১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্স ও প্রাশিয়ার মধ্যে সংঘটিত সেডানের যুদ্ধের ফলাফল বা গুরুত্ব প্রসঙ্গে জার্মানির ঐক্য সম্পন্ন, ইউরোপীয় রাজনীতির প্রাণকেন্দ্র পরিবর্তন, জার্মানির সম্রাট ঘোষণা, ইতালির ঐক্য সম্পন্ন, জার্মানির মর্যাদা বৃদ্ধি, ইউরোপীয় রাজনীতির নতুন পথে মোড়, বিসমার্কের মর্যাদা বৃদ্ধি, ফ্রান্সে রাজতন্ত্র চিরতরে বিলুপ্ত, ফ্রান্সে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, প্যারিস কমিউন গঠন, ক্যাথলিকদের বিরোধিতা, প্রাচ্যের সমস্যায় প্রভাব ও লণ্ডন বৈঠক সম্পর্কে জানবো।
সেডানের যুদ্ধের ফলাফল বা গুরুত্ব
ঐতিহাসিক ঘটনা | সেডানের যুদ্ধের ফলাফল |
সময়কাল | ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দ |
বিবাদমান পক্ষ | প্রাশিয়া ও ফ্রান্স |
ফলাফল | ফ্রান্সের পরাজয় |
পরিস্থিতি | জার্মানির ঐক্য আন্দোলন |
প্রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী | বিসমার্ক |
ভূমিকা:- প্রাশিয়ার নেতৃত্বে জার্মানির ঐক্য আন্দোলনের শেষ যুদ্ধ ছিল ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে সেডানের যুদ্ধ। এই যুদ্ধে ফ্রান্স প্রাশিয়ার কাছে চূড়ান্তভাবে পরাজিত হয়।
সেডানের যুদ্ধের ফলাফল
ইউরোপ-এর ইতিহাসে সেডানের যুদ্ধের গুরুত্ব অপরিসীম। যেমন –
(১) জার্মানির ঐক্য সম্পন্ন
এই যুদ্ধের ফলে ভিয়েনা ব্যবস্থার সমাধি রচিত হয়, ফ্রান্স ও জার্মানির সীমানা সংশোধিত হয়, ফ্রান্সের দ্বিতীয় সাম্রাজ্য-এর পতন ঘটে এবং জার্মানির ঐক্য সম্পন্ন হয়।
(২) ইউরোপীয় রাজনীতির প্রাণকেন্দ্র পরিবর্তন
দীর্ঘ দুশো বছর ধরে প্যারিস ছিল ইউরোপীয় রাজনীতির প্রাণকেন্দ্র। এই যুদ্ধের ফলে ইউরোপীয় রাজনীতির প্রাণকেন্দ্র প্যারিস থেকে বার্লিনে স্থানান্তরিত হয়। তাই বলা হয় যে, “ইউরোপ একজন কর্ত্রী হারিয়ে একজন কৰ্তা পেল।”
(৩) জার্মানির সম্রাট প্রথম উইলিয়াম
এই যুদ্ধের পর দক্ষিণ জার্মানির রাজ্যগুলি ও আলসাস-লোরেন উত্তর জার্মানির সঙ্গে যুক্ত হয়। ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দের ১৮ই জানুয়ারি ভার্সাই রাজপ্রাসাদে প্রাশিয়া-রাজ প্রথম উইলিয়ম ঐক্যবদ্ধ জার্মানির সম্রাট হিসেবে ঘোষিত হন।
(৪) ইতালির ঐক্য সম্পন্ন
এই যুদ্ধের সময় ফরাসি সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়ন রোম থেকে সেনা অপসারণে বাধ্য হন। এই সুযোগে পিডমন্ট-অধিপতি ভিক্টর ইমান্যুয়েল রোম দখল করেন। এর ফলে ইতালির ঐক্যও সম্পূর্ণ হয়।
(৫) জার্মানির মর্যাদা বৃদ্ধি
ফ্রান্স ও অস্ট্রিয়াকে পরাজিত করার ফলে প্রাশিয়া তথা জার্মানির মর্যাদা বহুল পরিমাণে বৃদ্ধি পায় এবং জার্মানি ইউরোপের শ্রেষ্ঠ শক্তিতে পরিণত হয়।
(৬) ইউরোপীয় রাজনীতির নতুন পথে মোড়
বিসমার্কের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, সামরিক শক্তি, জনসংখ্যা, ভারী শিল্প এবং রেল যোগাযোগের মাধ্যমে ইউরোপে এক নতুন ‘কলোসাস’ হিসেবে জার্মানির উত্থান ঘটে। ইউরোপীয় রাজনীতি নতুন পথে মোড় নেয়।
(৭) বিসমার্কের মর্যাদা বৃদ্ধি
বিসমার্ক ইউরোপের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কূটনীতিক হিসেবে স্বীকৃতি পান এবং ইউরোপীয় শক্তির ভারকেন্দ্র ভিয়েনা থেকে বার্লিনে স্থানান্তরিত হয়। কেটেলবি বলেন যে, এই যুদ্ধে জয়লাভের ফলে জার্মানি ইউরোপের কর্ত্রী এবং বিসমার্ক জার্মানির কর্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন।
(৮) ফ্রান্সের রাজতন্ত্রে চিরতরে বিলুপ্ত
এই যুদ্ধের ফলে ফ্রান্সের মর্যাদা ধূলিলুণ্ঠিত হয়। ফরাসি সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়ন পরাজিত ও বন্দি হন। ফরাসি পার্লামেন্ট তাঁকে পদচ্যুত করে ফ্রান্সে দ্বিতীয় সাম্রাজ্যের অবসান ঘোষণা করে—ফ্রান্সে রাজতন্ত্র চিরতরে অবলুপ্ত হয়।
(৯) ফ্রান্সে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা
ফরাসি পার্লামেন্ট ফ্রান্সে তৃতীয় প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করে। ফ্রান্স থেকে প্রজাতন্ত্র আর কখনও বিলুপ্ত হয় নি।
(১০) প্যারিস কমিউন গঠন
প্যারিসের শ্রমজীবী জনতা এই প্রজাতন্ত্রের উপর আস্থা রাখতে পারে নি। এই কারণে তারা ‘প্যারিস কমিউন’ নামে একটি সমান্তরাল সরকার প্রতিষ্ঠা করে সমাজতন্ত্রের পক্ষে লড়াই শুরু করে। বলা হয় যে, মানব সভ্যতার ইতিহাসে ‘প্যারিস কমিউন’ হল মেহনতি জনতার প্রথম শাসন। তাদের উদ্যোগ ব্যর্থ হয়, কারণ এই সরকারের স্থায়িত্ব ছিল মাত্র দু’ মাস।
(১১) ক্যাথলিকদের বিরোধিতা
রোম থেকে পোপের অধিকার অপসৃত হওয়ায় পোপ ও ক্যাথলিক চার্চ প্রবল ক্ষুব্ধ হয়। পরাজিত দুই রাষ্ট্র অস্ট্রিয়া ও ফ্রান্স ছিল ক্যাথলিক সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র। স্বাভাবিকভাবেই ইতালি ও জার্মানির সঙ্গে ক্যাথলিকদের সুসম্পর্ক ছিল না। বিসমার্ককে অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে ক্যাথলিকদের বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়।
(১২) প্রাচ্যের সমস্যায় প্রভাব
সেডানের যুদ্ধ প্রাচ্য সমস্যাকেও প্রভাবিত করে। এই যুদ্ধের সুযোগ নিয়ে রাশিয়া প্যারিসের সন্ধি (১৮৫৬ খ্রিঃ)-র নৌ-সংক্রান্ত শর্তগুলি লঙ্ঘন করতে থাকে। রাশিয়া কৃষ্ণসাগরের তীরে দুর্গ নির্মাণ করে তার শক্তিবৃদ্ধি করতে সচেষ্ট হয়।
(১৩) লণ্ডন বৈঠক
ইংল্যান্ড রাশিয়ার কার্যকলাপের বিরোধিতা করতে থাকে এবং এই উদ্দেশ্যে লন্ডনে একটি আন্তর্জাতিক বৈঠক ডাকা হয় (ডিসেম্বর, ১৮৭০ – মার্চ, ১৮৭১ খ্রিঃ)। এই বৈঠকে প্যারিসের সন্ধি লঙ্ঘন করার জন্য রাশিয়াকে দায়ী করা হলেও তার বিরুদ্ধে কোনও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয় নি। এর ফলে রাশিয়ার অবৈধ কার্যকলাপ একরকম স্বীকৃতি পায়।
উপসংহার:- অধ্যাপক এ. জে. পি. টেলর বলেন যে, সেডানের যুদ্ধের পর ইউরোপীয় রাজনীতি নতুন চরিত্র ধারণ করে। এই উক্তির মধ্যে কোনও বাহুল্য নেই। বস্তুত এই সময় থেকে ইউরোপীয় রাজনীতিতে যে সব পরিবর্তনের সূচনা হয়, তা পরবর্তী ইতিহাসকে নানাভাবে প্রভাবিত করে। অধ্যাপক ডেভিড টমসন বলেন যে, ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দের আশা-আকাঙ্ক্ষাই ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে পূর্ণতা পায়।
(FAQ) সেডানের যুদ্ধের ফলাফল সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে প্রাশিয়া ও ফ্রান্স।
বিসমার্ক।
সেডানের যুদ্ধ।
ফ্রাঙ্কফোর্টের সন্ধি ১০ মে ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দ।