পরবর্তী বৈদিক যুগের রাজনৈতিক অবস্থা প্রসঙ্গে উপাদান সাম্রাজ্যবাদের প্রবণতা, মধ্যদেশের প্রাধান্য, সার্বভৌমত্ব, রাজার ক্ষমতা বৃদ্ধি, রাজার ঐশ্বরিক ক্ষমতা, রাজ কর্মচারী, রাজার কর্তব্য এবং সভা ও সমিতি সম্পর্কে জানবো।
পরবর্তী বৈদিক যুগের রাজনৈতিক অবস্থা
ঐতিহাসিক ঘটনা | পরবর্তী বৈদিক যুগের রাজনৈতিক অবস্থা |
সভ্যতা | বৈদিক সভ্যতা |
অধিবাসী | আর্য জাতি |
রাজার উপাধি | একরাট, বিরাট |
সংস্থা | সভা ও সমিতি |
ভূমিকা :- পরবর্তী বৈদিক যুগ বলতে ঋগ্বেদ -এর পরবর্তী যুগ বুঝায়। ঋক বেদিক যুগ-এর সঙ্গে পরবর্তী বৈদিক যুগের প্রভূত সময়ের ব্যবধান আছে। আর এই ব্যবধানের মধ্যে রাজনৈতিক পরিবর্তনও ঘটে যথেষ্ট পরিমাণে।
পরবর্তী বৈদিক যুগের রাজনীতি সম্পর্কে উপাদান
পরবর্তী বৈদিক যুগ সম্পর্কে পরবর্তী বৈদিক গ্রন্থগুলি যথা সামবেদ, যজুর্বেদ, অথর্ববেদ থেকে, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদ থেকে তথ্য পেতে পারি। এছাড়া গঙ্গা-যমুনা উপত্যকায় খননের ফলে প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান যথা – হস্তিনাপুরের মৃৎ শিল্পের নিদর্শন পাওয়া যায়। তবে বৈদিক সাহিত্যই হল এই যুগের ইতিহাসের প্রধান উপাদান।
পরবর্তী বৈদিক যুগে সাম্রাজ্যবাদের প্রবণতা
ঋকবেদের যুগে আর্য গোষ্ঠীগুলির সঙ্গে অনার্যদের এবং বিভিন্ন আর্য গোষ্ঠীগুলির মধ্যে যুদ্ধ-বিগ্রহ চলত। নিরন্তর যুদ্ধ-বিগ্রহ ও কৃষিক্ষেত্র দখলের জন্য সংগ্রামের দরুণ বৈদিক আর্যদের মধ্যে সাম্রাজ্যবাদের প্রবণতা দেখা দেয়। কুরু, পাঞ্চাল প্রভৃতি নবোদিত আর্য গোষ্ঠীগুলি পরবর্তী বৈদিক যুগে প্রাধান্য পায়। পুরাতন আর্য উপজাতিগুলি ভেঙে নতুনভাবে সংমিশ্রণ হয়ে এই নতুনতর আর্য গোষ্ঠী বা উপজাতিগুলি গড়ে ওঠে। যেমন – ভরত ও পুরুর মিলনে কুরু উপজাতির সৃষ্টি হয়।
পরবর্তী বৈদিক যুগে মধ্যদেশের প্রাধান্য
এই যুগে আর্য বসতি পূর্ব ভারত -এ এবং দক্ষিণে বিস্তৃত হলে আর্যদের একমাত্র বাসস্থান হিসেবে পাঞ্জাবের প্রভাব কমে যায়। গঙ্গা-যমুনা উপত্যকা বা মধ্যদেশ আর্য সভ্যতার প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়।
পরবর্তী বৈদিক যুগে সার্বভৌমত্ব
পরবর্তী বৈদিক যুগে পূর্ব ভারত -এর দিকে আর্য বসতি বিস্তারের ফলে বৃহৎ রাজ্য গড়ে ওঠে। কাশী, কোশল, বিদেহ, বৎস, মথুরা প্রভৃতি রাজ্য এই যুগে গড়ে ওঠে। মগধ, অঙ্গ ও বাংলা তখন আর্য সভ্যতার বাইরে ছিল। এই বৃহৎ রাজ্যগুলির মধ্যে একচ্ছত্র ক্ষমতা লাভের প্রতিদ্বন্দ্বিতা আরম্ভ হয়। এর ফলে সার্বভৌম আদর্শ জনপ্রিয়তা পায়।
পরবর্তী বৈদিক যুগে সাম্রাজ্যবাদ
এই যুগের শক্তিশালী রাজারা তাদের ক্ষমতা বুঝবার জন্য সম্রাট, একরাট, বিশ্বজননী প্রভৃতি উপাধি গ্রহণ করেন। এই সকল রাজারা রাজসূয় ও অশ্বমেধ যজ্ঞ দ্বারা তাদের ক্ষমতাকে আনুষ্ঠানিক মর্যাদা দেন। শতপথ ব্রাহ্মণে অশ্বমেধ যজ্ঞের অনুষ্ঠানের উল্লেখ দেখা যায়।
পরবর্তী বৈদিক যুগে রাজার ক্ষমতা বৃদ্ধি
এই পরবর্তী বৈদিক যুগে রাজার ক্ষমতা প্রধানত তিনটি কারণে বৃদ্ধি পায়। যথা –
- (১) বৃহৎ রাজ্য বা ভৌগোলিক সীমা চিহ্নিত রাজ্য গড়ে ওঠার ফলে উপজাতিক যুগ অপেক্ষা রাজার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
- (২) বিভিন্ন উপজাতির যুদ্ধ ও রাজ্য বিস্তারের জন্য যুদ্ধের ফলে রাজার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
- (৩) রাজা তার কর্মচারীদের সাহায্যে তার ক্ষমতা প্রসারিত করেন।
পরবর্তী বৈদিক যুগে রাজার ঐশ্বরিক ক্ষমতা
- (১) রাজার ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবার ফলে তাঁর দৈব অধিকারের তত্ত্বকে জোরালোভাবে প্রচার করা হয়। প্রজাপতি ব্রহ্মা বা দেবরাজ ইন্দ্র রাজপদ সৃষ্টি করেন বলে বলা হয়। রাজা অভিষেক প্রথার দ্বারা স্বর্গীয় ক্ষমতা লাভ করেন বলে ব্রাহ্মণরা ঘোষণা করেন।
- (২) সমাজে রাজা ছাড়া ব্রাহ্মণ বা পুরোহিত ছিলেন একমাত্র ঐশ্বরিক ক্ষমতার অধিকারী। রাজা ও পুরোহিত ঐশ্বরিক ক্ষমতা দাবী করে নিজেদের সাধারণ লোক হতে স্বতন্ত্র বলে দাবী করেন।
- (৩) ঐতিহাসিক বাসাম -এর মতে, পরবর্তী বৈদিক যুগে রাজার স্বৈর ক্ষমতার ওপর বিশেষ কোন নিয়ন্ত্রণ ছিল না। ব্রাহ্মণদের বিশেষ অধিকার ও জনমত রাজার ক্ষমতাকে কিছুটা নিয়ন্ত্রিত করত মাত্র।
- (৪) কোশাম্বী প্রমুখ ঐতিহাসিক মনে করেন যে, কার্যত রাজার ক্ষমতা স্বৈরাচারী ছিল না। নির্বাচনের মাধ্যমে রাজা নিয়োগের প্রথা তখনও কিছুটা প্রচলিত ছিল। ঐতরেয় ব্রাহ্মণে এরূপ নির্বাচনের উল্লেখ দেখা যায়।
- (৫) রাজপদ তখনও পুরোপুরি বংশানুক্রমিক হয় নি। জনসাধারণের মতামতের দাম ছিল। জনসাধারণ অত্যাচারী রাজাকে সিংহাসন থেকে বিতাড়িত করত।
- (৬) উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় যে, সঞ্জয় উপজাতি তাদের অত্যাচারী রাজা দৃষ্ট ধাতুকে বিতাড়িত করে। তবে ক্রমে রাজপদ বংশানুক্রমিক হতে থাকে। রাজার ওপর যে নিয়ন্ত্রণগুলি ছিল তা শিথিল হয়ে পড়ে।
পরবর্তী বৈদিক যুগের রাজকর্মচারী
রাজার ক্ষমতা এবং রাষ্ট্রের আকৃতি বৃদ্ধির ফলে নতুন নতুন কর্মচারীর পদ সৃষ্টি করা হয়। রত্নিন নামে এক শ্রেণীর অভিজাত কর্মচারী রাজাকে রাজকার্যে পরামর্শ দিত। এছাড়া পুরোহিত, রাজকর্মচারীগণ সূত বা রথ চালক, সংগ্রহিত্রী বা কোষাধ্যক্ষ, ভাগদুখ বা রাজস্ব সংগ্রাহক প্রভৃতি কর্মচারী ছিল। এছাড়া রাজসভায় ক্ষত্রী, অক্ষবাপ বা পাশা খেলার সঙ্গী থাকত। এই সকল সভাসদরা নিজেদের রাজার প্রতিভু বলে দাবী করত। অভিষেকের আগে রাজা এই সকল ব্যক্তির গৃহে সাক্ষাৎ করতেন।
পরবর্তী বৈদিক যুগে রাজার কর্তব্য
এই যুগে রাজার ক্ষমতা আইনত নিরঙ্কুশ হলেও কার্যত প্রজাপালন ও ন্যায় বিচার স্থাপন তার কর্তব্য ছিল। অভিষেকের সময় রাজা অঙ্গীকার করতেন যে, তিনি ব্রাহ্মণ, গোধনকে রক্ষা করবেন এবং জনহিতকর কাজ করবেন।
পরবর্তী বৈদিক যুগে সভা ও সমিতি
- (১) পরবর্তী বৈদিক যুগে সভা-সমিতির কথা অথর্ববেদ ও শতপথ ব্রাহ্মণে উল্লেখ করা হয়েছে। শতপথ ব্রাহ্মণে রাজার মতই সভা ও সমিতির ক্ষমতা ভগবানের দান বলা হয়েছে। তথাপি রাজার ক্ষমতা বৃদ্ধির ফলে পরবর্তী বৈদিক যুগে সমিতির ক্ষমতা অনেক পরিমাণে কমে যায়।
- (২) সমিতি ছিল উপজাতিক প্রতিষ্ঠান। রাজ্যসীমা বাড়লে এবং তাতে বিভিন্ন উপজাতি পন করলে সমিতি তার আগের ক্ষমতা হারায়। তুলনামূলকভাবে সভার ক্ষমতা বাড়ে। রাজা সভার সম্মতি নিয়ে শাসনকার্য পরিচালনা করাকে উপযুক্ত মনে করতেন। অন্যথা সভা তাঁকে অনেকটা বিব্রত করতে পারত।
- (৩) সমিতির মত সভা গণতান্ত্রিক সংস্থা ছিল না। সভা ছিল এই যুগে রাজ অমাত্য, উচ্চ কর্মচারীদের নিয়ে গঠিত। সমিতির মর্যাদা ক্রমে এতই কমে যায় যে, উপনিষদের যুগে সমিতি বলতে জ্ঞানী লোকেদের সভা বুঝাত।
উপসংহার :- বৈদিক সাহিত্য থেকে এই যুগের সামাজিক নীতিবোধের নমুনা পাওয়া যায়। নরহত্যা, সম্পত্তি অপহরণ, গোধন অপহরণ, সুরাপান, রাজদ্রোহ নিন্দনীয় ও দণ্ডযোগ্য ছিল। নারীদের সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার ছিল না। রাজা রাষ্ট্রের প্রচলিত আইন অনুযায়ী বিচার করতেন। রাজার প্রতিনিধি হিসেবে অধ্যক্ষ নামে কর্মচারী বিচারের কাজ করতেন।
(FAQ) পরবর্তী বৈদিক যুগের রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
একরাট, বিরাট।
রাজসূয়, অশ্বমেধ যজ্ঞ।
কোষাধ্যক্ষ।
সূত।
ভাগদুখ নামে কর্মচারী।