নরমপন্থা ও চরমপন্থার বিরোধ প্রসঙ্গে সাময়িক আপস, চরমপন্থীদের নেতৃত্বে প্রত্যক্ষ সংগ্ৰামের পথ প্রদর্শন, রাজনীতির পুরোভাগে চরমপন্থী নেতৃত্ব, বাংলায় চরমপন্থীদের চাঞ্চল্য, সর্বভারতীয় নরমপন্থী ও চরমপন্থী নেতা, নরমপন্থী ও চরমপন্থী দলের বিরোধী রাজনৈতিক লক্ষ্য, নরমপন্থী ও চরমপন্থী চরম বিরোধ ও বিচ্ছেদ সম্পর্কে জানবো।
নরমপন্থা ও চরমপন্থার বিরোধ
ঐতিহাসিক ঘটনা | নরমপন্থা ও চরমপন্থার বিরোধ |
নরমপন্থী | সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় |
চরমপন্থী | বাল গঙ্গাধর তিলক, বিপিনচন্দ্র পাল |
সুরাট বিচ্ছেদ | ১৯০৭ খ্রি: |
ভূমিকা :- বঙ্গভঙ্গের রাজনৈতিক পটভূমিকায় ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসের শেষদিকে বারাণসীতে কংগ্রেসের অধিবেশন বসে। অধিবেশনের সভাপতি হন গোপালকৃষ্ণ গোখলে। কিন্তু বঙ্গভঙ্গের ফলে বিক্ষুব্ধ চরমপন্থীদের নিয়ন্ত্রিত করা এই নেতার পক্ষেও সম্ভব হল না।
নরমপন্থা ও চরমপন্থার সাময়িক আপস
- (১) ‘বিষয় নির্বাচনী কমিটি’র অধিবেশনে কংগ্রেস নেতৃত্বের পক্ষ থেকে সপত্নীক ‘প্রিন্স অফ ওয়েলস’-এর আসন্ন ভারত ভ্রমণ উপলক্ষে রাজ-দম্পতিকে অভিনন্দন জ্ঞাপনের প্রস্তাব তোলা হয়।
- (২) এর ফলে মহারাষ্ট্রের বাল গঙ্গাধর তিলক, পাঞ্জাবের লালা লাজপৎ রায়, বাংলার বিপিনচন্দ্র পাল প্রমুখের নেতৃত্বে চরমপন্থীরা গোখেল সহ আপসপন্থী নেতৃবৃন্দের ইংরেজ তোষণ নীতির প্রতি তীব্র ঘৃণা প্রকাশ করে বিদ্রূপ বাক্য বর্ষণ করতে থাকেন।
- (৩) এই ঘৃণ্য প্রস্তাবের আলোচনা আরম্ভ হওয়া মাত্র চরমপন্থীরা অধিবেশন ত্যাগ করে চলে যান। কিন্তু আপসপন্থীরাও শর্তাধীন ভাবে হলেও বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ পণ্য বর্জনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে বাধ্য হন এবং এইভাবে কংগ্রেস নেতৃত্ব ও চরমপন্থীদের মধ্যে একটা সাময়িক আপস স্থাপিত হয়।
চরমপন্থীদের নেতৃত্বে প্রত্যক্ষ সংগ্ৰামের পথ প্রদর্শন
চরমপন্থীর তাঁদের গ্রামের প্রচার অব্যাহতভাবে চালাতে থাকেন এবং বাংলা ও ভারতের মধ্যশ্রেণী ক্রমশ তাঁদের দিকেই ঝুঁকে পড়ে। ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে চরমপন্থী নেতা বিপিনচন্দ্র পাল কংগ্রেস নেতৃত্বের আপসপন্থী রাজনীতির স্বরূপ উদ্ঘাটন করে জনগণকে ব্রিটিশ বিরোধী প্রত্যক্ষ সংগ্রামের পথ দেখাতে থাকেন।
রাজনীতিক আন্দোলনের পুরোভাগে চরমপন্থী নেতৃত্ব
- (১) ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে চরমপন্থীদের ব্রিটিশ বিরোধী প্রচার চরমে উঠে এবং জনসাধারণের মধ্য থেকেও সংগ্রামের ধ্বনি উঠতে থাকে। এর ফলে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ভূপেন্দ্রনাথ বসু প্রমুখ নরমপন্থী নেতৃবৃন্দ গণ আন্দোলনের সাথে সমান তালে অগ্রসর হতে না পেরে পিছিয়ে পড়েন।
- (২) এরপর বাংলার বিপিনচন্দ্র ও অরবিন্দ, মহারাষ্ট্রের বাল গঙ্গাধর তিলক, পাঞ্জাবের লালা লাজপৎ রায় প্রমুখ চরমপন্থী নেতৃবৃন্দ দেশের রাজনীতিক আন্দোলনের পুরোভাগে স্থান গ্রহণ করেন।
বাংলায় চরমপন্থীদের চাঞ্চল্য
- (১) ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে বাংলা ও মহারাষ্ট্রের চরমপন্থীদের যোগাযোগ আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠে। এর পূর্বেই বাংলাদেশ-এও মহারাষ্ট্রের আদর্শে ‘শিবাজি-উৎসব’-এর অনুষ্ঠান আরম্ভ হয়েছিল।
- (২) ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের ‘শিবাজী উৎসব‘ ও ‘স্বদেশী মেলা’ উপলক্ষে নিমন্ত্রিত হয়ে স্বয়ং বাল গঙ্গাধর তিলক এবং পাঞ্জাবের চরমপন্থীদের নায়ক লালা লাজপৎ রায় বাংলাদেশে আগমন করেন।
- (৩) এই দুই দেশ বিখ্যাত চরমপন্থী নায়কের পদার্পণে বাংলার যুবশক্তি বৈপ্লবিক উৎসাহে চঞ্চল হয়ে উঠে, মহারাষ্ট্রের বিপ্লবীদের সাথে বাংলার বিপ্লবীদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ স্থাপিত হয় এবং মহারাষ্ট্র ও বাংলার বৈপ্লবিক আন্দোলনের স্রোত পাঞ্জাব ও অন্যান্য প্রদেশেও পৌঁছাবার পথ প্রস্তুত হয়।
নরমপন্থা ও চরমপন্থার বিরোধের ফলে কলকাতা কংগ্রেসের অসুবিধা
বারাণসী কংগ্রেসে আপসপন্থী নেতৃত্ব ও চরমপন্থীদের মধ্যে যে বিভেদ সৃষ্টি হয়েছিল, তা তখন সাময়িকভাবে মেটানো সম্ভব হলেও অল্পকাল পরেই আবার তীব্রভাবে আরম্ভ হয়। ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেসের অধিবেশন হয় কলকাতায়। এই অধিবেশনে দুই দলের বিরোধের ফলে অধিবেশনের কাজ পরিচালনা অসম্ভব হয়ে উঠে।
দক্ষিণপন্থী ও বামপন্থী নেতৃবৃন্দ
বাঙলাদেশে দুই দলের বিরোধ চরম আকারে দেখা দেয়। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ভূপেন্দ্রনাথ বসু প্রমুখ দক্ষিণপন্থী নেতৃবৃন্দ থাকলেন একদিকে, আর একদিকে থাকলেন বিপিনচন্দ্র পাল, অরবিন্দ ঘোষ, ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় প্রমুখ বামপন্থী নেতৃবৃন্দ।
সর্বভারতীয় নরমপন্থী ও চরমপন্থী নেতা
সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে একদিকে গেলেন গোখলে ও ফিরোজ শাহ মেহতার নেতৃত্বে সকল আপসপন্থীরা, আর তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন তিলক ও লাজপৎ রায়ের নেতৃত্বে সকল চরমপন্থী নেতৃবৃন্দ।
নরমপন্থী ও চরমপন্থী দলের বিরোধী রাজনৈতিক লক্ষ্য
কলকাতা কংগ্রেসে দুই পরস্পর বিরোধী দল দুটি পরস্পর বিরোধী রাজনৈতিক লক্ষ্য নিয়ে শেষ বোঝাপড়ার জন্য দণ্ডায়মান হল।
দক্ষিণপন্থীদের রাজনৈতিক লক্ষ্য
দক্ষিণপন্থীদের রাজনীতিক লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্য-এর যে সকল দেশে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেগুলির অনুরূপ একটি শাসন ব্যবস্থা, অবশ্য তা পরে হলেও ক্ষতি নেই।
বামপন্থীদের রাজনৈতিক লক্ষ্য
বামপন্থীদের রাজনীতিক লক্ষ্য ছিল ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা এবং সেই স্বাধীনতা ভারতবাসীরা আবেদন-নিবেদনের দ্বারা নয়, নিজেদের শক্তি দ্বারাই অর্জন করবে।
দুই দলের লক্ষ্য সিদ্ধির উপায়
দক্ষিণপন্থীদের লক্ষ্য সিদ্ধির উপায় ছিল নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন, আর বামপন্থীদের লক্ষ্য সিদ্ধির উপায় ছিল বৈপ্লবিক প্রচেষ্টা দ্বারা অবিলম্বে ব্রিটিশ শাসনের ধ্বংসসাধন।
নৌরজির চেষ্টায় নরমপন্থী চরমপন্থী আপস
- (১) কলকাতা কংগ্রেসে এই দুই পরস্পর-বিরোধী দল ও উদ্দেশ্যের সমন্বয় সাধন করে কংগ্রেসের ঐক্য বজায় রাখা অসম্ভব হয়ে উঠলে কেবলমাত্র সর্বজনমান্য নেতা দাদাভাই নওরোজির সভাপতিত্ব গ্রহণের ফলেই তা কোন প্রকারে রক্ষা করা সম্ভব হয়।
- (২) এবারেও সভাপতি দাদাভাই নৌরজির বিশেষ চেষ্টায় শেষ পর্যন্ত এই দুই দলের মধ্যে একটা আপস স্থাপিত হয় এবং কংগ্রেসের সাংগঠনিক ঐক্য কোন প্রকারে বজায় থাকে।
নরমপন্থী চরমপন্থী আপসের শর্ত
আপসের শর্ত অনুসারে কংগ্রেসের দক্ষিণপন্থী নেতৃবৃন্দ তাঁদের লক্ষ্য হিসাবে ‘ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসন’ ঘোষণা করলেও ব্রিটিশ পণ্য বর্জন ও স্বদেশী পণ্য গ্রহণের আন্দোলন সমর্থন করবার স্বীকৃতি দেয়।
চরমপন্থীদের জনপ্রিয়তা
কলকাতা কংগ্রেসেই “স্বরাজ” (ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসন) কথাটি প্রথম ব্যবহৃত হয়। চরমপন্থীরা কংগ্রেসের অধিবেশনে পরাজয় বরণ করলেও তারা তাঁদের মতবাদের জন্য দেশের মধ্যে যে জনপ্রিয়তা অর্জন করলেন, তা এ পর্যন্ত অন্য কোনো দলের বা নেতার ভাগ্যে ঘটে নি। সারা দেশের যুবশক্তি তাঁদের কাছ থেকে বিপ্লবের পথে পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনের মন্ত্র গ্রহণ করে।
পরবর্তী কংগ্ৰেসে আপস ভঙ্গ
কলকাতা কংগ্রেসে ভারতের প্রবীণতম নেতা দাদাভাই নৌরজির চেষ্টায় দুই দলের মধ্যে সাময়িকভাবে আপস স্থাপন সম্ভব হলেও পরবর্তী অধিবেশনে কংগ্রেসের মধ্যে ঐক্য বজায় রাখা কোনো প্রকারেই সম্ভব হল না।
কংগ্রেসের সুরাট অধিবেশন
১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে, কংগ্রেসের অধিবেশন হয় সুরাটে। প্রথমে নাগপুর অধিবেশনের জন্য নির্দিষ্ট হয়েছিল। কিন্তু নাগপুর ছিল তিলকের পরিচালনাধীন চরমপন্থী মারাঠীদের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। তাই নাগপুরে কংগ্রেসের অধিবেশন হলে দক্ষিণপন্থীরা বিশেষ সুবিধা করতে পারবে না ভেবে ফিরোজ শাহ মেহতার চেষ্টায় সুরাটে অধিবেশনের আয়োজন হয়।
সুরাট অধিবেশনে সভাপতি নির্বাচনে বিরোধিতা
বামপন্থীরা লাজপৎ রায়কে সভাপতি করতে চাইলে শাসকগণ রুষ্ট হতে পারে এই ভয়ে দক্ষিণপন্থীরা রাসবিহারী ঘোষকে সভাপতি নির্বাচিত করেন। বামপন্থীদের সাথে দক্ষিণপন্থীদের বিরোধ আর এক ধাপ অগ্রসর হয়।
কংগ্রেসের নরমপন্থী চরমপন্থী চরম বিরোধ
- (১) দক্ষিণপন্থীরা যেন আগে থেকেই এবারের কংগ্রেস অধিবেশনে চরমপন্থীদের সাথে বিচ্ছেদ ঘটাবার জন্য সচেষ্ট হয়ে উঠেছিলেন। তাঁরা আগে থেকেই ঘোষণা করেন যে, এবারের কংগ্রেস অধিবেশনে ব্রিটিশ পণ্য বর্জন, স্বরাজ প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে আলোচনা চলবে না।
- (২) এর ফলে দুই দলের বিরোধ চরমে উঠে। দক্ষিণপন্থীরা এবার প্রকাশ্যেই বিচ্ছেদের কথা বলতে থাকেন। কারণ, তাঁরাই ছিলেন কংগ্রেসের মধ্যে সংখ্যাধিক্য দল। দক্ষিণপন্থীদের নেতা ফিরোজ শাহ মেহতার চেষ্টায় দুই দলের বিচ্ছেদ স্পষ্ট হয়ে উঠে।
চরমপন্থীদের সভা
অধিবেশনের পূর্বে সুরাটে অরবিন্দ ঘোষের নেতৃত্বে চরমপন্থীদের এক সভা হয়। এই সভায় দক্ষিণপন্থীদের “অপচেষ্টা” ও আপস নীতির বিরুদ্ধে সর্বশক্তি দিয়ে বাধা দেবার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
নরমপন্থী ও চরমপন্থী বিচ্ছেদ সম্পন্ন
কংগ্রেস অধিবেশনে বামপন্থীদের প্রস্তাব উত্থাপন করেন বাল গঙ্গাধর তিলক। কিন্তু ভোটাধিক্যে প্রস্তাবগুলি পরাজিত হয়। প্রস্তাবের উপর বিতর্কের সময় চরমপন্থীরা ক্রুদ্ধ হয়ে সুরেন্দ্রনাথ ও ফিরোজ শাহ মেহতাকে লক্ষ্য করে পাদুকা নিক্ষেপ করেন। এই অধিবেশনে কোনো কাজই সম্ভব হবে না বুঝে চরমপন্থীরা অধিবেশন পণ্ড করিয়া দেন। দুই দলের বিচ্ছেদ সম্পূর্ণ হল।
উপসংহার :- এর পর কংগ্রেস সম্পূর্ণরূপে দক্ষিণপন্থীদের অধিকারে চলে গেলেও দেশের স্বাধীনতাকামী যুবশক্তি চরমপন্থীদের নেতৃত্বই মেনে নেয় এবং চরমপন্থীদের জাতীয়তাবাদী রাজনীতিই প্রাধান্য লাভ করে।
(FAQ) নরমপন্থা ও চরমপন্থার বিরোধ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
দাদাভাই নৌরজি ও ফিরোজ শাহ মেহতা।
বিপিনচন্দ্র পাল, বাল গঙ্গাধর তিলক।
রাসবিহারী ঘোষ।
১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে