সুলতানি যুগের সাহিত্য

সুলতানি যুগের সাহিত্য প্রসঙ্গে আরবি সাহিত্য, ফার্সী সাহিত্যের অগ্ৰগতি, আমীর খসরু, বদরুদ্দিন ও ইসামি, ইতিহাস সাহিত্য, সিকান্দার লোদীর পৃষ্ঠপোষকতা, প্রাদেশিক শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতা, ফার্সী ইতিহাসবিদ, দর্শন শাস্ত্র, সংস্কৃত সাহিত্য, ভক্তি সাহিত্য, হিন্দি সাহিত্য ও উর্দু সাহিত্য সম্পর্কে জানবো।

সুলতানি যুগের সাহিত্য

বিষয়সুলতানি যুগের সাহিত্য
তহকিক-ই-হিন্দঅলবিরুণি
তুঘলক নামাআমীর খসরু
পৃথ্বিরাজ রসোচাঁদ বরদাই
রাজতরঙ্গিনীকলহন
সুলতানি যুগের সাহিত্য

ভূমিকা :- সুলতানি যুগে ফার্সী, সংস্কৃত ও প্রাদেশিক ভাষায় সাহিত্য রচিত হয়। দিল্লীর সুলতানরা ও প্রাদেশিক শাসনকর্তারা সাহিত্যিকদের সমাদর করতেন। যদিও কোনো কোনো গবেষক মনে করেন যে, সুলতানি যুগে সাহিত্যের তেমন বিকাশ হয় নি, অধিকাংশ পণ্ডিত এই মত অগ্রাহ্য করেন।

সুলতানি যুগে আরবি সাহিত্য

  • (১) দিল্লির সুলতানরা আরবী ও ফার্সী সাহিত্যের সমাদর করতেন। আরবী ভাষা ছিল ধর্মগুরুদের ও পবিত্র কোরাণের ভাষা। মুসলিম ধর্ম সাহিত্যের অধিকাংশ এই ভাষাতেই রচিত হয়। ভারতীয় মুসলিম পণ্ডিত ও দার্শনিকরা এই ভাষায় তাদের ভাবপ্রকাশ করতেন।
  • (২) আরবী ভাষাতেই তারা প্রধানত মুসলিম আইন-কানুনের সারসংগ্রহ করেন। পরে অবশ্য ফার্সীতেও তা করা হয়। সুলতানি শাসনের গোড়ার দিকে আলবিরুণী তার বিখ্যাত তহকিক-ই-হিন্দ গ্রন্থটি রচনা করেন। একাদশ শতকের ভারতের অবস্থা সম্পর্কে এতে বহু তথ্য পাওয়া যায়।

সুলতানি যুগে ফার্সী সাহিত্যের অগ্ৰগতি

  • (১) তুর্কীরা ভারত -এ আসার পর ফার্সীর সমাদর বাড়তে থাকে। মধ্য এশিয়া থেকে তুর্কীরা ফার্সীর ঐতিহ্য বহন করে এদেশে আসেন। তারা ফার্সীকেই রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্থান দেন এবং সাহিত্যের বাহন হিসেবে গ্রহণ করেন। লাহোরে ফার্সী চর্চার একটি কেন্দ্র গড়ে ওঠে।
  • (২) সুলতান ইলতুৎমিস তাঁর দরবারে বহু ফার্সী লেখককে আশ্রয় দেন। নুর-উদ-দিন তার লুবাতো-উল-আলবাব রচনা করেন। মোঙ্গল আক্রমণের ভয়ে বহু ফার্সী পণ্ডিত বলবন -এর দরবারে আশ্রয় নেন। বলবনের জ্যেষ্ঠ পুত্রও ফার্সী পণ্ডিতদের অনুরাগী ছিলেন।
  • (৩) সুলতান আলাউদ্দিন খলজিও ফার্সী পণ্ডিতদের সমাদর করতেন। আমীর খসরু ও হাসান দেহলভী সুলতানি আশ্রয় ও সহযোগিতায় সাহিত্য রচনা করেন।

দিল্লির সুলতানি যুগের সাহিত্যিক আমীর খসরু

  • (১) আমীর খসরুর গদ্য রচনা খাজাইল-উল-ফুতুহ, তুঘলক নামা, তারিখ-ই-আলাই অতিশয় বিখ্যাত। এছাড়া তিনি তাঁর কবিতায় হিন্দী শব্দ ব্যবহারের রীতি প্রচলন করেন।
  • (২) তিনি ফার্সী সাহিত্যের ভারতীয়করণ করেন। আমীর খসরু ভারতবর্ষকে তাঁর জন্মভূমি বলে গর্ববোধ করতেন। খসরু হিন্দীকে হিন্দভী বলতেন। ফার্সী মেশানো হিন্দীতে তিনি বেশ কিছু কবিতা রচনা করেন।

সুলতানি যুগের ফার্সি সাহিত্যিক বদরুদ্দিন ও ইসামি

মহম্মদ বিন তুঘলক-এর রাজসভায় বিখ্যাত ফার্সী সাহিত্যিক ছিলেন বদরুদ্দিন মহম্মদ। ইসামিও এই সময় তার ঐতিহাসিক রচনাগুলি লেখেন।

সুলতানি যুগের ইতিহাস সাহিত্য

দিল্লির সুলতান ফিরোজ শাহের পৃষ্ঠপোষকতায় জিয়াউদ্দিন বরণী ও সামস-ই-ফিরোজ আফিফ তাঁদের বিখ্যাত ঐতিহাসিক রচনাগুলি লিপিবদ্ধ করেন। বরণীর রচনা তারিখ-ই-ফিরোজ শাহী ও ফতোয়া-ই-জাহান্দারী বিখ্যাত গ্রন্থ। এছাড়া ফিরোজ শাহ তুঘলক তাঁর আত্মজীবনী রচনা করেন।

সুলতানি যুগে সাহিত্যের বিকাশে সিকান্দার লোদীর পৃষ্ঠপোষকতা

দিল্লির সুলতান সিকান্দার লোদীও পণ্ডিতদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। এঁদের মধ্যে রফিউদ্দিন সিরাজী প্রমুখ বিশেষ খ্যাতিমান ছিলেন। তিনি ‘গুলরুখী’ ছদ্মনামে ফার্সী গীতিকাব্য রচনা করেন। তাঁর দরবারে ১৭ জন ফার্সী পণ্ডিত ছিলেন।

সুলতানি যুগে সাহিত্যের বিকাশে প্রাদেশিক শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতা

প্রাদেশিক শাসনকর্তারাও বহু ফার্সী পণ্ডিতের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। বাহমনী রাজ্য-এর সুলতান তাজউদ্দিন ফিরোজ শাহ ও বাহমনী মন্ত্রী মামুদ গাওয়ান ফার্সী সাহিত্যে পণ্ডিত ছিলেন।

সুলতানি যুগের ফার্সী ইতিহাসবিদ

দিল্লির সুলতানি যুগের বিখ্যাত ফার্সী ইতিহাসবিদদের মধ্যে হাসান নিজামীর তাজ-উল-মাসির, মিনহাজের তবকং-ই-নাসিরী, বরণীর তারিখ-ই ফিরোজ শাহী প্রমুখ লেখক ও তাদের গ্ৰন্থের নাম উল্লেখ্য। সুলতানি যুগে হিন্দুরাও ফার্সী চর্চা শুরু করেন। কেবলমাত্র ধর্মান্তরিত হিন্দু নন, হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরাও ফার্সী শিক্ষা করেন। সিকান্দার লোদী এ বিষয়ে উৎসাহ দেন।

সুলতানি যুগের দর্শন শাস্ত্র

দর্শনের বহু শাখায় এই যুগে সংস্কৃত গ্রন্থ রচিত হয়। শঙ্করের অদ্বৈতবাদ অনুসরণে বল্লভাচার্য, মাধবাচার্য, রামানুজ প্রভৃতি গ্রন্থ রচনা করেন। সুলতানি যুগে কাগজের ব্যবহার বাড়লে সংস্কৃত পান্ডুলিপিগুলির বিভিন্ন সংস্করণ প্রকাশিত হয়। সম্ভবত হিন্দু আইনের গ্রন্থ ‘মিতাক্ষরা’ দ্বাদশ শতকে রচিত হয়। বিজ্ঞানেশ্বর এই গ্রন্থ রচনা করেন।

সুলতানি যুগে সংস্কৃত সাহিত্য

  • (১) সংস্কৃত সাহিত্য রচনায় জৈনরাও অংশ নেন। জৈন ধর্ম অবলম্বীরা ভারতে মুসলিমদের উৎপত্তি ও ইসলামের প্রচার নিয়ে কোনো উদ্বেগ ও আশঙ্কায় ভুগতেন না। এই ব্যতিক্রম যথেষ্ট কৌতূহল জনক।
  • (২) সংস্কৃত ভাষার পণ্ডিতরা এতই সঙ্কীর্ণ মনের ছিলেন যে, তাঁরা উচ্চমানের ফার্সী গ্রন্থগুলি সংস্কৃত ভাষায় অনুবাদ করার দরকার মনে করতেন না। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল ইউসুফ ও জুলেখার প্রেমকাহিনী। এজন্য অলবিরুণী ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন।

দিল্লির সুলতানি যুগে আঞ্চলিক ভাষার বিকাশ

ইসলামের আগমনের পর ব্রাহ্মণদের সামাজিক মর্যাদা অনেকাংশে ক্ষয় পায়। এর ফলে সংস্কৃতের পরিবর্তে হিন্দীসহ আঞ্চলিক ভাষাগুলির বিকাশ ঘটে।

সুলতানি যুগে ভক্তি সাহিত্য

ভক্তিগুরুরা হিন্দীসহ কথ্যভাষায় ভক্তি সাহিত্য রচনা করায় হিন্দী, বাংলা, মারাঠা ভাষার বিশেষ অগ্রগতি ঘটে।

দিল্লির সুলতানি যুগে সংস্কৃত গ্ৰন্থ

  • (১) সুলতানি যুগে হিন্দু রাজারা সংস্কৃত রচনায় প্রেরণা দেন। এর ফলে কাব্য, গদ্য, নাটকে বহু সংস্কৃত গ্রন্থ রচিত হয়। বরঙ্গলরাজের পৃষ্ঠপোষকতায় অগস্ত্য প্রতাপরুদ্রদেব যশোভূষণ কাব্য রচনা করেন। তৃতীয় বীর বল্লালের পৃষ্ঠপোষকতায় বিদ্যাচক্রবর্তী রুক্মিনীকল্যাণম রচনা করেন।
  • (২) বিজয়নগর সাম্রাজ্য-এর বিরূপাক্ষ নরকাসুর বিজয় কাব্য রচনা করেন। বামনভট্ট পার্বতীপরিণয় রচনা করেন। বিদ্যাপতি দুর্গাভক্তি তরঙ্গিনী রচনা করেন। জৈন পণ্ডিত ন্যায়চন্দ্র হাম্মির বিজয় কাব্য রচনা করেন।
  • (৩) বিজয়নগরের রাজা কৃষ্ণদেব রায় জাম্ববতীকল্যাণ কাব্য রচনা করেন। রামানুজ ব্রহ্মসূত্রের টীকা রচনা করেন। কাশ্মীরের ইতিহাস সম্পর্কে পন্ডিত কলহন তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ রাজতরঙ্গিনী রচনা করেন।

সুলতানি যুগে হিন্দি সাহিত্য ও উর্দু সাহিত্য

  • (১) সুলতানি যুগে হিন্দী সাহিত্যের বিকাশ হয়। এই সময় কথ্য হিন্দী ‘খাড়িবোলী’, ব্রজভাষা’ এই দুভাগে বিভক্ত ছিল। এই দুই ভাষাকে আশ্রয় করে হিন্দী সাহিত্যের বিকাশ ঘটে। কবি চাঁদ বরদাই তাঁর বিখ্যাত পৃথিরাজ রাসো কাব্য রচনা করেন।
  • (২) শাঙ্গধর তাঁর হাম্মির রাসো ও হাম্মির কাব্য রচনা করেন। জয়নায়ক অলখনন্দা রচনা করেন। কবি বিদ্যাপতি ঠাকুর ব্রজবুলি বা মৈথিলী ভাষায় তাঁর ভক্তিগীতি বা পদাবলী রচনা করেন। উর্দুভাষায় বা জবান-ই-হিন্দভী ভাষায় এই যুগে কিছু সাহিত্য রচিত হয়।

সুলতানি যুগে আঞ্চলিক ভাষার সাহিত্য

বিভিন্ন প্রাদেশিক ভাষায় সুলতানি যুগে সাহিত্য রচিত হয়। মারাঠি ভাষায় নামদেব, জ্ঞানেশ্বর, একনাথ আভঙ্গ বা ভক্তিগীতি, রাজস্থানী ভাষায় ভক্তিগীতি, বাংলায় পদাবলী সাহিত্য, কন্নড়, তেলেগু ও তামিল ভাষায় স্থানীয় সাহিত্যের সৃষ্টি হয়। বাঙালি স্মৃতিশাস্ত্রের পণ্ডিত রঘুনন্দন স্মৃতিশাস্ত্রের উপর গ্রন্থ রচনা করেন।

উপসংহার :- সুলতানি যুগে বাংলায় হুসেন শাহনসরৎ শাহ-এর উদ্যমে মহাভারতের বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হয়। কবীন্দ্র পরমেশ্বর পরাগল খাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় মহাভারতের বঙ্গানুবাদ করেন। কবি শ্রীকর নন্দী ছুটি খাঁর পরামর্শে অপর একটি বাংলা মহাভারত রচনা করেন। কবি বিজয়গুপ্ত মনসামঙ্গল কাব্য রচনা করেন।

(FAQ) সুলতানি যুগের সাহিত্য সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. সুলতানি যুগে মনসামঙ্গল কাব্য রচনা করেন কে?

বিজয়গুপ্ত।

২. ব্রজবুলি ভাষায় পদাবলী রচনা করেন কে?

বিদ্যাপতি।

৩. পৃথ্বিরাজ রসো কে রচনা করেন?

চাঁদ বরদাই।

৪. হিন্দু আইন গ্ৰন্থ মিতাক্ষরা কে রচনা করেন?

বিজ্ঞানেশ্বর।

Leave a Comment