ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়নের রাশিয়া অভিযানের কারণ প্রসঙ্গে জটিল ও বৃহত্তর পরিকল্পনা, টিলসিটের সন্ধির ব্যর্থতার কারণ হিসেবে জারের উদ্দেশ্য ব্যর্থ, জারের ক্ষোভ, নেপোলিয়নের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ, জারের উপলব্ধি, গ্ৰান্ড ডাচি অফ ওয়ারশ গঠন, ওল্ডেনবার্গ দখল, অস্ট্রিয়ার সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক, মহাদেশীয় ব্যবস্থা ও রাশিয়া অভিযানের কারণের গুরুত্ব সম্পর্কে জানবো।
নেপোলিয়নের রাশিয়া অভিযানের কারণ
ঐতিহাসিক ঘটনা | নেপোলিয়নের রাশিয়া অভিযানের কারণ |
সময়কাল | ২৬ জুন, ১৮১২ খ্রিস্টাব্দ |
রাশিয়ার জার | প্রথম আলেকজান্ডার |
টিলসিটের সন্ধি | ১৮০৭ খ্রিস্টাব্দ, নেপোলিয়ন ও রাশিয়া |
ফলাফল | নেপোলিয়নের ব্যর্থতা |
ভূমিকা:- ১৮০৭ খ্রিস্টাব্দে টিলসিটের সন্ধি (Treaty of Tilsit) দ্বারা ফ্রান্স ও রাশিয়ার মধ্যে মৈত্রী গড়ে ওঠে, এবং পরের বছর ১৮০৮ খ্রিস্টাব্দে এরফার্ট-এর সন্ধি (Treaty of Erfurt) দ্বারা এই মৈত্রীচুক্তি সমর্থিত হয়। তা সত্ত্বেও ফ্রান্স-রুশ মৈত্রী বেশি দিন স্থায়ী হয় নি।
জটিল ও বৃহত্তর পরিকল্পনা
নেপোলিয়নকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে এক ব্যাপক অভিযানে অগ্রসর হতে হয়। তাঁর নিজের মতে, এই অভিযান ছিল তাঁর জীবনের সর্বাপেক্ষা জটিল ও বৃহত্তর পরিকল্পনা।
নেপোলিয়নের রুশ অভিযানের কারণ
ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়নের রাশিয়া অভিযান বা ফ্রান্স ও রাশিয়ার মৈত্রীতে ফাটল ধরার জন্য বেশ কয়েকটি কারণকে দায়ী করা যায়। যথা –
(১) টিলসিটের সন্ধির বিফলতা
টিলসিটের সন্ধি স্বাক্ষরের কিছুদিন পরেই নেপোলিয়ন সম্পর্কে জারের আশাভঙ্গ হয়। কারণ,
(ক) জারের উদ্দেশ্য ব্যর্থ
তুরস্ক সাম্রাজ্যকে ভাগ করে নেওয়া এবং কনস্ট্যান্টিনোপল দখলের উদ্দেশ্যেই জার এই সন্ধি সম্পর্কে আগ্রহী হয়েছিলেন, কিন্তু তিনি শীঘ্রই বুঝে গেলেন যে, তাঁর এই উদ্দেশ্য সফল হওয়ার নয়।
(খ) জারের ক্ষোভ
নেপোলিয়ন কোনওভাবেই তুরস্ক বিভাজনে রাজি হবেন না । এই সন্ধির দ্বারা নেপোলিয়ন তুরস্কের বিরুদ্ধে রাশিয়াকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন, কিন্তু রুশ-তুরস্ক যুদ্ধের সময় নেপোলিয়ন তাঁর প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেন নি। এতে জার প্রবল ক্ষুব্ধ হন।
(গ) নেপোলিয়নের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ
নেপোলিয়ন সুইডেনের বিরুদ্ধেও জারকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন। এই প্রতিশ্রুতিও পালিত হয় নি।
(ঘ) জারের উপলব্ধি
কিছুদিনের মধ্যেই জার বুঝতে পারেন যে, নেপোলিয়ন রাশিয়াকে তাঁর তাঁবেদার রাষ্ট্র -এ পরিণত করতে চান।
(ঙ) স্টাইনের বক্তব্য
প্রাশিয়ার নির্বাসিত দেশপ্রেমিক স্টাইন এই সময় মস্কোতে বসবাস করছিলেন। তিনি রুশ মন্ত্রীদের বোঝান যে, জার-শাসিত রাশিয়ার ফরাসি তোষণ নীতির পরিবর্তন হওয়া দরকার — অন্যথায় রাশিয়া নিজেই বিপন্ন হবে।
(চ) ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূতের বক্তব্য
ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূতও রুশ নেতৃবৃন্দকে এইভাবেই বোঝাতে থাকেন এবং জারকে নেপোলিয়ন-বিরোধী বিভিন্ন রাষ্ট্রজোটে যোগ দেওয়ার জন্য প্ররোচিত করতে থাকেন। এর ফলে জার টিলসিটের সন্ধি সম্পর্কে নতুন করে ভাবনা-চিন্তা শুরু করেন।
(২) গ্র্যান্ড ডাচি অফ ওয়ারশ
- (ক) প্রাশিয়া-অধিকৃত পোল্যান্ড-এর অংশ নিয়ে নেপোলিয়ন ‘গ্র্যান্ড ডাচি অফ ওয়ারশ গঠন করেন। ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দে অস্ট্রিয়ার কাছ থেকে গ্যালিসিয়া দখল করে এর আয়তন বৃদ্ধি করা হয়।
- (খ) রাশিয়ার ধারণা হয় যে, নেপোলিয়ন পূর্বেকার স্বাধীন পোল্যান্ড রাষ্ট্র গঠনের চেষ্টা করছেন এবং সেক্ষেত্রে তিনি রাশিয়া কর্তৃক অধিকৃত পোল্যান্ডের অংশগুলিকে নবগঠিত গ্র্যান্ড ডাচি অফ ওয়ারশ-এর সঙ্গে যুক্ত করার উদ্যোগ নেবেন।
- (গ) জার এই মর্মে নেপোলিয়নের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি চান যে, পোল্যান্ডকে কখনোই একটি পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্রে পরিণত করা হবে না। নেপোলিয়ন এই প্রতিশ্রুতি দিতে অস্বীকৃত হলে জার সন্দিগ্ধ, ভীত ও ক্ষুব্ধ হন।
(৩) ওল্ডেনবার্গ দখল
ওল্ডেনবার্গের ডিউক ছিলেন জারের ভগ্নিপতি—তিনি জারের প্রিয় ভগিনী, ক্যাথারিনকে বিবাহ করেন। তিনি মহাদেশীয় অবরোধ প্রথা অগ্রাহ্য করলে নেপোলিয়ন এই রাজ্যটি দখল করেন। এই আক্রমণ ছিল টিলসিটের সন্ধির পরিপন্থী। এর ফলে জার এবং রুশ অভিজাত সম্প্রদায় নেপোলিয়নের প্রতি প্রচণ্ড বিরক্ত হন। তাঁরা নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের পক্ষপাতী ছিলেন।
(৪) অস্ট্রিয়ার সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক
নেপোলিয়ন জারের ভগিনী আনা-কে বিবাহের প্রস্তাব দেন। জার, তাঁর মাতা ও রুশ দরবার এই প্রস্তাবে অসম্মতি জানালে তিনি প্রবল অপমানিত বোধ করেন। এই অবস্থায় তিনি অস্ট্রিয়ার হ্যাপস্বার্গ-বংশীয়া রাজকন্যা মারিয়া লুইসা-কে বিবাহ করেন। এর ফলে জার বিপদের আশঙ্কা করেন। তিনি মনে করেন যে, ফ্রান্স ও অস্ট্রিয়া ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাশিয়ার ক্ষতি করবে।
(৫) মহাদেশীয় ব্যবস্থা
- (ক) মহাদেশীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে রাশিয়া প্রবল অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। ইংল্যান্ড-জাত দ্রব্যাদির অভাবে রুশ জনসাধারণের দুর্দশা বৃদ্ধি পায়। রাশিয়ার কারখানাগুলি ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায়, বেকার সমস্যা বৃদ্ধি পায় এবং জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়।
- (খ) রাশিয়া অবরোধ প্রথা মানতে বাধ্য হলেও নেপোলিয়ন নিজে ফরাসি বণিকদের ইংল্যান্ড থেকে মাল আমদানির লাইসেন্স দিতে থাকেন। এর ফলে ক্ষুব্ধ জার ১৮১০ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়ার বন্দরগুলি ব্রিটিশ বাণিজ্যের জন্য খুলে দেন। এর ফলে মহাদেশীয় অবরোধ ব্যবস্থায় ফাটল ধরে এবং নেপোলিয়ন প্রবল ক্ষুব্ধ হন।
নেপোলিয়নের রুশ অভিযানের কারণের গুরুত্ব
নেপোলিয়ন ও জারের মধ্যে সম্পর্কের অবনতির জন্য কোন কারণটি সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ তা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে। যেমন –
- (১) ডেভিড টমসন-এর মতে, নেপোলিয়নের রুশ অভিযানের মূল কারণ হল মহাদেশীয় অবরোধ ব্যবস্থা কার্যকর করতে জারের অনিচ্ছা ও অস্বীকৃতি। মর্স স্টিফেন্স ও হবসবমও একই বক্তব্য প্রকাশ করেছেন।
- (২) গ্রান্ট ও টেম্পারলি-র মতে, উভয় দেশের মধ্যে বিরোধের মূল ও প্রধান কারণ হল পোল্যান্ডের সমস্যা। নেপোলিয়নের জীবনীকার ভিনসেন্ট ক্রোনিন (Vincent Cronin)-ও অনুরূপ বক্তব্য রেখেছেন।
- (৩) ঐতিহাসিক কোবান এই সম্পর্কে একটি ভিন্নতর বক্তব্য রেখেছেন। এই ব্যাপারে তিনি মহাদেশীয় অবরোধ ব্যবস্থা অপেক্ষা রুশ-তুরস্ক মৈত্রীর উপর অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করেছেন।
- (৪) ফরাসি-রুশ মৈত্রী ভেঙে পড়ার জন্য কোন কারণটি সবচেয়ে বেশি দায়ী ছিল, তা নির্ণয় করা দুরূহ, তবে এ কথা বললে অযৌক্তিক হবে না যে, এই দুই দেশের মধ্যে প্রকৃত মিত্রতার কোনও সুযোগই ছিল না, এবং উভয়ের মধ্যে সংঘর্ষই ছিল স্বাভাবিক ও প্রত্যাশিত।
উপসংহার:- আসলে নেপোলিয়নের তুরস্ক ও পোল্যান্ড নীতি ছিল ভ্রান্ত এবং রাশিয়ার উপর মহাদেশীয় অবরোধ ব্যবস্থা চাপিয়ে দিয়ে তিনি খুবই অন্যায় করেছিলেন।
(FAQ) নেপোলিয়নের রাশিয়া অভিযানের কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
২৬ জুন, ১৮১২ খ্রিস্টাব্দ।
১৮০৭ খ্রিস্টাব্দ, নেপোলিয়ন ও রাশিয়ার জার।
প্রথম আলেকজান্ডার।
লিও তলস্তয় (টলস্টয়) ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’ গ্ৰন্থে।