ধর্মপালের রাজ্য জয়

ধর্মপালের রাজ্য জয় প্রসঙ্গে ত্রিশক্তি দ্বন্দ্বের সূত্রপাত, কনৌজ অধিকারের চেষ্টা, ধর্মপাল-বৎসরাজ-ধ্রুব সম্পর্ক, রাজ্য বিস্তার, কনৌজের দরবার, ভাগ্য বিপর্যয় ও লুপ্ত ক্ষমতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা সম্পর্কে জানবো।

ধর্মপালের রাজ্য জয়

ঐতিহাসিক ঘটনাধর্মপালের রাজ্য জয়
রাজাধর্মপাল
রাজত্ব৭৭৫-৮১২ খ্রি:
সাম্রাজ্যপাল সাম্রাজ্য
রাজধানীমগধ
প্রতিষ্ঠাতাগোপাল
শ্রেষ্ঠ রাজাদেবপাল
ধর্মপালের রাজ্য জয়

ভূমিকা :- গোপালের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র ধর্মপাল বাংলার সিংহাসনে বসেন। পাল বংশের আঞ্চলিক রাজ্যকে এক সর্বভারতীয় সাম্রাজ্যে তিনি পরিণত করেন। প্রাচীন যুগের বাংলায় যে সকল রাজার নাম পাওয়া যায় তাঁদের মধ্যে ধর্মপাল শ্রেষ্ঠত্বের দাবী করতে পারেন।

ত্রিশক্তি দ্বন্দ্বের সূত্রপাত

ধর্মপালের সিংহাসনে বসার সময় উত্তর ভারত -এ রাজনৈতিক আধিপত্য নিয়ে ত্রিশক্তি সংগ্রাম আরম্ভ হয়। এই ত্রিশক্তির মধ্যে বাংলার পাল শক্তি ছিল অন্যতম।

কনৌজ অধিকারের চেষ্টা

মালব বা রাজপুতানা থেকে প্রতিহার শক্তি পূর্ব দিকে রাজ্য বিস্তার করে কনৌজ অধিকার করার চেষ্টা করে। পূর্ব ভারত বা মগধ থেকে ধর্মপাল প্রতিহার শক্তিকে দমিয়ে কনৌজ নিজ অধিকারে রাখার চেষ্টা করেন।

ত্রিশক্তি দ্বন্দ্বের বৈশিষ্ট্য

  • (১) ত্রিশক্তি দ্বন্দ্বের বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে, তিনটি শক্তিই ছিল প্রান্তিক বা প্রান্তসীমার; তিনটি শক্তির লক্ষ্য ছিল মধ্যদেশ বা উত্তরপ্রদেশ বিশেষত কনৌজ অধিকার করা। কারণ, অষ্টম ও নবম খ্রিস্টাব্দে হর্ষবর্ধন -এর রাজধানী কনৌজকেই ভারতের প্রধান শাসনকেন্দ্র মনে করা হত।
  • (২) “পশ্চিম এশিয়ার যোদ্ধা জাতিগুলির নিকট যেমন ছিল ব্যাবিলন, টিউটন জাতীয় বর্বরদের কাছে যেমন ছিল রোম আকর্ষণের বস্তু, সেরূপ অষ্টম, নবম শতকের রাজবংশগুলির কাছে কনৌজ বা মহোদয় শ্রীর ওপর অধিকার ছিল মর্যাদা ও সার্বভৌমত্ব লাভের মানদণ্ড।”

ত্রিকোণ দ্বন্দ্বে পরিণত

পাল-প্রতিহার শক্তি যদিও উত্তর ভারতে অবস্থিত ছিল রাষ্ট্রকূট শক্তি ছিল দক্ষিণ ভারতের। উত্তর ভারতে কনৌজের আধিপত্য নিয়ে পূর্বাঞ্চলের পাল ও পশ্চিম অঞ্চলের প্রতিহারের পক্ষে প্রতিদ্বন্দ্বিতা স্বাভাবিক হলেও, দক্ষিণ থেকে রাষ্ট্রকূট তাতে যোগ দিয়ে এই দ্বন্দ্বকে ত্রিকোণ দ্বন্দ্বে পরিণত করে।

রাষ্ট্রকূট শক্তির সন্দেহ

সম্ভবত রাষ্ট্রকূট শক্তি মনে করত যে, উত্তর ভারতে পাল বা প্রতিহার যে কোনো একক শক্তির প্রাধান্য স্থাপিত হলে তারা পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে রাষ্ট্রকূটকে আক্রমণ করবে। এই কথা ভেবে রাষ্ট্রকুটরা pre-emptive attack বা প্রতিরোধমূলক আক্রমণ চালায়।

ধর্মপাল-বৎসরাজ-ধ্রুব

  • (১) ধর্মপাল মগধ জয় করে, দোয়াবের এলাহাবাদ বা প্রয়াগ পর্যন্ত গঙ্গার উপকূল ধরে অধিকার বিস্তার করলে, বৎসরাজ প্রতিহার তাঁকে বাধা দিতে দোয়াবে এগিয়ে আসেন। দোয়াবের যুদ্ধে ধর্মপাল পরাস্ত হন।
  • (২) কিন্তু বৎসরাজ তাঁর বিজয় স্থায়ী করার আগেই দক্ষিণের রাষ্ট্রকূট রাজা ধ্রুব, বৎসরাজকে পরাস্ত করে রাজপুতানার মরু অঞ্চলে বিতাড়িত করেন। ধ্রুব এর পর ধর্মপালকে পরাস্ত করার জন্য এগিয়ে এলে, ধর্মপাল তাকে বাধা দেন।
  • (৩) রাষ্ট্রকূট বল্লমধারী পদাতিক ধর্মপালকে পরাস্ত করলেও, এই জয় স্থায়ী হয়নি। ধ্রুব দক্ষিণে নিজ রাজ্য হতে বেশীদিন দূরে থাকতে না পেরে দক্ষিণে ফিরে যান। এই শক্তিশূন্যতার সুযোগে ধর্মপাল তার হৃতশক্তি পুনঃ-প্রতিষ্ঠা করেন।

ধর্মপালের রাজ্য বিস্তার

খলিমপুর তাম্রলিপি, মুঙ্গের লিপি প্রভৃতি থেকে জানা যায় যে, রাষ্ট্রকূট ও প্রতিহার উভয় শক্তির সামরিক দুর্বলতার সুযোগে ধর্মপাল উত্তর ভারতের বহু স্থান অধিকার করেন। নারায়ণ পালের ভাগলপুর তাম্রলিপি থেকে জানা যায় যে, ধর্মপাল কনৌজের সিংহাসন থেকে ইন্দ্রায়ুধকে বিতাড়িত করে চক্রায়ুধকে নিজের হাতের পুতুল হিসেবে বসান। ধর্মপালের সামন্ত রাজা হিসেবে চক্রায়ুধ রাজত্ব করতে থাকেন। ধর্মপাল দূরবর্তী অঞ্চলে অধীনস্থ সামন্তের দ্বারা শাসনের নীতি গ্রহণ করেন।

ধর্মপালের উদ্দ্যোগে কনৌজের দরবার

পাল রাজা ধর্মপাল উত্তর ভারতের নানা অঞ্চল জয় করে কনৌজে যে দরবারের অনুষ্ঠান করেন তাতে উত্তর ভারতের নানা অঞ্চলের রাজারা উপস্থিত হয়ে তাঁর প্রতি বশ্যতা জানান বলে খলিমপুর লিপিতে বলা হয়েছে। এই রাজাদের মধ্যে ছিলেন –

  • (১) ভোজ (বেরার);
  • (২) মৎস (জয়পুর ও আলওয়ার);
  • (৩) মদ্র (মধ্য পাঞ্জাব);
  • (৪) কুরু (পূর্ব পাঞ্জাব, থানেশ্বর);
  • (৫) যদু (পাঞ্জাব);
  • (৬) যবন (উত্তর পূর্ব ভারত অথবা সিন্ধুর মুসলিম রাজ্য);
  • (৭) অবন্তী (রাজপুতানা);
  • (৮) গান্ধার (পশ্চিম পাঞ্জাব) ইত্যাদি।

ডঃ মোমিন চৌধুরীর অভিমত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডঃ আব্দুল মোমিন চৌধুরীর মতে, খলিমপুর লিপিতে সামন্ত রাজাদের ওপর ধর্মপালের আধিপত্য স্থাপন সম্পর্কে অতিশয়োক্তি আছে। ধর্মপালের পক্ষে এত বড় রাজ্য জয় করা সম্ভব ছিল না বলে তিনি বলেছেন। কিন্তু মুঙ্গের লিপি ও গুজরাটী কবি সোঢঢলের উদয়সুন্দরী কথা কাব্যে খলিমপুর লিপির বিবরণ সমর্থিত হয়।

ডঃ মজুমদারের অভিমত

  • (১) ডঃ মজুমদারের মতে, ধর্মপাল সমগ্র সাম্রাজ্যে প্রত্যক্ষ শাসন করতেন না। বাংলা ও বিহার ছিল তাঁর প্রত্যক্ষ শাসনে। বাংলা-বিহার ছিল তাঁর সাম্রাজ্যের হৃৎপিণ্ড। কনৌজ তাঁর প্রত্যক্ষ শাসনে না হলেও তার বিশেষ এক্তিয়ারে ছিল।
  • (২) তার বাইরে পাঞ্জাব পর্যন্ত ও মালব-রাজপুতানা পর্যন্ত তার সামন্ত রাজ্য ছিল। এই সামন্ত রাজারা তাঁর প্রতি আনুগত্য জানাতেন। ডঃ মজুমদারের মতে, খলিমপুর লিপি একটি সমকালীন উপাদান। এই লিপির সাক্ষ্যকে অবিশ্বাস করার কারণ নেই।

ধর্মপালের ভাগ্য বিপর্যয়

ধর্মপালের রাজত্বের শেষ দিকে তাঁকে পুনরায় ত্রিশক্তি দ্বন্দ্বে ভাগ্য বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হয়। বৎসরাজের পুত্র নাগভট্ট প্রতিহার সিন্ধু, বিদর্ভ, অন্ধ্র প্রভৃতি রাজ্যের সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করে ধর্মপালকে মিত্রহীন করেন। তারপর তিনি কনৌজ আক্রমণ করে ধর্মপালের সামন্ত ও প্রতিনিধি চক্রায়ুধকে বিতাড়িত করেন।

তৃতীয় গোবিন্দের কাছে ধর্মপালের সাহায্য প্রার্থনা

এই অবস্থায় সম্ভবত ধর্মপাল রাষ্ট্রকুট রাজ তৃতীয় গোবিন্দের সাহায্য চান। গোবিন্দ ‘রাষ্ট্রকূটাত্মজা” অর্থাৎ রাষ্ট্রকূট রাজকন্যা রন্নাদেবী ছিলেন ধর্মপালের পত্নী।

প্রতিহারদের কাছে ধর্মপালের পরাজয়

রাষ্ট্রকূট হস্তক্ষেপের আগেই ধর্মপাল কনৌজ পুনরুদ্ধারের জন্য এগিয়ে যান। প্রতিহার রাজাদের গোয়ালিয়র লিপি থেকে জানা যায় যে, এই যুদ্ধে ধর্মপাল পরাস্ত হন। যুদ্ধটি সম্ভবত মুঙ্গেরে অনুষ্ঠিত হয়। পাল লিপিতে এই যুদ্ধের কোনো উল্লেখ নেই।

রাষ্ট্রকূটদের কাছে ধর্মপালের বশ্যতা স্বীকার

ইতিমধ্যে রাষ্ট্রকূট শক্তি দক্ষিণ থেকে আক্রমণ চালায়। রাষ্ট্রকূট শক্তি প্রতিহারদের হাত থেকে বিজয়লক্ষ্মীকে ছিনিয়ে নেয়। রাষ্ট্রকুট তৃতীয় গোবিন্দ, নাগভট্ট প্রতিহারকে পরাস্ত করেন। বাঁশ গাছ যেমন ঝড়ের সময় নুয়ে পড়ে, পরে সোজা হয়ে যায়, ধর্মপাল রাষ্ট্রকূট তৃতীয় গোবিন্দের কাছে সেইরূপ “বেতসীবৃত্তি” দেখান। তিনি স্বেচ্ছায় রাষ্ট্রকূট তৃতীয় গোবিন্দের কাছে বশ্যতা জানান।

ধর্মপালের লুপ্ত ক্ষমতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা

ডঃ মজুমদারের মতে, রাষ্ট্রকূট তৃতীয় গোবিন্দ দক্ষিণে ফিরে গেলে, উত্তরে যে শক্তিশূন্যতা দেখা দেয় তার সুযোগে ধর্মপাল তাঁর লুপ্ত ক্ষমতা পুনঃ-প্রতিষ্ঠা করেন। সম্ভবতঃ তাঁর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাকে আর কোনো বিপদের সম্মুখীন হতে হয়নি।

উপসংহার :- ধর্মপাল বাংলার একটি প্রাদেশিক রাজ্যকে এক উত্তর ভারতীয় সাম্রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত করেন। ডঃ মজুমদারের মতে, “ধর্মপালের রাজত্বকে বাঙালী জীবনের সুপ্রভাত” বলা চলে।

(FAQ) ধর্মপালের রাজ্য জয় সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. পাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন কে?

গোপাল।

২. গোপালের পর কে সিংহাসনে আরোহণ করেন?

ধর্মপাল।

৩. বিক্রমশীলাবিহার কে স্থাপন করেন?

ধর্মপাল।

৪. কে কাকে উত্তরাপথস্বামীন বলে অভিহিত করেছেন?

গুজরাটি কবি সোঢঢল, ধর্মপালকে।

৫। ধর্মপাল কোন ধর্মের অনুরাগী ছিলেন?

বৌদ্ধ ধর্ম

Leave a Comment