প্রাচীন যুগের বিভাজন

প্রাচীন যুগের বিভাজন প্রসঙ্গে আধুনিক মানুষের উদ্ভব, আদি মানবের হাতিয়ার, প্রাগৈতিহাসিক যুগ, প্রায় ঐতিহাসিক যুগ, ঐতিহাসিক যুগ ও ভারতে ধারাবাহিক ইতিহাসের অভাব সম্পর্কে জানবো।

ইতিহাসে প্রাচীন যুগের বিভাজন প্রসঙ্গে প্রাগৈতিহাসিক যুগ, ইতিহাসে প্রায় ঐতিহাসিক যুগ, ঐতিহাসিক যুগ, ভারতে ধারাবাহিক ইতিহাসের অভাব, প্রাচীন যুগের বিভিন্ন বিভাগের সময়কাল ও উপাদান সম্পর্কে জানব।

প্রাচীন যুগের বিভাজন

ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রাচীন যুগের বিভাজন
প্রাগৈতিহাসিক যুগপ্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান
প্রায় ঐতিহাসিক যুগলিপির পাঠোদ্ধারে ব্যর্থ
ঐতিহাসিক যুগলিখিত বিবরণের উপস্থিতি
অষ্টাধ্যায়ীপাণিনি
প্রাচীন যুগের বিভাজন

ভূমিকা :- মানবসভ্যতার ইতিহাসকে তিনভাগে ভাগ করা যায় – প্রাচীন যুগ, মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগ। মানব-ইতিহাসে প্রাচীন যুগের ব্যাপ্তি খুবই সুদীর্ঘ।

আধুনিক মানুষের উদ্ভব

প্রাচীন যুগের প্রথম পর্বে আজ থেকে প্রায় ৩৬ লক্ষ বছর আগে দীর্ঘ বিবর্তনের মধ্য দিয়ে পৃথিবীতে হোমো-স্যাপিয়েন্স বা প্রথম আধুনিক মানুষের উদ্ভব ঘটেছিল বলে ঐতিহাসিকরা অনুমান করেন। ভারত-এর মাটিতেও অন্তত ৫ লক্ষ বছর আগে মানুষের বসবাস ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়।

আদি মানবের হাতিয়ার

সভ্যতার আদি পর্বে এই আধুনিক মানুষ পৃথিবীর সর্বত্রই পাথরের হাতিয়ার ব্যবহার করত। পরবর্তীকালে তারা তামা, ব্রোঞ্জ, লোহা প্রভৃতি ধাতুর হাতিয়ার ব্যবহার শুরু করে। হাতিয়ারের পরিবর্তনের পাশাপাশি প্রাচীন যুগের সংস্কৃতিতেও বিভিন্ন পরিবর্তন ঘটতে থাকে। ক্রমে লিপির প্রচলন ঘটে।

প্রাচীন যুগের বিভাজন

এইসব বিভিন্ন পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রাচীন যুগকে তিনভাগে ভাগ করা হয়। যথা – প্রাগৈতিহাসিক যুগ (Pre- Historic Age), প্রায়-ঐতিহাসিক যুগ (Proto-Historic Age) এবং ঐতিহাসিক যুগ (Historic Age)।

প্রাগৈতিহাসিক যুগ

প্রাচীন যুগের প্রথম অংশ প্রাগৈতিহাসিক যুগের বিভিন্ন দিক গুলি হল –

(ক) সময়কাল

মানবসংস্কৃতির প্রারম্ভকাল থেকে শুরু করে লিখিত উপাদানের প্রাপ্তিকালের মধ্যবর্তী সময়কালকে বলা হয় ‘প্রাগৈতিহাসিক যুগ’ (Pre-Historic Age)। এক কথায়, যে যুগের কোনো লিখিত ঐতিহাসিক উপাদান পাওয়া যায় না সেই যুগকে ‘প্রাগৈতিহাসিক যুগ’ বলা হয়।

(খ) কথাটির ব্যবহার

ফরাসি প্রত্নতত্ত্ববিদ পল তুর্নাল দক্ষিণ ফ্রান্স-এর গুহায় প্রাপ্ত প্রাচীন নিদর্শনগুলির বিবরণ দিতে গিয়ে ১৮৩০-এর দশকে সর্বপ্রথম প্রাক্-ইতিহাস কথাটি ব্যবহার করেন এবং এটি ইংরেজি ভাষায় প্রথম ব্যবহার করেন ড্যানিয়েল উইলসন, ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দে।

(গ) ইতিহাসের উপাদান

এই সময় মানুষ লিপি বা অক্ষরের ব্যবহার জানত না, তাই এই সময়ের কোনো লিখিত বিবরণ নেই। এই যুগের মানুষের ব্যবহৃত হাতিয়ার, বাসস্থান, মৃৎশিল্প, গৃহস্থালির সরঞ্জাম প্রভৃতি অর্থাৎ কেবলমাত্র প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান-এর ওপর ভিত্তি করেই এই যুগের ইতিহাস রচিত হয়। ভারতে হরপ্পা সভ্যতার পূর্বের কোনো লিখিত ঐতিহাসিক উপাদান পাওয়া যায় নি বলে প্রাক্-হরপ্পা যুগ ছিল প্রাগৈতিহাসিক যুগ।

(ঘ) মানুষ ও জন্তু

প্রাগৈতিহাসিক যুগের মানুষ বলতে গুহামানব এবং জন্তু বলতে ডাইনোসরদের উদাহরণ দেওয়া যায়।

(ঙ) উপবিভাগ

বিভিন্ন প্রত্নতত্ত্ববিদ পাথরে নির্মিত হাতিয়ারের ক্রমোন্নতি লক্ষ্য করে প্রাগৈতিহাসিক যুগকে তিন ভাগে ভাগ করেছেন – প্রাচীন প্রস্তর যুগ (Palaeolithic Age), মধ্য প্রস্তর যুগ (Mesolithic Age) ও নব্য প্রস্তর যুগ (Neolithic Age)।

প্রায়-ঐতিহাসিক যুগ

প্রাচীন যুগের দ্বিতীয় পর্ব প্রায় ঐতিহাসিক যুগের বিভিন্ন দিক গুলি হল –

(ক) সময়কাল

প্রায়-ঐতিহাসিক যুগের সময় কালকে দু ভাবে দেখা যেতে পারে। যেমন –

(১) লিপির ব্যবহার

‘প্রায়-ঐতিহাসিক যুগ’ (Proto-Historic Age) বলতে সেই যুগকে বোঝায়, যখন লিপির ব্যবহার শুরু হয়েছে, কিন্তু আজও পর্যন্ত যার পাঠোদ্ধার সম্ভব হয় নি। উদাহরণ হিসেবে হরপ্পা সভ্যতার কথা বলা যায় । হরপ্পা সভ্যতায় লিপির প্রচলন হয়েছিল। কিন্তু ‘সিন্ধু লিপি‘ নামে হরপ্পা সভ্যতার এই লিপির পাঠোদ্ধার করা আজও সম্ভব হয় নি।

(২) ধাতুর ব্যবহার

অনেকে আবার ‘প্রাক্- ইতিহাস’ ও ‘প্রায়-ইতিহাস’ পর্যায়ভেদে লিপিজ্ঞানের এই অতি সরল বিভাজনকে গুরুত্ব দিতে চান না। তাঁরা ভারতে ধাতুর অর্থাৎ তাম্র-ব্রোঞ্জ ব্যবহারের সূত্রপাত থেকে লৌহ যুগ-এর সূচনা পর্যন্ত কালপর্বটিকে ‘প্রায়-ঐতিহাসিক যুগ’ হিসেবে চিহ্নিত করেন।

(খ) ধাতুর ব্যবহারভিত্তিক যুগ বিভাজনের সমস্যা

বলা বাহুল্য, ধাতুর ব্যবহারের ভিত্তিতে ভারতে যুগ বিভাজনের কিছু সমস্যা আছে। ভারতের সর্বত্র ধাতুর ব্যবহারের ক্রম-পরিবর্তন সমানভাবে হয় নি। যেমন –

(১) উত্তর ভারত

উত্তর ভারতে পাথরের পরেই তামা এবং তামার পর লোহার ব্যবহার শুরু হয়। অর্থাৎ উত্তর ভারতে প্রস্তর, তাম্র এবং লৌহ যুগ পরপর আসে।

(২) দক্ষিণ ভারত

কিন্তু দক্ষিণ ভারতে প্রস্তর যুগের পরেই আসে লৌহ যুগ – তামার যুগ সেখানে অনুপস্থিত।

(৩) ব্রোঞ্জ যুগ

ইউরোপ-এ পৃথক ব্রোঞ্জ যুগের অস্তিত্ব ছিল। কিন্তু ভারতে পৃথক কোনো ব্রোঞ্জ যুগের অস্তিত্ব ছিল না। এখানে তামা ও ব্রোঞ্জ ধাতু একই সঙ্গে ব্যবহৃত হতে থাকে।

ঐতিহাসিক যুগ

ইতিহাসের প্রাচীন যুগের নবীনতম অংশ ঐতিহাসিক যুগের বিভিন্ন দিকগুলি হল –

(ক) সময়কাল

লিখনপদ্ধতির উদ্ভাবন ও লিখিত বিবরণের অস্তিত্বকে ‘ঐতিহাসিক যুগের’ সূচনা হিসেবে ধরা হয়। এদিক থেকে বলা যায় যে, পৃথিবীর সব দেশে একই সময়ে লিপি বা বর্ণমালার আবির্ভাব ঘটেনি এবং এর ফলে সর্বত্র একই সময়ে ‘ঐতিহাসিক যুগের ’ সূচনা হয় নি।

(খ) মিশর ও মেসোপটেমিয়ার দৃষ্টান্ত

খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ অব্দের কাছাকাছি সময় থেকেই মিশর, মেসোপটেমিয়া প্রভৃতি দেশে লিপির প্রচলন হয়েছিল এবং এগুলির পাঠোদ্ধার সম্ভব হয়েছে। এই সময় থেকেই এইসব দেশের রাজবংশ, রাজন্যবর্গ এবং সন-তারিখের মোটামুটি লিখিত বিবরণ পাওয়া যায়।

(গ) ভারতের দৃষ্টান্ত

আর্য সভ্যতার যুগে বিশাল ও অনুপম সাহিত্য সৃষ্টি হলেও আর্যদের কোনো লিপিজ্ঞান ছিল না বলেই অনুমান করা হয়। কারও কারও মতে প্রাচীন ভারতের শিলালিপিগুলির মধ্যে মৌর্য সম্রাট অশোকের শিলালিপিগুলিই (২৬০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের পরবর্তী) হল প্রাচীনতম, যেগুলির পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। তাই কেউ কেউ ভারতে ‘ঐতিহাসিক যুগের’ সূচনাকাল হিসেবে খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতককে চিহ্নিত করে থাকেন।

(ঘ) ভারতীয় প্রসঙ্গে ভিন্ন মত

  • (১) অনেকে সোহগোর তাম্রলিপিকেই ভারতের ক্ষেত্রে প্রাচীনতম লিপি বলে মনে করেন। তাঁদের মতে এই লিপিটি অশোক-এর জন্মের পঞ্চাশ বছর পূর্বে রচিত। উত্তর ভারতে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের পরবর্তীকালে বিভিন্ন বৌদ্ধ ও জৈন গ্রন্থ রচিত হলে সেগুলি থেকে সমসাময়িক বিভিন্ন ঐতিহাসিক তথ্য জানা যায়।
  • (২) কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. দিলীপকুমার চক্রবর্তী ভারতের ঐতিহাসিক যুগের সূচনাকাল খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতক থেকে আরও পিছিয়ে দেওয়ার পক্ষে জোরালো সওয়াল করেছেন। তিনি বলেছেন যে, “খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকের আগে গাঙ্গেয় উপত্যকায় লিপি ছিল না এটা অবান্তর কথা হওয়াই স্বাভাবিক।”
  • (৩) বক্তব্যের সপক্ষে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন যে, খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে পাণিনির ব্যাকরণ রচনা কি কখনও লিপি প্রচলনের পূর্বে হতে পারে! তাই কেউ কেউ মনে করেন যে, খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের পরবর্তীকালেই ভারতে ঐতিহাসিক যুগের সূচনা হয়।

ভারতে ধারাবাহিক ইতিহাসের অভাব

লিপির পাঠোদ্ধার ও সন-তারিখ সমন্বিত ইতিহাস আধুনিক যুগের ইতিহাসের ভিত্তি। লিপির পাঠোদ্ধার না হওয়ার কারণে ভারতে খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ অব্দ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৬৫০ অব্দ পর্যন্ত কালপর্বের সন-তারিখ সংবলিত কোনো ধারাবাহিক ইতিহাস রচনা করা সম্ভব হয় নি।

উপসংহার :- ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট স্মিথ (V. Smith)-এর মতে, উত্তর ভারতের কালানুক্রম সংবলিত ইতিহাস (‘Chronological History’) জানা যায় ৬৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে। দাক্ষিণাত্যের ক্ষেত্রে আরও পরে। তাঁর মতে, সকল দিক বিবেচনা করে ভারতে ঐতিহাসিক যুগের সূচনার সময়টি হল ৩২৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণ-এর বৎসর থেকে।

(FAQ) প্রাচীন যুগের বিভাজন হতে জিজ্ঞাস্য?

১. ইতিহাসের প্রাচীন যুগকে কয়টি ভাগে ভাগ করা যায়?

তিনটি।

২. ইতিহাসের প্রাচীন যুগের তিনটি ভাগ কি কি?

প্রাগৈতিহাসিক যুগ, প্রায়-ঐতিহাসিক যুগ ও ঐতিহাসিক যুগ।

৩. ঐতিহাসিক যুগের ইতিহাস রচনার প্রধান উপাদান কি?

প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান।

৪. হরপ্পা সভ্যতায় প্রাপ্ত লিপির নাম কি?

সিন্ধু লিপি।

৫. ঐতিহাসিক যুগকে কি কি ভাগে ভাগ করা যায়?

প্রাচীন প্রস্তর যুগ মধ্য প্রস্তর যুগ ও নব্য প্রস্তর যুগ।

৬. ভারতের প্রাগৈতিহাসিক যুগের একটি সভ্যতার নাম লেখ।

মেহেরগড় সভ্যতা।

৭. ভারতের প্রায় ঐতিহাসিক যুগের একটি সভ্যতার নাম লেখ।

হরপ্পা সভ্যতা।

Leave a Comment