উপদ্বীপের যুদ্ধে ফরাসিদের ব্যর্থতার কারণ হিসেবে স্পেনের ভৌগোলিক অবস্থান, খাদ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাব, গেরিলা যুদ্ধনীতি, হ্যাজেনের মন্তব্য, স্পেনের জাতীয়তাবোধ, সর্বশক্তি দিয়ে যুদ্ধে নামেন নি, ইংল্যান্ডের সাফল্য, ক্যাথলিক ধর্ম ও যোশেফের অযোগ্যতা সম্পর্কে জানবো।
উপদ্বীপের যুদ্ধে ফরাসিদের ব্যর্থতার কারণ
ঐতিহাসিক ঘটনা | উপদ্বীপের যুদ্ধে ফরাসিদের ব্যর্থতার কারণ |
সময়কাল | ১৮০৮-১৮১২ খ্রিস্টাব্দ |
বিবাদমান পক্ষ | স্পেন ও পোর্তুগাল জোট এবং নেপোলিয়ন |
উদ্দেশ্য | মহাদেশীয় ব্যবস্থা কার্যকর |
ফলাফল | নেপোলিয়নের ব্যর্থতা |
ভূমিকা:- মহাদেশীয় ব্যবস্থাকে কার্যকর করতে গিয়ে নেপোলিয়ন আইবেরীয় উপদ্বীপ অর্থাৎ স্পেন ও পোর্তুগালের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। স্পেন ও পোর্তুগালের সাথে নেপোলিয়ন তথা ফ্রান্স -এর এই যুদ্ধ উপদ্বীপের যুদ্ধ নামে পরিচিত।
উপদ্বীপের যুদ্ধে ফরাসিদের ব্যর্থতার কারণ
স্পেনের সাথে যুদ্ধে নেপোলিয়ন তথা ফরাসিদের ব্যর্থতার জন্য নানা কারণকে দায়ী করা যায়। যেমন –
(১) স্পেনের ভৌগোলিক পরিবেশ
স্পেন ছিল পাহাড়-পর্বত-অরণ্য ও জলাভূমিতে পূর্ণ এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নদী দ্বারা পরিবেষ্টিত একটি দেশ। এর জলবায়ু বড়োই বিচিত্র — শীত-গ্রীষ্মের পরিবর্তন ছিল বড়োই আকস্মিক। এই ধরনের বিচিত্র ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশ নেপোলিয়নের সেনাদলের কাছে যথেষ্ট অসুবিধাজনক ছিল।
(২) খাদ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাব
স্পেন ছিল একটি পর্বতসঙ্কুল দরিদ্র দেশ। এর জনবসতি ছিল বিক্ষিপ্ত এবং কৃষিক্ষেত্রও যথেষ্ট উন্নত নয়। এখানে কোনও বিশাল সেনাবাহিনীর পরিবহন ও খাদ্য সমস্যার সমাধান সহজ ছিল না। স্পেন এমন একটি দেশ যেখানে বিশাল সেনাবাহিনী অনাহারে শুকিয়ে মরে, আর ক্ষুদ্র বাহিনী পরাজিত হয়।
(৩) গেরিলা যুদ্ধনীতি
স্পেনের এই ভৌগোলিক পরিবেশ গেরিলা যুদ্ধের অনুকূল ছিল। স্পেনীয় গেরিলারা অতর্কিত আক্রমণে ফরাসি সেনাদের ছিন্নভিন্ন করে দিত, তাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং খাদ্য ও অস্ত্র সরবরাহে নানা বিঘ্ন ঘটাত।
(৪) হ্যাজেনের মন্তব্য
ঐতিহাসিক হ্যাজেন (Hazen) বলেন যে, “রক্ষণাত্মক যুদ্ধের জন্য স্পেন উপযুক্ত ছিল, কিন্তু আক্রমণাত্মক যুদ্ধের জন্য তা সুবিধাজনক ছিল না।”
(৪) স্পেনের জাতীয়তাবোধ
এতদিন পর্যন্ত নেপোলিয়ন বিভিন্ন রাজন্যবর্গের ভাড়াটিয়া সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। স্পেনের মানুষদের দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের স্বরূপ তিনি বুঝতে পারেন নি। নবজাগ্রত জাতীয়তাবাদের কাছে তাঁকে মাথা নত করতে হয়।
(৫) সর্বশক্তি দিয়ে যুদ্ধে নামেন নি
- (ক) স্পেনের যুদ্ধে নেপোলিয়ন পূর্ণ সময় এবং মনোযোগ দিতে পারেন নি। কারণ, এই সময় তিনি মধ্য ইউরোপ-এর সমস্যা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। ১৮০৮ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে তিনি স্পেনের যুদ্ধে যোগ দেন।কিন্তু করুন্নার যুদ্ধের পর ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি স্পেন-ত্যাগে বাধ্য হন। তিনি আর স্পেনে যান নি।
- (খ) ১৮১০ খ্রিস্টাব্দে তিনি সেনাপতি ম্যাসেনা-কে স্পেনে পাঠান, কিন্তু তাঁকে উপযুক্ত সাহায্য দিতে ব্যর্থ হন। ১৮১২ খ্রিস্টাব্দে তিনি সেনাপতি সুল্ট-কে ফ্রান্সে ফেরত পাঠান।
- (গ) অবশেষে ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে যখন সব দিক থেকে বিধ্বস্ত তখন তিনি বিনা কারণে বেশ কিছু নির্দোষ সৈনিককে হত্যা করেন। তিনি যদি সর্বশক্তি দিয়ে স্পেনে যুদ্ধে নামতেন, তাহলে তার কী ফল হত বলা দুরূহ।
- (ঘ) এছাড়া, ফরাসি সেনাপতিদের পারস্পরিক বিদ্বেষ ও ঈর্ষা ফরাসি বাহিনীকে ঐক্যবদ্ধ হতে দেয় নি।
(৬) ইংল্যান্ডের সাফল্য
ইংল্যান্ডের বিরোধিতা নেপোলিয়নের পরাজয়ের অন্যতম কারণ। ইংল্যান্ড অর্থ, অস্ত্র, সৈন্য দিয়ে সর্বভাবে স্পেনকে সাহায্য করে। এছাড়া, আর্থার ওয়েলেসলির মতো দক্ষ ব্রিটিশ সেনানায়কও স্পেনীয়দের পক্ষে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। ঐতিহাসিক ম্যারিয়ট লিখছেন যে, “ইউরোপকে জানানো হল যে, নেপোলিয়ন অপরাজেয় নন।”
(৭) ক্যাথলিক ধর্ম
স্পেনের গণ-আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিল ক্যাথলিক সম্প্রদায়-ভুক্ত নিম্ন যাজক সম্প্রদায় ও পুরোহিত শ্রেণি। গির্জার সম্পত্তির উপর নেপোলিয়নের হস্তক্ষেপ তাঁদের ক্ষিপ্ত করে তোলে। তাঁরা নেপোলিয়নের বিরোধিতা করেন এবং স্পেনীয়দের যুদ্ধে অনুপ্রাণিত করেন।
(৮) যোসেফের অযোগ্যতা
নেপোলিয়ন তাঁর ভ্রাতা যোসেফকে স্পেনের সিংহাসনে বসান। স্পেনবাসী তাঁকে মেনে নেয় নি। এছাড়া, তিনি ছিলেন অযোগ্য ও অপদার্থ। পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার কোনও ক্ষমতাই তাঁর ছিল না। তিনি সেনাপতিদের পারস্পরিক বিদ্বেষ মিটিয়ে তাঁদের লক্ষ্যকে একমুখী করতে ব্যর্থ হন।
উপসংহার:- প্রকৃতপক্ষে স্পেনে নেপোলিয়নের ক্ষমতার ভিত্তিই ছিল দুর্বল। তাছাড়া স্পেনের অধিবাসীদের জাতীয়তাবোধ ছিল প্রবল। তাই তাদের প্রতিরোধ করা নেপোলিয়নের পক্ষে সম্ভব হয় নি।
(FAQ) উপদ্বীপের যুদ্ধে ফরাসিদের ব্যর্থতার কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
১৮০৮-১৮১২ খ্রিস্টাব্দে স্পেন ও পোর্তুগালে নেপোলিয়ন বিরোধী মে গণ অভ্যুত্থান ঘটে তা উপদ্বীপের যুদ্ধ নামে পরিচিত।
যোশেফ বোনাপার্ট।
গেরিলা যুদ্ধনীতি।