আগস্ট প্রস্তাব

লিনলিথগো প্রস্তাব বা আগস্ট প্রস্তাব প্রসঙ্গে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, কংগ্রেসের ক্ষোভের কারণ হিসেবে জরুরি ক্ষমতা অর্পণ, গ্রেপ্তারি আইন জারি, পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি অগ্রাহ্য, যুদ্ধে ভারতকে জড়িয়ে দেওয়া, সুভাষচন্দ্র বসুর আপসহীন সংগ্রামের ডাক, বিশ্বযুদ্ধে ইংল্যান্ডের বিপর্যয়, লিনলিথগোর ঘোষণা বা প্রস্তাব পেশ, লিনলিথগো প্রস্তাব বা আগস্ট প্রস্তাবের বিষয়সমূহ, কংগ্রেস ও লীগের প্রতিক্রিয়া, কংগ্রেসের প্রতিবাদ ও হডসনের অভিমত সম্পর্কে জানবো।

লিনলিথগো প্রস্তাব বা আগস্ট প্রস্তাব

ঐতিহাসিক ঘটনা আগস্ট প্রস্তাব
সময়কাল ৮ আগস্ট, ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দ
পেশ করেন লর্ড লিনলিথগো
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল
উদ্দেশ্য বিশ্বযুদ্ধে ভারতের সম্পদ ব্যবহার 
আগস্ট প্রস্তাব

ভূমিকা:- ব্রিটিশ সরকার প্রবর্তিত ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইন অনুসারে ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে ভারতের অধিকাংশ প্রদেশে কংগ্রেস দলের বিরাট সাফল্য ব্রিটিশ সরকারকে চিন্তায় ফেলে দেয়। ফলে সরকার কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করে ভারতবাসীকে নানান সমস্যায় বিব্রত করতে থাকে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ

১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ১ সেপ্টেম্বর জার্মানি পোল্যান্ড আক্রমণ করে। এর প্রতিক্রিয়ায় ৩ সেপ্টেম্বর ফ্রান্স ও ইংল্যান্ড জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়।

কংগ্রেসের ক্ষোভ

এই পরিস্থিতিতে যে কয়েকটি ঘটনায় কংগ্রেস ক্ষুব্ধ হয়েছিল সেগুলি হল –

(১) জরুরি ক্ষমতা অর্পণ

১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইন সংশোধন করে প্রাদেশিক শাসন-সংক্রান্ত বিষয়ে বড়োলাটের হাতে জরুরি ক্ষমতা দেওয়া হয়। ফলে নির্বাচিত ভারতীয় প্রতিনিধিদের সমস্ত ক্ষমতাই মূল্যহীন হয়ে পড়ে।

(২) গ্রেপ্তারি আইন ঘোষণা

১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ব্রিটিশ সরকার আভ্যন্তরীণ অরাজকতা দমনের অজুহাতে স্বৈরাচারী ‘ভারত রক্ষা আইন’ ও অন্যান্য দমনমূলক আইন প্রণয়ন করে। এই আইন প্রণয়নের মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকার যেকোনো ভারতবাসীকে যেকোনো সময়ে গ্রেপ্তার করার ক্ষমতা হাতে তুলে নেয়।

(৩) পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি অগ্রাহ্য

১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ১৪ সেপ্টেম্বর কংগ্রেস কার্যনির্বাহক সমিতি অবিলম্বে ভারতকে স্বাধীন রাষ্ট্র বলে ঘোষণার দাবি জানায়। কিন্তু বড়োলাট এই বিষয়ে কোনো প্রতিশ্রুতি না দিয়ে জানান যে, যুদ্ধশেষে ভারতের বিভিন্ন দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে ভারতকে ‘ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস’ বা স্বায়ত্ব শাসনের মর্যাদা দেওয়ার বিষয়ে চিন্তাভাবনা করা হবে।

(৪) যুদ্ধে ভারতকে জড়িয়ে দেওয়া

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সঙ্গে ভারতবাসীর কোনো প্রত্যক্ষ যোগ ছিল না। তা সত্বেও ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে ক্ষমতাসীন কংগ্রেস মন্ত্রীসভা ও জাতীয় স্তরের নেতাদের সঙ্গে কোনো আলাপ আলোচনা না করেই বড়োলাট লর্ড লিনলিথগো একতরফাভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভারত সরকার ও ভারতীয় জনগণের পক্ষে জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে ভারতকে যুদ্ধে জড়িয়ে দেন।

(৫) লিনলিথগোর খুশি

এসব ঘটনায় ব্রিটিশ সরকারের ওপর কংগ্রেস ক্ষুদ্ধ হয়। কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটির নির্দেশে ৮টি প্রদেশে গঠিত কংগ্রেস মন্ত্রীসভা পদত্যাগ করে। লিনলিথগো অবশ্য এতে খুশিই হন।

সুভাষচন্দ্র বসুর আপসহীন সংগ্রামের ডাক

  • (১) ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে রামগড়ে অনুষ্ঠিত সারা ভারত আপসবিরোধী সম্মেলনে কোনোভাবেই যুদ্ধপ্রচেষ্টায় শামিল না হওয়া এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রামের ডাক দেওয়া হয়।
  • (২) সিদ্ধান্ত হয় ৬-১৩ই এপ্রিল (১৯৪০) দেশজুড়ে আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করার। জুনে সুভাষচন্দ্র গান্ধিজিকে আইন অমান্য শুরু করার জন্য চিঠিও লেখেন। কিন্তু গান্ধিজি বলেন, “ব্রিটেনের ধ্বংসস্তূপ থেকে আমরা স্বাধীনতা চাই না।”

বিশ্বযুদ্ধে ইংল্যান্ডের বিপর্যয়

১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের আগস্টের শুরুতে জার্মানির কাছে মিত্রপক্ষের ফ্রান্স পরাজিত হয় এবং ব্রিটেনও প্রচণ্ড বিপর্যয়ের মুখে পড়ে।

লিনলিথগো-র ঘোষণা

এই পরিস্থিতিতে ভারতীয় নেতৃবৃন্দকে কিছুটা খুশি করে এদেশের জনসম্পদ ও অর্থসম্পদ যুদ্ধের কাজে ব্যবহারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এই উদ্দেশ্যে বড়োলাট লিনলিথগো ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের ৮ আগস্ট একটি ঘোষণা করেন। তাঁর এই ঘোষণা ‘আগস্ট প্রস্তাব’ বা ‘লিনলিথগো প্রস্তাব’ নামে পরিচিত।

লিনলিথগোর প্রস্তাব সমূহ

এই প্রস্তাবে লিনলিথগো বলেন যে,

  • (১) শীঘ্রই ভাইসরয় অর্থাৎ গভর্নর-জেনারেলের শাসন পরিষদের সম্প্রসারণ করে তাতে অতিরিক্ত ভারতীয় সদস্য গ্রহণ করা হবে।
  • (২) দেশীয় রাজ্যগুলির প্রতিনিধি এবং জাতীয় নেতাদের নিয়ে একটি ‘যুদ্ধ উপদেষ্টা পরিষদ’ গঠন করা হবে।
  • (৩) যুদ্ধের পর ভারতের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি গণপরিষদ গঠন করা হবে। এই পরিষদ ভারতের সংবিধান রচনা করবে। ব্রিটিশ সরকারের অনুমোদনক্রমে এই সংবিধান চালু হবে।
  • (৪) ব্রিটিশ সরকার এমন কোনো ভারতীয় সরকারকে মেনে নেবে না, যা ভারতের একটি বড়ো অংশের জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।
  • (৫) ভবিষ্যতে ভারতকে স্বায়ত্তশাসনের মর্যাদা বা ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাসদেওয়ার বিষয়ে বিবেচনা করা হবে।

কংগ্রেস ও লিগের প্রতিক্রিয়া

লিনলিথগো আশা করেছিলেন যে, ভারতের সব সম্প্রদায় ও রাজনৈতিক দল এই প্রস্তাব মেনে নিয়ে যুদ্ধে ব্রিটিশ শক্তিকে সহায়তা করবে। কিন্তু ভারতের প্রধান রাজনৈতিক দল কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে।

এই  পিছনে দু-পক্ষের যে কারণ ছিল সেগুলি হল-

কংগ্রেসের প্রত্যাখ্যানের কারণ

  • (১) আগস্ট প্রস্তাবে ভারতকে পূর্ণ স্বাধীনতা দানের কোনো প্রতিশ্রুতিই দেওয়া হয়নি। তাই ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে (২১ আগস্ট) ওয়ার্ধা অধিবেশনে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি লিনলিথগো-র ‘আগস্ট প্রস্তাব’ প্রত্যাখ্যান করে।
  • (২) দিল্লিতে অনুষ্ঠিত কংগ্রেস কার্যনির্বাহক সমিতির বৈঠকে কংগ্রেস জানায় যে, ফ্যাসিবাদী শক্তিগুলির বিরুদ্ধে জয়লাভের জন্য ভারতবাসী ব্রিটিশ সরকারকে সাহায্য দিতে প্রস্তুত।
  • (৩) তবে বড়োলাটকে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে যে, যুদ্ধের পর সংবিধান সভা গঠন করা হবে, এই সভা স্বাধীন ভারতের সংবিধান রচনা করবে এবং কেন্দ্রে আপাতত কোনো দায়িত্বশীল সরকার গঠন করা হবে।

মুসলিম লিগের প্রত্যাখ্যানের কারণ

লিনলিথগো-র প্রস্তাবে ভারত বিভাগ এবং মুসলিমদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান গঠনের কোনো সুস্পষ্ট আশ্বাস দেওয়া হয়নি। তাই মুসলিম লিগও এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে।

কংগ্রেসের প্রতিবাদ

জাতীয় কংগ্রেস যে বিভিন্ন উপায়ে আগস্ট প্রস্তাবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের উদ্যোগ নেয় সেগুলি হল –

  • (১) কংগ্রেস নতুন করে আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করার হুমকি দেয়।
  • (২) এদিকে সুভাষ চন্দ্র বসুর নেতৃত্বে ‘ফরওয়ার্ড ব্লকে’র আইন অমান্য আন্দোলন জনজীবনে প্রবল সাড়া ফেলেছিল।
  • (৩) তাই গান্ধিজির নির্দেশে ব্যক্তিগত সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু হয়। আচার্য বিনোবা ভাবে, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, জওহরলাল নেহরু ব্যক্তিগত সত্যাগ্রহে যোগদান করে গ্রেপ্তার বরণ করেন। প্রায় ২৫ হাজার সত্যাগ্রহী এই সময় গ্রেপ্তার বরণ করেন।

হডসনের অভিমত

ব্রিটিশ সংবিধান-বিশেষজ্ঞ হডসন আগস্ট প্রস্তাবকে অস্পষ্ট, অসংলগ্ন ও চিন্তাহীনতার প্রতিফলন বলে মন্তব্য করেছেন। তাঁর মতে, আগস্ট প্রস্তাবের অপ্রাসঙ্গিকতার কারণ ছিল বড়োলাট লর্ড লিনলিথগো এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের অনমনীয় মনোভাব।

মূল্যায়ণ

আগস্ট প্রস্তাব সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল।জাতীয় কংগ্রেস নিজেদের সাংগঠনিক দুর্বলতা এবং অন্যান্য কিছু কারণে তখনই ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে বৃহত্তর আন্দোলন শুরু করতে পারেনি। কিন্তু ব্রিটিশ শক্তির অনমনীয় আচরণে কংগ্রেস নতুন করে আন্দোলনের কর্মসূচি গ্রহণের চিন্তাভাবনা করতে বাধ্যহয়।

উপসংহার:- ভারতীয়রা ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার পর ব্রিটিশ সরকার এই প্রস্তাবের কিছু অংশ সংশোধন করে ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ক্রিপস মিশন -এর প্রস্তাবের মাধ্যমে তা ভারতীয়দের সামনে তুলে ধরে।

(FAQ) আগস্ট প্রস্তাব সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. আগস্ট প্রস্তাব কে ঘোষণা করেন?

ভারতের বড়লাট লর্ড লিনলিথগো।

২. আগস্ট প্রস্তাব কবে ঘোষিত হয়?

৮ আগস্ট, ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দ।

৩. আগস্ট প্রস্তাব ঘোষণার সময় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কে ছিলেন?

উইনস্টন চার্চিল।

1 thought on “আগস্ট প্রস্তাব”

Leave a Reply

Translate »