সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহ প্রসঙ্গে জন্ম ও পূর্ব পরিচয়, উজির পদ লাভ, নতুন ও অনুগত লোকেদের নিয়োগ, বাংলাদেশের সীমানা বিস্তার, কামতা রাজ্য আক্রমণ, উড়িষ্যা আক্রমণ, ত্রিপুরা রাজ্য জয়, আরাকানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, বিহার ও নেপালে অভিযান সম্পর্কে জানবো।
সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহ
সুলতান | আলাউদ্দিন হুসেন শাহ |
সময়কাল | ১৪৯৩-১৫১৯ খ্রি: |
বংশ | হুসেন শাহী বংশ |
পূর্ব শাসন | হাবসি শাসন |
উত্তরসূরি | নসরৎ শাহ |
ভূমিকা :- হাবসি শাসনে বঙ্গদেশের এক অন্ধকারময় যুগের সূচনা হয়। বঙ্গদেশের আপামর জনসাধারণ এই হাবসি শাসনে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে।
হুসেন শাহ সম্পর্কে নিজামউদ্দিনের অভিমত
নিজামউদ্দিনের মতে, মুজাফ্ফর শাহের বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমান ‘উজির’ সৈয়দ হুসেন কোনোক্রমে মুজাফ্ফর শাহের হাত থেকে বঙ্গদেশকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে গোপনে বিদ্রোহীদের নেতৃত্ব দেন।
হুসেন শাহর আগমনে অন্ধকারময় শাসনের অবসান
সম্ভবত ১৪৯৩ খ্রিস্টাব্দে সৈয়দ হুসেন মুজাফ্ফরকে হত্যা করে আলাউদ্দিন হুসেন শাহ উপাধি নিয়ে সিংহাসনে বসেন। মুজাফ্ফরের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গদেশে এক অন্ধকারময় শাসনের অবসান ঘটে।
হুসেন শাহী বংশ
আলাউদ্দিন হুসেন শাহের সিংহাসনে আরোহণের সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গদেশে এক নতুন রাজবংশের উত্থান ঘটে। এই রাজবংশ ইতিহাসে হুসেন শাহী বংশ নামে খ্যাত এবং এই রাজবংশ প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে বঙ্গদেশে এক গৌরবময় শাসনের সূচনা করে।
বিখ্যাত ব্যক্তি হুসেন শাহ
সবদিক দিয়ে বিচার করলে, বঙ্গদেশের স্বাধীন সুলতানদের মধ্যে আলাউদ্দিন হুসেন শাহই সবচেয়ে বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব। আলাউদ্দিন হুসেন শাহের জীবন খুবই রহস্যাবৃত।
হুসেন শাহর জন্ম ও পূর্ব পরিচয়
- (১) মুদ্রা ও লিপি থেকে জানা যায় যে, তিনি সৈয়দ বংশ-এ জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ‘রিয়াজ’-এর মতে, হুসেন শাহ তাঁর পিতার সঙ্গে আরব থেকে বঙ্গদেশে এসেছিলেন এবং মুর্শিদাবাদ জেলার চাঁদপাড়া গ্রামে প্রথম বসতি স্থাপন করেছিলেন।
- (২) কিন্তু ফ্রান্সিস বুকাননের মতে, হুসেন শাহ রংপুরের দেবনগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বাবর তাঁর আত্মজীবনী বাবরনামাতে হুসেন শাহের পুত্র নসরৎ শাহকে নসরৎ শাহ বাঙালি বলে উল্লেখ করেছেন।
হুসেন শাহর উজির পদ লাভ
প্রকৃতপক্ষে হুসেন শাহের প্রথম জীবন অজ্ঞাত হলেও, তিনি নিজ প্রতিভার বলে মুজাফ্ফর শাহের ‘উজির’ পদে অভিষিক্ত হয়েছিলেন।
হুসেন শাহর সময় শান্তি ও সমৃদ্ধির পথে পরিচালিত বাংলা
- (১) হাবসি কুশাসনে বঙ্গদেশে যে অন্ধকারময় যুগের সূচনা হয়, আলাউদ্দিন হুসেন শাহ সেই কুশাসন থেকে বঙ্গদেশকে মুক্ত করে শান্তি ও সমৃদ্ধির পথে পরিচালিত করতে যত্নবান হন।
- (২) এই উদ্দেশ্যে প্রথমেই তিনি হাবসি প্রাসাদরক্ষী সেনাদলের ক্ষমতা সঙ্কুচিত করে, তাদের বঙ্গদেশ থেকে বিতাড়িত করেন। তিনি কঠোর হস্তে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রবর্তন করেন।
হুসেন শাহ কর্তৃক নতুন ও অনুগত লোকেদের নিয়োগ
পুরাতন আমলের কর্মচারীদের বরখাস্ত করে, তিনি সমস্ত দপ্তরে নতুন ও নিজের অনুগত লোকদের নিয়োগ করেন। দেশের সর্বত্র অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা কঠোর হাতে দমন করেন। বহু ধনসম্পত্তি উদ্ধার করেন।
হুসেন শাহ সম্পর্কে ফিরিস্তার অভিমত
ফিরিস্তার মতে, বঙ্গদেশে তখন ধনী ব্যক্তিরা উৎসবে সোনার থালা ব্যবহার করতেন। আলাউদ্দিন হুসেন শাহ এরকম প্রায় তেরোশো সোনার থালা উদ্ধার করেন।
আলাউদ্দিন হুসেন শাহ সম্পর্কে সাহিত্যের প্রমাণ
হুসেন শাহ সিংহাসনে আরোহণ করেই অল্প সময়ের মধ্যে বঙ্গদেশে যে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন, তার প্রমাণ সমসাময়িক সাহিত্যেও পাওয়া যায়। হাবসিদের তিনি বিতাড়িত করে মুঘল ও আফগানদের উচ্চপদে নিয়োগ করেন।
হুসেন শাহর আমলে বঙ্গদেশের সীমানা বিস্তার
তাঁর সিংহাসনে আরোহণের সময়, সমগ্র উত্তর ভারতে বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য চলছিল এবং উত্তর ভারতের অধিকাংশ শাসক তখন স্বাধীন হয়ে যায়। এই সুযোগে হুসেন শাহ বঙ্গদেশের তিন খণ্ডকে একই সার্বভৌম ক্ষমতার অধীনে এনে বঙ্গদেশে রাজনৈতিক ঐক্য সম্পন্ন করেন এবং সামরিক বিজয়ের মাধ্যমে বঙ্গদেশের সীমানা বহুদুর বিস্তার করেন।
হুসেন শাহর সময় সিকান্দার শাহ লোদীর বাংলা আক্রমণ
১৪৯৫ খ্রিস্টাব্দে জৌনপুরের রাজ্যচ্যুত সুলতান হুসেন শাহ শার্কি দিল্লির সুলতান সিকান্দার লোদীর কাছে পরাজিত হয়ে বঙ্গদেশে পালিয়ে আসেন এবং বঙ্গদেশের সুলতান হুসেন শাহ তাঁকে আশ্রয় দেন। এতে ক্রুদ্ধ হয়ে সিকন্দার শাহ বঙ্গদেশের বিরুদ্ধে এক বাহিনী প্রেরণ করেন।
সিকান্দার লোদী ও হুসেন শাহর মধ্যে সন্ধি স্থাপন
শেষ পর্যন্ত উভয়পক্ষের মধ্যে এক সন্ধি স্থাপিত হয়। উভয়পক্ষই পরস্পরের সীমানা লঙ্ঘন না করতে প্রতিশ্রুত হয় এবং হুসেন শাহ এই প্রতিশ্রুতি দেন যে, তিনি আশ্রয়প্রাপ্ত জৌনপুরের সুলতানকে কোনো রাজনৈতিক উচ্চাশা পূরণের সুযোগ দেবেন না। অতঃপর সিকদার শাহ দিল্লি ফিরে যান। দিল্লির পরাক্রান্ত সুলতানের সঙ্গে সংঘর্ষের এই সম্মানজনক সন্ধি হুসেন শাহের মর্যাদা ও প্রাধান্য বৃদ্ধি করে।
হুসেন শাহর কামতা রাজ্য আক্রমণ
১৪৯৯ থেকে ১৫০২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে হুসেন শাহ আসামের কামতা রাজ্য আক্রমণ করেন এবং কামরূপ জেলা পর্যন্ত বঙ্গদেশের সীমানা বিস্তার করেন। হুসেনের কামতা রাজ্য আক্রমণের বিজয়ে অনেক ঐতিহাসিক সন্দেহ পোষণ করলেও এটা যে ঐতিহাসিক সত্য, তা ‘রিয়াজ’ ও বুকাননে’র বিবরণীতে সমর্থন মেলে।
উড়িষ্যার সাথে হুসেন শাহর যুদ্ধ
- (১) মেদিনীপুর ও হুগলির আরামবাগ অঞ্চল উড়িষ্যার প্রভাবাধীন ছিল। এই প্রভাব উৎখাত করার জন্য হুসেন শাহ দীর্ঘকাল উড়িষ্যার সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন এবং তাতে কিছুটা সফলও হয়েছিলেন। উড়িষ্যার প্রতাপরুদ্রদেব মান্দারণ দুর্গ অবরোধ করেও তা অধিকার করতে ব্যর্থ হন।
- (২) উড়িষ্যার রাজার সঙ্গে হুসেন শাহের দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রাম শুরু হয়। এমনকি, ১৫১৫ খ্রিস্টাব্দে হুসেন শাহ স্বয়ং উড়িষ্যা অভিযানে নেতৃত্ব দেন। কিন্তু কোনো পক্ষই এই সংগ্রামে লাভবান হয়েছিল বলে মনে হয় না।
হুসেন শাহর ত্রিপুরা রাজ্য জয়
‘রাজমালা’ থেকে জানা যায় যে, ত্রিপুরা রাজ্যের সঙ্গেও হুসেন শাহের দীর্ঘকালীন সংগ্রাম চলেছিল। এই সংগ্রামের ফলে ত্রিপুরার সামান্য অঞ্চল দখল করা ছাড়া আর বিশেষ কোনো লাভ হয় নি। তবে কবীন্দ্র পরমেশ্বর তাঁর মহাভারতে লিখেছেন হুসেন শাহ ত্রিপুরা জয় করেছিলেন। শ্রীকর নন্দীও তাঁর মহাভারতে হুসেন শাহের ত্রিপুরা রাজ্য জয়ের কথা বলেছেন।
আরাকানের বিরুদ্ধে হুসেন শাহর যুদ্ধ
১৫১৩ থেকে ১৫১৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে হুসেন শাহ কয়েকবার আরাকানের বিরুদ্ধে অবতীর্ণ হন। কারণ, ত্রিপুরার বিরুদ্ধে যুদ্ধে আরাকানিরা ত্রিপুরার রাজা ধনমাণিক্যকে সাহায্য করেছিল। আরাকানিদের কাছ থেকে চট্টগ্রাম অধিকার করতে সমর্থ হয়েছিলেন এবং আরাকানরাজ হুসেন শাহের সামন্তে পরিণত হয়েছিলেন।
বিহার ও নেপালে অভিযান
হুসেন শাহ রিয়তের কিয়দংশ সমেত বর্তমান বিহার রাজ্যের বিস্তর অংশ জয় করেছিলেন। এমনকি, তিনি নেপাল-এর রাজধানী কাঠমাণ্ডু পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছিলেন বলে অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন।
হুসেন শাহর রাজ্যের আয়তন
প্রকৃতপক্ষে হুসেন শাহের রাজ্যের আয়তন অত্যন্ত বিশাল ছিল। বঙ্গদেশের প্রায় সমস্তটা এবং বিহারের এক বিরাট অংশ তাঁর রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এছাড়া কামরূপ রাজ্য ও কামতা রাজ্য এবং উড়িষ্যা ও ত্রিপুরার কিয়দংশ সাময়িকভাবে তাঁর রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।
স্থায়ী ফললাভে অসমর্থ হুসেন শাহ
- (১) পর্তুগিজদের বিতাড়িত করে বাংলার নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করেছিলেন। কিন্তু তাসত্বেও তাঁর রাজনৈতিক বিজয়ে স্থায়ী ফললাভ করতে পারেন নি বলে অনেকে মনে করেন। কারণ তিনি বহু যুদ্ধ করেছেন, অর্থ ব্যয় করেছেন কিন্তু কোনোটিতেই স্থায়ী ফললাভ করতে পারেন নি।
- (২) কোনো কোনো ক্ষেত্রে তিনি চুক্তি করেছেন বা সামান্য ভূখণ্ড জয় করেই প্রত্যাবর্তন করেছেন। স্থায়িত্বলাভের জন্য রাজনৈতিক দিক থেকে যা করণীয় তা তিনি করেননি। ফলে অর্থ, শ্রম, শক্তি ও সময় যে পরিমাণ ব্যয় করেছেন সে তুলনায় রাজ্যের কল্যাণ হয়েছিল সামান্যই।
উপসংহার :- আলাউদ্দিন হুসেন শাহ যে দীর্ঘ ছাব্বিশ বছর ধরে প্রশাসনিক দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন তা সুনিশ্চিতভাবে বলা যায়।
(FAQ) সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
আলাউদ্দিন হুসেন শাহ।
১৪৯৩ খ্রিস্টাব্দে।
হাবসি শাসন।
নসরৎ শাহ।