১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে সম্পাদিত বার্লিন চুক্তির সমালোচনা প্রসঙ্গে রাশিয়ার অগ্ৰগতি প্রতিহত, ডিসরেলির ঘোষণা, বহু সমস্যার বীজ নিহিত, তুরস্কের খণ্ডীকরণ, বলকান জাতীয়তাবাদ উপেক্ষিত, বুলগার জাতীয়তাবাদের কন্ঠরোধ, বার্লিন সম্মেলনের সিদ্ধান্ত ভ্রান্ত, জটিলতর সমস্যার সৃষ্টি, রাশিয়ার ক্ষোভ, তুরস্ক-জার্মান মৈত্রী, অস্ট্রো-জার্মান মৈত্রী, ফ্রাঙ্কো-রাশিয়া মৈত্রী, চারটি নতুন আন্তর্জাতিক প্রতিয়ন্দ্বিতার সূচনা ও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনা সম্পর্কে জানবো।
বার্লিন চুক্তির সমালোচনা
ঐতিহাসিক ঘটনা | বার্লিন চুক্তির সমালোচনা |
সময়কাল | জুলাই, ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দ |
স্থান | জার্মানির বার্লিন |
উদ্যোক্তা | বিসমার্ক |
স্বাক্ষরকারী দেশ | রাশিয়া, তুরস্ক, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, ইতালি ও জার্মানি |
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া | প্রথম বিশ্বযুদ্ধ |
ভূমিকা:- ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে জার্মানির চ্যান্সেলর বিসমার্কের উদ্যোগে জার্মানির বার্লিন শহরে বার্লিন চুক্তি বা বার্লিন সন্ধি স্বাক্ষরিত হয়।
বার্লিন চুক্তির সমালোচনা
নানাভাবে বার্লিন চুক্তির সমালোচনা করা হয়। যেমন –
(১) রাশিয়ার অগ্ৰগতি প্রতিহত
বার্লিন সন্ধি রুশ-তুর্কি যুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে ইউরোপ-এ শাস্তি প্রতিষ্ঠা করে। তুর্কি সাম্রাজ্য-এর অখণ্ডতার নীতি গৃহীত হয় এবং বলকান অঞ্চলে রাশিয়ার অগ্রগতি প্রতিহত হয়।
(২) ডিসরেলির ঘোষণা
ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ডিসরেলি বার্লিন কংগ্রেস থেকে ফিরে সদম্ভে ঘোষণা করেন যে, “আমি সম্মানের সঙ্গে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছি”। তিনি বলেন যে, ইরোপে তুরস্ক তার অস্তিত্ব বজায় রেখেছে”।
(৩) বহু সমস্যার বীজ নিহিত
ডিসরেলির এই দাবি সম্পূর্ণ যথার্থ নয় – বরং বলা যায় যে, বার্লিন সন্ধির দ্বারা পূর্বাঞ্চল সমস্যার কোনও সমাধান হয় নি, উপরন্তু সমস্যা জটিলতর হয়ে ওঠে। এই সন্ধিতে পরবর্তীকালের বহু সমস্যার বীজ নিহিত ছিল।
(৪) তুরস্কের খণ্ডীকরণ
- (ক) বার্লিন সন্ধির দ্বারা কোনওভাবেই তুরস্কের অখণ্ডতা রক্ষিত হয় নি। এই সন্ধির ফলে তুরস্ক প্রায় ৫ লক্ষ অধিবাসী-সহ ৬০ হাজার বর্গমাইল এলাকা ফিরে পেলেও, এর দ্বারাই তার সাম্রাজ্যের প্রায় অর্ধাংশ হাতছাড়া হয়।
- (খ) সাম্রাজ্যের কিছু অংশ স্বাধীন হয় এবং কিছু অংশ ইংল্যান্ড, অস্ট্রিয়া বা রাশিয়া দখল করে। তুরস্ক সাম্রাজ্যের অখণ্ডতা রক্ষার নামে নিজ নিজ স্বার্থ চরিতার্থ করাই ছিল বৃহৎ শক্তিগুলির উদ্দেশ্য। এর ফলে তুরস্ক দুর্বলতর হয়ে পড়ে।
- (গ) তাই বলা হয় যে, ডিসরেলি তুরস্ক সাম্রাজ্যকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে পারেন নি বরং তার ধ্বংসকে বিলম্বিত করে তার যন্ত্রণা বর্ধিত করেছিলেন মাত্র।
(৫) বলকান জাতীয়তাবাদ উপেক্ষিত
এই চুক্তির দ্বারা বলকান জাতীয়তাবাদ চরমভাবে উপেক্ষিত হয় এবং অতৃপ্ত জাতীয়তাবাদী আশা-আকাঙ্ক্ষা জটিলতর সমস্যার সৃষ্টি করে।
(৬) বুলগার জাতীয়তাবাদের কন্ঠরোধ
বুলগেরিয়াকে তিনভাগে ভাগ করে বুলগার জাতীয়তাবাদের কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা করা হয়। ম্যাসিডোনিয়াকে তুরস্কের হাতে তুলে দেওয়া হয়।
(৭) বার্লিন সম্মেলনের সিদ্ধান্ত ভ্রান্ত
বৃহৎ বুলগেরিয়ার অপর দুই অংশ বুলগেরিয়া ও রুমেলিয়া ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে মাত্র সাত বছরের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রমাণ করে যে, বার্লিন সম্মেলনের সিদ্ধান্ত ভ্রান্ত।
(৮) জটিলতর সমস্যার সৃষ্টি
স্লাভ জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা পদানত করে বসনিয়া ও হারজেগোভিনাকে অস্ট্রিয়ার হাতে তুলে দেওয়া হয়। রুমানিয়-অধ্যুষিত বেসারাবিয়া রাশিয়াকে দেওয়া হলে রুমানিয়া ক্ষুব্ধ হয় (ঘ) ইংল্যান্ডকে সাইপ্রাস দেওয়া হয়। এইসব অতৃপ্ত জাতীয়তাবাদী আশা-আকাঙ্ক্ষা বলকানে জটিলতর সমস্যার সৃষ্টি করে।
(৯) রাশিয়ার ক্ষোভ
এই সন্ধির দ্বারা স্যানস্টিফানোর সন্ধি একেবারে পরিবর্তিত হয় এবং রাশিয়ার মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হয়। দার্দানালিস প্রণালীতে রুশ যুদ্ধ জাহাজের প্রবেশ নিষিদ্ধ হওয়ায় কৃষ্ণসাগরের পথে ভূমধ্যসাগরের সঙ্গে রাশিয়ার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়। এর ফলে রুশ ‘উষ্ণ জলনীতি’ ব্যাহত হয় এবং রাশিয়া বার্লিন সন্ধি ভেঙে ফেলতে সচেষ্ট হয়।
(১০) তুরস্ক-জার্মান মৈত্রী
ইংল্যান্ড মুখে তুরস্ক সাম্রাজ্যের অখণ্ডতা রক্ষার নীতি ঘোষণা করেও সাইপ্রাস দখল করে। এর ফলে ইংল্যান্ডের প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কে তুরস্ক সন্দিহান হয়ে ওঠে এবং জার্মানির সঙ্গে মিত্রতা স্থাপনে তৎপর হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি ও তুরস্ক মৈত্রীবদ্ধ ছিল।
(১১) অস্ট্রো-জার্মান মৈত্রী
রাশিয়ার ধারণা হয় যে, ‘সাধু দালাল’ বিসমার্ক অস্ট্রিয়ার প্রতি পক্ষপাতমূলক আচরণ করেছেন। এজন্য রাশিয়া জার্মান নেতৃত্বাধীন ‘তিন সম্রাটের চুক্তি‘ থেকে সরে যায়। এর ফলে বিসমার্কের বৈদেশিক নীতিতে পরিবর্তন ঘটে। তিনি প্রথমে অস্ট্রিয়ার সঙ্গে দ্বি-শক্তি চুক্তি স্বাক্ষর করেন এবং পরে ইতালিকে নিয়ে ত্রিশক্তি মৈত্রী সম্পাদন করেন।
(১২) ফ্রাঙ্কো-রাশিয়া মৈত্রী
রাশিয়া জার্মান নেতৃত্বাধীন ‘তিন সম্রাটের চুক্তি’ থেকে আসে এবং ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়া ও ফ্রান্স চুক্তিবদ্ধ হয়। এইভাবে ইউরোপে দুটি পৃথক শক্তিজোটের সূচনা হয়, যা পরবর্তীকালের বিশ্ব-রাজনীতিকে নানাভাবে প্রভাবিত করে।
(১৩) চারটি নতুন আন্তর্জাতিক প্রতিয়ন্দ্বিতার সূচনা
অধ্যাপক এ. জে. পি. টেলর বলেন যে, বার্লিন চুক্তির ফলে ইউরোপে চারটি নতুন আন্তর্জাতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার সৃষ্টি হয় – অস্ট্রো-রুশ, অস্ট্রো-সার্ব, অস্ট্রো-বুলগেরিয় এবং সার্বো-বুলগেরিয়।
(ক) অস্ট্রো-রুশ প্রতিদ্বন্দ্বিতা
বলকানে রুশ আগ্রাসন প্রতিহত করতে গিয়ে সেখানে অস্ট্রিয়ার আধিপত্যের দ্বার উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। এর ফলে অস্ট্রো-রুশ প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখা দেয়।
(খ) অস্ট্রো-সার্ব দ্বন্দ্ব
অস্ট্রিয়া সাব জাতি অধ্যুষিত বসনিয়া ও হারজেগোভিনা দখল করায় অস্ট্রো-সাব দ্বন্দ্ব শুরু হয়।
(গ) অস্ট্রো-বুলগেরিয় দ্বন্দ্ব
অস্ট্রিয়ার স্বার্থেই বৃহৎ বুলগেরিয়াকে ত্রিধা-বিভক্ত করা হয়। এর ফলে জন্ম নেয় অস্ট্রো-বুলগেরিয় দ্বন্দ্ব।
(ঘ) সার্বো-বুলগেরিয় দ্বন্দ্ব
পরবর্তীকালে বুলগেরিয়ার শক্তিবৃদ্ধিতে সার্বিয়া ঈর্ষান্বিত হলে সার্বো-বুলগেরিয় দ্বন্দ্ব দেখা দেয়।
(১৪) প্রথম বিশ্বযুদ্ধ
সুতরাং বার্লিন চুক্তি বলকান অঞ্চলে কোনও শাস্তির পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে নি, বরং এইসব প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকেই শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ।
উপসংহার:- অধ্যাপক এ জে পি টেলর বলেন, “বার্লিন কংগ্রেস ইউরোপের ইতিহাসে এক জলবিভাজিকা। এর সামনে রয়েছে তিরিশ বছরের দ্বন্দ্ব এবং পিছনে রয়েছে চৌত্রিশ বছরের শান্তি।” অধ্যাপক ডেভিড টমসন বলেন, “এই চুক্তি প্রতিটি দেশকেই পূর্বাপেক্ষা অধিকতর অসন্তুষ্ট ও উদগ্রীব করে তোলে।”
(FAQ) বার্লিন চুক্তির সমালোচনা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
১৬ জুন, ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে জার্মানির বার্লিন শহরে।
জার্মানির চ্যান্সেলর বিসমার্ক।
জুলাই ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে।
রাশিয়া, তুরস্ক, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া, ইতালি ও জার্মানি।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ।