পূর্বাঞ্চল সমস্যার কারণ

পূর্বাঞ্চল সমস্যার কারণ প্রসঙ্গে তুরস্ক সাম্রাজ্যের দুর্বলতা হিসেবে যুগোপযোগী সংস্কারের অভাব, অযোগ্য ও অকর্মণ্য শাসক, ইউরোপের রুগ্ন মানুষ, বলকান জাতীয়তাবাদ হিসেবে জাতিগোষ্ঠী, শাসকবর্গ, স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগ, জাতীয়তাবাদী বিক্ষোভের সঞ্চার, লিপসনের মন্তব্য, রাশিয়ার অগ্ৰসর নীতি হিসেবে জলপথের অভাব, বাল্টিক সাগর, উষ্ণজল নীতি, তুরস্কের দিকে সম্প্রসারণ নীতি, রুশ-তুরস্ক সম্পর্কে তিক্ততা এবং ইংল্যান্ড ফ্রান্স ও অস্ট্রিয়ার স্বার্থ সম্পর্কে জানবো।

পূর্বাঞ্চল সমস্যার কারণ

ঐতিহাসিক ঘটনাপূর্বাঞ্চল সমস্যার কারণ
সার্বিয়ার যুদ্ধ১৮০৪-১৮১৪ খ্রিস্টাব্দ
গ্ৰিসের স্বাধীনতা যুদ্ধ১৮২১-১৮৩২ খ্রিস্টাব্দ
ক্রিমিয়ার যুদ্ধ১৮৫৪-১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দ
বলকান যুদ্ধ১৯১২-১৯১৩ খ্রিস্টাব্দ
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ১৯১৪-১৯১৮ খ্রিস্টাব্দ
পূর্বাঞ্চল সমস্যার কারণ

ভূমিকা:- অষ্টাদশ শতক থেকে শুরু করে বিশ শতকের সূচনায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূত্রপাত পর্যন্ত যে সব সমস্যা ইউরোপীয় রাজনীতিকদের ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিল, তার মধ্যে ‘পূর্বাঞ্চল সমস্যা‘ বা ‘প্রাচ্য সমস্যা’-ই হল জটিলতম।

বিভিন্ন যুদ্ধ

এই সমস্যাকে কেন্দ্র করেই সংঘটিত হয়েছে সার্বিয়ার যুদ্ধ (১৮০৪-১৮১৪ খ্রিঃ), গ্রিসের স্বাধীনতা যুদ্ধ (১৮২১-১৮৩২ খ্রিঃ), ক্রিমিয়ার যুদ্ধ (১৮৫৪-১৮৫৬ খ্রিঃ), রুশ-তুর্কি যুদ্ধ (১৮৭৭-১৮৭৮ খ্রিঃ), বলকান যুদ্ধ (১৯১২-১৯১৩ খ্রিঃ) এবং শেষ পর্যন্ত প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪ খ্রিঃ)।

পূর্বাঞ্চল সমস্যার কারণ

‘পূর্বাঞ্চল সমস্যা’-র মূলে চারটি কারণ বিদ্যমান। যথা –

  • (ক) তুরস্ক সাম্রাজ্যের ক্রমাবনতি,
  • (খ) বলকান অঞ্চলে বসবাসকারী জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ বিভিন্ন খ্রিস্টান জাতিগোষ্ঠীর মুক্তিলাভের আকাঙ্ক্ষা,
  • (গ) তুরস্কের দুর্বলতার সুযোগে বলকান অঞ্চলে রাশিয়ার দ্রুত অগ্রগতি এবং
  • (ঘ) রুশ সম্প্রসারণ রোধে ইংল্যান্ড, ফ্রান্সঅস্ট্রিয়ার প্রয়াস।

তুরস্ক সাম্রাজ্যের দুর্বলতা

একদা এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপ-এর বিস্তীর্ণ অংশে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করলেও অষ্টাদশ শতক থেকে নানা কারণে তুর্কি সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়ে। যেমন –

(১) যুগোপযোগী সংস্কারের অভাব

যুগোপযোগী সংস্কারের অভাবে মধ্যযুগীয় মোল্লাতন্ত্র-শাসিত তুরস্ক সামাজিক, অর্থনৈতিক, সামরিক ও প্রশাসনিক – সব দিক থেকেই ইউরোপের অন্যান্য দেশ অপেক্ষা পিছিয়ে পড়ে।

(২) অযোগ্য ও অকর্মণ্য শাসক

তুর্কি শাসকরা ছিলেন স্বেচ্ছাচারী, দুর্বল, অকর্মণ্য, ব্যভিচারী ও সংস্কারবিমুখ। প্রজাবর্গের মঙ্গলসাধন বা তুরস্কে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি প্রবর্তনের কোনও আগ্রহ তাঁদের ছিল না। আধুনিক সংস্কারের দ্বারা সামরিক বাহিনীকে শক্তিশালী করে তোলার দিকেও তাঁরা কোনও নজর দেন নি।

(৩) ইউরোপের রুগ্ন মানুষ

আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত ইউরোপীয় প্রতিবেশীদের পাশে তুরস্ক দুর্বল ও নিষ্প্রভরূপে প্রতিভাত হয়। অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমন বা বহিঃশত্রুর আক্রমণ রোধের কোনও ক্ষমতাই তুরস্কের ছিল না। এজন্য তুরস্ককে ব্যঙ্গ করে বলা হত ‘ইউরোপের রুগ্ন মানুষ’।

বলকান জাতীয়তাবাদ

পূর্বাঞ্চল সমস্যার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল বলকান জাতীয়তাবাদ। যেমন –

(১) জাতিগোষ্ঠী

তুর্কি সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত বলকান অঞ্চলে গ্রিক, মিশরীয়, সার্ব, বুলগেরিয়, রুমানিয়, আলবেনিয় প্রভৃতি বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষ বসবাস করত। ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি কোনও দিক থেকেই তাদের মধ্যে মিল ছিল না। তারা ইউরোপীয়, খ্রিস্টান এবং শ্বেতকায় হলেও তাদের মধ্যে নানা দ্বন্দ্ব ছিল।

(২) শাসকবর্গ

শাসক তুর্কিরা ছিল এশিয়াবাসী, ইসলাম ধর্মাবলম্বী ও কৃষ্ণবর্ণের। শাসক ও শাসিতের সম্পর্ক ছিল তিক্ত। সামরিক বল-নির্ভর তুর্কি শাসকেরা এই অঞ্চলে সংঘটিত যে কোনও বিদ্রোহ দমননীতির মাধ্যমে স্তব্ধ করে দিতেন।

(৩) স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগ

তুর্কি সাম্রাজ্যের দুর্বলতার সুযোগে এই অঞ্চলে বসবাসকারী বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী তুরস্কের অধীনতাপাশ ছিন্ন করে নিজ নিজ স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগী হয়। ফরাসি বিপ্লব -এর জাতীয়তাবাদী ভাবধারা তাদের প্রভাবিত করে।

(৪) জাতীয়তাবাদী বিক্ষোভের সঞ্চার

ইউরোপের অন্যান্য অঞ্চলে বসবাসকারী স্ব স্ব জাতিগোষ্ঠী-অধ্যুষিত রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে তাদের সম্পর্ক স্থাপিত হয়। ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে গ্রিস স্বাধীনতা লাভ করে। ১৮৪১ খ্রিস্টাব্দে মিশর স্বাধীনতা ঘোষণা করে। রুমানিয়া, ক্রিট, বুলগেরিয়া, বসনিয়া, মন্টেনিগ্রো, সেরাজেভো – সমগ্র বলকান অঞ্চলে জাতীয়তাবাদী বিক্ষোভের সঞ্চার হয়।

(৫) লিপসনের মন্তব্য

ঐতিহাসিক লিপসন বলেন যে, বলকান জাতিগুলির মধ্যে বিপ্লবী চেতনার প্রসার পূর্বাঞ্চলীয় সমস্যাকে কূটনীতিকদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে যায়।

রাশিয়ার অগ্রসর নীতি

তুরস্ক সাম্রাজ্যের দুর্বলতায় সবচেয়ে খুশি হয় রাশিয়া এবং সে এই অবস্থার পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করে। যেমন –

(১) জলপথের অভাব

রাশিয়ার সবচেয়ে বড়ো সমস্যা ছিল বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য জলপথের একান্ত অভাব, অথচ রাজনৈতিক প্রাধান্য ও বাণিজ্যিক সমৃদ্ধির জন্য রাশিয়ার পক্ষে এই জলপথ অপরিহার্য ছিল।

(২) বাল্টিক সাগর

এক সময় বাল্টিক সাগর দিয়ে রাশিয়া বাইরে যাতায়াত করত, কিন্তু এতেও এক সমস্যা দেখা দেয়। বাল্টিক সাগর সারা বছর বরফমুক্ত থাকে না।

(৩) উষ্ণজল নীতি

তাই রাশিয়া কৃষ্ণসাগরের উপর দিয়ে দার্দানালিস প্রণালী অতিক্রম করে ভূমধ্যসাগরে পৌঁছানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এই পরিকল্পনা বা নীতি ‘উষ্ণ জলনীতি’ বা ‘বরফমুক্ত সমুদ্র উপকূল পর্যন্ত বিস্তার নীতি’ নামে পরিচিত।

(৪) তুরস্কের দিকে সম্প্রসারণ নীতি

এই অঞ্চলটি ছিল তুরস্ক সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত। এই কারণে রুশ জার পিটার দ্য গ্রেটের আমল থেকে রাশিয়া তুরস্কের দিকে সম্প্রসারণ নীতি বা ‘উষ্ণ জলনীতি’ গ্রহণ করে।

(৫) রুশ আধিপত্য বিস্তার

জারিনা দ্বিতীয় ক্যাথারিনের আমলে রাশিয়া ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে কুচুক কাইনার্ডজির সন্ধি এবং ১৭৯২ খ্রিস্টাব্দে জাসির চুক্তির মাধ্যমে তুরস্কের বেশ কিছু অঞ্চল দখল করে এবং কৃষ্ণসাগরের উপকূল পর্যন্ত রুশ অধিকার বিস্তৃত হয়।

(৬) কৃষ্ণসাগরীয় শক্তিতে পরিণত

বিনাযুদ্ধে ইউক্রেন, ক্রিমিয়া প্রভৃতি অঞ্চল অধিকৃত হয় এবং তুরস্ক সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত গ্রিক অর্থোডক্স খ্রিস্টান ও চার্চের উপর রুশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এইভাবে রাশিয়া একটি কৃষ্ণসাগরীয় শক্তিতে পরিণত হয়।

(৭) রুশ-তুরস্ক সম্পর্কে তিক্ততা

১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে ভিয়েনা সন্ধির দ্বারা রাশিয়া তুরস্কের কাছ থেকে বেসারাবিয়া অধিকার করে। তুরস্কের বিরুদ্ধে রাশিয়ার এই সাম্রাজ্য-লোলুপতা রুশ-তুরস্ক সম্পর্ক তিক্ততর করে দেয়।

ইংল্যান্ড অস্ট্রিয়া ও ফ্রান্সের স্বার্থ

বলকান অঞ্চলের উপর এই রুশ প্রভাব অপরাপর ইউরোপীয় শক্তিগুলির পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। যেমন –

(১) শক্তিসাম্য বিনষ্ট

ইংল্যান্ড, অস্ট্রিয়া ও ফ্রান্স আশঙ্কা করে যে বলকান অঞ্চলে রুশ প্রভাব বৃদ্ধি পেলে শক্তিসাম্য বিনষ্ট হবে। তারা চাইত যে, তুরস্ক সাম্রাজ্য অখণ্ড থাকুক এবং রুশ আধিপত্য বিনষ্ট হোক।

(২) ইংল্যান্ডের আশঙ্কা

ইংল্যান্ড মনে করে যে, ভূমধ্যসাগর অঞ্চলে রুশ অগ্রগতি ঘটলে এই অঞ্চলে ব্রিটিশ নৌ-প্রাধান্য বিনষ্ট হবে এবং ইংল্যান্ডের ভারতীয় সাম্রাজ্যও বিপন্ন হবে।

(৩) অস্ট্রিয়ার আশঙ্কা

অস্ট্রিয়া ছিল মূলত একটি স্থলসাম্রাজ্য এবং আড্রিয়াটিক সাগর ও দানিয়ুব উপত্যকায় তার অর্থনৈতিক স্বার্থ জড়িত ছিল। রুশ অগ্রগতিতে তার সেই স্বার্থ বিপন্ন হয়। এছাড়া, রাশিয়া ছিল স্লাভ জাতিগোষ্ঠীর নেতা। রাশিয়ার ‘নিখিল স্লাভ আন্দোলন’-এর সঙ্গে অস্ট্রিয়া সাম্রাজ্যে বসবাসকারী স্লাভদের যোগাযোগের সম্ভাবনা ছিল এবং এর ফলে অস্ট্রিয় সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হত। এইসব কারণে অস্ট্রিয়া বলকান অঞ্চলে রুশ প্রাধান্যের বিরোধী ছিল।

(৩) ফ্রান্সের আশঙ্কা

রুশ সম্প্রসারণে ফ্রান্স ও শঙ্কিত হয়ে ওঠে। সিরিয়া ও মিশরে ফ্রান্স কিছু বাণিজ্যিক সুবিধা ভোগ করত এবং বলকান অঞ্চলের রোমান ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের উপর কর্তৃত্ব করত। রুশ সম্প্রসারণে ফ্রান্সেরও স্বার্থহানি হয়।

উপসংহার:- এইসব নানা কারণে ‘পূর্বাঞ্চল সমস্যা’ জটিল রূপ ধারণ করে। লর্ড মলে বলেন যে, পূর্বাঞ্চল সমস্যা হল “একটি পরিবর্তনশীল, সমাধানবিহীন পাকানো গ্রন্থি, যাতে পরস্পর সংঘাতশীল ধর্মমত, পরস্পর-বিরোধী জাতিগোষ্ঠী ও পরস্পর-বিরোধী স্বার্থ জটিলতা সৃষ্টি করেছে।”

(FAQ) পূর্বাঞ্চল সমস্যার কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. পূর্বাঞ্চল কোথায়?

ইউরোপের ইতিহাসে পূর্বাঞ্চল বলতে ইউরোপের পূর্ব দিকে অবস্থিত স্থান সমূহকে বোঝায়।

২. পূর্বাঞ্চল সমস্যা কি?

অষ্টাদশ শতক থেকে তুরস্ক সাম্রাজ্য দ্রুত প্রতনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এই পতনের ফলে পূর্বাঞ্চলে যে রাজনৈতিক শূন্যতা ও অস্থিরতা দেখা দেয়, তাই পূর্বাঞ্চল সমস্যা বা বলকান সমস্যা বা নিকট প্রাচ্য সমস্যা নামে পরিচিত।

৩. পূর্বাঞ্চল সমস্যার ফলে কোন কোন যুদ্ধ শুরু হয়?

সার্বিয়ার যুদ্ধ, গ্ৰিসের স্বাধীনতা যুদ্ধ, রুশ-তুর্কি যুদ্ধ, ক্রিমিয়ার যুদ্ধ, বলকান যুদ্ধ।

৪. পূর্বাঞ্চল সমস্যার আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া কি ছিল?

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ।

Leave a Comment