১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দের ২২-২৪ ফেব্রুয়ারি ফ্রান্সে সংঘটিত ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের ফলাফল হিসেবে রাজতন্ত্রের অবসান, সরকারের উদ্দেশ্য, সুন্দর বিপ্লব, আইনসভা গঠন, সাধারণ বুর্জোয়া শ্রেণীর প্রাধান্য, লিপসনের মন্তব্য, শ্রমিক শ্রেণীর উন্নতি, জাতীয় কর্মশালা প্রতিষ্ঠা, অর্ধ বিপ্লব, ফ্রান্সের সংহতি, জুন বিদ্রোহ, ফ্রান্সের বাইরে প্রভাব হিসেবে স্পেরবারের মন্তব্য, টেলরের মন্তব্য, শহরের বিপ্লব, ঝটিকা কেন্দ্র, বিপ্লবের বৎসর, জনতার যুগের সূচনা, দেশে দেশে বিপ্লব হিসেবে জার্মানি, ইতালি, অস্ট্রিয়া, নেদারল্যান্ড ও ডেনমার্ক এবং বিপ্লবের সীমিত সাফল্য সম্পর্কে জানবো।
ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের ফলাফল
ঐতিহাসিক ঘটনা | ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের ফলাফল |
সময়কাল | ২২-২৪ ফেব্রুয়ারি ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে |
স্থান | প্যারিস |
নেতা | থিয়ার্স, লা মার্টিন |
রাজা | লুই ফিলিপ |
ফলাফল | প্রজাতন্ত্র স্থাপন |
রাষ্ট্রপতি | লুই নেপোলিয়ন |
ভূমিকা:- ২২-২৪ ফেব্রুয়ারি ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সে সংঘটিত ফেব্রুয়ারি বিপ্লব ছিল এক যুগান্তকারী ঘটনা। ফ্রান্স ও ইউরোপ-এর ইতিহাসে এই বিপ্লবের প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী।
(১) ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের ফলে রাজতন্ত্রের অবসান
এই ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের মাধ্যমে ফ্রান্সে রাজতন্ত্রের অবসান এবং প্রজাতন্ত্রের জয় ঘোষিত হয়। লা-মার্টিন এই অস্থায়ী প্রজাতান্ত্রিক সরকারের রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হন। ফ্রান্সের জাতীয় সভার ১০ জন সদস্যকে নিয়ে একটি কার্যনির্বাহক সমিতি গঠিত হয়।
(২) সরকারের উদ্দেশ্য
প্রাপ্ত বয়স্কের সার্বজনীন ভোটাধিকার, শিক্ষাবিস্তার, বেকারদের কর্মসংস্থান, শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষা, সকল শ্রেণির অর্থনৈতিক ও গণতান্ত্রিক অধিকারের স্বীকৃতি দান, দারিদ্র্য দূরীকরণ, দাসপ্রথা লোপ, জাতীয় রক্ষীবাহিনীর গণতন্ত্রীকরণ প্রভৃতি এই সরকারের উদ্দেশ্য বলে ঘোষিত হয়।
(৩) সুন্দর বিপ্লব
বিপ্লবের পর ফ্রান্সে কোনও অরাজকতা দেখা দেয় নি। তাই কার্ল মার্কস এই বিপ্লবকে ‘Nice Revolution’ বা ‘সুন্দর বিপ্লব’ বলে অভিহিত করেছেন।
(৪) আইনসভা গঠন
সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে ৭৫০ জন সদস্যবিশিষ্ট একটি আইনসভা গঠিত হয়। এই আইনসভা ছিল এককক্ষ বিশিষ্ট। তাতে চার বছরের জন্য একজন নির্বাচিত রাষ্ট্রপতির ব্যবস্থা হয়। নেপোলিয়ন বোনাপার্ট -এর ভ্রাতুষ্পুত্র লুই নেপোলিয়ন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।
(৫) দ্বিতীয় সাম্রাজ্য
১৮৫২ খ্রিস্টাব্দের ২রা ডিসেম্বর অকস্মাৎ প্রজাতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে তিনি রাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন এবং তৃতীয় নেপোলিয়ন নামধারণ করে নিজেকে ‘ফরাসিদের সম্রাট’ বলে ঘোষণা করেন। এইভাবে দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্রের অবসান ঘটে এবং ফ্রান্সে ‘দ্বিতীয় সাম্রাজ্য‘ প্রতিষ্ঠিত হয়। সম্রাট পদে আসীন হয়ে তৃতীয় নেপোলিয়ন নিজ সাম্রাজ্যকে “The final flower of the French Revolution” বলে অভিহিত করেন।
(৬) ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের ফলে সাধারণ বুর্জোয়াদের ক্ষমতা লাভ
ফেব্রুয়ারি বিপ্লব একেবারে ব্যর্থ হয় নি। ফ্রান্সে স্বৈরশাসন ফিরে এলেও সার্বজনীন ভোটাধিকারের নীতি স্বীকৃতি লাভ করে এবং ভোটাধিকার সম্প্রসারণের ফলে নিম্নবিত্ত সাধারণ বুর্জোয়ারা রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভ করে।
(৭) লিপসনের মন্তব্য
ঐতিহাসিক লিপসন বলেন, “১৮৩০ খ্রিস্টাব্দের জুলাই বিপ্লব -এ অভিজাততন্ত্রের পতন ঘটে। ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি বিপ্লবে মূলধনী উচ্চ বুর্জোয়া শ্রেণির হাত থেকে ক্ষমতা চলে যায় এবং বুদ্ধিজীবী নিম্ন বুর্জোয়া বা পাতি বুর্জোয়া শ্রেণি ক্ষমতা করায়ত্ত করে।”
(৮) ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের ফলে শ্রমিক শ্রেণীর উন্নতি
অর্থনৈতিক গণতন্ত্রের ইতিহাসেও এক যুগান্তর ঘটে যায়। নানা ধরনের সমাজতান্ত্রিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হয়। শ্রমিক শ্রেণির উন্নতির জন্য শ্রম কমিশন গঠিত হয়। তাদের কাজের সময় সীমা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়—স্থির হয় যে প্যারিসে দশ ঘন্টা এবং প্রদেশগুলিতে শ্রমিকরা এগারো ঘন্টা করে কাজ করবে।
(৯) ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের ফলে জাতীয় কর্মশালা প্রতিষ্ঠা
সকলের জন্য কাজের অধিকার বা Right of Work স্বীকার করা হয়। বেকারদের কর্মসংস্থানের জন্য জাতীয় কর্মশালা’ (National Workshop) স্থাপিত হয়। এইসব কাজের ফল ছিল সুদূরপ্রসারী।
(১০) অর্ধ বিপ্লব
ঐতিহাসিক গ্রেনভিল ফ্রান্সের ফেব্রুয়ারি বিপ্লবকে ‘অর্ধ বিপ্লব’ বা ‘Half Revolution’ বলে অভিহিত করেছেন। ফ্রান্সে যে ‘জাতীয় কর্মশালা’ গঠিত হয়েছিল তা কার্যকর হয় নি। এর কারণ প্রজাতন্ত্রী ও সমাজতন্ত্রী দলের বিরোধ।
(১১) ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের ফলে ফ্রান্সের সংহতি
প্রজাতন্ত্রীদের বক্তব্য ছিল যে বিপ্লবের উদ্দেশ্য হল গণভোট প্রবর্তন ওপ্রজাতন্ত্র গঠন। সে উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হয়েছে। তাই এখন আর বিপ্লবের দরকার নেই—দরকার ফ্রান্সের সংহতি।
(১২) জুন বিদ্রোহ
সমাজতন্ত্রীদের বক্তব্য ছিল যে, বিপ্লবের ধ্বংসাত্মক কাজ শেষ হয়েছে, কিন্তু গঠনমূলক কাজ এখনও বাকি। এই বিরোধের ফলে প্রজাতন্ত্রী সরকার থেকে সমাজতন্ত্রীদের বাদ দেওয়া হয়। ‘জাতীয় কর্মশালা’-ও বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর বিরুদ্ধে শুরু হয় শ্রমিক বিদ্রোহ যা ‘জুন বিদ্রোহ’ নামে পরিচিত। এই বিদ্রোহ কঠোরভাবে দমিত হয়।
ফ্রান্সের বাইরে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের প্রভাব
১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দের বিপ্লবের সূচনা হয় প্যারিসে। কালক্রমে তা সমগ্র ইউরোপে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। যেমন –
(১) জোনাথন স্পেরবারের মন্তব্য
ঐতিহাসিক জোনাথন স্পেরবার (Jonathan Sperber) এই বিপ্লবকে ঊনিশ শতকের ইউরোপে সর্বাপেক্ষা ব্যাপকতম এবং সর্বাপেক্ষা হিংসাত্মক রাজনৈতিক আন্দোলন বলে অভিহিত করেছেন।
(২) টেলরের মন্তব্য
অধ্যাপক এ. জে. পি. টেলর-এর কথায়, “প্যারিস হল বিপ্লবের জননী।” এই বিপ্লব ইউরোপের ১৫টি দেশে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে গতি সঞ্চার করে।
(৩) শহরের বিপ্লব
এই বিপ্লব ছিল প্রধানত শহরের বিপ্লব। প্যারিস, মিলান, বার্লিন, রোম, ফ্লোরেন্স, বুদাপেস্ট, ভিয়েনা—ইউরোপের এই প্রধান শহরগুলিই ছিল বিপ্লবের প্রাণকেন্দ্র।
(৪) ঝটিকা কেন্দ্র
ডেভিড টমসন বলেন যে, প্যারিসকে পেছনে ফেলে মধ্য ও দক্ষিণ ইউরোপের রাজ্যগুলি অনেক অগ্রসর হয়। তাঁর মতে, প্যারিস নয়—মধ্য ও দক্ষিণ ইউরোপের শহরগুলিই ছিল এই বিপ্লবের ঝটিকা কেন্দ্র।
(৫) বিপ্লবের বৎসর
এই বিপ্লব সংঘটিত হয় মধ্যবিত্ত শ্রেণির সক্রিয়তায়, যারা মেটারনিখ পদ্ধতি আর মানতে চাইছিল না। এরিখ হবসবমের মতে, এটি ‘প্রথম সম্ভাব্য বিশ্ব বিপ্লব’। ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দকে তাই সাধারণভাবে ‘বিপ্লবের বৎসর বলে অভিহিত করা হয়।
(৬) জনতার যুগের সূচনা
ইতালি, জার্মানি, অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি—সর্বত্রই স্বৈরশাসন, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অনাচার এবং মেটারনিখ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তীব্র জাতীয়তাবাদী গণ-আন্দোলন দেখা দেয়। ডেভিড টমসন তাই বলেন যে, ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দ জনতার যুগের সূচনা করে”
ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের ফলে দেশে দেশে বিপ্লব
ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের ফলে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিপ্লব শুরু হয়। যেমন –
(১) ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের ফলে জার্মানিতে বিপ্লব
- (ক) জার্মানির প্রাশিয়া, হ্যানোভার, স্যাক্সনি, ব্যাভেরিয়া, ব্যাডেন, ব্রান্সউইক প্রভৃতি রাজ্যে উদারনৈতিক গণ-আন্দোলন শুরু হয় এবং এইসব রাজ্যের রাজন্যবর্গ জনগণকে উদারনৈতিক শাসনতন্ত্র মঞ্জুর করতে বাধ্য হন।
- (খ) ফ্রাঙ্কফোর্ট শহরে সমবেত হয়ে জার্মান জাতীয়তাবাদীরা ঐক্যবদ্ধ জার্মানির জন্য একটি জাতীয় পার্লামেন্ট ও সংবিধান তৈরি করেন। প্রাশিয়া-রাজ চতুর্থ ফ্রেডারিক উইলিয়মকে জার্মানির রাষ্ট্রপ্রধানের পদ গ্রহণের অনুরোধ করা হয়।
- (গ) স্বৈরতন্ত্র ও রাজার দৈবস্বত্বে বিশ্বাসী । প্রাশিয়া-রাজ এই পদ গ্রহণে অসম্মত হন। অস্ট্রিয়া বলপূর্বক এই ‘ফ্রাঙ্কফোর্ট পার্লামেন্ট ভেঙে দেয়। এ সত্ত্বেও বলতে হয় যে, এই সংবিধান ও ফ্রাঙ্কফোর্ট পার্লামেন্ট জার্মান ঐক্যের পথ প্রশস্ত করে।
(২) ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের ফলে ইতালিতে বিপ্লব
- (ক) ইতালির পার্মা, মডেনা, মিলান, ভেনিস, টাস্কানি, সিসিলি, নেপলস্ এবং পোপের রাজ্যে বিদ্রোহ দেখা দেয়। পিডমন্ট-সার্ডিনিয়ার অধিপতি চার্লস অ্যালবার্ট নিজ রাজ্যে একটি উদারনৈতিক শাসনতন্ত্র প্রবর্তন করেন।
- (খ) ভেনিস প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয় এবং লম্বার্ডি, ভেনেশিয়া ও মিলানের অধিবাসীরা অস্ট্রিয়ার সেনাবাহিনীকে বিতাড়িত করে। বিপ্লবী নেতা ম্যাৎসিনির নেতৃত্বে রোমে একটি প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়।
(৩) ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের ফলে অস্ট্রিয়ায় বিপ্লব
- (ক) মেটারনিখের নিজ সাম্রাজ্য অস্ট্রিয়ায় ভয়াবহ পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। ভিয়েনা, হাঙ্গেরি, বোহেমিয়া- সর্বত্র বিপ্লব ছড়িয়ে পড়ে। রাজধানী ভিয়েনাতে মেটারনিখের বাসভবন আক্রান্ত হয়। মেটারনিখ ইংল্যান্ড -এ আশ্রয় নেন এবং মেটারনিখতন্ত্রের সমাধি রচিত হয়।
- (খ) অস্ট্রিয়ার সম্রাট একটি উদারনৈতিক সংবিধান প্রবর্তনে বাধ্য হন। ‘হাঙ্গেরির ম্যাৎসিনি’ লুই কসুথের নেতৃত্বে হাঙ্গেরির স্বায়ত্তশাসনের দাবি জয়যুক্ত হয়। বোহেমিয়ায় চেক ও স্লাভ জাতীয়তাবাদীরা তাদের দাবি আদায়ে সক্ষম হয়।
(৪) ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের ফলে নেদারল্যান্ড ও ডেনমার্কে বিপ্লব
ডেনমার্ক ও নেদারল্যান্ডস-এও এই বিপ্লবের প্রভাব পড়ে। আন্দোলনের চাপে ডেনমার্ক-রাজ সপ্তম ফ্রেডারিক সংবিধান সভার অধিবেশন আহ্বান করতে বাধ্য হন। ডেভিড টমসন বলেন যে, “এইসব বিপ্লবের গতিপ্রকৃতি ছিল একই”।
ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের সীমিত সাফল্য
১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দের বিপ্লবের সাফল্যও ছিল সীমিত। প্রাথমিক বিপর্যয়ের ধাক্কা সামলে উঠে অস্ট্রিয়া অচিরেই প্রতি-আক্রমণ শুরু করে এবং তাতে ইতালি, জার্মানি ও অস্ট্রিয়ার বিভিন্ন প্রদেশের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়। প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির বিরুদ্ধে সাফল্যের জন্য জাতীয়তাবাদীদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হয়।
উপসংহার:- ঐতিহাসিক ট্রাভেলিয়ান বলেন যে, “১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দ ইউরোপের ইতিহাসে দিক-পরিবর্তন, কিন্তু ইউরোপ এই সময় মোড় ঘুরতে ব্যর্থ হয়।”
(FAQ) ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের ফলাফল সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
২২-২৪ ফেব্রুয়ারি ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সে।
লুই ফিলিপ।
ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের ফলে।
থিয়ার্স, লা মার্টিন।