ভিয়েনা সম্মেলন -এর সময়কাল, স্থান, সম্মেলন স্থগিত, পুনরায় সম্মেলনের কাজ, আন্তর্জাতিক সম্মেলন, অস্ট্রিয়ার সম্রাটের অর্থ ব্যয়, প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলন, রাজাদের উপস্থিতি, উপস্থিত কূটনীতিক, গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সমাবেশ, চার প্রধান, সম্মেলনের শোভাবর্ধনকারী, প্রধান ব্যক্তিত্ব, সভাপতি, রাশিয়ার প্রতিনিধি, ফ্রান্সের প্রতিনিধি, সমস্যা, মিত্রপক্ষের পারস্পরিক দাবি, প্রকাশ্যে ঘোষণা ও প্রকৃত ঘোষণা সম্পর্কে জানবো।
ভিয়েনা সম্মেলন বা বন্দোবস্ত
ঐতিহাসিক ঘটনা | ভিয়েনা সম্মেলন |
সময়কাল | নভেম্বর ১৮১৪ – নভেম্বর ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দ |
স্থান | ভিয়েনা |
উদ্দেশ্য | নেপোলিয়ন পরবর্তী ইউরোপ-এর পুনর্গঠন |
সভাপতি | প্রিন্স মেটারনিখ |
সম্পাদক | ফ্রেডারিখ ভন জেনৎস |
অনুপস্থিত | পোপ ও তুরস্ক |
ভূমিকা :- নেপোলিয়নের নির্বাসনের পর ইউরোপীয় রাজ্যগুলির পুনর্গঠন, সীমানার পুনর্বিন্যাস এবং নেপোলনীয় যুদ্ধের ফলে উদ্ভূত অপরাপর নানা সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে ইউরোপীয় শক্তিবর্গ ১৮১৪ খ্রিস্টাব্দের ১লা নভেম্বর অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনাতে এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে মিলিত হয়।
ভিয়েনা সম্মেলন সাময়িক স্থগিত
ইতিমধ্যে নেপোলিয়ন অকস্মাৎ ফ্রান্স -এ প্রত্যাবর্তন করলে ১লা মার্চ ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে ইউরোপীয় নেতৃমণ্ডলী সাময়িকভাবে সম্মেলনের কাজ স্থগিত রাখে।
পুনরায় ভিয়েনা সম্মেলনের কাজ শুরু
ইউরোপীয় শক্তিবর্গ নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন এবং ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দের ১৮ই জুন ওয়াটার্লুর যুদ্ধ -এ তাঁর চূড়ান্ত পরাজয়ের পর পুনরায় সম্মেলনের কাজকর্ম শুরু হয়।
আন্তর্জাতিক সম্মেলন ভিয়েনা সম্মেলন
বিভিন্ন দেশের রাজা, রাজনীতিজ্ঞ ও সাংবাদিকদের উপস্থিতির ফলে ভিয়েনা সম্মেলন এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের রূপ ধারণ করে। ইউরোপে এর আগে এত জাঁকজমকপূর্ণ সম্মেলন আর হয় নি।
ভিয়েনা সম্মেলনে অস্ট্রিয়ার সম্রাটের অর্থ ব্যয়
অস্ট্রিয়ার সম্রাট প্রথম ফ্রান্সিস এই সম্মেলনে যোগদানকারী প্রতিনিধিদের জন্য প্রতিদিন ১০ হাজার পাউন্ড মুদ্রা ব্যয় করতেন।
প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলন ভিয়েনা সম্মেলন
১৮১৫ খ্রিস্টাব্দের এই সম্মেলন সমগ্র ইউরোপ তথা সমগ্র বিশ্বের ইতিহাসে প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলন। বস্তুত এত বড়ো রাজনৈতিক সমাবেশ ইতিপূর্বে আর কখনও অনুষ্ঠিত হয় নি। পোপ ও তুরস্কের সুলতান ছাড়া ইউরোপের সব দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা এই সম্মেলনে যোগ দেন।
ভিয়েনা সম্মেলনে রাজাদের উপস্থিতি
সমসাময়িক তিনজন রাজা – অস্ট্রিয়ার প্রথম ফ্রান্সিস, প্রাশিয়ার তৃতীয় ফ্রেডারিক উইলিয়ম এবং রাশিয়া -র প্রথম আলেকজান্ডার এই সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।
ভিয়েনা সম্মেলনে উপস্থিত কূটনীতিক
কুটনীতিকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন অস্ট্রিয়ার প্রধানমন্ত্রী মেটারনিখ, ইংল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্যাসালরি ও ডিউক অফ ওয়েলিংটন, প্রাশিয়ার মন্ত্রী হার্ডেনবার্গ ও হামবোল্ড, রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী নেসেলরোড। এছাড়াও এখানে উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন ছোটো ছোটো দেশের রাজা ও ঐতিহাসিক।
গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সমাবেশ ভিয়েনা সম্মেলন
হ্যাজেন-এর মতে, এই সম্মেলনে আলোচিত সমস্যাবলীর জটিলতা, ব্যাপকতা, গৃহীত সিদ্ধান্ত, গুরুত্ব এবং সম্মেলনে যোগদানকারী প্রতিনিধিদের সংখ্যা ও কূটনীতিজ্ঞরা। মর্যাদার কথা বিবেচনা করে একে ইউরোপের ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সমাবেশ বলা যায়।
ভিয়েনা সম্মেলনে চার প্রধান
ইউরোপের সব দেশের কূটনীতিকরা এই সম্মেলনে উপস্থিত থাকলেও, নেপোলিয়নের পতন -এ বিশিষ্ট ভূমিকা গ্রহণকারী চারটি রাষ্ট্র – অস্ট্রিয়া, রাশিয়া, প্রাশিয়া ও ইংল্যান্ড এই সম্মেলনে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করে। এই চার শক্তি ‘চার প্রধান’ বা ‘Big Four’ নামে পরিচিতি লাভ করে।
ভিয়েনা সম্মেলনের শোভাবর্ধনকারী
এই চার শক্তি ব্যতীত সম্মেলনে যোগদানকারী অন্যান্য প্রতিনিধিদের বিশেষ কোনও ভূমিকা ছিল না, তাঁরা সম্মেলনের শোভাবর্ধনকারী ছিলেন মাত্র।
ভিয়েনা সম্মেলনের প্রধান ব্যক্তিত্ব
এই সম্মেলনের প্রধান ব্যক্তিত্বের মধ্যে ছিলেন অস্ট্রিয়ার প্রধানমন্ত্রী মেটারনিখ, রাশিয়ার জার প্রথম আলেকজাণ্ডার ইংল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবার্ট স্টিয়ার্ট ক্যাসালরি এবং পরাজিত ফ্রান্সের প্রতিনিধি তালেরা।
ভিয়েনা সম্মেলনের সভাপতি
সম্মেলনের সভাপতি মেটারনিখ ছিলেন এই সম্মেলনের সর্বাধিক প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব ও মূল নিয়ন্ত্রক। তিনি ছিলেন এক বর্ণময় চরিত্র—সুদর্শন, সুবক্তা এবং অতি বিচক্ষণ কূটনীতিক। তিনি নিজেকে ‘বিজয়ীর বিজয়ী’ বলে গর্ববোধ করতেন। ভিয়েনা সম্মেলনের ঘূর্ণিজলে তিনি স্বচ্ছন্দে ভেসে বেড়াতেন।”
ভিয়েনা সম্মেলনে রাশিয়ার প্রতিনিধি
এই সম্মেলনে মেটারনিখের পরেই সর্বাধিক দৃষ্টি আকর্ষণ করেন রাশিয়ার জার প্রথম আলেকজান্ডার। নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে ইউরোপীয় শক্তিবর্গকে যথেষ্ট সাহায্য করার জন্য ভিয়েনা সম্মেলন এবং ইউরোপীয় রাজনীতিতে তিনি প্রভূত সম্মান ও প্রতিপত্তি লাভ করেন।
ভিয়েনা সম্মেলনে ফ্রান্সের প্রতিনিধি
ফরাসি প্রতিনিধি তালেরা এই সম্মেলনে যথেষ্ট গুরুত্ব অর্জন করেন। পরাজিত ফ্রান্সের প্রতিনিধি হয়ে তাঁর লক্ষ্য ছিল সম্মেলনে উপস্থিত প্রতিনিধিদের সম্মিলিত ক্ষোভ থেকে ফ্রান্সকে রক্ষা করা। এ কাজে তিনি যথেষ্ট সফল হন।
ভিয়েনা সম্মেলনের প্রতিনিধিদের সামনে সমস্যা
সম্মেলনের প্রতিনিধিদের সামনে বেশ কিছু জটিল সমস্যা উপস্থিত হয়েছিল। নেপোলিয়নোত্তর যুগের ওই জটিল সমস্যাগুলির সমাধানই ছিল এই সম্মেলনের মুখ্য উদ্দেশ্য। এই সমস্যাগুলি হল –
- (১) নেপোলিয়নের আগ্রাসনের ফলে সমগ্র ইউরোপের মানচিত্র পরিবর্তিত হয়েছিল। ইউরোপের এই পরিবর্তিত রাজনৈতিক কাঠামোর পুনর্গঠনকরা।
- (২) নেপোলিয়ন কর্তৃক বিতাড়িত পুরোনো রাজবংশগুলির পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা।
- (৩) ফ্রান্স যাতে পুনরায় শক্তি সঞ্চয় করে ইউরোপের শান্তি বিঘ্নিত করতে না পারে তার ব্যবস্থা করা।
- (৪) নেপোলিয়নের সঙ্গে যুদ্ধকালে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পাদিত গোপন চুক্তিগুলির মর্যাদা দানকরা।
- (৫) পোল্যান্ড, ইতালি ও জার্মানি -র ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করা।
- (৬) ব্যাভেরিয়া, স্যাক্সনি ও রাইন অঞ্চলের ভবিষ্যৎ নির্ণয় করা।
- (৭) নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে সংগ্রামে ক্ষতিগ্রস্ত রাষ্ট্রগুলির ক্ষতিপূরণ করা।
- (৮) ভবিষ্যতে ইউরোপে যাতে শক্তিসাম্য বজায় থাকে তার ব্যবস্থা করা।
ভিয়েনা সম্মেলনে মিত্রপক্ষের পারস্পরিক দাবি
এইসব সমস্যাগুলির সমাধান করার উদ্দেশ্য নিয়ে সমবেত হলেও সম্মেলনের নেতৃবর্গের মধ্যে যথেষ্ট আদর্শগত বিভেদ ছিল। যেমন –
- (১) রাশিয়ার জার প্রথম আলেকজান্ডার ব্যতীত সকল প্রধান নেতৃমণ্ডলীই ছিলেন প্রতিক্রিয়াশীল। ব্রিটেন, অস্ট্রিয়া ও প্রাশিয়ার নেতৃবর্গ ছিলেন প্রতিক্রিয়াশীল এবং তাঁদের লক্ষ্য ছিল ইউরোপে বিপ্লবী ভাবধারার সম্প্রসারণ প্রতিহত করে রক্ষণশীলতাকে বজায় রাখা।
- (২) নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা ব্যতীত তাদের মধ্যে কোনও ঐক্যসূত্র ছিল না। অস্ট্রিয়া কখনোই রাশিয়ার শক্তিবৃদ্ধি বা জার্মানিতে এশিয়ার প্রাধান্য স্থাপনের পক্ষপাতী ছিল না।
- (৩) জারের লক্ষ্য ছিল সমগ্র পোল্যান্ডের উপর আধিপত্য স্থাপন। ইংল্যান্ড, অস্ট্রিয়া ও প্রাশিয়া এই দাবির বিরোধী ছিল। অস্ট্রিয়া ও প্রাশিয়া পোল্যান্ডের রাজ্যাংশ দাবি করে।
- (৪) ব্রিটেন জেনোয়ার স্বাধীনতার পক্ষপাতী ছিল। অপরদিকে সার্ডিনিয়া জেনোয়া দাবি করে। পিডমন্ট-সার্ডিনিয়া ইতালির ঐক্যের পক্ষপাতী ছিল, কিন্তু অস্ট্রিয়া ইতালিতে তার অধিকার ছাড়তে রাজি ছিল না।
- (৫) এইসব নানা পরস্পর-বিরোধী স্বার্থ এবং বিভিন্ন দাবি ও পাল্টা দাবি ভিয়েনা সম্মেলনের পরিস্থিতিকে জটিলতর করে তোলে।
ভিয়েনা সম্মেলনের প্রতিনিধিদের প্রকাশ্যে ঘোষণা
সম্মেলনের নেতৃবৃন্দ ন্যায় ও সততার ভিত্তিতে ইউরোপের পুনর্গঠন ও পুনর্বণ্টন ইউরোপে নিরবচ্ছিন্ন ও স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা, ইউরোপের রাজনৈতিক ব্যবস্থার পুনরুজ্জীবন প্রভৃতি উচ্চ আদর্শের কথা প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছিলেন।
ভিয়েনা সম্মেলনের প্রতিনিধিদের প্রকৃত উদ্দেশ্য
বাস্তবে সম্মেলনের প্রতিনিধিদের মূল লক্ষ্য ছিল ফরাসি বিপ্লব-প্রসূত উদারনৈতিক ভাবধারা দমন করে ইউরোপে পুরাতনতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং নেপোলিয়নকে পরাজিত করার পুরস্কার-স্বরূপ ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চল আত্মসাৎ করা।
উপসংহার:- ভিয়েনা সম্মেলনের সম্পাদক ফ্রেডারিখ ভন জেনৎস (Friedric Von Gentz) বলেন, “বিজয়ীরা একত্রিত হয়েছিল বিজয়ের ফসলকে ভাগ করে নেওয়ার জন্য।”
(FAQ) ভিয়েনা সম্মেলন সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
নভেম্বর ১৮১৪-নভেম্বর ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দ।
অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায়।
প্রিন্স মেটারনিখ।
নেপোলিয়নের নির্বাসনের পর ইউরোপীয় রাজ্যগুলির পুনর্গঠন, সীমানার পুনর্বিন্যাস এবং নেপোলনীয় যুদ্ধের ফলে উদ্ভূত অপরাপর নানা সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে।