গান্ধী আরউইন চুক্তি -র পটভূমি, চুক্তি স্বাক্ষর, চুক্তির শর্তাবলী, বামপন্থী নেতাদের হতাশা, চুক্তির নিন্দা, উত্তেজিত যুবসমাজ, চুক্তির অনুমোদন, গান্ধীজির সমালোচনা, চুক্তির সমালোচনা ও দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকে কংগ্রেসের যোগদান সম্পর্কে জানবো।
দিল্লি চুক্তি বা গান্ধী আরউইন চুক্তি
ঐতিহাসিক ঘটনা | গান্ধী আরউইন চুক্তি |
সময়কাল | ৫ মার্চ, ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দ |
স্বাক্ষরকারী | মহাত্মা গান্ধী ও ভারত -এর ভাইসরয় লর্ড আরউইন |
স্থান | দিল্লি |
ভূমিকা :- প্রথম গোলটেবিল বৈঠক -এর পর ব্রিটিশ সরকার বুঝেছিল যে, জাতীয় কংগ্রেস ছাড়া ভারতীয় রাজনীতিতে কোনো শান্তিপূর্ণ ও সমাধানযোগ্য আলোচনা সম্ভব নয়। তাই তারা কংগ্রেসের সঙ্গে এক চুক্তি স্বাক্ষরে আগ্রহী হয়ে ওঠে। সরকারি মনোভাবের এই পরিবর্তন লক্ষ্য করে গান্ধীজি ভাইসরয় আরউইন এর সঙ্গে আলোচনায় বসতে রাজি হন।
গান্ধী আরউইন চুক্তির পটভূমি
বেশ কিছু ঘটনা গান্ধী-আরউইন চুক্তি পটভূমি তৈরি করে। যেমন –
(১) প্রথম গোলটেবিল বৈঠকের ব্যর্থতা
সাম্প্রদায়িক মতভেদে জাতীয় কংগ্রেসের অনুপস্থিতির কারণে প্রথম গোলটেবিল বৈঠক ব্যর্থ হয়। তাই সরকার জাতীয় কংগ্রেসের গুরুত্ব অনুভব করে কংগ্রেসের ওপর আরোপিত সকল নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় ও শীর্ষ নেতৃবৃন্দের মুক্তি দিয়ে মৈত্রীর পটভূমি গড়ার চেষ্টা করে।
(২) আপোষ মীমাংসার উদ্যোগ
জাতীয় নেতাদের মধ্যে তেজ বাহাদুর সপ্রু, জয়াকার প্রমুখ উদারপন্থী নেতৃবৃন্দ গান্ধিজি এবং বড়োলাট আরউইন উভয়কেই আপোষ মীমাংসার অনুরোধ জানালে এক মৈত্রীর পটভূমি রচিত হয়।
(৩) বণিক ও শিল্পপতি গোষ্ঠীর চাপ
ব্রিটিশ সরকার বিভিন্ন শিল্পের শুল্ক আদায়ের ব্যাপারে নমনীয় নীতি গ্রহণ করলে দেশীয় বণিক ও শিল্পপতি গোষ্ঠীগুলি পরবর্তী গোলটেবিল বৈঠকগুলিতে যোগ দেওয়ার জন্য গান্ধীজিকে অনুরোধ জানান।
(৪) বস্ত্র ব্যবসায়ীদের উদ্যোগ
কংগ্রেসের একটানা আন্দোলনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্রিটেনের ম্যাঞ্চেস্টারের বস্ত্র ব্যবসায়ীরাও কংগ্রেসের সঙ্গে আপস মীমাংসায় আসার জন্য ব্রিটিশ সরকারকে চাপ দেয়। ফলে গান্ধী আরউইন চুক্তির পটভূমি গড়ে ওঠে।
গান্ধী আরউইন চুক্তি স্বাক্ষর
দীর্ঘ ১৫ দিন ধরে আলোচনার পর রাজধানী দিল্লিতে ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দের ৫ মার্চ গান্ধী আরউইন চুক্তি সম্পাদিত হয়। গান্ধী আরউইন চুক্তির অপর নাম হল দিল্লি চুক্তি।
গান্ধী আরউইন চুক্তির শর্তাবলী
এই চুক্তি দ্বারা –
- (১) সরকার সকল স্বৈরাচারী আইন ও অর্ডিনান্স প্রত্যাহার করে নেয়।
- (২) একমাত্র হিংসাত্মক কার্যে বন্দি ছাড়া সকল রাজনৈতিক বন্দিকে মুক্তি দেওয়া হয়।
- (৩) ‘সত্যাগ্রহ আন্দোলনে যোগ দেওয়ার জন্য যাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল তা ফেরৎ দেওয়া হয়।
- (৪) বলা হয় যে, যে-সব অঞ্চলে সহজে লবণ তৈরি হয়, সেই সব স্থানের লোক নিজেদের ব্যবহারের জন্য লবণ তৈরি করতে পারবে।
- (৫) বিলাতি কাপড় ও মদের দোকানে শান্তিপূর্ণ পিকেটিং বেআইনি ঘোষিত হবে না।
- (৬) দেশীয় শিল্পের উন্নতির জন্য ভারতীয়দের বিদেশি পণ্য বর্জন নীতি ব্রিটিশকে মানতে হবে।
- (৭) পুলিশের দমনপীড়নমূলক কাজের জন্য কোনো তদন্তের দাবি জানানো যাবে না।
- (৮) অনাদায়ি জরিমানা সরকার মকুব করবে, কিন্তু আদায় করা জরিমানা সরকার ফেরত দেবে না।
- (৯) পদত্যাগী সরকারি কর্মীদের আবার কাজে ফিরিয়ে নেওয়া হবে।
- (১০) গান্ধীজি আইন অমান্য আন্দোলন প্রত্যাহার করতে ও দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠক -এ যোগ দিতে সম্মত হন।
গান্ধী আরউইন চুক্তির ফলে বামপন্থী নেতাদের হতাশা
এই চুক্তি বামপন্থী নেতৃবৃন্দকে হতাশা করে। পূর্বে প্রতিশ্রুতি দেওয়া সত্ত্বেও এই চুক্তির মাধ্যমে গান্ধীজি ‘পূর্ণ স্বাধীনতা’র সংগ্রাম ত্যাগ করেন।
গান্ধী আরউইন চুক্তির নিন্দা
সুভাষচন্দ্র বসু এবং কার্যনির্বাহক সমিতির সদস্য পন্ডিত জওহরলাল নেহরু তীব্র ভাষায় এই চুক্তির নিন্দা করেন।
গান্ধী আরউইন চুক্তির ফলে উত্তেজিত যুবসমাজ
এই চুক্তির দ্বারা ভগৎ সিং, রাজগুরু ও শুকদেবের প্রাণদণ্ড মকুবের কোন ব্যবস্থা করা হয় নি বলে যুবসমাজ গান্ধীজির ওপর প্রবল উত্তেজিত হয়। ভগৎ সিং ও তাঁর সহকর্মীদের মৃত্যুর জন্য তারা গান্ধীজিকে দায়ী করে।
গান্ধী আরউইন চুক্তির অনুমোদন
১৯৩১ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে জাতীয় কংগ্রেসের করাচি অধিবেশনে এই চুক্তি অনুমোদিত হয়। এই অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে বল্লভভাই প্যাটেল ‘পূর্ণ স্বাধীনতা”র কথা না বলে পুনরায় ঔপনিবেশিক স্বায়ওশাসনকেই কংগ্রেসের লক্ষ্য বলে ঘোষণা করেন।
আরউইন গান্ধীর দেওয়া শর্তাবলী পুরোপুরি মেনে নেয়নি। আরউইন রাজবন্দিদের উপর নির্যাতন বন্ধ করতে, বাজেয়াপ্ত বিষয় সম্পত্তি আন্দোলনকারীদের ফিরিয়ে দিতে এবং সমুদ্রতীর থেকে নির্দিষ্ট দূরত্বে বসবাসকারী ব্যক্তিদের বিনা শুল্ক -এ লবণ উৎপাদনের অনুমতি দিতে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। তবে
গান্ধী আরউইন চুক্তির স্বাক্ষরের জন্য গান্ধীজির সমালোচনা
ভগৎ সিং, রাজগুরু, সুখদেব ও বটুকেশ্বর দত্ত -এর মৃত্যুদন্ড দিলেন এবং গান্ধীজির সাথে কোনো আলোচনা না করায় জওহরলাল নেহরু, সুভাষচন্দ্র বসু প্রমুখ নেতা গান্ধীজিকে সমালোচনা ও নানা দোষারোপ করেছিলেন।
গান্ধী আরউইন চুক্তির সমালোচনা
জনগণের সামগ্রিক স্বার্থের পরিপন্থী গান্ধী-আরউইন চুক্তি কংগ্রেসের মধ্যে ব্যাপক ভাবে সমালোচিত হয়েছিল । সমালোচকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু।
দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকে কংগ্রেসের যোগদান
আইন অমান্য আন্দোলন বন্ধ হবার ফলে কংগ্রেসের পক্ষে মুখ রক্ষার উপায় হিসাবে দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকে যোগদানের সিদ্ধান্ত সহ গান্ধি-আরউইন চুক্তি কংগ্রেসে অনুমোদিত হয়।
উপসংহার :- আইন অমান্য আন্দোলন বন্ধ হবার ফলে কংগ্রেসের পক্ষে মুখ রক্ষার উপায় হিসাবে দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকে যোগদানের সিদ্ধান্ত সহ গান্ধি-আরউইন চুক্তি কংগ্রেসে অনুমোদিত হয়েছিল। এই চুক্তির অপেক্ষাকৃত ভালো দিক ছিল এই যে, বহু রাজনৈতিক বন্দী এর দ্বারা মুক্তি পেয়েছিলেন।
(FAQ) গান্ধী আরউইন চুক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
৫ মার্চ, ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দ।
১৯৩১ খ্রিস্টাব্দের ৫ মার্চ দিল্লিতে ভারতের বড়লার্ট লর্ড আরউইন ও মহাত্মা গান্ধীর মধ্যে যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় তা গান্ধী আরউইন চুক্তি নামে পরিচিত।
৫ মার্চ, ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দ।
দিল্লি চুক্তি।
৫ মার্চ, ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দ।
(i) সরকার সকল স্বৈরাচারী আইন ও অর্ডিনান্স প্রত্যাহার করেন।
(ii) একমাত্র হিংসাত্মক কার্যে বন্দি ছাড়া সকল রাজনৈতিক বন্দিকে মুক্তি দেওয়া হয়।