বাহমনি রাজ্য প্রসঙ্গে প্রতিষ্ঠা, হাসান, প্রথম মহম্মদ, মুজাহিদ শাহ, দাউদ শাহ, তাজউদ্দিন ফিরোজ শাহ, আহমদ শাহ, দ্বিতীয় আলাউদ্দিন শাহ, হুমায়ুন শাহ, নিজাম শাহ, তৃতীয় মহম্মদ, মামুদ শাহ সম্পর্কে জানবো।
বাহমনি রাজ্য
বিষয় | বাহমনি রাজ্য |
প্রতিষ্ঠাতা | আলাউদ্দিন বাহমান শাহ |
প্রতিষ্ঠাকাল | ১৩৪৭ খ্রিস্টাব্দ |
রাজধানী | গুলবর্গা |
বিখ্যাত মন্ত্রী | মামুদ গাওয়ান |
পতন | ১৫২৭ খ্রিস্টাব্দ |
ভূমিকা :- দিল্লীর সুলতান মহম্মদ বিন-তুঘলকের রাজত্বকালে দক্ষিণে সুলতানি প্রশাসনে নানা গণ্ডগোল দেখা দেয়। এই সুযোগেই দক্ষিণ ভারতে বাহমণি রাজ্যের উত্থান ঘটে।
রাজ্য প্রতিষ্ঠা
বিদ্রোহী আমীররা হাসান নামে এক ব্যক্তিকে দৌলতাবাদের সুলতান নির্বাচন করে। হাসান সিংহাসনে বসে আলাউদ্দিন বাহমন শাহ উপাধি নেন। এজন্য তাঁর প্রতিষ্ঠিত রাজবংশের নাম হয় বাহমনী রাজবংশ।
হাসান
হাসান যোগ্য শাসক ছিলেন। তিনি প্রতিবেশী অঞ্চলগুলি জয় করে ওয়েন গঙ্গা থেকে কৃষ্ণা পর্যন্ত এবং দৌলতাবাদ থেকে ভাঙ্গীর পর্যন্ত রাজ্য বিস্তার করেন। তিনি গুলবর্গায় রাজধানী স্থাপন করেন এবং তার সাম্রাজ্যকে ৪টি তরফ বা প্রদেশে ভাগ করেন। ১৩৫৮ খ্রিস্টাব্দে হাসানের মৃত্যু হয়।
প্রথম মহম্মদ
হাসানের পর তাঁর পুত্র প্রথম মহম্মদ শাহ (১৩৫৮-৭৭ খ্রি) সিংহাসনে বসেন। তিনি বাহমনী রাজ্যের শাসনব্যবস্থাকে সংস্কার করেন। তার আমল থেকেই কৃষ্ণা-তুঙ্গভদ্রার মধ্যস্থিত উর্বরা ভূখণ্ড রায়চুর দোয়াব ও মারাঠাবাদী অঞ্চলের আধিপত্য নিয়ে বাহমনী-বিজয়নগরের ঐতিহাসিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার সূচনা হয়। ১৩৭৭ খ্রিস্টাব্দে প্রথম মহম্মদ শাহের মৃত্যু হয়।
মুজাহিদ শাহ
মহম্মদ শাহের পুত্র মুজাহিদ শাহ পিতার সিংহাসনে বসে বিজয়নগর আক্রমণ করেন। কিন্তু বিজয়নগরের আনেগুণ্ডি দুর্গ অধিকার করতে ব্যর্থ হয়ে তিনি ফিরে আসেন। ১৩৭৮ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যু হয়।
দাউদ শাহ
মুজাহিদের পর যথাক্রমে দাউদ শাহ ও দ্বিতীয় মহম্মদ শাহ বাহমনী সিংহাসনে বসেন। তাঁরা বিজয়নগরের ক্ষমতা প্রতিপত্তির কথা ভেবে এই রাজ্যের সঙ্গে শান্তি নীতি মেনে চলেন।
তাজউদ্দিন ফিরোজ শাহ
- (১) দ্বিতীয় মহম্মদ শাহের পর বাহমনী রাজ্যের উল্লেখযোগ্য সুলতান ছিলেন তাজউদ্দিন ফিরোজ শাহ (১৩৯৭-১৪২২ খ্রি)। তাজউদ্দিন ছিলেন উচ্চাকাঙ্খী, ক্ষমতালোভী শাসক। তিনি বিজয়নগর রাজ্যের সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে লিপ্ত হন।
- (২) ফিরোজ শাহ বাহমন এক বিশিষ্ট সুলতান ছিলেন। আইন ও ধর্মশাস্ত্রে তার পাণ্ডিত্য ছিল। উদ্ভিদবিদ্যা, চিকিৎসা, অর্থশাস্ত্রে তাঁর আগ্রহ ছিল। তিনি মুখে মুখে কবিতা রচনা করতেন। ফার্সী ও আরবী ভাষা ছাড়া তামিল, তেলেগু ও মারাঠী তিনি জানতেন।
- (৩) ফিরোজ শাহ তাঁর সরকারে বহু হিন্দুকে নিয়োগ করেন। দক্ষিণী কৃতি হিন্দু কর্মচারীদের তিনি পছন্দ করতেন। তিনি তার রাজ্যের চৌল ও দাভল বন্দরের সমৃদ্ধি ঘটান। পশ্চিম এশিয়ার সঙ্গে বাহমনী রাজ্যের বাণিজ্য সম্পর্ক বৃদ্ধির জন্য তিনি যত্ন নেন।
- (৪) ফিরোজ শাহ বাহমনী তাঁর রাজ্যকে দক্ষিণের একটি সংস্কৃতি কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলেন। ইরাণ ও ইরাক থেকে বহু জ্ঞানী-গুনী তাঁর দরবারে আসেন। ধর্মগুরু, ঐতিহাসিক, কবিদের সঙ্গে তিনি দীর্ঘ সময় কাটাতেন।
- (৫) ফেরিস্তার মতে, গোড়া মুসলিম হলেও তিনি অন্য ধর্মের প্রতি সহিষ্ণুতা দেখাতেন। তার শেষজীবন শান্তিতে কাটেনি। তার ভ্রাতার সঙ্গে গৃহযুদ্ধের ফলে তাঁর মৃত্যু হয়।
আহমদ শাহ
- (১) ফিরোজের পর তার ভ্রাতা আহমদ শাহ (১৪২২-৩৫ খ্রি) বাহমনী সিংহাসনে বসেন। তিনি গুলবর্গা থেকে বিদরে রাজধানী স্থানান্তর করেন। তাঁর শাসনকালে বিজয়নগর রাজ দ্বিতীয় দেবরায় বাহমনী আক্রমণে পরাজিত হয়ে এক অপমানজনক সন্ধি করতে বাধ্য হন। বাহমনী সুলতান এই সন্ধি দ্বারা যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ ও বাৎসরিক কর পান।
- (২) আহমদ শাহ মালবের অধিপতি হুসাং শাহকে পরাস্ত করে তার বিস্তর ক্ষতি করেন। তিনি গুজরাট আক্রমণ করেন এবং কোঙ্কন জয় করেন। ফিরোজ শাহের সময় বরঙ্গলের রাজা বিজয়নগরের সঙ্গে যুদ্ধে যোগ দিয়ে বাহমনী রাজ্যের ক্ষতি করেন। আহমদ শাহ তার প্রতিশোধ নিতে বরঙ্গল আক্রমণ করে এই রাজ্যের কিছু অংশ দখল করে নেন।
- (৩) তার শাসন নীতির ওপর সুফী দরবেশ গেসুদরাজের প্রভাব ছিল। আহমদ শাহ বিদ্বানদের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাঁর দরবারে সুন্নীপন্থী স্থানীয় দক্ষিণী অভিজাত বনাম শিয়াপন্থী বহিরাগত তুর্কী, পারসিক, আরবীয় অভিজাতদের দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এই গোষ্ঠী সংঘাতের ফলে বাহমনী শাসন দুর্বল হয়ে পড়ে।
দ্বিতীয় আলাউদ্দিন শাহ
- (১) ১৪৩৫ খ্রিস্টাব্দে আহমদ শাহের মৃত্যু হলে তার পুত্র দ্বিতীয় আলাউদ্দিন শাহ বাহমনী সিংহাসনে বসেন। তিনি কোঙ্কনের বিদ্রোহী হিন্দু রাজাকে দমন করেন। তিনি খান্দেশের নাসির খাঁকে পরাস্ত করেন।
- (২) বিজয়নগরের রাজা দ্বিতীয় দেবরায় রায়চুর দোয়াব আক্রমণ করলে, তিনি দেবরায়কে পরাস্ত করে বহু অর্থ আদায় করেন এবং বার্ষিক করের প্রতিশ্রুতি পান। দ্বিতীয় আলাউদ্দিন প্রজানুরাগী ছিলেন। তিনি প্রজাদের জন্য একটি দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপন করেন। ১৪৫৭ খ্রিস্টাব্দে তার মৃত্যু হয়।
হুমায়ুন শাহ
আলাউদ্দিনের পর তাঁর পুত্র হুমায়ুন শাহ কিছুকাল রাজত্ব করেন (১৪৫৭–১৪৬১ খ্রি)। তিনি খুব অত্যাচারী শাসক ছিলেন। এজন্য লোকে তাকে “জালিম” নাম দেয়।
নিজাম শাহ
হুমায়ুন শাহের পর নিজাম শাহ (১৪৬১–৩৩ খ্রি) সিংহাসনে বসেন। তিনি নাবালক অবস্থায় সিংহাসনে বসেন। সেই সুযোগে উড়িষ্যা ও তেলেঙ্গানার রাজারা বাহমনী রাজ্য আক্রমণ করেন। ১৪৬৩ খ্রিস্টাব্দে নিজাম শাহের মৃত্যু হয়।
তৃতীয় মহম্মদ শাহ
- (১) এরপর তার ভ্রাতা তৃতীয় মহম্মদ শাহ (১৪৬৫ – ১৪৮২ খ্রী) বাহমনী সিংহাসনে বসেন। তৃতীয় মহম্মদ শাহ ছিলেন অলস, সুরাসক্ত ও নৈতিক চরিত্রহীন। কিন্তু তিনি সৌভাগ্যক্রমে মহম্মদ গাওয়ান নামে এক দক্ষ মন্ত্রীর সাহায্য পান।
- (২) মহম্মদ গাওয়ান আনুগত্য ও নিষ্ঠা সহকারে তার প্রভুর সেবা করেন এবং বাহমনী রাজ্য পরিচালনা করেন। তিনি কোঙ্কনের হিন্দু রাজার বিদ্রোহ দমন করেন। তিনি সঙ্গমেশ্বরের রাজাকেও পরাস্ত করেন। তিনি বিজয়নগর রাজাকে পরাস্ত করে গোয়া বন্দর, রাজমান্দ্রী ও কোন্দাবির অধিকার করেন।
- (৩) তৃতীয় মহম্মদ উড়িষ্যার বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে প্রভূত ধনরত্ন ও বহু রণহস্তী পান। মহম্মদ শাহের রাজত্বকালের শেষের দিকে বাহমনী রাজ্যে বহু গণ্ডগোল দেখা দেয়। অনাবৃষ্টির দরুন বাহমনী রাজ্যে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়।
- (৪) এদিকে ঈর্ষাপরায়ণ মন্ত্রীদের কুপরামর্শে, তৃতীয় মহম্মদ শাহ তার সুযোগ্যমন্ত্রী মহম্মদ গাওয়ানের প্রাণদণ্ড দেন। দারুণ বিশৃঙ্খলার মধ্যে মহম্মদ শাহের ১৪৮২ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যু হয়।
মামুদ শাহ
তৃতীয় মহম্মদ শাহের মৃত্যুর পর বাহমনী রাজ্যে আর কোনো যোগ্য শাসক আসেন নি। তার পুত্র মামুদ শাহ ছিলেন অযোগ্য শাসক। তিনি দক্ষিণী ও বহিরাগত অভিজাতদের দ্বন্দ্ব মেটাতে ব্যর্থ হন। অভিজাতরা স্ব স্ব প্রধান হয়ে ওঠে।
বাহমণি রাজ্যের পতন
মামুদ শাহের মৃত্যুর পর তিন জন শাসক রাজত্ব করেন। কিন্তু তারা ছিলেন একান্তই অযোগ্য। বাহমনী বংশের শেষ রাজা ছিলেন কলিমুল্লাহ শাহ। ১৫২৭ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যু হলে বাহমনী বংশের পতন ঘটে।
উপসংহার :- বাহমনী রাজ্য ভেঙে পাচটি স্বাধীন রাজ্যের উদ্ভব হয় – বিজাপুরের আদিল শাহী রাজ্য, আহমদনগরের নিজাম শাহী রাজ্য, বেরারের ইমাদ শাহী রাজ্য, গোলকুণ্ডার কুতব শাহী রাজ্য ও বিদরের বারিদ শাহী রাজ্য।
(FAQ) বাহমনি রাজ্য সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
আলাউদ্দিন বাহমান শাহ, ১৩৪৭ খ্রিস্টাব্দে।
হাসান।
গুলবর্গা।
বিজয়নগর রাজ্য।
১৫২৭ খ্রিস্টাব্দে।