আনুষ্ঠানিকভাবে লিগের বিলুপ্তি ঘোষণা করা হয়।
জাতিসংঘের কৃতিত্ব
লিগ তার উদ্দেশ্যপূরণে ব্যর্থ হলেও তার কৃতিত্বকে অস্বীকার করা যায় না। যেমন –
- (১) প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর যুদ্ধবিধ্বস্ত ও রণক্লান্ত পৃথিবীতে শান্তিপূর্ণভাবে আন্তর্জাতিক বিবাদ-বিসম্বাদের মীমাংসা ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় লিগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। সর্বক্ষেত্রে সফল না হলেও তার ভূমিকাকে অস্বীকার করা যায় না।
- (২) বিশ্বের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও আর্থিক উন্নয়নেও লিগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে।
- (৩) জনস্বাস্থ্য, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, শ্রমিকদের কল্যাণসাধন, দাসপ্রথার উচ্ছেদ, দরিদ্র জনসাধারণের আর্থিক উন্নয়ন, শিক্ষা-সংস্কৃতির উন্নয়ন প্রভৃতি কাজে লিগের ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়।
উপসংহার:- সবশেষে বলা যায় যে, জাতিসংঘ বা লিগই প্রথম আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও সম্প্রীতির ধারণাটিকে জনপ্রিয় করে তোলে। এটিই তার শ্রেষ্ঠ অবদান। এই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রতিষ্ঠিত হয় সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ।
(FAQ) জাতিসংঘের ব্যর্থতার কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ২৮ এপ্রিল।
২৮ এপ্রিল।
১০ জানুয়ারি, ১৯২০ খ্রিস্টাব্দ।
স্যার এরিক ড্রুমন্ড।
১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দ।