মধ্যযুগের ইউরোপের নগরায়ন

মধ্যযুগের ইউরোপের নগরায়ন প্রসঙ্গে তৎকালীন ইউরোপের প্রধান প্রধান শহর বা নগর, নগর সম্পর্কে হেনরি পিরেনের মন্তব্য, ইউরোপে নগরের বিকাশের কারণ হিসেবে বর্বর আক্রমণের তীব্রতা হ্রাস, সামন্ত প্রথার প্রসার, কৃষির উন্নতি, বাণিজ্যের প্রসার, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা, প্রাসাদ দুর্গ, প্রাচীর, ভৌগোলিক অবস্থান, দর্শনীয় স্থান ও সামরিক কেন্দ্র সম্পর্কে জানব।

ইউরোপের নগরায়ন প্রসঙ্গে মধ্যযুগের ইউরোপের প্রধান প্রধান শহর ও নগর, ইউরোপে নগরের বিকাশের কারণ, মধ্যযুগের ইউরোপের নগরগুলির উৎপত্তির সর্বজনগ্রাহ্য একটি বিশ্লেষণী ব্যাখ্যা সম্ভব নয়, ইউরোপে নগর জীবনের বিস্তার, মধ্যযুগের ইউরোপে নগর শহরের উত্থান ও বিকাশ সম্পর্কে জানব।  

মধ্যযুগের ইউরোপের নগরায়ন

ঐতিহাসিক ঘটনাইউরোপে নগরায়ণ
ইংল্যান্ডলণ্ডন, ব্রিস্টল
ফ্রান্সপ্যারিস, মার্সেই
জার্মানিহামবুর্গ, মিউনিখ
ইতালিফ্লোরেন্স, মিলান, পিসা
রাশিয়ামস্কো, কাজান
মধ্যযুগের ইউরোপের নগরায়ন

ভূমিকা :- মধ্যযুগের প্রথমার্ধে বিভিন্ন বর্বর জাতির আক্রমণে ইউরোপ-এ যে অস্থিরতা, বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য দেখা দেয় তার ফলে সেখানকার অর্থনীতি ও প্রাচীন নগরগুলি ভেঙে পড়েছিল। ইউরোপে সামন্তপ্রথা সুপ্রতিষ্ঠিত হলে নগরের বিকাশের পরিবর্তে গ্রামীণ সমাজ ও অর্থনীতির ভিত সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীকালে অশান্তি ও অস্থিরতা দূর হলে খ্রিস্টীয় নবম শতকে ইউরোপে আবার আর্থসামাজিক অগ্রগতি শুরু হয়। এর ফলে খ্রিস্টীয় নবম শতক থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যবর্তীকালে ইউরোপে একদিকে প্রাচীন ও ক্ষয়িষ্ণু নগরগুলি নতুন করে জেগে ওঠে এবং অন্যদিকে বিভিন্ন নতুন নতুন শহরের উত্থান ঘটে। এই ঘটনা ইউরোপের ‘নগর- বিপ্লব’ নামে পরিচিত।

তৎকালীন ইউরোপের প্রধান প্রধান শহর বা নগর

মধ্যযুগে, বিশেষ করে ১০০০-১৩০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পুরাতন ও নতুন বেশ কিছু নগরের অস্তিত্ব ছিল। এর মধ্যে প্রধান শহর বা নগরগুলি ছিল –

(১) ইংল্যান্ড

ইংল্যান্ডের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলি ছিল লন্ডন, অক্সফোর্ড, কেম্ব্রিজ, ব্রিস্টল প্রভৃতি।

(২) ফ্রান্স

ফ্রান্সের প্রধান শহরগুলি ছিল প্যারিস, মার্সেই, অর্লিয়েন্স, নারবোনে, মন্টপেলিয়ার প্রভৃতি।

(৩) জার্মানি

জার্মানির প্রধান শহরগুলি ছিল হামবুর্গ, নুরেনবার্গ, মিউনিক, ব্রেমেন প্রভৃতি।

(৪) ইতালি

ইতালির প্রধান শহরগুলি ছিল ফ্লোরেন্স, ফ্লানডার্স, মিলান, ভেনিস, জেনোয়া, পিসা প্রভৃতি।

(৫) অন্যান্য দেশ

এছাড়া অন্যান্য দেশে অবস্থিত উল্লেখযোগ্য নগরগুলি ছিল মস্কো, কিয়েভ, কনস্ট্যান্টিনোপল, বার্সেলোনা, অ্যান্টোয়ার্প প্রভৃতি।

ইউরোপের নগরায়ন সম্পর্কে হেনরি পিরেনের অভিমত

ঐতিহাসিক হেনরি পিরেন মনে করেন যে, মধ্যযুগে ইউরোপের কৃষিনির্ভর অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় নগরের উৎপত্তির বিষয়টি খুবই সময়সাপেক্ষ ছিল। তবে দশম-একাদশ শতকে বাণিজ্যের প্রসার ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে ইউরোপে নগর প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয়।

ইউরোপে নগরের বিকাশের কারণ

মধ্যযুগে একাদশ শতক থেকে চতুর্দশ শতকের মধ্যে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে নগরজীবনের যথেষ্ট প্রসার ঘটে। এর প্রধান কারণগুলি হল –

(ক) বর্বর আক্রমণের তীব্রতা হ্রাস

পঞ্চম শতক থেকে ইউরোপে বারংবার বর্বর জাতির আক্রমণে যে অরাজকতা ও নৈরাজ্য দেখা দিয়েছিল তার ফলে বহু প্রাচীন শহর অবক্ষয়ের সম্মুখীন হয়েছিল। পরবর্তীকালে বর্বর আক্রমণের তীব্রতা হ্রাস পেলে প্রাচীন শহরগুলি আবার নতুনভাবে জেগে ওঠে। পরিস্থিতির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বহু স্বাধীন কৃষক ও ভূমিদাস গ্রাম ছেড়ে এই সব শহরে চলে এলে শহরগুলি আবার প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে।

(খ) সামন্তপ্রথার প্রসার

সামন্তপ্রথা আপাত দৃষ্টিতে নগরজীবনের বিরোধী এবং গ্রামজীবনের সহায়ক হলেও ইউরোপে মধ্যযুগে সামন্ততন্ত্র-এর প্রসার পরোক্ষে নগরজীবনের প্রসারে সহায়তা করেছিল। বর্বর জাতিগুলির বারংবার আক্রমণে পঞ্চম শতক থেকে ইউরোপে যে অশান্তি, নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা চলছিল তা দূর করতেই সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব ঘটে। সামন্তপ্রভুদের শাসনে ইউরোপের অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা দূরীভূত হয়। এই শান্তি ও সমৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে ইউরোপে নগর সভ্যতার বিকাশ ঘটতে থাকে।

(গ) কৃষির উন্নতি

  • (১) জমিতে সার প্রয়োগ, উন্নত কৃষি প্রযুক্তির ব্যবহার প্রভৃতির ফলে একাদশ শতক থেকে ইউরোপে কৃষির যথেষ্ট অগ্রগতি ঘটে। এই সময় থেকে কৃষকের হাতে উদ্‌বৃত্ত শস্য জমা হয়। উদবৃত্ত ফসলের ওপর ভিত্তি করে শিল্পেরও বিকাশ শুরু হয়।
  • (২) এই কৃষিপণ্য ও শিল্পজাত সামগ্ৰী বিক্রির উদ্দেশ্যে গ্রাম্য হাট, মেলা প্রভৃতির পথ চলা শুরু হয়। পণ্য ক্রয়বিক্রয়ের কেন্দ্র হিসেবে এই সব স্থান ক্রমে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। বিভিন্ন পেশার বহু মানুষ এই সব স্থানে বসবাস শুরু করলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায়। এই ভাবে এই সব স্থান শহরে পরিণত হয়।

(ঘ) বাণিজ্যের প্রসার

  • (১) সামন্ততন্ত্রের মাধ্যমে ইউরোপে শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরে এলে সেখানে শিল্প, ব্যাবসাবাণিজ্য প্রভৃতির প্রসার ঘটতে শুরু করে। তা ছাড়া খ্রিস্টানদের পবিত্রভূমি জেরুজালেমের অধিকারকে কেন্দ্র করে খ্রিস্টান ও মুসলিম ধর্মযোদ্ধাদের মধ্যে দীর্ঘ প্রায় ২০০ বছর ধরে (১০৯৬-১২৯১ খ্রি.) বেশ কয়েকটি ধর্মযুদ্ধ বা ক্রুসেড অনুষ্ঠিত হয়।
  • (২) এর ফলে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপিত হয় এবং প্রাচ্যের বিভিন্ন পণ্যসামগ্রীর সঙ্গে ইউরোপীয়রা পরিচিত হয়। ক্রমে প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের মধ্যে বাণিজ্যের অগ্রগতির ফলে বণিক, শিল্পী, কারিগর, শ্রমিক ও অন্যান্যদের বাসস্থান এবং পণ্য ক্রয়বিক্রয়ের কেন্দ্র হিসেবে নদী ও সমুদ্রের উপকূলে বিভিন্ন শহর প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে।

(ঙ) ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা

  • (১) মধ্যযুগে ইউরোপে অসংখ্য চার্চ ও মঠ স্থাপিত হয়। স্থানীয় এলাকায় বহিরাগত আক্রমণের সময় এই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলি স্থানীয় মানুষদের আশ্রয় ও নিরাপত্তা দিত। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠান গুলির অধীনে থাকা বিপুল পরিমাণ ভূসম্পত্তিতে প্রচুর কৃষক ও শ্রমিক কাজ পেত।
  • (২) এই সব কারণে যে সব অঞ্চলে চার্চ ও মঠগুলি অবস্থিত ছিল সেই অঞ্চলে জনসংখ্যা ক্রমে বাড়তে থাকে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এখানে বিভিন্ন ধরনের পেশার সূত্রপাত ঘটে। এই ভাবে এই অঞ্চল ক্রমে শহরে পরিণত হয়।

(চ) প্রাসাদ দুর্গ

মধ্যযুগে সামন্তপ্রভু দুর্গবেষ্টিত সুবিশাল প্রাসাদে বসবাস করত। এই প্রাসাদ-দুর্গগুলি স্থানীয় শাসনকেন্দ্র এবং বহিরাক্রমণের সময় স্থানীয় মানুষের আশ্রয়স্থল হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। ফলে মানুষ নিরাপত্তা ও অন্যান্য প্রয়োজনে প্রাসাদ দুর্গের নিকটবর্তী অঞ্চলে বসতি গড়ে তুললে এখানে জনসংখ্যা বাড়তে থাকে এবং ক্রমে তা শহরে পরিণত হয়।

(ছ) দুর্গ প্রাচীর

  • (১) পঞ্চম শতক থেকে ইউরোপে বর্বর আক্রমণ বৃদ্ধি পেলে বিভিন্ন অঞ্চল প্রাচীর দ্বারা সুরক্ষিত করার উদ্যোগ শুরু হয়। সম্রাট কনস্টানটাইনের আমল থেকেই এরূপ দুর্গ-প্রাচীর নির্মাণের কাজ শুরু হয়।
  • (২) পরবর্তীকালে শার্লামেন-এর মৃত্যুর (৮১৪ খ্রি.) পর নতুন করে বর্বর আক্রমণ শুরু হলে প্রশাসনিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলগুলি প্রাচীর দিয়ে ঘিরে সুরক্ষিত করা হয়। এইসব প্রাচীরবেষ্টিত স্থানগুলিতে নিরাপত্তার ছত্রছায়ায় ব্যাবসাবাণিজ্য, শিল্প প্রভৃতির বিকাশ ঘটে এবং জনবসতি বাড়তে থাকে। এই স্থানগুলি ক্রমে শহরে পরিণত হয়।

(জ) ভৌগোলিক অবস্থান

মধ্যযুগে জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং নতুন নতুন পেশার সৃষ্টি হতে থাকলে মানুষ জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে সুবিধাজনক ভৌগোলিক অঞ্চলে বসতি স্থাপন করতে থাকে। নদী বা সমুদ্রের উপকূল, পাহাড়ের গিরিপথের নিকটবর্তী অঞ্চল, প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ অঞ্চল প্রভৃতি স্থানগুলিতে মানুষের বসতি বাড়তে থাকে। এরূপ স্থানগুলি ক্রমে শহরে পরিণত হয়। ভৌগোলিক সুবিধার জন্যই অক্সফোর্ড, কেম্ব্রিজ প্রভৃতি স্থানগুলি জনবহুল শহরে পরিণত হয়েছিল।

(ঝ) দর্শনীয় স্থান

দর্শনীয় স্থান হিসেবে প্রাচীন রোম ও অন্যান্য নগরীর পুনরুজ্জীবন ঘটে।

(ঞ) শিক্ষাকেন্দ্র

শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে প্যারিস, প্যালারামো প্রভৃতি স্থান সুপরিচিত হয়ে ওঠে।

(ট) স্থায়ী রাজধানী

এই যুগে স্থায়ী রাজধানী গড়ে ওঠার ফলে ইউরোপের প্রতিটি দেশেই চেস্টার বা ব্রিস্টলের মতো একটি করে রাজধানী শহরের উৎপত্তি ঘটে।

(ঠ) সামরিক কেন্দ্র

সামরিক কেন্দ্র হিসেবে ওয়েলস-এর মতো স্থানগুলি শহরে পরিণত হয় ।

কবি দার্শনিকদের গ্ৰাম্য জীবন

প্রাচীন গ্রিস ও রোমে নগরের গুরুত্ব বজায় থাকলেও ভার্জিল, সিসেরো, ভ্যারো, ক্যাটো প্রমুখ কবি, রাজনীতিক ও দার্শনিকদের কাছে নগরজীবনের তুলনায় গ্রামজীবনই বেশি পছন্দের ছিল। তা সত্ত্বেও মধ্যযুগে বিভিন্ন নগরের উৎপত্তি ঘটলে ইউরোপের বহু মানুষ এগুলিতে বসবাস শুরু করেছিল

উপসংহার :- প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্য-এর নগরগুলির ওপর ভিত্তি করেই ফ্রান্স, ইটালি প্রভৃতি দেশের বিভিন্ন নগরীগুলি গড়ে উঠেছিল। লন্ডন, ক্যান্টারবেরি, উইনচেষ্টার, লিঙ্কন প্রভৃতি নগরগুলিও এই ভাবেই গড়ে উঠেছিল বলে অনেকে মনে করেন।

(FAQ) মধ্যযুগের ইউরোপের নগরায়ন সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. ইউরোপে নগরায়নের সূচনা হয় কখন?

নবম শতক থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যে।

২. ইংল্যান্ডের দুটি গুরুত্বপূর্ণ শহর বা নগর এর নাম লেখ।

 লন্ডন, অক্সফোর্ড।

৩. ফ্রান্সের দুটি গুরুত্বপূর্ণ শহর বা নগরের নাম লেখ।

 প্যারিস, মার্সেই।

৪. জার্মানির দুটি গুরুত্বপূর্ণ শহরের নাম লেখ।

মিউনিখ, হামবুর্গ।

৫. ইতালির দুটি গুরুত্বপূর্ণ শহরের নাম লেখ।

ফ্লোরেন্স, মিলান, পিসা।

Leave a Comment