গিয়াসউদ্দিন বলবন প্রসঙ্গে পূর্ব জীবন, বলবনের উত্থান, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বলবন, বলবনের উচ্চাকাঙ্ক্ষা, সিংহাসন লাভ, মেওয়াটি দমন, বলবনের সামরিক সংগঠন, গুপ্তচর ব্যবস্থা ও মোঙ্গল নীতি সম্পর্কে জানবো।
সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবন
সুলতান | গিয়াসউদ্দিন বলবন |
পূর্ব নাম | উলুঘ খাঁ |
রাজত্ব | ১২৬৬-৮৬ খ্রি |
পূর্বসূরি | নাসিরুদ্দিন মামুদ শাহ |
উত্তরসূরি | কাইকোবাদ |
ভূমিকা :- দাস হিসেবে জীবন শুরু করলেও সুলতান ইলতুৎমিসের হাত ধরে গিয়াসউদ্দিন বলবনের উত্থান ঘটে। ইলতুৎমিসের চল্লিশ চক্র সমিতির প্রধান নায়ক ছিলেন গিয়াসউদ্দিন বলবন।
পূর্বজীবন
গিয়াসউদ্দিন বলবন ছিলেন জাতিতে ইলবারী তুর্কী। তিনি তুর্কীস্থানের এক খান বংশে জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু ভাগ্যদোষে বন্দী হয়ে ক্রীতদাসে পরিণত হন।
বলবনের উত্থান
- (১) বসরার খাজা জামালউদ্দিন তাঁকে দাস হিসেবে খরিদ করে শিক্ষা-দীক্ষা দেন এবং সুলতান ইলতুৎমিসের নিকট তাকে বিক্রি করেন। ইলতুৎমিস তাঁর কর্মদক্ষতায় সন্তুষ্ট হয়ে তাকে আমির-ই-শিকার পদে নিয়োগ করেন।
- (২) সুলতান ইলতুৎমিসের মৃত্যুর পর তার চল্লিশ ক্রীতদাসের সমিতির অন্যতম ছিলেন বলবন। রাজিয়ার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী আমীরদের অন্যতম নায়ক ছিলেন বলবন। সুলতান বাহারাম শাহ তাকে হান্সির শাসনকর্তার পদে নিয়োগ করেন।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বলবন
- (১) বাহারাম শাহের পর, আলাউদ্দিন মাসুদ শাহের শাসনকালে বলবন এক ক্ষমতাশালী আমীরে পরিণত হন। তিনি মাসুদ শাহের পতন ঘটিয়ে সুলতান নাসিরুদ্দিন মামুদ শাহকে বসাতে মুখ্য ভূমিকা নেন।
- (২) নাসিরুদ্দিন মামুদ শাহকে নামে মাত্র ক্ষমতায় রেখে বলবন নায়েব-ই-মামলিকা হিসেবে সকল ক্ষমতা অধিকার করেন। এই সময় তিনি বিদ্রোহী অঞ্চলগুলিকে দমন করে সাম্রাজ্যের ঐক্য রক্ষার চেষ্টা করেন। সুলতান নাসিরুদ্দিনের মৃত্যুর পর বলবন তুর্কী আমীরদের সাহায্যে নিজেই সিংহাসনে বসেন।
ইসামীর মন্তব্য
ঐতিহাসিক ইসামী বলেছেন যে, বলবন সুলতান নাসিরুদ্দিনকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করে সিংহাসন অধিকার করেন। নায়েব-ই-মামলিকাৎ হিসেবে কাজ করার সময় বলবন নিজ কন্যার সঙ্গে সুলতান নাসিরুদ্দিনের বিবাহ দেন। সুতরাং বলবন তাঁর নিজ জামাতা এবং একান্ত অনুগত যুবক সুলতানকে এরূপভাবে হত্যা করেন বলে অনেকে মনে করেন না।
বলবনের উচ্চাকাঙ্ক্ষা
- (১) অপর দিকে বলা হয় যে, মৃত্যুকালে নাসিরুদ্দিনের বয়স ছিল ৩৬ বৎসর আর বলবনের তখন বয়স ছিল ৫৬ বা ৬০ বৎসর। সুতরাং উচ্চাকাঙ্ক্ষী বলবন দেখেন যে, নাসিরুদ্দিনের জীবিতকালে তাঁর সুলতান হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
- (২) এজন্য তিনি নাসিরুদ্দিনকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করেন বলে অনেকে মনে করেন। সুলতান নাসিরুদ্দিনের অন্তত ৪ পুত্র ছিল। বংশানুক্রমিক শাসনের নিয়ম চালু থাকলে তারাই সিংহাসনে বসতেন। বলবন সিংহাসনে বসার ফলে তাঁদের ভাগ্যে কি ঘটেছিল তা সঠিক জানা যায়নি।
সিংহাসন লাভ
১২৬৫ খ্রিস্টাব্দে সুলতান নাসিরুদ্দিন মামুদ শাহের মৃত্যু হয়। এরপর তাঁর শ্বশুর ও প্রধান নায়ের গিয়াসউদ্দিন বলবন দিল্লীর সিংহাসনে বসেন। নায়েব-ই-মামলিকাৎ হিসেবে বলবনের শাসনকার্যে বহু অভিজ্ঞতা ছিল।
মেওয়াটী দমন
- (১) তিনি মেওয়াটী দস্যুদলকে দমনের জন্য দিল্লীর চতুর্দিকে জঙ্গলগুলি কাটাই করান। এই জঙ্গলে দস্যুরা বাসা বেঁধেছিল। তিনি দ্রুতগামী অশ্বারোহী বাহিনী দ্বারা বহু মেওয়াটীদের ধরে নিহত করেন। দিল্লীর চতুর্দিকে সামরিক ছাউনী ও থানা স্থাপন করেন।
- (২) মেওয়াটী দস্যুদের দমনের জন্য গোপালগিরে একটি দুর্গ স্থাপন করা হয়। মেওয়াটী গ্রামগুলি আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। মেওয়াটীদের জমিগুলি বাজেয়াপ্ত করে সাহসী তুর্কী সেনাদের বন্দোবস্ত দেওয়া হয়। বলবনের রক্ত ও লৌহ নীতির ফলে মেওয়াটী উপদ্রব দমিত হয়।
বলবনের সামরিক সংগঠন
- (১) বলবন বিশ্বাস করতেন যে, সুলতানি শক্তির প্রধান স্তম্ভ ছিল সেনাদল। বলবনের শাসন ছিল মূলত সামরিক শাসন। এজন্য তিনি সেনা সংগঠনের দিকে সতর্ক দৃষ্টি দেন। তিনি সেনা দপ্তরকে অন্যান্য দপ্তর থেকে আলাদা করে সংগঠন করেন।
- (২) তিনি সেনাদলে দক্ষ লোক নিয়োগ করে অভিজ্ঞ লোকেদের দ্বারা সেনাদের শিক্ষা ও সংগঠনের ব্যবস্থা করেন। তিনি সেনাদের বেতন বাড়ান। তিনি সেনা নিয়োগ কর্তা ও শৃঙ্খলা রক্ষা কর্তার উপাধি দেন দেওয়ান-ই-আরজ। তাঁর বিশ্বাসী কর্মচারী ইমাদ-উল-মূলককে তিনি এই পদে নিয়োগ করে তাঁর সাহায্যে সেনাদলে কঠোর শৃঙ্খলা স্থাপন করেন।
- (৩) তিনি সেনাদলকে নিয়মিত কুচ-কাওয়াজ বা আরিজ করতে বাধ্য করতেন। দেওয়ান-ই-আরজ সাম্রাজ্যের বিভিন্ন দুর্গরক্ষা ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সেনা স্থাপনের কাজও করতেন। তিনি গোপনে রণপরিকল্পনা রচনা করতেন। যুদ্ধক্ষেত্রে সেনাদল যাতে অসামরিক লোক ও দরিদ্র লোকদের ওপর অত্যাচার না করে সেদিকে তিনি কড়া নজর রাখতেন।
গুপ্তচর ব্যবস্থা
বলবন তাঁর সাম্রাজ্যের খবর রাখার জন্য বহু গুপ্তচর বা বারিদ নিয়োগ করেন। এই গুপ্তচররা সাম্রাজ্যের সর্বত্র খবর যোগাড় করত। বলবন গুপ্তচর নিয়োগে সতর্কতা নিতেন। সৎ ও দায়িত্বশীল লোকেদের তিনি এই পদ দিতেন। স্ট্যানলি লেনপুলের মতে, “বলবনের রাজ্যে এমন কিছু ছিল না গুপ্তচররা যার খবর রাখত না। এই গুপ্তচরদের ভয়ে বিদ্রোহী আমীররা সন্ত্রস্ত থাকত।
মোঙ্গল নীতি
- (১) বলবন মোঙ্গল আক্রমণকে তাঁর রাজ্যের নিরাপত্তার সর্বপ্রধান বাধা বলে মনে করতেন। এজন্য তিনি সীমান্তে বহু দুর্গ স্থাপন করে তাতে অভিজ্ঞ রণকুশলী আফগান সেনা বসিয়ে রাখেন। সমগ্র অঞ্চলের দায়িত্ব তিনি তাঁর আত্মীয় বিখ্যাত যোদ্ধা শের খানের হাতে দেন।
- (২) ১২৭০ খ্রিস্টাব্দে শের খানের মৃত্যু হলে বলবন সমগ্র উত্তর-পশ্চিম সীমান্তকে দুভাগে ভাগ করেন। মূলতান, সিন্ধু ও লাহোরের দায়িত্ব তিনি দেন তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র মহম্মদের হাতে। পাঞ্জাবের সুনাম, দীপালপুর ও সামানার দায়িত্ব দেন তাঁর দ্বিতীয় পুত্র বুঘরা খানের হাতে। এঁদের অধীনে সেনাদল উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল রক্ষায় নিযুক্ত হয়।
উপসংহার :- বলবনের শাসনব্যবস্থা রক্ত ও লৌহ নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। জনকল্যাণমূলক সংস্কার দ্বারা তিনি তার শাসনব্যবস্থার ভিত মজবুত করা থেকে বিরত থাকেন।
(FAQ) গিয়াসউদ্দিন বলবন সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
উলুঘ খাঁ।
গিয়াসউদ্দিন বলবন।
গিয়াসউদ্দিন বলবন।
১২৬৬-১২৮৭ খ্রিস্টাব্দ।